স্মরণে - শতবর্ষের আলোকে - মাণিক রাজা তোমারে সেলাম
- শ্রাবস্তী সেন
- May 9, 2021
- 13 min read

সত্যজিৎ রায় – এই মানুষটা শুধু বাঙ্গালির নয় গোটা ভারতবাসীর গর্ব। নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক দীর্ঘদেহী মহীরুহ-সম মানুষের ছবি। যে মানুষটা কে কুর্ণিশ জানিয়েছিল সমগ্র বিশ্ব। সেই কোন ছোটবেলায় ‘গুপী-বাঘা’র গল্পের সঙ্গে ওনার কাজের সঙ্গে পরিচয়। ছোটদের জন্য সিনেমা হয়ত আরও অনেক আছে কিন্তু এত সাবলীল ভাবে ‘বাচ্চাদের মনের মধ্যে একটা চিরস্থায়ী দাগ কেটে যাওয়া’ সেটা সম্ভব হয়না, বেশির ভাগ সময়। এমন কোন বাচ্চা নেই যে ‘ভূতের রাজা’কে দেখে মজা পায়নি। ‘হাল্লার রাজা’, ‘দুষ্টু মন্ত্রী’, এরা যেন আমাদের কত পরিচিত হয়ে উঠেছিল আপনার পরিচালনায়। তপেন চট্টোপাধ্যায় আর রবি ঘোষের অভিনয় তাদেরকে করে তুলেছিল আমাদের সবার আপনজন। এরপর দেখি হীরক রাজার দেশে – কোন নীতিকথা ছাড়া কত সুন্দর ভাবে ভালো খারাপের পার্থক্য শিখেছিলাম সেখান থেকেই। সিনেমা দেখতে দেখতে আমরা সবাই উদয়ন পণ্ডিতের সমব্যথী হয়ে উঠেছি, আবার প্রতি মুহূর্তে গুপী বাঘা কি ভাবে উদয়ন পণ্ডিত কে সাহায্য করবে , কি ভাবে হীরক রাজা জব্দ হবে তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে গেছি। বড় হয়ে বুঝেছি আসল জহুরি তো ছিলেন আপনি , নাহলে ওই সাবলীল অভিনয় সবার থেকে বের করে আনা আর কারুর পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর শুধু অভিনয় কেন বলছি- গানের কথা না বললে বিরাট অন্যায় হবে। কি অসাধারণ কথা ও সুর। অত ছোটবেলাতেও সব গান মুখস্থ হয়ে গেছিল।
এরপর আসি ফেলুদার সিনেমার কথায়- প্রথম বার যখন ‘সোনার কেল্লা’ দেখি তখন ক্লাস টুতে পরি। আপনার হাত ধরে মুকুলের সঙ্গে আমরাও চলে যাই রাজস্থানে। নকল ডক্টর হাজরা ও মন্দার বস কে যেভাবে মগজাস্ত্রর সাহায্যে ফেলুদা ঘায়েল করল তাতে আমরা অভিভূত হয়ে পরি। মুকুলের সঙ্গে আমাদের সবাইকে রাজস্থানে মানস ভ্রমণ করিয়ে দিয়েছিলেন আপনি। বহু বছর পরে যখন সত্যি সোনার কেল্লা দেখতে গেছি, ওখানে স্থানীয় ‘গাইড’ বলেছিলেন আগে এই কেল্লা ত্রিকূট কেল্লা বলে পরিচিত ছিল, কিন্তু বাংলার ডিরেক্টর সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমার পরে লোকে এটা ‘সোনার কেল্লা’ বলেই চেনে। সত্যি বলব বাঙালি হিসেবে গর্বিত বোধ করেছিলাম।
পরপর আপনার কিছু সিনেমা দেখলেও তখনও আপনার কোন লেখা পরিনি। সোনার কেল্লা সিনেমা দেখার পর ফেলুদার আরও গল্প আছে জানতে পেরে বাড়ীতে আবদার শুরু করি। তাই পরের বার বইমেলা থেকে বাবা কিনে দিয়েছিলেন ‘রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য।‘ এখনও মনে পড়ে গল্পটা পরতে পরতে আপনাদের ‘ থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’র ভক্ত হয়ে গেছিলাম। রয়্যাল বেঙ্গল রহস্যর সেই টানটান উত্তেজনা আমার কিশোর মনে ছাপ ফেলেছিল। আর সংকেত টা বোধহয় আপনার সব পাঠকদের মুখস্থ আছে আজও। পরে যখন নিজে মা হয়েছি, আর আমার ছোট্ট ছেলে যে গল্প শুনতে ভীষণ ভালবাসত, তাকেও ওই গল্পটাই বলতাম। আর আশ্চর্য বিষয় ওই গল্প শুনেই তারও ফেলুদার গল্পের ওপর একটা আগ্রহ তৈরি হয়ে যায়। আপনার লেখনীর জাদুর ছোঁয়ায় এইভাবেই বুঁদ হয়ে থেকেছি আমরা পরের পর প্রজন্মের কিশোর কিশোরীরা।
