স্মরণে - ধেয়ানে আলোকরেখা
- সুমি দত্তগুপ্ত
- Apr 1, 2022
- 4 min read

সাবিত্রীবাই ফুলে
জন্ম - 3রা জানুয়ারি, 1831
মৃত্যু -10 ই মার্চ, 1897
সকাল থেকেই বাড়ীতে ফুলের বেচাকেনা, তার সাথে চাষের জমির দেখাশোনার মুনিষদের কাজ বুঝিয়ে দেওয়া, সব কাজ একহাতে সামলাতে হয় গোবিন্দরাও কে| ছেলের মতিগতি বোঝা দায়, চাষবাসে মন নেই, পড়তে খুব ভালোবাসে ছেলেটা, তাই তো গ্রামের মোড়ল, আর নেতা লোকেদের বারণ না শুনেই, ছেলেকে স্কটিশ মিশনারারীদের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে, গোবিন্দরাও|পরিবারে তো লেখাপড়ার অতো চল নেই, ওরা যে মালী | শাস্ত্রে আছে, ওদের লেখাপড়া করতে নেই, শাস্ত্র পড়ার অধিকার শুধু ব্রাহ্মণদেরই আছে| তবু ছেলের ইচ্ছের কাছে হার মানে গোবিন্দরাও| তবে লেখাপড়ার সাথে,বিয়ের তো কোনও বিরোধ নেই বাপু,তাই ছেলের ওজর আপত্তিকে কোনও পাত্তা না দিয়ে, ছেলের তেরো পেরোতে না পেরোতেই, গোবিন্দরাও কাছের নাইগাঁও গ্রামের খান্দজী পাতিলের বড়ো মেয়ের সাথে, ছেলে জ্যোতিবা রাওয়ের চারহাত এক করে দিলেন |
কবে সেই একবছর বয়েসে মা হারা ছেলেটা| বাড়িতে বউ এলে যদি বাউন্ডুলেপনা একটু ঘোচে| হা হতোস্মি, গোবিন্দরাও অবাক চোখে একদিন দেখলেন, রাতে উঠেছিলেন কলে যাবার জন্য, ছেলে বউ কে পড়াচ্ছে, বুক কাঁপতে লাগলো গোবিন্দরাও এর, একথা জানতে পারলে গ্রামের মুরুব্বিদের হাতে কি যে হেনস্থা হবে, কে জানে|পরদিন সকালে ছেলে এক অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে এলো তার কাছে সাবিত্রীকে সে পড়াবে, মিসেস মিশেলের স্কুলে| এমন অবাক কোনোদিনও হন নি গোবিন্দ রাও| তবুও ঢোঁক গিলে রাজি হলেন| সেই শুরু হলো, সাবিত্রীর জীবনে এক নতুন অধ্যায়| মিসেস মিশেলের স্কুলে প্রথাগত পড়াশোনা শেষ করে ভর্তি হলেন সাতারায় মিসেস ফারারের স্কুলে, শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য| সাবিত্রীর চোখে তখন নতুন স্বপ্ন, মেয়েদের স্কুল খুলতে হবে, শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে হবে ঘরে, ঘরে|
সেই স্বপ্নের উড়ানে সাবিত্রীবাঈ, জ্যোতিবা রাও, ও তাদের বন্ধুদের. সহায়তায় পুনের ভিদেওয়ারায় আট জন বাল্যবিধবাকে নিয়ে খুলে ফেললেন মেয়েদের স্কুল| পড়তে হলো সমাজের রোষে, কটূক্তি, টিটকিরি শারীরিক মানসিক লাঞ্ছনার শেষ ছিল না| প্রতিদিন সকালে, একটি শাড়ি পরে একটি শাড়ি ব্যাগে পুরে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হতেন, সাবিত্রীবাঈ, রাস্তায় তাঁকে ছুঁড়ে মারা হত পচা ডিম, পাথর, পুরীষ, কাদা, চিৎকার করে বলা হত,'ওই যে বেহায়া বেবুশ্যে মেয়েমানুষ-টা যাচ্ছে|' একটুও দমে যেতেন না তিনি| স্কুলে গিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে পড়াতে বসতেন ছাত্রীদের| ফেরার পথে আবার একই অভিজ্ঞতা |' কিন্তু, সমাজের এই কটুকাটব্য, হেনস্থা সহ্য করতে পারলেন না গোবিন্দরাও,তাই জ্যোতিবা, ও সাবিত্রীকে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দিলেন গোবিন্দরাও|তাঁরা আশ্রয় পেলেন তাঁদেরই বন্ধু উসমান শেখের বাড়ীতে| উসমান শেখ ও তার স্ত্রী ফতিমা বিবি ছিলেন ফুলে দম্পতির সব কাজের সঙ্গী|
