গল্প - পিতা এবং পিতৃত্ব
- সুস্মিতা
- Apr 6, 2022
- 9 min read
"তুমি কিন্তু বিরাট ভুল করছ সায়ন...এত বড় সুযোগ জীবনে বারবার আসে না, এরকম ব্রাইট অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার তোমার... এই সুযোগ নষ্ট কোরোনা...ভাবো, আর একবার ভেবে দেখ"- টেলিফোনে অনিমেষ রায়চৌধুরীর কন্ঠস্বর ক্রমশ অধৈর্য ও উচ্চগ্রামে...
রাত এখন প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। টেলিফোনের অপর প্রান্তে সায়ন নিরুত্তর...
আজ বিকেলেই সায়ন অফিসে ওর ফাইনাল ডিসিশন ভাইস প্রেসিডেন্ট অনিমেষ রায়চৌধুরীকে জানিয়ে দিয়ে এসেছে। না, ওর মনে কোনও দ্বিধা নেই, নেই কোনোরকম আপশোস বা দুঃখবোধ।
সায়ন অত্যন্ত সচেতনভাবে, সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওর আলটিমেট সিদ্ধান্ত- "যতই লোভনীয় সুযোগ, যত বড় সম্মানই হোক না কেন...সায়ন এখন অস্ট্রেলিয়া যাবেনা, কোনোমতেই না।"- ওর মন,ওর বিবেক বলেছে এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত, সত্যিই ওর কোনও আপশোস হচ্ছেনা। এই মুহূর্তে ওর জীবনের প্রায়োরিটি নিজের কেরিয়ার নয়।
অনিমেষ রায়চৌধুরীকেও অবশ্য কোনো দোষ দেওয়া যায় না। বস হিসেবে তিনি বুদ্ধিমান, ঝকঝকে স্মার্ট সায়নকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। ম্যনেজমেন্ট প্রতিভু হওয়ার কারণে কোম্পানীর স্বার্থের কথাও তাঁকে ভাবতেই হয়। তাই রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ছেলেটিকে বুঝিয়ে রাজি করানোর শেষ চেষ্টা করলেন তিনি...
সায়ন অনড়...ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ল্যান্ডফোনের রিসিভারটা ধীরেধীরে নামিয়ে রাখার আগে শুধু দুটি বাক্য উচ্চারণ করল সে- "স্যার, আমার জীবনে আমার বাবাই প্রথম এবং শেষ...তিনিই আমার সবকিছু... এতএব...।"
দেরি হয়ে যাচ্ছে...বাবাকে এবার খাওয়াতে হবে। পরপর দুটো হার্ট অ্যাটাকের পর থেকে বাবা ডান হাতটা আর তুলতে পারেনা। ডান পা'টাও অবশ। ফিজিওথেরাপি আর মনের জোরে তবুও বাবা বিছানা থেকে উঠে এখন হুইলচেয়ারে বসে ঘরের মধ্যেই একটু এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করেন।
গত তিনমাস ধরে বাবাকে রাতের খাবারটা সায়ন নিজের হাতে খাওয়ায়।
সায়নের জীবনে তার বাবাই সবকিছু। জন্মের পর থেকেই মাকে ও পায়নি।
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে অনিমেষ রায়চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলছিল সায়ন। সোফা থেকে উঠে ঘুরে দাঁড়াতেই হোঁচট খেল সে। কখন যেন হুইলচেয়ারটা ঠেলে ঠেলে বাবা নিঃশব্দে পেছনে এসে অপেক্ষা করছেন...
গভীর মমতায় পিতার দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিলো একমাত্র সন্তান। বৃদ্ধের চোখের জল আর ঠোঁটের কোণের লালা তখন মিলেমিশে একাকার...