এরপর আসে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ দেখার পালা। আবার আমরা বেরিয়ে পরি ফেলুদাদের সঙ্গে এবার বেনারসে। এবার মুকুলের জায়গায় আসে আরও একটা বাচ্চা – ‘ক্যাপ্টেন স্পার্ক’ ওরফে রুকু। বড়দের কথা ছেড়ে দিলাম, কিন্তু আপনার সিনেমা তে মুকুল বা রুকুর মতন বাচ্চারা যেরকম সাবলীল ভাবে অভিনয় করেছে, তা অনেক জায়গাতেই দেখা যাবে না। আর মগনলাল মেঘরাজ ছিলেন সত্যিকারের ‘দুর্ধর্ষ দুশমন’। পরে বড় হয়ে ভেবেছি যে ‘নাইফ থ্রোয়িং’ খেলা দেখে শিউরে উঠেছিলাম আমরা দর্শকরা, সেই খানে কত বড় অভিনেতা ছিলেন যে সন্তোষ দত্ত অত সহজ ভাবে অভিনয় করেছিলেন। তবে আবার একই কথা বলতে হয়, ক্যামেরার পেছনে যেখানে আপনি রয়েছেন সেখানে অভিনেতা দের সেরা টা দেওয়া টা ছিল খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে যখন সন্তোষ দত্তের মৃত্যুর পরে যখন আপনি আর ফেলুদার সিনেমা তৈরি করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন আরও অনেক কিশোর কিশোরীর মতন আমারও খুব অভিমান হয়েছিলো। পরে বড় হয়ে আপনার পুত্র সন্দীপ রায়ের করা ফেলুদা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম আপনার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। কাউকে অসম্মান না করেই বলছি, জটায়ুর চরিত্র পরে অনেকেই করলেও কেউ সন্তোষ দত্তর মতন করে চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। যদিও এটা আমার একেবারেই ব্যক্তিগত মতামত।
ফেলুদার প্রত্যেকটা গল্পই অনবদ্য। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবো? আপনার লেখনীর গুনে ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের’ সঙ্গে আমরাও তো পৌঁছে গেছি কখন ও পৌঁছে গেছি কেদারনাথে,কখন ও গ্যাংটকে, কখন ও পুরী, তো কখন ও ইলোরাতে। সত্যি কথা বলব ভ্রমণের নেশাটা যে কখন আপনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন তা বুঝতেই পারিনি। আজও যখন বিভিন্নও জায়গায় ঘুরতে যাই বুঝতে পারি তপেশের থেকে বড় ট্যুর গাইড কেউ নেই। কোন জায়গা গেলে মনে হয় এইতো এইখানে ফেলুদা মন্দার বোসকে নাস্তানাবুদ করেছিলো, এখানে নকল বাটরা কে ধাওয়া করেছিলো ইত্যাদি।
এরপর আসতেই হবে প্রফেসর শঙ্কুর কথায়। যদিও কল্পবিজ্ঞান কোনোদিনই আমার প্রিয় বিষয় নয়, তবু এই পৃথিবী বিখ্যাত প্রফেসরের হাত ধরে কল্পবিজ্ঞানও আমার মতন মানুষের ভালো লাগতে শুরু করে। যখনই আমাদের কাছের কেউ অসুস্থ হয়ে পরে হয়তো একবারও মনে হয় প্রফেসর শঙ্কুর ‘মির্যাকেল’ থাকত হয়তো আমাদের কাছের লোকজন সুস্থ হয়ে উঠতে পারত। ওনার ‘আয়নিহিলিন’ বা ‘অম্নিস্কোপ’ যে আমাদের কল্পনার ডানায় চড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। কোনও রকম রক্তপাত ছাড়া শত্রুদের জব্দ করা যায় সেটাতো এই প্রফেসরই দেখিয়েছেন। এছাড়াও ছিলেন তারিণী খুড়ো – এইরকম একজন গল্পদাদু ছিল বাচ্চাদের অতি প্রিয়। ওনার তথাকথিত ‘সত্য অভিজ্ঞতা’ গুলো সত্যি ছিল যথেষ্ট রোমহর্ষক। টানটান উত্তেজনা নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছি প্রতিটা গল্প।
আপনার আরও কিছু ছোট গল্পর উল্লেখ করতেই হবে যেগুলো আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। আপনার বইগুলো ‘একের পিঠে দুই’, ‘এক ডজন গল্প’, ‘আরো এক ডজন’, ‘আরো বারো’ ইত্যাদি এগুলো নিয়ে আজও মাঝে মধ্যে পাতা ওলটাতে বেশ ভাল লাগে। এরমধ্যে ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’, ‘পিকুর ডাইরি’, ময়ূরকণ্ঠী জেলি, কাকতাড়ুয়া, ব্রাউন সাহেবের বাড়ি, চিলেকোঠা, বিষফুল, সহযাত্রী, দুই বন্ধু, খগম কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলব? এছাড়া মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প এক নিঃশ্বাসে পড়েনি এমন কোন বাচ্চা আছে নাকি? আর ‘ফটিকচাঁদ’ – ওই যে বাচ্চা ছেলেটা যাকে গুণ্ডারা ধরে নিয়ে গেল, তারপর ঘটনাচক্রে তার স্মৃতি হারিয়ে যাওয়া, তারপর নানান ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে তার আবার বাড়িতে ফিরে আসার যে টানটান উত্তেজনা ছিল তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
