top of page

গল্প - মানুষপুরের গল্প

  • শর্মিষ্ঠা বসু
  • Dec 26, 2020
  • 4 min read

Updated: Jan 22, 2021



ফাল্গুনী পূর্নিমার সন্ধ্যায় পূজায় বসেছেন মানুষপুরের রাজা সূর্যনারায়ণ । সামনে সোনার থালায় ফলমূল, ক্ষীর , মিষ্টান্ন , ফুল , বেলপাতা। ধূপ , দীপ আর ফুলের সৌরভে এক অপূর্ব পবিত্র , ভাবগম্ভীর পরিবেশ । মন্ত্রপাঠ করতে করতে অধীর হয়ে উঠছেন তিনি। প্রতি বৎসর ফাল্গুন মাসের পূর্নিমার সন্ধ্যায় , স্বয়ং ঈশ্বরের আবির্ভাব হয় তার পূজাগৃহে। কিন্তু আজ এত বিলম্ব হচ্ছে কেন? অস্হির হলেন সূর্যনারায়ণ ।


“রাজা সূর্যনারায়ণ, “দেবতার কন্ঠস্বর শুনে মুদিত চক্ষু খুললেন রাজা। কিন্তু একি ! আজ এত অন্ধকার কেন? সব দীপ কেন নিভে গেছে হঠাৎ ? তবে কি এ কোন অমঙ্গলের সূচনা সংকেত ? উদ্বেগ , উৎকন্ঠায় , মস্তিষ্ক কাজ করছিল না তার । স্বল্পালোকে রাজা লক্ষ্য করলেন ঈশ্বর আজ বড় গম্ভীর।


ঈশ্বরের চরণস্পর্শ করলেন রাজা। যুক্তহস্তে বললেন “ হে প্রভু,আপনাকে বড় চিন্তিত , বিচলিত মনে হচ্ছে। আমি প্রজাপালক, ধর্মপ্রাণ , তবু যদি কোন অন্যায় বা অপরাধ করে থাকি , আপনি তা ক্ষমা করুন। “কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন ঈশ্বর । তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “ কাল ভোরের আলো পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করার মুহুর্তেই অনির্দিষ্টকালের জন্য মানুষপুরের সব মানুষের বন্দিজীবন আরম্ভ হবে।এক অদৃশ্য কীটের আক্রমণের ভয়ে গৃহে আবদ্ধ হয়ে থাকবি তোরা। বহির্জগতের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হবে তোদের ।পরিচিত, অপরিচিত কারো নিকটে গেলেই সেই বিষাক্ত কীট দংশন করবে সবাইকে। যার পরিণতি মর্মান্তিক ।”


রাজার চোখের সামনে সমস্ত কক্ষ আন্দোলিত হচ্ছিল । তিনি বললেন ,” হে ভগবান, এ কোন অপরাধের দন্ড জানিনা। আমি রাজকার্যে কখনও অবহেলা করিনি। আমার শাসনকালে শহরে , গ্রামে সর্বত্র উন্নতি , অগ্রগতি অব্যাহত । চাষীরা মাঠে ফসল ফলায়, মৎসজীবিরা মাছ ধরে , তাঁতীরা তাঁত বোনে। সুসজ্জিত , আলোকিত নগরীতে সুখে দিনযাপন করে আমার প্রজারা । তবু কেন এই কঠিন শাস্তি ? “


ম্লান হাসলেন ঈশ্বর । বললেন , “ তোর দেশে অভাব নেই। ক্ষেতে ধান আছে, দীঘিতে মাছ আছে। আলোকিত নগরে বিত্ত বিলাসের প্রাচুর্য আছে। তবু, তোরা লোভী। আমার আশীর্বাদে মন ভরেনা তোদের । রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে ফসল বৃদ্ধি করিস, সবুজ নিশ্চিহ্ন করে প্রাসাদ, নগরী তৈরী করিস । নির্বিচারে প্রাণীহত্যা করিস । এর শাস্তি , এর ফল ভোগ কর তোরা। তোদের কোষাগারে অর্থ থাকবে, অথচ ব্যয় করতে পারবি না ,ক্ষমতা থাকবে , প্রদর্শন করতে পারবি না। অদৃশ্য সেই কীটের আতঙ্ক তোদের সর্বক্ষণ তাড়া করে বেড়াবে। স্বাভাবিক জীবনযাপন স্ত্বদ্ধ হয়ে যাবে।