চোখের জলে ভাসতে ভাসতেই সায়নের বাবা সুকল্যান মনেমনে একটি জরুরি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন।
গত ছাব্বিশ বছর ধরে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা একটা গভীর গোপন ব্যাপারকে এবার মুক্তি দিতে হবে।
আগামীকাল সকালে সায়ন অফিসে বেরিয়ে গেলেই "সেই মেডিকেল রিপোর্টটা" ছিঁড়ে পুড়িয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
সুকল্যানের মনে আর কোনও দ্বিধা রইল না।
একটা মেডিকেল রিপোর্ট কখনোই কোনও সম্পর্কের মাপকাঠি হতে পারে না, হয় না।
*
রাতে বিছানায় শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসছে না সুকল্যানের।
রাত সাড়ে ন'টার মধ্যেই সায়ন আজ ভারি চমৎকার চিকেন স্ট্যু আর পাউরুটি খাইয়ে দিলো তার বাবাকে।
প্রতিদিনই বড় পরিতৃপ্ত বোধ করেন সুকল্যান, সায়নের হাতের এই সেবাটুকু পেয়ে।
কিন্তু আজ সন্ধ্যায় সায়ন যখন তার কোম্পানির বসকে জানিয়ে দিলো- "আমার জীবনে আমার বাবাই সব...তিনিই আমার প্রথম ও শেষ প্রায়োরিটি, বাবাকে এই অবস্থায় দেশে ফেলে রেখে আমি কোথাও যাব না...।"- তখন কথাগুলো শুনে ভেতরে ভেতরে একেবারে কেঁপে উঠলেন সুকল্যান।
তারপর থেকেই মনটা একেবারে এলোমেলো হয়ে গিয়েছে তার।
সাতাশ বছর আগের সব স্মৃতি আজ তাকে নিদ্রাহীন করে রেখেছে।
সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো মনে পড়ছে সব কথা।
সুকল্যানের দেরাজের গোপন ড্রয়ারে সাতাশ বছর ধরে লুকিয়ে রাখা আছে একটি মেডিকেল রিপোর্ট আর বুকের মধ্যে জমে আছে এক গভীর গোপন কথা।
*
সেই সাতাশ বছর আগের ঘটনা। নীলাঞ্জনা আর সুকল্যানের বিয়ের বয়স তখন সদ্য তিন বছর পেরিয়েছে।
তৃতীয় বিবাহবার্ষিকীর রাতে সুকল্যানই প্রথমে কথাটা তুললেন। নীলাকে কাছে টেনে আদর করতে করতে তিনি বললেন- "নীলা এবার আমাদের পরিবার একটু বড় হোক, কি বলো...আমাদের মাঝখানে তৃতীয় জন আসুক। বাড়িতে একটা ছোট বাচ্চা না থাকলে কি ভালো লাগে?"
খুব আশা উত্তেজনা নিয়ে সুকল্যান কথাটা বলেছিলেন। কিন্তু গম্ভীর স্বভাবের নীলাঞ্জনা সে প্রস্তাব শুনে যেন আরও বেশি গম্ভীর এবং শীতল হয়ে গেল।
খুব ঠান্ডা গলায় নীলাঞ্জনা বলেছিল- "আমি এখন একেবারেই প্রস্তুত নই সুকল্যান। শুধুমাত্র গ্রাজুয়েশন শেষ করে ব্যাংকের চাকরিটা আমি পেয়েছি। কিন্তু আমার আরেকটু বেশি পড়াশোনা এবং কেরিয়ারটাকেও আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে।"
মনেমনে একটু দমে গেলেও সুকল্যান নীলাঞ্জনার ইচ্ছের মধ্যে সত্যিই কোনও দোষ দেখেননি। এরকম তো হতেই পারে। তিনি এটাও ভেবেছিলেন "স্ত্রীর ইচ্ছেকে অবশ্যই মর্যাদা এবং সম্মান দেওয়া উচিৎ।"
*
বছর গড়াতে থাকে। নীলাঞ্জনা তখন চাকরির সঙ্গেসঙ্গে আরও নানারকম পড়াশোনা ও পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সুকল্যানের সে ব্যাপারে পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা।