আবার ফিরে আসি আপনার সিনেমার কথায় – ‘পথের পাঁচালি’ গল্পটা কিন্তু তখনও পড়িনি, কিন্তু আপনার হাত ধরেই পরিচয় হয় অপুর সাথে। অপু, দুর্গার খুনসুটি, হরিহর – সর্বজয়ার জীবন যুদ্ধ, আর সর্বোপরি ইন্দিরা ঠাকুরণের একদিকে নাতি –নাতনিদের আগলে রাখা আবার বাচ্চাদের সঙ্গে দ্বিতীয় শৈশবে ফিরে যাওয়া আপনি যেভাবে দেখিয়েছেন তা অনবদ্য। মানতে পারিনি দুর্গার ওইভাবে অকালে চলে যাওয়া। পরে শুনেছিলাম লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী সবাইকে ছেড়ে একরকম জেদ করেই গল্পের সত্ত্ব দিয়েছিলেন আপনাকেই। মহীয়সী মহিলা, ওনার এই সিদ্ধান্ত যে কতটা সঠিক ছিল সেটা সবাই দেখেছে। পরে যখন গল্পটা পড়ি তখন বুঝতে পারি কি অসাধারণ ভাবে দেখিয়েছিলেন আপনি। এরপর আসে ‘অপরাজিত’। এবার আপনি আসল গল্প থেকে একটু সরে এসে দেখালেন মা ও যুবক ছেলের সম্পর্কের টানাপড়েন। এখানেই প্রমাণ হয়ে গেল সময়ের থেকে কতটা এগিয়ে আপনি চিন্তা করতে পারতেন। ভারতীয় দর্শকদের খুব একটা সমর্থন না পেলেও বিশ্বের নামি দামী চিত্র পরিচালকদের কুর্ণিশ আদায় করে নিয়েছিলেন আপনি অনায়াসে। এমনকি আপনার সমসাময়িক আরেক বিশ্ব বরেণ্য পরিচালক মৃণাল সেন বলেছিলেন যে ভারতীয় সিনেমাতে ‘অপরাজিত’ অন্যতম সেরা সিনেমা। আর এরপরেই আসতে হবে এই সিরিজের তৃতীয় গল্প ‘অপুর সংসারের’ কথায়। এখনে আপনি নিয়ে এলেন বাঙ্গালির ইতিহাসের সুপুরুষ নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর কিশোরী শর্মিলা ঠাকুরকে। জহুরির চোখ আপনার, আর তাই এই দুই নায়ক নায়িকাকে আপনি নিয়ে এসে ভারতীয় সিনেমাকে আরও সমৃদ্ধ করে তুললেন। পর্দায় তাদের মিষ্টি প্রেম, একে অপরের প্রতি বিশ্বাস ও ভালবাসা আজও অনেক যুবক যুবতীকে ভালবাসতে শেখায়। অপরিসীম দারিদ্রর মধ্যেও অপু লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখে, আর অপর্ণা ধনী পরিবারের আদরের মেয়ে হয়েও হাসি মুখে সব কষ্ট সহ্য করে স্বামীকে স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করে যায়। তাই অপর্ণার মৃত্যু ছারখার করে দেয় অপুর জীবন। তার স্বপ্নের পাণ্ডুলিপি টুকরো টুকরো করে ফেলে দিতে সে আর দ্বিধা করেনা। যখন জীবন থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তখন আবার তার জীবনে তার ছেলে কাজল। বাবা নয় বন্ধু হয়ে কাজল তাকে মেনে নেয়, ও একে অপরের ভরসা অর্জন করতে পারে। অপুর এই তিনটি সিনেমা শুধু দেশে বিদেশে আপনাকে পরিচিতই করেনি, এনে দিয়েছে অনেক পুরস্কারও।
এছাড়া বলতেই হবে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিনেমার কথায়। শহরের এক ধনী পরিবার ছুটি কাটাতে আসে দার্জিলিঙে। সেখানে বিভিন্ন চরিত্রের জীবনের টানাপড়েন আর একই সঙ্গে প্রকৃতির সেই মোহময় রূপ যা বিভিন্ন সময় নিপুণ ভাবে ধরা পড়েছে আপনার ক্যামেরাতে তা এককথায় অনবদ্য। যদিও শুনেছি এই সিনেমা খুব একটা জনপ্রিয় হয়েনি তখনকার দিনে , কিন্তু সিনেমাটা আমার অন্যতম প্রিয়। আরেক অন্যতম প্রিয় সিনেমা হল ‘জলসাঘর’। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প থেকে এই চিত্রনাট্য লিখেছিলেন আপনি। বাংলার এক পড়তি জমিদারের অভ্যাস, আর্থিক দুরবস্থাতেও নিজের বোলবোলা বজায় রাখা , মজলিস বসানো, দানধ্যান বজায় রাখা ইত্যাদি ছবি বিশ্বাস আপনার পরিচালনায় যেভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন তা বাংলা সিনেমার দর্শক এর আগে বেশি দেখেনি। জমিদারি প্রথা অবলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পরে পুরানো জমিদারি পরিবারের কর্তাদের পুরনো আদব কায়দা ধরে রাখার যে মরিয়া চেষ্টা তার এক অসাধারণ চিত্রায়ন এই সিনেমা। বনেদি বড়লোক আর উঠতি বড়লোক এর যে মানসিকতার তফাৎ টা এত সুন্দর ভাবে আপনি দেখিয়েছেন যে দর্শক একাত্ম হয়ে উঠেছেন ।