top of page

মুক্তগদ্য - চুপকথার চিঠিরা

  • অয়ন ঘোষ
  • Jun 12, 2021
  • 4 min read





আদি দিগন্ত মাঠ ঘাট যেন ফুঁসছে মধ্য চৈত্রের খরতাপে। চোখের উজানি স্রোতের বাইরে যেটুকু হিম ঝরে ছিল আহেরের কালে, তার সবটাই গিলে খেলো এই রাক্ষুসী দুপুর। এমনিতেই এই কাকডাকা দুপুরগুলো বুকের মাঝে এমন মোচড় দেয় যে হাড় পাঁজর পর্যন্ত ঝনঝন করে ওঠে। চাকরির কারনে ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির দল অনেককাল আগেই ছেড়ে গেছে দ্বিপ্রহরের বন্দর। কিন্তু অতিমারির প্রভাব এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। একটি গ্রাম্য কলেজে পড়ানোর কারনে তাই এখনো বাড়ি থেকেই চলছে চাকরি বাঁচানোর সাথে সাথে সিলেবাসের খবরাখবর, প্রযুক্তির সাহায্যে। ফলত হাতে অঢেল সময়। যে বয়সে পৌঁছেছি সেখানে সময় বেশি থাকলেই মনের ভিতর একটা চোরাটান ফিরে ফিরে আসে, ফেলে আসা চিলেকোঠার জন্য, দিদার হাতের আচার, গয়না বড়ির জন্য, স্কুলছুট বাউন্ডুলে দুপুরগুলোর জন্য, আলতা লাগানো বাখারির তরোয়াল হাতে তালপাতার সেপাইটার জন্য আর একটা টিনের তোরঙ্গের জন্য যার ভিতর মন রাখলেই নড়েচড়ে ওঠে একটা শ্রীচরণেষু পৃথিবী। কিছু আবছা ঘুম ঘুম অক্ষর নীল সমুদ্র রঙের মলিন ইনল্যান্ড লেটার অথবা শৌখিন লেফাফার ভিতর থেকে আসে উজাড় করে গল্পের ঝাঁপি। তাতে যেমন থাকে গৃহস্থের দাওয়ায় সদ্য নেমে আসা খোকা-খুকুর খবর তেমনই থাকে কালো গাইয়ের মা হবার বা পোয়াতি আউশের ক্ষেতের বিয়েন কাঠিতে দুধ জমার ঘ্রাণ। ভরন্ত সংসারের ফলবতী হবার আনন্দ সংবাদের সঙ্গে বিষাদ ঋতুর কান্না, যা ঝরেছিল শেষ আশ্বিনের অলৌকিক কুয়াশার সাথে কানা দামোদরের টলটলে জলের বিছানায়, তারও কথা থাকে মুক্তদানার মতো অক্ষরে। এদের সাথেই সাজানো আছে বেশ কিছু হলদেটে পোস্টকার্ড, বিভিন্ন দামের - কোনটা পঁচিশ পয়সা, কোনটা পনের পয়সা। এদের গল্পে কোনো গোপন অভিজ্ঞান নেই, নেই ইনল্যান্ড লেটার এর ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা আড়ালের কথা, যাতে মাখামাখি সাংসারিক প্রেম ও বিরহ। পোস্টকার্ডগুলো নিতান্তই সোজাসুজি, কিছু কেজো বার্তা নিয়ে হাজির। এদের কোনোটায় শুভ নববর্ষের প্রীতির সাথে শুভেচ্ছা ফ্রি আবার কোনোটায় বিজয়ার প্রণাম অথবা কোলাকুলি।