তবুও অফিস থেকে সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরে বাড়িটাকে বড় ফাঁকা শূন্য লাগে। সব ঠিকঠাক আছে, স্বামী স্ত্রীর দুজনেরই ভালো চাকরি। স্বচ্ছলতা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আড্ডার কোনও অভাব নেই, কিন্তু একটি শিশুর দুরন্তপনা, কলকাকলির অভাবে সুকল্যান বড় বিষণ্ণ বোধ করেন। বন্ধুবান্ধব, কলিগদের মধ্যে অনেকেই ততদিনে বাবা হয়েছেন, সুকল্যান নিজের ভেতরে তীব্র পিতৃত্বের ক্ষুধা টের পান।
সাধারণত নারীর মনেই মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা জাগে বলে মনে করা হয়। কিন্তু চার বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও নীলাঞ্জনা জানায়- "সে তখনও মা হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়।"
এবার একটু বিরক্তবোধ শুরু হয় সুকল্যানের। পিতামাতা হওয়ার জন্য উপযুক্ত বয়সের কথাটাও তো একটা ভাবার বিষয়। সেটা তো ক্রমশ দেরিই হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নীলা বড় অবুঝ। সন্তানের প্রসঙ্গ উঠলেই সে আরও নিরুত্তাপ হয়ে যায়।
অতীতের সেই সময়টার কথা ভাবলে সুকল্যান আজও একেক সময় মনের মধ্যে ছোট একটি অপরাধের কাঁটা অনুভব করেন।
পঞ্চম বিবাহবার্ষিকী পেরিয়ে যাওয়ার পরে সুকল্যান সন্তান আকাঙ্খায় নীলার ওপরে একটু জোরজার খাটাতেই শুরু করেছিলেন। তিনি মনে করতেন- "একবার মা হয়ে গেলেই, নীলার এইসব ভীতি ভাবনা দূর হয়ে যাবে।"
*
কিন্তু মানুষ ভাবে একরকম, আর জীবন তার নিজস্ব খেলা নিজের মনে খেলতে থাকে।
প্রায় সাত আট মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন নীলার সন্তানসম্ভাবনা দেখা দেয়না, সুকল্যান তখন ভেতরে ভেতরে বড় অস্থির, বড় চিন্তিত হয়ে পড়েন।
কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ তিনি ছিলেন না। নীলাকে না জানিয়েই সুকল্যান এক ইওড়লোজিস্টের কাছে চিকিৎসার জন্য যাতায়াত শুরু করেন।
সুকল্যানের তখন মনমেজাজ খুব খারাপ থাকত। পুরুষের পিতৃত্বের ক্ষিধে যে এত তীব্র হতে পারে, নিজের না হলে সুকল্যান টের পেতেন না।
নানা দুশ্চিন্তা, অশান্তিতে নীলার সঙ্গে সম্পর্কটায় ভালোবাসার উত্তাপ তখন ক্রমশ কমছে।
সুকল্যানেরও দোষ ছিল কিনা কে জানে...তার তখন শুধু একটাই চাহিদা- "পরিবারে নতুন অতিথি আসুক, একটি সন্তান চাই।"
এরই মধ্যে কানাঘুষোয় ব্যাঙ্কের এক কলিগের সঙ্গে নীলাঞ্জনার ঘনিষ্ঠতার খবর সুকল্যানের কানে আসে। কিছুদিন আগে অফিসের কোনও ট্রেনিং প্রোগ্রামে ওরা একসঙ্গে মুম্বাই থেকে ঘুরেও এসেছে।
সুকল্যান ওসব উড়ো খবরে কান দেননি। তার মাথায় তখন একটাই চিন্তা। নিজের কোনও চিকিৎসার প্রয়োজন থাকলে, তিনি অবশ্যই সেটা করাবেন। তা নাহলে এর পরের পদক্ষেপ হবে- নীলাকে বুঝিয়েসুজিয়ে গাইনোকলজিস্টয়ের কাছে নিয়ে যাওয়া।
*
ইউরোলজিস্ট ডক্টর সীতাংশু চ্যাটার্জির পরামর্শ অনুযায়ী নিজের স্পার্ম টেস্ট করাতে দিয়েছিলেন সুকল্যান। এটাই রুটিন চিকিৎসা পদ্ধতি।
তৃতীয়বার টেস্টের রিপোর্টটা যেদিন হাতে এল, সেদিনই...