রাজার করুণ মিনতিতেও এতটুকু টললেন না ঈশ্বর। তখন রাজা বললেন , “ হে করুণাময় , আমার দেশে বহু শ্রমিক আছে। তারা দরিদ্র , অসহায় । গৃহবন্দী অবস্হায় কর্মহীন হয়ে অনাহারে মৃত্যু হবে এদের। এদের কথা ভেবে আপনি মানুষপুরের সব মানুষকে রক্ষা করুন। “


অট্টহাস্য করলেন ঈশ্বর । বললেন, “এদের কথা ভেবে বৃথা সময় অপচয় করিস না। কত রাজা , এসেছে, গেছে। এদের অবস্হার পরিবর্তন হয়নি কখনও।অর্ধাহারে, অনাহারে দিনযাপন করেছে এরা। এতদিন ক্ষুধার জ্বালায় মরছিল, এবার হয়ত কীটের দংশনে মরবে। তোরা এবার এই শৃঙ্খলিত, বদ্ধ জীবনের জন্য প্রস্তুত হও। তোরা বন্দী হলে , বসুন্ধরা, সজীব, শ্যামল হবে, কাননে ফুল ফুটবে। পাখি গান গাইবে।


শেষ চেষ্টা করলেন সূর্যনারায়ণ । বললেন” হে ভগবান,আপনি একবার বিবেচনা করে দেখুন। মানুষপুরের বহু মানুষ নির্লোভ, পরোপকারী , সৎ । আপনি এদের সবাইকে রক্ষা করুন প্রভু। “রুষ্ট হলেন ঈশ্বর। বললেন, “ মানুষপুরের কেউ নির্লোভ নয় । যারা দান করেছে, পরোপকার করেছে , তারা কেবলমাত্র নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের আশায় তা করেছে। নিজেকে মহৎ প্রতিপন্ন করার নেশায় করেছে। ওটা তাদের দম্ভ।ভাবমূর্তি গড়া আর অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টার মধ্যে কোন মহত্ব নেই। মানুষপুরের মানুষ , বিভেদ, বিদ্বেষের এক ঘৃণ্য চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে।লোভ, আত্মসুখ, আর স্বার্থপরতার এক বৃত্তের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে তোদের জীবন। শ্রদ্ধা নেই, ভালবাসা নেই, সহমর্মিতা নেই।


ঈশ্বরের ভর্ৎসনায় হৃদয় বিদীর্ণ হল রাজার । নীরবে বসে রইলেন তিনি। ঈশ্বর বললেন,” তোদের কর্ম , তোদের ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে। শুভবোধ জাগ্রত হলে, এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাবি তোরা।” একথা বলে ধীরে ধীরে নৈশ আকাশে মিলিয়ে গেলেন ঈশ্বর ।


সবকিছু ঘটে গেল আচমকা, প্রস্তুতিবিহীন। অলিন্দে দাঁড়িয়ে নিনির্মেষ নয়নে বাইরে তাকিয়ে রইলেন রাজা। যেন শেষবারের মতন স্বাধীন জীবনের আনন্দ উপভোগ করছেন।


ভয়ে, আশঙ্কায়, আতঙ্কে দিনপাত করতে লাগল মানুষপুরের মানুষ। আজকাল নতুন দিনের সূর্য আর নতুন স্বপ্ন দেখায় না। রাজা সূর্যনারায়ণ আর রানী পদ্মগন্ধাও অসহনীয় যন্ত্রনায় প্রাসাদে দিনযাপন করেন। অতিথিশালা, সভাগৃহ সব আজ শূণ্য । মৃত্যুর আগমন বার্তা পেয়ে সবাই চলে গেছে । শুধু উৎকন্ঠায় , উদ্বেগে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বাস করছেন এই দুইজন।