নতুন বইয়ের যেমন একটা মিঠে গন্ধ আছে, পুরনো চিঠির তেমনই একটা ভিজে ভিজে গন্ধ আছে। আমাদের পারিবারিক ওই তোরঙ্গে, যা আপাতত উত্তরাধিকার সূত্রে আমার হস্তগত, তাতে জমা হয়ে রয়েছে বিবিধ সম্পর্কের রঙিন ইতিহাস ও সমীকরণ। সুযোগের এই ভরদুপুরে আমি মাঝে মাঝেই ওতে ঝাঁক দিয়ে দেখি। সময় পেরিয়েছে নিজের নিয়মে, অনেক অনেক জল বয়ে গেছে হাতের মুঠো ছড়িয়ে, সাক্ষী বুড়ো দামোদর। কিন্তু চিঠিগুলো যখনই হাতে নিই, দেখি ওর মলিন অক্ষর মালায় সাজানো রয়েছে, আমাদের দুই ভাইয়ের জন্মের ক্ষণ, আমাদের শৈশব ও আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের নানা রঙের রোজনামচা। তখন মনে হয়, "রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে"। ওরই মধ্যে একটা চিঠি আছে যা আমার দাদু ( পিতামহ) লিখেছিলেন আমার মাকে, মানে তার সেজো বৌমাকে। ক্লাস নাইন থেকে টেনে ওঠার পরই আমাদের মায়ের বিয়ে হয়ে যায়। প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমার দাদু চেয়েছিলেন আমার মা যেনো মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন। মাকে বাপের বাড়িতে তিনি পাঠিয়ে দিতেন স্কুল করার জন্য। তারপর চিঠি লিখে খোঁজ নিতেন লেখাপড়ার। সংসারে সদ্য বউ হয়ে আসা, একটি গ্রাম্য মেয়েকে তিনি লিখছেন লেখাপড়া শেখা কেন জরুরি। উৎসাহ দিচ্ছেন তার ভালোলাগার জিনিস, নাটক আবৃত্তিকে বাঁচিয়ে রাখার। আজকের দিনেও বোধহয় এ জিনিস খুব একটা সহজলভ্য নয়! ছোটো থেকেই আমি মামার বাড়ির আদরে বাঁদর। বেশ মনে পড়ে, আমি তখন ক্লাস থ্রি। মামারবাড়ি থেকে পোস্টকার্ডে স্কেল দিয়ে লাইন টেনে ( যাতে লাইন বেঁকে না যায়) আমার বড় মামিমার ত্বত্তাবধানে আমি মাকে চিঠি লিখতাম - তুমি কেমন আছো? আমি ভালো আছি। - এটুকু লিখতেই শ্রাবণ নামতো চোখের পাতায়। আমি নিশ্চিত জানি শ্রাবণের সেই মেঘে শুধু আমার মামারবাড়ীর মাটি না, ভিজে যেতো আমার মায়ের একলা দুপুরগুলো।