প্রথম দুবারের টেস্ট রিপোর্টগুলোকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেনি সুকল্যানের। ডাক্তারও তখন বলেছিলেন- "নানারকম টেনশন, কাজের স্ট্রেস ইত্যাদি কারণে স্পার্ম কাউন্ট রিপোর্ট প্রথমে একবার দুবার ঠিক নাও আসতে পারে।" সুকল্যান নিজেও তাই ভেবেছিলেন। মেন্টাল স্ট্রেস তো তার চলছেই বেশ কিছুদিন ধরে।
কিন্তু তৃতীয়বারের টেস্ট রিপোর্টটা পরিষ্কার জানিয়ে দিলো- "স্পার্ম কাউন্ট এবং কোয়ালিটির ত্রুটির জন্য সুকল্যানের পক্ষে সন্তানের জন্ম দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তার ক্ষেত্রে চিকিৎসাতেও বিশেষ ভালো ফল পাওয়ার আশা নেই বললেই চলে।"
একেবারে ভেতর থেকে ভেঙে গিয়েছিলেন সুকল্যান।
একজন পুরুষের কাছে এইরকম একটি রিপোর্ট যে কতটা গভীর গোপন যন্ত্রণার- সেটা ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন। এটা তো শুধুমাত্র দুঃখ নয়, এ যেন তার পৌরুষের অপমান, তার ব্যর্থতা।
এই যন্ত্রণা কারুর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না।
রিপোর্টটা খুঁটিয়ে পড়ার পরে একলা ঘরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল সুকল্যানের। কিন্তু পুরুষ যে কাঁদতে জানে না। শৈশব থেকে তার সামাজিক শিক্ষা তাকে কাঁদতে শেখায় না, কাঁদতে দেয় না।
একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সুকল্যান।
*
সম্পূর্ণ ভাঙাচোরা একটা মানুষ বাড়ি ফিরেছিল সেদিন।
আর সেদিনই সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে খবরটা দিয়েছিল নীলাঞ্জনা।
ইউরিন টেস্টের রিপোর্টটা সুকল্যানের দিকে এগিয়ে দিয়ে নীলা বলেছিল- "সে অন্তঃসত্ত্বা, চার মাস পেরিয়ে পাঁচ মাস শুরু হয়েছে।"
জীবনের কি অদ্ভুত পরিহাস। যে খবরের অপেক্ষায় গত কয়েক বছর সুকল্যান প্রতিটা মুহূর্ত অধীর আগ্রহে কাটিয়েছেন, আজ যখন সেই খবর সত্যি হল...সুকল্যান তখন বাকরুদ্ধ, কেমন যেন স্থবির হয়ে রইলেন।
সুকল্যানের প্রতিক্রিয়ায় নীলাঞ্জনা একটু অবাক হলেন ঠিকই, কিন্তু গত দু বছরে তাদের সম্পর্কটা এতটাই জটিল এবং শীতল হয়ে গিয়েছে যে স্ত্রী সে ব্যাপারে আর বেশি কথা বাড়ালেন না।
এরপরের সাড়ে তিনমাস এক অদ্ভুত সময়।
সুকল্যান মাঝেমধ্যেই মনেমনে ক্রোধে জ্বলে ওঠেন, ভাবেন একেবারে সোজাসুজি প্রশ্ন করবেন নীলাকে। জানতে চাইবেন তার গর্ভস্থ সন্তানের পিতার পরিচয়। স্বামী হিসেবে তার অধিকার আছে প্রশ্ন করার। কেন নীলা তাদের দাম্পত্যকে এইভাবে অপমানিত, কলুষিত করেছে।
কিন্তু তার পরমুহূর্তেই সম্পূর্ণ নিভে যান সুকল্যান।
নীলাকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হলে, সুকল্যানের নিজেকেও নগ্ন হতে হবে। তার নিজের মেডিকেল রিপোর্টটিকেও সর্বসমক্ষে আনতে হবে প্রমাণ হিসেবে। না, সেটা তিনি করতে পারবেন না। সেটা যেন তার পৌরুষের হেরে যাওয়ার দলিল। সে যে বড় লজ্জার।