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরও একটি গল্প নিয়ে আপনি আরেকটা সিনেমা করেছিলেন ‘অশনি সংকেত’। এখানেও নায়ক আমাদের সবার প্রিয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। একদিকে যেখানে ‘জলসাঘর’এ জমিদারি ঠাট বাট বজায় রাখার মরিয়া চেষ্টা, আর অন্যদিকে ‘অশনি সংকেত’এ ১৯৪৩-র দুর্ভিক্ষের কঠিন চিত্র। অথচ দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্রকে আপনি কি সুনিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যারা দেখেছেন তাঁরা জানেন। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছিলেন প্রায় তিন লক্ষ মানুষ। একটা শান্ত গ্রাম্য পরিবেশ যে কিভাবে বদলে যেতে পারে প্রাণঘাতী দুর্ভিক্ষের কারণে তা দেখে শিউরে উঠেছে লোকজন। আবার অন্যদিকে বলতেই হবে ‘পরশপাথর’ সিনেমার কথা। বিখ্যাত সাহিত্যিক রাজশেখর বসুর গল্প অবলম্বনে এই সিনেমার মধ্যে যে হাসির তরঙ্গ আপনি তুলেছেন তা এককথায় অসাধারণ। আর তুলসী চক্রবর্তীর সাবলীল অভিনয় আজও বাংলা সিনেমার অমূল্য সম্পদ। আরও একটা সিনেমা যার কথা উল্লেখ করতেই হয় ‘দেবী’। আবার আপনি এখানে ফিরিয়ে এনেছিলেন সৌমিত্র – শর্মিলা জুটিকে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ছোট গল্প অবলম্বনে আপনি তৈরি করেন এই সিনেমা। দয়াময়ী ও উমাপ্রসাদের স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনে একটা ঝড় ওঠে যখন উমাপ্রসাদের বাবা কালিকিঙ্কর যখন স্বপ্ন দেখেন ওনার ছোট বউএর মধ্যে মা কালীর রূপ রয়েছে। এরপরেই উনি দয়াময়ী কে দেবী রূপে পূজা করতে শুরু করেন। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসতে শুরু করে দেবীর দর্শনে। দয়াময়ীর জীবনযাত্রা আমূল বদলে যায় এর পরে । উমাপ্রসাদ আসে দয়াময়ী কে এই পরিবেশ থেকে উদ্ধার করে তাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে। কিন্তু বাধ সাধে দয়াময়ী নিজেই। তরুণী এই মেয়েটার মনে একটা ভয় ও দ্বিধা ভর করে বসে। এত অল্প বয়সে একটা মেয়ের এই করুণ পরিণতির মধ্যে দিয়ে সমাজের একটা করুণ ছবি তুলে ধরেছিলেন আপনি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেকগুলো গল্প নিয়ে আপনি সিনেমা করেছেন। যেমন ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে তৈরি করেন ‘চারুলতা’। চারুর জীবনে সে ছিল ভীষণ একাকী। তার একাকীত্ব কাটাতে সারাদিন বাইনোকুলার চোখে দিয়ে সে সারাদিন বাইরের জগতটাকে দেখে সময় কাটাত। তার একাকী জীবনে বন্ধু হয়ে আসে তার সম্পর্কে দেবর অমল। অমলকে পেয়ে চারুর একাকীত্ব অনেকটাই কেটে যায়, মানসিক দিক দিয়ে তার ওপর অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে পরে। কিন্তু সেই অমল যখন কাউকে কিছু না জানিয়ে একটা চিঠি লিখে রেখে চলে যায়, ভেঙ্গে পড়ে চারু। শেষ অবধি যখন ভূপতি ও চারু এক হতে চায় তখন সেই দুজনের দুজনের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া হাতের ওপর ক্যামেরা আটকে দেওয়া মধ্যে ছিল এক অভিনবত্ব। এরপরে ‘পোস্টমাস্টার’, ‘মণিহারা’, ও ‘সমাপ্তি’ অবলম্বনে করলেন ‘তিন কন্যা’। গ্রামের ছোট্ট মেয়ে রতন যখন শহরের পোস্টমাস্টার নন্দলাল এর কাছে একটু সহানুভূতিশীল ব্যবহার পায়, সে নিজেকে উজাড় করে সেবা করতে থাকে নন্দলালের। তার প্রতিদানে নন্দলাল যখন তাকে টাকা দিতে চায়, কান্নায় ভেঙ্গে পরে রতন। এরপর আসে মণিহারা – মণিমালিকার