ব্রাহ্মণের ঘরের বালবিধবারাও তাদের আত্মীয় স্বজন, পরপুরুষদের দ্বারা গর্ভবতী হতেন | নিজেদের জীবন শেষ করে দেওয়া কিংবা ভ্রুণ নষ্ট করা ছাড়া তাদের কিছু করার থাকতো না, তিনি এরকম 35 জন ধর্ষিতা কে নিজের বাড়ীতে আশ্রয় দেন, গড়ে তোলেন ভারতের প্রথম 'ভ্রূন হত্যা প্রতিরোধ সংস্থা|'1852 সালে নারীর অধিকার ও সম্মান রক্ষার জন্য গড়ে তোলেন,'মহিলা সেবা মন্ডল' |
জলচল তো দূরের কথা, খাবার জল সংগ্রহ করাও দলিত শ্রেণীর কাছে খুবই কষ্টকর ছিল| গ্রামের নলকূপে, পুকুরে তাদের জল নেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা ছিল |তিনি নিজের বাড়ীতে নলকূপ তৈরী করে ব্যবস্থা করলেন তাদের পানীয় জলের|
তিনি বুঝেছিলেন,এই পিছিয়ে পড়া মানুষদের আগে প্রয়োজন শিক্ষার, তাহলে তাদের মধ্যে সচেতনতা আসবে, মনুবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের তাদের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া নিয়মকানুনের অসারতা তারা বুঝতে পারবে| মাঙ্গ, মাহার সম্প্রদায়ের জন্য তৈরী করলেন দুটি স্কুল|তার স্কুলের ছাত্ররা,সরকারি স্কুলের ছাত্রদের তুলনায় ভালো ফল করতে লাগল | 18 টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন সাবিত্রীবাঈ| ছাত্রীদের স্কুলমুখী করার জন্য তাদের বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন| ব্রিটিশ সরকার তার স্কুলগুলোকে অনুদান দেওয়া শুরু করল| 1852 সালে ব্রিটিশ সরকার সাবিত্রীবাঈকে সেরা শিক্ষকের শিরোপা দেয়|
বিধবা হলেই জীবন শেষ, সকলের চোখের আড়ালে কেঁদে কেঁদে মনোকষ্টে জীবন কাটানো ছাড়া কোনও কিছু আর নেই, বিশ্বাস করতেন না সাবিত্রীবাঈ| বিধবা হলেই কেন চুল কেটে ফেলতে হবে, পুনে শহরের সব নাপিত তাঁরই উদ্যোগে,একদিন কোনও বিধবার চুল কাটবে না বলে,হরতাল করে| বালবিধবাদের জন্য তাঁর লড়াই শুধুমাত্র শিক্ষাক্ষেত্রেই ছিল না, সমাজে তাদের স্বীকৃতি র জন্যও তিনি লড়াই করেছেন, হাসিমুখে|
1857 সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময়,সরকার অনুদান বন্ধ করে দিলেন তাঁর স্কুলের, পিছপা হন নি, তিনি ,বাড়ী ঘুরে ঘুরে,বালবিধবাদের পড়াতেন, উৎসাহ দিতেন সাহিত্য রচনা ও ছবি আঁকায়| 1873 সালে অস্পৃশ্যতা, ও শোষণের হাত থেকে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের রক্ষা করার জন্য জ্যোতিবা রাও এর সাথে গড়ে তোলেন 'সত্য শোধক সমাজ '|
1876 সালে ভারত জুড়ে শুরু হয় খরা ফল স্বরূপ দুর্ভিক্ষ| মহারাষ্ট্র জুড়ে না খেতে পাওয়া মানুষের হাহাকার|এই সময়ে তিনি মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় 52 টি লঙ্গরখানা খোলেন শুধুমাত্র প্রান্তিক, নিরন্ন মানুষগুলোর কাছে বিনামূল্যে খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য| বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিতেন স্বামী এবং চিকিৎসক পুত্রকে নিয়ে|