সবকিছু বুঝেও মুখ বুজে থাকেন সুকল্যান। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে সহ্য করতে পারতেন না তিনি।
তবুও নিরুপায়ভাবে নীলার ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে যথাযোগ্য সেবার ব্যবস্থা তাকেই করতে হয়।
*
নির্ধারিত সময়ের তিন সপ্তাহ পূর্বে জন্ম হয় শিশু পুত্রের।
জন্ম দেওয়ার তিনদিন আগে থেকেই কিছু শারীরিক জটিলতার জন্য নীলাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করে দিতে হয়েছিল।
ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলা, ছুটোছুটি সবকিছু সুকল্যানই করেছিলেন। তার বুকের ভেতরে তখন ঝড়। মানসিক টানাপোড়েনে তিনি ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু বাইরে তিনি ছিলেন অবিচল। তাকে থাকতে হয়েছিল সেরকম। তার কোনও উপায় ছিল না।
স্পার্ম কাউন্ট রিপোর্টটা সুকল্যানের জীবনের সব আত্মবিশ্বাস কেড়ে নিয়েছিল। অপয়া কাগজের টুকরোটিকে তিনি ব্যক্তিগত আলমারির ড্রয়ারে লুকিয়ে রেখে দিয়েছিলেন।
সেদিন ছিল এক শনিবার। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বেলা দেড়টা নাগাদ সিজারিয়ান করে জন্ম হল নীলার ছেলের।
শিশুপুত্রটিকে সুকল্যান প্রথম দেখলেন বেলা তিনটে নাগাদ। নীলা তখন ওষুধের ঘুমঘোরে।
নার্সিংহোমের নার্স এবং আয়ারা সুকল্যানের কোলে তুলে দিলেন শিশুটিকে।
কি যে ছিল সেই সদ্যজাতর মুখমণ্ডলে, তার নিষ্পাপ হাসিতে...
সুকল্যান অনুভব করলেন তার দুহাতের মধ্যে যেন এক দেবশিশু।
তার বুকের ভেতরের অশান্ত ঝড় সহসা শান্ত হয়ে গেল। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে নামল শ্রাবণধারা।
শিশুটি তার কচি নরম হাতের মুঠোয় জড়িয়ে ধরল সুকল্যানের একটি আঙ্গুল।
সুকল্যান মুখ নামিয়ে শিশুটির কপালে এঁকে দিলেন এক গভীর স্নেহ চুম্বন। ফিসফিস করে বললেন- "সায়ন আমার সন্তান সায়ন।"
*
ছেলেকে নিয়ে পাগলের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সুকল্যান।
তাকে স্নান করানো, ঘুম পাড়ানো সাজানো, যত্ন করা সবকিছুই নিজের হাতে করতে ইচ্ছে করে সুকল্যানের। অফিসের থেকে লম্বা ছুটির ব্যবস্থা করলেন।
স্তন্যপান করানো ছাড়া নীলার তেমন দায়িত্বই রইল না। সুকল্যানের ওপরে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তিনি নিজেও যেন অনেকটা নিশ্চিন্ত।
দেখতে দেখতে দেড় বছর সময় কেটে গেল এইভাবেই।
একদিন নীলা সুকল্যানকে জানালেন- "বিদেশের এক বিশাল বড় কোম্পানিতে কাজের অফার পেয়েছে সে। কেরিয়ারের এই সুযোগ সে হারাতে চায় না। সুকল্যান চাইলে ছেলেকে নিজের কাছেই রাখতে পারেন, নীলার আপত্তি নেই। সে নিজে বছরে দুবার দেশে আসবে।"