ছিল গয়নার ওপর অসম্ভব টান। সেই মণিমালিকার স্বামী যখন ব্যবসার জন্য তার গয়না চায়, সে নিজের এক আত্মীয়র সঙ্গে বাপের বাড়ি চলে যায়। তার স্বামী আর তার খোঁজ পান না। পরে তিনি স্ত্রী কে নয় দেখতে পান স্ত্রীর কঙ্কাল সর্বাঙ্গে গয়না পরিহিত। শেষে আসি সমাপ্তির কথায়। আবার নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর আপনার নতুন আবিষ্কার অপর্ণা দাশগুপ্ত। একটা কিশোরী কন্যার নানান ঘটনার মধ্যে যুবতি হয়ে ওঠা, তার মানসিক পরিবর্তন নিয়ে এই গল্প। প্রথম সিনেমাতেই অপর্ণা দাশগুপ্ত ওরফে সেন যা সাবলীল ভাবে অভিনয় করেন যে বাঙলা সিনেমা পেয়ে যায় আরেক কিংবদন্তি অভিনেত্রীকে।
এরপর আসতে হবে ‘ঘরে বাইরে’ র কথায়। এখানেও আপনি আবার নিয়ে এসেছেন সেই সময়ের আরেকজন নবাগতা নায়িকা স্বাতিলেখা সেনগুপ্তকে। নিখিলেশ ও বিমলার সুখের সংসার ছিল। এখানেই আবির্ভাব ঘটে সন্দীপের। নিখিলেশ ছিলেন ভীষণ উদারপন্থী, তখনকার দিনের পর্দাপ্রথা ভেঙ্গে বিমলাকে নিয়ে আসেন বাইরের জগতটাকে দেখতে। বলতেই হয় ‘মহানগর’ সিনেমার কথায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারণা ভেঙ্গে গৃহবধূর বেরিয়ে এসে একজন সেলসের কাজ করতে আসা তখনকার দিনে থিয়োরীতে ছিল এক মস্ত পদক্ষেপ। কিন্তু স্বামীর চাকরি চলে যাবার পরে সংসারের হাল ধরতে চাকরিতে যোগ দেয় আরতি।
এরপর আসি আপনার কলকাতা ট্রিলজির তিনটি সিনেমা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘সীমাবদ্ধ’, ও ‘জন অরণ্যের’ কথায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিয়ে তৈরি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ সিনেমাতে আপনি দেখিয়েছিলেন নকশাল আমলের সময় সিদ্ধার্থ, যে কিনা শিক্ষিত। মধ্যবিত্ত এক যুবক তার জীবন যুদ্ধের যে প্রতিচ্ছবি আপনি ফুটিয়ে তুলেছেন তার সঙ্গে সেই সময়ের শিক্ষিত ছেলেরা মিল খুঁজে পেয়েছিলো। এখানে আবার আপনি নিয়ে এলেন ধৃতিমান চ্যাটারর্জিকে – পরে যাকে বাঙলা সিনেমা চিনল একজন অভিজাত অভিনেতা হিসাবে। এরপর আসতে হবে ‘সীমাবদ্ধ’র কথায়- বিখ্যাত সাহিত্যিক শঙ্করের উপন্যাস নিয়ে তৈরি করলেন কালজয়ী সিনেমা। এখানে আপনি সুন্দর ভাবে দেখিয়ে দিলেন কলকাতার দ্রুত পালটে যাওয়া কর্পোরেট কালচার, ক্রমবর্ধমান লোভ, ও ইঁদুর দৌড়ের এক বাস্তব ছবি। নায়িকার ভূমিকায় শর্মিলা ঠাকুর আর ফিরিয়ে আনলেও নায়কের ভূমিকায় নিয়ে এলেন নবাগত বরুণ চন্দকে। আপনার নিয়ে আসা বাংলা সিনেমায় নতুন নায়ক নায়িকার তালিকা খুবই লম্বা। কলকাতা ট্রিলজির শেষ সিনেমা ‘জন অরণ্য’ সাহিত্যিক শঙ্করের রচনা। নবাগত প্রদীপ মুখার্জি এক সাধারণ এক পরিবারের ছেলে, যে অতি সাধারণ রেসাল্ট করে বেরিয়ে নানা ঘটনার মধ্যে একটা চাকরি যোগাড় করতে পারে। কিন্তু এই চাকরি করতে গিয়ে সে উপলব্ধি করতে পারে ক্লায়েন্টকে খুশী করতে গিয়ে যে দাম তাকে দিতে হচ্ছে তা তার মধ্যবিত্ত মানসিকতার সঙ্গে মেলেনা। বাস্তবের কঠিন মাটিতে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার যুবককে যে আপোষ করে চলতে হয় তা যেমন সুন্দরভাবে লেখক ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাকে পরিপূর্ণতা দিয়েছিলেন আপনি।
আপনি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘অভিযান’। সেখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিয়ে এলেন বম্বে থেকে ওয়াহিদা রহমানকে। অবাঙালী গুলাবির চরিত্র তাঁর অভিনয় ও অবাঙালী টানে কথার মধ্যে দিয়ে অনবদ্য ভাবে ফুটিয়ে তোলেন ওয়াহিদা। আসলে আপনি বারবার প্রমাণ দিয়েছেন চরিত্রর উপযোগী নায়ক বা নায়িকা খুঁজে নিতে আপনি ঠিক কতটা পারদর্শী। আর ঠিক সেই কারণেই আপনি আপনার প্রিয় নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে না নিয়ে পরপর দুটো সিনেমা ‘নায়ক’ ও ‘চিড়িয়াখানাতে’ নিলেন মহানায়ক উত্তমকুমারকে। উত্তমকুমারের ক্যারিশমা ছাড়া ‘নায়ক’ চিত্রায়ন করা বোধহয় সম্ভব ছিল না, বুঝেছিলেন তিনি। আর ফেলুদা ও ব্যোমকেশ দুজনের চরিত্র এক ব্যক্তি করতে পারেনা, তাই নিয়ে এলেন উত্তমকুমারকে।