এভাবেই অতিক্রান্ত হয় বেশ কিছুকাল। একাকীত্বের যন্ত্রণা যে এত তীব্র আগে কখনও বোঝেননি রাজা। কি বিচিত্র এই জীবন। শয্যায় একাকী শুয়ে স্মৃতিচারণ করেন শুধু। কাল্পনিক কথোপকথনে সময় অতিবাহিত করেন।কাছে কেউ নেই, যে দিকে দুচোখ যায় সব ফাঁকা, শূণ্য , প্রাণহীন। শুধু অনন্ত নীল আকাশে পুঞ্জ, পুঞ্জ মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায় আপনমনে। জীবনে বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হয় সূর্যনারায়ণের ।অসীম আনন্দে এগিয়ে চলার গতি রুদ্ধ হয়ে গেছে হঠাৎ। শূণ্য কক্ষে , হঠাৎ চীৎকার করে ওঠেন, “মহামন্ত্রী, সেনাপতি। “বিশাল কক্ষে আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হতে হতে যেন হাহাকারের মতন শোনায় ।কান্নায় ভেঙে পড়েন রাজা।


হঠাৎ রৌদ্রজ্জ্বল আকাশ ঢেকে যায় কালো মেঘে, শীতল হাওয়ায় জুড়িয়ে যায় শরীর । মেঘের গর্জন শোনা যায় , বর্ষার ধারায় সজীব, সুন্দর হয়ে ওঠে প্রকৃতি। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন রাজা। দুচোখ ভরে দেখেন মেঘ মেদুর আকাশের বুকে বিদ্যুতের ঝলকানি।


সহসা যেন চিত্তশুদ্ধি হয় তার । আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হয় অন্তর। মনে হয় ঐশ্বর্য, বিত্ত , প্রাচুর্য সব তুচ্ছ । খ্যাতি নয়, ক্ষমতা নয়,বাঁচার জন্য শুধু প্রয়োজন ভালবাসা। ভালবাসার অভাবে বিভেদ সৃষ্টিকারী মানুষ আজ একা । এক অঘোষিত যুদ্ধ যেন সব বন্ধন ছিন্ন করে একলা করে দিয়েছে সবাইকে। ভয়ে , আতঙ্কে পঙ্গু হয়ে গেছে মানুষপুরের মানুষ ।


গবাক্ষের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন সূর্যনারায়ণ। রানী পদ্মগন্ধা পাশে এসে দাঁড়াতেই ম্লান হাসলেন তিনি। রানী স্হির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন রাজার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বললেন,” এই যুদ্ধে আমরা জয়ী হব, আমি নিশ্চিত। রাজা তাকিয়ে দেখলেন পদ্মগন্ধাকে । সন্ধ্যার রাঙা আলোর ছোঁয়া লেগেছে পদ্মগন্ধার মুখে।” মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রইলেন রাজা। দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞ ভাব ফুটে উঠল ।বাহুস্পর্শ করে বললেন, কিভাবে তা সম্ভব , বল তুমি? পদ্মগন্ধা হাসলেন, বললেন ,” পরম করুণাময় সব কেড়ে নিলেও বুদ্ধি আর বিশ্বাসটুকু কেড়ে নেননি।সেই বুদ্ধিবলেই উপায় খুঁজব আমরা সবাই। জীবন আবার সুস্হ হবে, সুন্দর হবে। “উজ্জ্বল হয়ে উঠল সূর্যনারায়ণের মুখ।


স্বর্গ থেকে নীরবে হাসলেন ঈশ্বর। তিনি সারা জীবন ভালবাসা দিয়ে আগলেছেন মানুষপুরের মানুষদের ।তিনিই এদের সৃষ্টিকর্তা । ভালবাসা, যত্ন আর মমতায় সৃষ্টি করা মানুষদের তিনি মেধা দিয়েছেন , বুদ্ধি দিয়েছেন। সেই মেধা আর বুদ্ধির জোরেই এদের জীবন বিপন্মুক্ত হবে, সংকটমুক্ত হবে।


তবু কর্তব্য বড় কঠিন জিনিস। স্নেহশীল পিতার মতন কর্তব্যে অবিচল থেকে তিনি এদের শিক্ষা দিয়েছেন। সব পাওয়ার নেশায় ওরা মনুষ্যত্ব হারিয়েছিল। সব হারিয়ে সেই মনুষ্যত্ব খুঁজে পাবে ওরা । ঈশ্বর সেই মুহুর্তের অপেক্ষায় দিন গুনছেন।




ree

Comments


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page