সুকল্যান কোনও আপত্তি করেননি। তিনি বুঝতে পারছিলেন এই ব্যাপারে কথা বাড়িয়ে কোনও লাভ হবে না। তাদের যৌথ পথচলার সময় শেষ হয়ে আসছে। নীলা তার কাছে আর থাকবে না। শুধু সায়নকে ছেড়ে তিনি এক মুহূর্তও বাঁচবেন না।
নীলার প্রস্তাবে এক কথায় সায় দিলেন সুকল্যান।
তার অনুমান একদম মিলে গিয়েছিল।
বছর দুয়েক ওইরকমভাবে চলার পরে ডিভোর্সের প্রস্তাব নীলাঞ্জনার দিক থেকেই এসেছিল।
বিনা প্রতিরোধে মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স মেনে নিয়ে ছিলেন সুকল্যান।
পরে খবর পেয়েছিলেন নীলা তার সেই সহকর্মীকে বিয়ে করেছেন।
*
জন্মের পরমুহূর্ত থেকে যে শিশুটি সুকল্যানের হাতের দুটি আঙ্গুল নিজের হাতের মুঠির মধ্যে আঁকড়ে ধরেছিল, বাকি জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও সেই হাতের মুঠো সুকল্যান আলগা হতে দেননি।
এরপরে সায়নই হয়ে গেল সুকল্যানের ধ্যানজ্ঞান। তার সবরকমের যত্ন, তাকে খাওয়ানো, স্নান করানো সুকল্যান বেশিটাই নিজের হাতে করতেন।
দেড় বছর বয়স থেকে সায়ন তার মাকে আর পায়নি। সুকল্যান তাকে মায়ের অভাব বোধ করতেই দেননি।
সুকল্যানের স্নেহ মমতা যত্নের মধ্যেই সায়ন একসঙ্গে মা ও বাবা দুজনকে পেয়েছিল।
তারপরে কৈশোর থেকে তো সুকল্যান আর সায়ন একে অপরের বেস্টফ্রেন্ড। সায়নকে মনের মতো করে গড়ে তুলে ছিলেন সুকল্যান। তাকে লেখাপড়া, খেলাধুলায়, কৃষ্টি, সংস্কৃতিতে সেরা জিনিসটি দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন তিনি।
দুজনের সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা, শ্রদ্ধায় এতটুকু ফাঁকি ছিলনা কোনও দিন।
বড় আনন্দে, শান্তিতে এবং একটি মানুষ গড়ার আনন্দে দিনগুলো কেটেছিল সুকল্যানের।
যথা সময়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ভালো বড় কোম্পানিতে জয়েন করে সায়ন।
*
এই সবকিছুর মধ্যে ছোট্ট একটি কাঁটা প্রায় সবসময়ই সুকল্যানকে বিদ্ধ করতে থাকে।
তার মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ সর্বদা কাজ করে। এতগুলো বছর ধরে রাতে ঘুমাতে গেলেই একটা প্রশ্ন তাকে তাড়া করে- "সায়নকে কি সব কথা খুলে বলা উচিৎ? তার তো অধিকার আছে সত্যকে জানার। রক্তের সম্পর্কে কে তার আসল পিতা, সেটা তো তার জানা প্রয়োজন। কোনোদিন কোনো মেডিকেল প্রয়োজনে যদি সত্যটা উদ্ঘাটিত হওয়ার প্রয়োজন হয়? কত কথাই যে মনে হয় সুকল্যানের। কখনও কোনো রাতে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন- "নাহ আর দেরি নয়, আর ভাবলে চলবে না, আগামীকাল সকালেই সায়নকে সব খুলে বলবেন তিনি।" পরমুহূর্তেই বড় ভয় করে...সায়নকে হারানোর ভয়। সব কথা জেনে সায়ন যদি তার জন্মদাতার কাছে চলে যেতে চায়? তাহলে? না না সায়নকে ছেড়ে থাকার কথা সুকল্যান ভাবতেও পারেন না। কিছুতেই তাকে তার আসল পিতার পরিচয় জানতে দেওয়া যাবে না।
কিন্তু সুকল্যান কি সায়নের সঙ্গে এটা অন্যায় করছেন?