আপনার সিনেমা আমাদের সবকটাই ভীষণ প্রিয়, কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলবো- তবে আমার ব্যক্তিগত মতে আমার অন্যতম প্রিয় সিনেমা হল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে করা ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। পালামৌ-এর জঙ্গলে চার বন্ধুর ছুটি কাটাতে গিয়ে ঘটনার মোড় যেভাবে ঘুরে যায় তা সত্যি আকর্ষণীয়। আর দুলির ভূমিকায় সিমি গাড়োয়াল ছিলেন অনবদ্য। সত্যি কথা বলতে অসীম, সঞ্জয়, হরি ও শেখরের বন্ধুত্ব যেন মানুষকে বন্ধুত্বটা হাতে করে শিখিয়ে দিয়ে যায়। আরেকটা অত্যন্ত প্রিয় সিনেমা হল রাজশেখর বসুর কাহিনী ‘বিরিঞ্চিবাবা’ অবলম্বনে ‘মহাপুরুষ’। বিরিঞ্চিবাবার ভণ্ডামো ফাঁস করে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে যে সূক্ষ্ম বার্তাটা লেখক দিতে চেয়েছিলেন সেটা আপনি খুব সুন্দরভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। এর সঙ্গে প্রেমেন্দ্র মিত্রর ‘জনৈক কাপুরুষের কাহিনী,’ অবলম্বনে ‘কাপুরুষ’ সিনেমাটা ছিল দর্শকদের কাছে উপরি পাওনা। প্রাক্তন প্রেমিকার সঙ্গে ঘটনাচক্রে হঠাৎ দেখা হওয়া, এবং ঘটনার মোড় নেওয়া ছিল এককথায় অসাধারণ।
বিভিন্ন বড় লেখকের গল্প নিয়ে আপনি যেমন সিনেমা করেছেন তেমন করেছেন আপনার নিজের পরিবারের লোকের লেখা নিয়েও করেছেন – আপনার ঠাকুরদার গল্প নিয়ে তৈরি করেছেন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। পরে এই সিনেমার দ্বিতীয় অধ্যায় ‘ হীরক রাজার দেশে’। বেসুরো গুপী, বাঘার ভূতের রাজার কৃপায় সুর খুঁজে পাওয়া ও তার সাথে আরও দুই বরের সাহায্যে দুষ্টের দমন করা ছিল বাচ্চাদের কাছে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। পরে এই সিনেমার তৃতীয় অধ্যায় তৈরি করেন আপনার পুত্র সন্দীপ রায়। একদিকে হাল্লার মন্ত্রীর ষড়যন্ত্র ফাঁস করে সবাইকে বাঁচানো, অন্যদিকে হীরক রাজার রাজধর্ম পালন না করে ক্ষমতার অপব্যবহার করা , শেষে গুপী বাঘার সাহায্যে দুষ্টের দমন করে সুশাসন নিয়ে আসা ছিল বাচ্চাদের কাছে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। বৈচিত্র্যের প্রতি ছিল আপনার অদম্য আকর্ষণ। আর তাই সম্পূর্ণ অন্য রকম এক বিষয় নিয়ে হেনরিক ইবসেনের গল্প অবলম্বনে আপনি করলেন ‘ গণশত্রু’ । অন্ধ ধর্ম বিশ্বাসের মুখের মতন জবাব দিয়েছিলেন আপনি এই সিনেমার মাধ্যমে। অশোধিত জলের চরণামৃত খেয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে পরলেও, এক শ্রেণির লোকজন এই ব্যাপারটাকে নিজেদের ফায়দার জন্য পরিকল্পিত ভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে চলেছে- এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কতটা কঠিন কাজ সেটাই আপনি দেখিয়েছিলেন এই সিনেমার মধ্যে দিয়ে। ন্যাশানাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল এই সিনেমা । এরপর এল ‘শাখাপ্রশাখা’। এই সিনেমার গল্পের মধ্যে আপনি একসঙ্গে চার প্রজন্মকে তুলে ধরেছেন। এক প্রজন্মের সততা, মূল্যবোধ যে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কতটা মূল্যহীন তা বোঝা যায় এই সিনেমাতে। আজকের সমাজের ক্ষয়টা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন সেদিন আপনি। আপনার সর্বশেষ সিনেমা ‘আগন্তুক’ – নিজের এক গল্প ‘অতিথি’ নিয়ে বানালেন এই সিনেমা। মনমোহন মিত্র দীর্ঘদিন পরে দেশে ফিরলেন। দীর্ঘ প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে উনি গল্প শুরু করেন। কিন্তু মনমোহন মিত্রের মুখ দিয়ে আপনি বোধহয় আপনার নিজের কথাই বলেছিলেন। অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন উৎপল দত্ত এই মনোমোহন মিত্রর ভূমিকায়।