সাবিত্রীবাঈ তাঁর যুগের চেয়ে অনেক এগিয়ে, তার পরিচয় আমরা আবারও পাই যখন 1890 সালের 28 শে নভেম্বর প্রয়াত হন সমাজসংস্কারক, চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, সমাজকর্মী তাঁর স্বামী মহাত্মা জ্যোতিবা ফুলে তখন|তাঁর শবযাত্রায়, অস্থিকলস মাথায় নেতৃত্ব দেন, সাবিত্রীবাঈ|জ্যোতিবা ফুলে তো শুধু তাঁর স্বামী ছিলেন না, তিনি ছিলেন তাঁর শিক্ষক,মার্গ নির্দেশক, বন্ধু, জীবনের ধ্রুবতারা| স্থাণুবৎ সাবিত্রীবাঈ এর এই পদক্ষেপকে লক্ষ্ করা ছাড়া রক্ষণশীল সমাজের আর বিশেষ কিছু করার ছিল না|
তাঁর প্রগতিশীল, আধুনিক মনের পরিচয় মেলে আবার যখন পুত্র যশবন্তের বিয়ের আগে পাত্রীকে নিজের বাড়ীতে এনে তাদের মেলামেশা করার সুযোগ করে দেন|সময়ের নিরিখে এই কাজ ছিল অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ|
1897 সালে পুনেতে শুরু হয় প্লেগ, মহারাষ্ট্র তখন উত্তাল একদিকে চলছে প্লেগের ত্রাণ কাজের নামে ব্রিটিশ সরকারের মানুষের ওপর অকথ্য অত্যাচার, যার প্রতিবাদে বাসুদেব বলবন্ত ফাদকের উদ্যোগে সংগঠিত হচ্ছে বিপ্লবীরা, পুত্র যশবন্ত কে নিয়ে সাবিত্রীবাঈ খুলে ফেলেছেন চিকিৎসাকেন্দ্র, রাস্তায় ঘুরে ঘুরে প্লেগ আক্রান্ত মানুষদের নিয়ে এসে চিকিৎসা চলত| এই দুঃসময়ে একটি দশ বছরের ছেলেকে কাঁধে করে উদ্ধার করে নিয়ে এসে নিজের হাতে তার সেবা শুশ্রূষা র ভার তুলে নেন|আক্রান্ত হন এই মারণ রোগে|1897 সালে পুত্র যশবন্তের সব চেষ্টা বিফল করে দিয়ে চলে যান সাবিত্রীবাঈ|
ঘূণধরা এই রক্ষণশীল, সংস্কারবিমুখ সমাজে নারীদের মুক্তির জন্য, তাদের স্বীকৃতি র জন্য, প্রান্তিক, শোষিত, নিম্নবর্গের মানুষদের অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার দাবী তুলেছিলেন তিনি| মনুবাদী সমাজব্যবস্থার অবসানে প্রান্তিক মানুষগুলোর অন্ধকারময় জীবনের অবসান ঘটুক সারা জীবন এই দাবিতেই পথ হেঁটেছিলেন সাবিত্রীবাঈ এবং জ্যোতিবা ফুলে| কিন্তু ইতিহাস মনে রাখে নি, এই আত্মত্যাগ, উদাসীন থেকেছে অনমনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী সমাজসেবিকা কে যথাযোগ্য সম্মানদানে| মনে রাখেনি ঊনবিংশ শতকের নবজাগরণের প্রদোষকালে নারী শিক্ষার প্রথম আলোর দিশারীকে|
আমাদের পিতৃতান্ত্রিক উচ্চবর্গীয় সমাজ সাবিত্রীবাঈকে যথাযোগ্য মর্যাদার আসন দিতে ভুলে গিয়েছেন| ইতিহাস বইয়ের পাতায় ' দক্ষিণ ভারতের বিদ্যাসাগর ' জ্যোতিবা রাও ফুলের কথা থাকলেও, স্থান পান নি সাবিত্রীবাঈ| যুগন্ধর সাবিত্রীবাঈ ইতিহাসবেত্তাদের চরম উদাসীনতায় এতদিন বিস্মৃতির অন্তরালে থাকলেও আজ নতুন যুগের সমাজ গবেষকরা নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে চাইছেন সাবিত্রী বাঈ ফুলের বিশাল কর্মকাণ্ডকে|
Comments