ন্যায় অন্যায় এবং অপরাধবোধের বোঝায় সুকল্যান অবসন্ন হয়ে পড়েন।
তারপরে আসে সেই দিন। সায়নের সামনে বেশ বড়সড় একটা সুযোগ এলো। কোম্পানি থেকে অন সাইটে বিদেশে পাঠাতে চায় সায়নকে। পাঠাতে চায় সেই বিদেশের সেই শহরে যেখানে নীলাঞ্জনা ও তার বর্তমান স্বামীর সংসার।
*
বুকের মধ্যে ঝড় ওঠে সুকল্যানের। সায়নের উন্নতিতে তিনি সত্যিই খুশি। কিন্তু কেন যেন তার মনে হতে থাকে- এবার সায়নকে হারিয়ে ফেলবেন তিনি। কি যেন একটা ঘটতে চলেছে...অদ্ভুত এক আনক্যানি ফিলিং।
রাতে ঘুম আসে না সুকল্যানের। ঘুম আসে না সায়নেরও।
পিতপুত্র দুজনের কেউই যে একে অপরকে ছাড়া থাকতে শেখেননি এতদিন। এ এক অদ্ভুত টান।
কেউই মুখে কিছু বলছেন না। অথচ হৃদয়ে তোলপাড়...।
সুকল্যানের হৃদপিণ্ড এই ভার আর বহন করতে পারে না।
মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে দুবার হার্ট অ্যাটাক হয় সুকল্যানের।
সায়নের তৎপরতায়, উদ্যোগে, মমতায় চিকিৎসা এবং সেবাযত্নের কোনও ত্রুটি হয় না।
কিন্তু তারপর থেকেই সুকল্যান হুইল চেয়ারে।
মনেমনে আরও বেশি অপরাধবোধে ভোগেন সুকল্যান। তার অসুস্থতার জন্যই সায়নের বিদেশযাত্রা পেছিয়ে গিয়েছে।
কিন্তু নিজের মনকে ক্রমশ শক্ত করেছেন তিনি। যা সত্য তা প্রকাশিত হবেই। সত্যকে স্বীকার করে নেওয়াই উচিৎ। নিজেকে ধীরেধীরে প্রস্তুত করছেন তিনি।
*
কিন্তু আজ সন্ধ্যায় অফিসের বসের সঙ্গে সায়নের কথোপকথন সুকল্যানকে আসল সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলো।
অসুস্থতার মধ্যেও গত কয়েকদিন সুকল্যান বুঝতে পারছিলেন- অফিস থেকে প্রবল চাপ আসছে সায়নের ওপরে। পিতার অসুখের জন্য সে তার বিদেশযাত্রাকে ক্রমশ পিছিয়ে দিচ্ছিল। প্রথম কিছুদিন কোম্পানি খুবই সহযোগিতা করেছে। কিন্তু এবার তারা আর অপেক্ষা করতে রাজি নয়। সেটাই তো স্বাভাবিক। কোম্পানির কাজের ব্যাঘাত হচ্ছে তো বটেই।
সায়নের মুখের দিকে তাকাতে পারতেন না সুকল্যান। বারবার মনে হ'ত- তার নিজেরই তো উচিৎ এই সময়ে মনের জোর দিয়ে সায়নকে ঠেলে বিদেশে পাঠানোর।
কিন্তু কিন্তু কিন্তু...সুকল্যান পারছিলেন না। বিদেশের অন্য যে কোনও জায়গায় যাওয়ার হলে হয়ত বা পারতেন কিন্তু বর্তমানে সায়নের যেখানে যাওয়ার কথা হচ্ছে, সেখানে যে আছে ওর রক্তের সম্পর্কের পিতা।
কথাটা ভাবলেই কেঁপে ওঠেন সুকল্যান। তার ভয় করে, মনে হয় ওই দেশে গেলেই তার সায়ন তার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে, অনেক দূরে সরে যাবে...তিনি বোধহয় আর কোনোদিন ফিরে পাবেন না তার সন্তানকে। কি যে অসহায় কষ্ট...
*
কিন্তু আজ সন্ধ্যায় সায়ন যখন নিজে অনিমেষ রায়চৌধুরীকে জানিয়ে দিলো- "আমার বাবাই আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ প্রায়োরিটি, বাবাই আমার সবকিছু। যত বড় সুযোগই আসুক, আমার বাবাকে দেশে একলা ফেলে রেখে কোথাও যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়....।"- তখন হুইলচেয়ারে বসে কেঁদে ফেললেন সুকল্যান।
"বাবা" শব্দটা আজ আবার নতুন করে ঢেউ জাগালো তার বুকে, সাত সমুদ্রের উথলপাতাল ঢেউ। কি মায়াময় একটা শব্দ- "বাবা"...সুকল্যানের মনের আনাচেকানাচে অনুরণিত হতে থাকল সে ডাক।
সুকল্যান আজ সত্যিকারের টের পেলেন শুধু রক্তমাংস দিয়েই একটা সম্পর্ক নির্ধারিত হয় না।
সম্পর্ক আসলে তৈরি হয় পারস্পরিক স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, ত্যাগ দিয়ে।
এটাই সত্য...।
সিদ্ধান্ত নিতে একটুও দ্বিধা এবং দেরি হলনা সুকল্যানের। আগামীকাল সকালেই সেই মেডিকেল রিপোর্টটা ছিঁড়ে পুড়িয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
Opmerkingen