যদিও আপনি বেশির ভাগ সিনেমা তৈরি করেছেন নিজের মাতৃভাষা বাংলাতে, কিন্তু আপনার মতন লোককে ভাষার বেড়াজালে আটকে রাখা যায়না। ১৯৭৭ সালে আপনি প্রথমবার নিজেই সেই বেড়াজাল ভেঙ্গে বেড়িয়ে এলেন। মুন্সি প্রেমচাঁদের গল্প নিয়ে তৈরি করলেন ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’। বিতাড়িত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহর চরিত্রে নিয়ে এলেন হিন্দি সিনেমার স্বনামধন্য ভিলেন আমজাদ খানকে। শুধু আমজাদ খান নয় আপনি নিয়ে এসেছিলেন হিন্দি সিনেমার এক ঝাঁক তারকাকে। এক সঙ্গে সঞ্জীব কুমার, শাবানা আজমি, ফরিদা জালাল, ফারুখ শেখ ও আরও অনেক বিখ্যাত অভিনেতা, অভিনেত্রীদের এক সঙ্গে পেয়েছিল দর্শক। উপরি পাওনা ছিল বর্ণনাকারী হিসেবে হিন্দি সিনেমার সুপার হিরো অমিতাভ বচ্চন। ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ী’ র পরে আপনি আবার মুন্সী প্রেমচাঁদের গল্প নিয়ে আবার আপনি তৈরি করলেন ‘সদগতি’। এখানেও আবার আপনি নিয়ে এলেন এক ঝাঁক হিন্দি অভিনেতা অভিনেত্রীদের। ওম পুরি, স্মিতা পাতিল, মোহন আগাসে মিলে করলেন এক অনবদ্য সিনেমা। জাতপাতের বিরুদ্ধে আপনার এই বলিষ্ঠ বক্তব্য ছিল সমাজের এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে আপনার প্রতিবাদ।
বেশ কিছু ডকুমেন্টরিও আপনি তৈরি করেছিলেন, যেমন কবিগুরুর জন্ম শতবর্ষে আপনি বানিয়েছিলেন ডকুমেন্টারি ‘ রবীন্দ্রনাথ’, ‘সিকিম’- যা আপনি করেছিলেন সিকিমের তদানীন্তন রাজার অনুরোধে। সিকিমের রাজার মনে করেছিলেন হিমালয়ের কোলে এই ছোট্ট রাজ্যকে ভারত ও চীন দুই মহাদেশের পক্ষ থেকেই বিপদ আছে। ১৯৭৫ সালে সিকিম ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরে এই ফিল্মটা ভারতে ব্যান হয়ে গেছিল। শেষ অবধি ২০১০ সালে এই ব্যান উঠিয়ে নেওয়া হয়। এছাড়াও আপনি একটা নির্বাক ডকুমেন্টরই বানিয়েছিলেন ‘টু’ । এক ধনীর সন্তান ও এক গরীবের সন্তানের জানলা দিয়ে একে ওপরের খেলনা দেখানোর মধ্যে দিয়ে যে বন্ধুত্বের যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাই আপনি দেখিয়েছিলেন এই সিনেমার মধ্যে দিয়ে। ১৯৮৭ সালে আপনি নিজের বাবার জন্মশতবার্ষিকী তে আপনি ‘সুকুমার রায়’ নামে এক ডকুমেন্টরই বানিয়ে আপনি আপনার শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন আপনার বাবাকে। সুকুমার রায়ের আঁকা ছবি, লেখা, ও ওনার কাজ নিয়ে এটাই ছিল আপনার তৈরি শেষ ডকুমেন্টরি।
আপনার সিনেমাতে সংগীতের এক বিরাট অবদান ছিল। কত বড় বড় সঙ্গীতজ্ঞর সঙ্গে আপনি কাজ করেছেন। যেমন অপুর ট্রিলজি ও পরশপাথরে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, জলসাঘরে ওস্তাদ বিলায়েত খান, দেবীতে আলী আকবর খান। তারপর ‘তিন কন্যা’ থেকে আপনি শুরু নিজে সঙ্গীত পরিচালনা করতে শুরু করলেন। আপনার সঙ্গীতে আপনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের এক অপরূপ মেলবন্ধন দেখিয়েছিলেন। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইনে’ আপনি নিয়ে এলেন অনুপ ঘোষালকে। কর্ণাটকি মিউজিকের প্রভাব দেখা যায় এই সিনেমাতে। আবার ‘চারুলতাতে’ সবাইকে ভুল প্রমাণ করে কিশোর কুমারকে দিয়ে অবলীলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ গাইয়ে প্রমাণ দিলেন আপনার রত্ন চিনতে ভুল হয়না। শাখাপ্রশাখা তে যেমন পৃথিবী বিখ্যাত অর্কেস্ট্রা বাচ ও বেথভেনর সফল প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে চমকে দিলেন বিশ্ববাসীকে। ফেলুদার সিনেমার জন্য যে থিম মিউজিক আপনি তৈরি করলেন তা আজ ও একই রকম জনপ্রিয়।