আটাত্তরের বানের সময় এক শ্রাবণ বিকেলে জন্ম হয়েছিল আমার। বন্যার কারনে আমার বাবা ও বাড়ির লোকজন প্রায় পনেরো দিনের আগে আমায় দেখতে যেতে পারেনি। একটি খাম আজও ধরে রেখেছে আমার জন্মক্ষণ ও তার পরিপার্শ্ব। আমার মাতামহ তার বেয়াইকে লিখছেন নাতির জন্ম বৃত্তান্ত ও কুশল সংবাদ। তারমধ্যে কোথাও একটা সূক্ষ শ্লেষ ও বেদনা রয়েছে, পরের ঘরের আমানতকে যত্নে রাখার দায় নিয়ে। এইসব চুপকথারা ঘুমিয়ে আছে ওই টিনের তোরঙ্গে। সময় পেলেই আমি নিজেরই সামনে খুলে ধরি ওই প্যান্ডোরার বাক্স। বাইরের হাওয়া পেয়ে প্রথমে একটা দুটো করে অক্ষর তারপর গোটা গোটা বাক্যগুলো বেরিয়ে আসে, আদরের ডাকে। ওরা আমার আর্শি নগরের পড়শি, আমার জিরানিয়া গান। তারপর সময় গিয়েছে বেঁকে, সোজা পথের থেকে। এসেছে কিশোর বেলা, গোঁসাই বাগান বলছে "আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন..."। ছোটবেলায় 'পাতা লুকোনো' খেলার সঙ্গী ও সঙ্গিনীরা একলপ্তে যেন বেড়ে উঠেছে খানিকটা, ভাঙছে গলার স্বর। শুরু হয়েছে মনেরও ভাঙাগড়া। বইয়ের ভাঁজে পাথরকুচি পাতার সাথে ঠাঁই হয়েছে একটা দুটো মুখচোরা রোগাসোগা প্রেম পত্রের যাতে কথার অভাব ঢেকেছে দু'একটি লাজুক পংক্তি - "ধুপ পুড়ে যায়, গন্ধ উড়ে যায়/ আকুল করে প্রাণ/ তোমার আমার ভালোবাসা হবে নাকো ম্লান"। আজকের অনলাইন পৃথিবীকে কি করে বোঝাই এর স্বাদ ও গন্ধ। ওই শালুক শাপলার গন্ধ যদি বুক ভরে না নিতাম, তাহলে আজ প্রায় ২৭ বছর পরে সেই ভালোবাসা না হয়ে ওঠা প্রেম কোন অমৃতে বেঁচে রইল? আশেপাশে সেই সময় থাকা বন্ধুদের প্রায় সবার একই দশা চলছে তখন। মিত্তিরদের আমবাগানে গোধূলির আবছায়াতে, গোপন অভিসারে পাঠ হতো সেইসব একক প্রেমপত্রের যৌথ লিপি। সেদিনের হারিয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া কথারা ঘরে আসেনি হয়তো কিন্তু মনে তাদের নিত্য যাওয়া আসা। যেমন করে মনে যাওয়া আসার ভাষ্য ব্যাখ্যা করে শোনালেন ঝুম্পা লাহিড়ী তাঁর Interpreter of Maladies শিরোনামে গল্পটিতে। Mrs Das চেয়ে নিয়েছিলেন Mr Kapasi এর ঠিকানা তাদের যৌথ ছবি পাঠাবেন বলে। সেই ঠিকানার সূত্র ধরে Mr Kapasi এর জমিয়ে রাখা ভাবনারা উড়ান পেতে শুরু করল, এক চিনচিনে ভালোলাগা ঘিরে ধরলো তার সর্বস্বকে। তারপর গল্পের এক আশ্চর্য বাঁকে ঠিকানা লেখা সেই কাগজের টুকরোটি ভেসে গেলে অনন্তের পথে, যেখানে আজ পর্যন্ত কোনো চিঠিই পৌঁছায়নি। আসলে এমনি করেই সব চিঠি আসে না সব ঠিকানায়। নিঃসময়ের বুকে সেগুলো ঘুরতে থাকে গোল গোল, একটা দুটো সংখ্যা বা শব্দের ইচ্ছেমতো রঙ বদলের কারনে।


বদলেছে সময়, বদলেছে দিন। আজকাল গলা ছেড়ে ডাক দিলে ভেসে আসে বোকা বোকা ইমোজী। কথার পিঠে এসে বসে না বার্তা। তবু পুরনো চিঠির গা থেকে এখনও ভেসে আসে চেনা এসেন্সের নিভু নিভু গন্ধ। চৈত্রের এই সর্বনাশী দুপুর গুলোতে একলা হলেই নাকে এসে ঝাপটা মারে পুরনো চিঠির শরীরে লেগে থাকা লোম্যানি সেন্টের ওই দস্যু গন্ধটা। বলে জাগো এবার, দেখো শ্যাম নামে বসন্ত এসেছে দুয়ারে। ওই দেখো আষাঢ়ের প্রথম দিনে চেনা ঠিকানায় চিঠিটা পৌঁছে দেবে বলে কেমন প্রস্তুত হয়েছে কালবোশেখির দামাল মেঘের দল। আজ আর অনলাইন হয়ে কাজ নেই। মন বলছে চিরকালের পিয়ন কাকুটা ঠিক আসবে এই বিহান বেলায়, হারানো চিঠির খবর নিয়ে।

Comentários


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page