আপনার প্রতিটা সিনেমা এনে দিয়েছে দেশে বিদেশে অনেক সম্মান। আপনার প্রথম সিনেমা পথের পাঁচালি বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালে পুরস্কৃত হয় – সেই শুরু তারপর দেশে বিদেশের কোন সম্মান আপনার অধরা ছিল না। চার দশকের কেরিয়ারে দেশের মধ্যে ন্যাশ্যানাল অ্যাওয়ার্ড, বিফজে অ্যাওয়ার্ড , দুটো রৌপ্য ভল্লুক অ্যাওয়ার্ড বার্লিনে, সান ফ্রাসসিস্কর গোল্ডেন গেট অ্যাওয়ার্ড দুটো, মস্কো ইন্তারন্যাশ্ন্যাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অ্যাওয়ার্ড, ক্যান্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অ্যাওয়ার্ড, ভেনিস ইণ্টারন্যাশানাল অ্যাওয়ার্ড, টোকিয়ো ইন্তেরন্যাশ্নাল অ্যাওয়ার্ড ইত্যাদি। এছাড়াও পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, সংগীত নাটক অ্যাকাডেমী অ্যাওয়ার্ড, র্যামন ম্যাগাস্যে অ্যাওয়ার্ড ইত্যাদি পুরস্কারে বিভূষিত হয়েছেন। এছাড়াও ১৯৮৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার ও ১৯৯২ সালে ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ সম্মান ভারতরত্নে আপনি সম্মানিত হন। পেয়েছেন ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান ‘কম্যান্ডার অফ দি লিজিয়ন অফ হন্যার’। সর্বোপরি ১৯৯২ সালে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আপনি প্রথম ভারতীয় হিসাবে অস্কারে ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ এ সম্মানিত হন।
তারপর এল সেই অভিশপ্ত দিন – ১৯৯২ সালের ২৩শে এপ্রিল। আপামর ভারতবাসীকে শোক-স্তব্ধ করে আপনি চলে গেলেন সেই ‘ হীরক রাজার দেশে’। বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন, তবু আমাদের মনে কোথাও একটা আশা ছিল কোন এক ভূতের রাজা এসে আপনার জীবন দান করবেন। হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি! ‘মহানগরের’ ‘জন অরণ্যকে’ স্তব্ধ করে চলে গেলেন বাঙালীর আসল ‘ নায়ক’। মনে আছে পরের দিন আপনার শেষ যাত্রার সময় আপনার অগণিত ভক্তের মতন আমিও গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম দূর থেকে একটা প্রণাম করবো বলে। যেদিকে তাকানো যাচ্ছে শুধু অগুনতি মানুষ। তারপর আপনি এলেন, এক ডালা খোলা লরিতে ফুলের শয্যায় শায়িত হয়ে। মাথার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আপনার সিনেমার একের পর নায়করা। কে নেই রঞ্জিত মল্লিক, দীপঙ্কর দে, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদিরা। পেছনে গাড়িতে বসে আপনার ‘অপু’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় – গত বছর যিনিও পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন আপনাদের সঙ্গে যোগ দিতে। চলে গেছেন আপনার সহধর্মিণী বিজয়া রায়ও পর্দার পেছনে থেকে আপনার সমস্ত কাজের সবচেয়ে বড় সহযোগী। বছরের পর বছর কেটে গেছে, কিন্তু আপনার কাজ আপনার প্রতিভার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। আজকের প্রজন্মের কাছেও আজ আপনার কাজ একই রকম জনপ্রিয়। তাই আপনার জন্ম শতবর্ষে এসে এ আপনার এক ক্ষুদ্র অনুরাগীর পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন।
** টাইমস অফ ইন্ডিয়ার আন্তর্জাল পত্রিকায় প্রকাশিত সত্যজিৎ রায়ের ছবি ব্যবহৃত হল।
Comentarios