top of page

প্রবন্ধ - পথ

  • তন্ময় মালিক
  • Dec 15, 2020
  • 5 min read



পথ , পথ আমরা সবাই চলি। মাতৃগর্ভ হতে ভূমিষ্ট হাওয়া, সময়ের সাথে আস্তে আস্তে পাস ফিরতে শেখা, হামাগুড়ি  দেওয়া , অন্যকে অবলম্বন করে  দুপায়ে ভড় দিয়ে  একটু একটু করে দাঁড়াতে শেখা, এবং  তাদেরই হাত ধরে শুরু হয় যে পথ চলা, আজীবন চলতে থাকে সেই প্রবাহ। এই চলার পথও ব্যক্তিবিশেষে  ভিন্ন, আর তা মূলত ভৌগোলিক বা  প্রাকৃতিক কারণে।   যে প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষ জন্মগ্রহণ করে সাধারণত  সেখানকার পথ দিয়েই শুরু হয় তার পথচলা।  প্রকৃতি ও পরিবেশ ভেদে,-  সেই পথ কোথাও সমতল, কোথাও ভঙ্গুর , কোথাও খানা খন্দে ভরা, কোথাও চড়াই - উৎরাই, কোথাও  মরুভূমি, কোথাও হিমশীতল  জমাট বরফ, কোথাও গ্রামের সরু আঁকা বাঁকা পথ শেষে মাঠের সরু আলপথ , আবার  কোথাও ঝাঁ চকচকে ফোর বা সিক্স লেন, কোথাও সেই পথই লাল কার্পেট  বিছানো, কোথাও আবার এই পথই চরম দুর্গম যেখানে প্রতি পদে  মনেহয়  বিপদ ওৎ পেতে অপেক্ষা করছে, কোথাও আবার কোন পথই নেই, সেখানে নিজেকেই নিজের চলার পথ তৈরি করে নিতে হয়, শুধুমাত্র না থেমে এগিয়ে চলার জন্য। এইভাবে পরিবেশ ও অবস্থা ভেদে  পথ পরিক্রমা করা চলে জীবনভোর।


শুধুমাত্র ভৌগোলিক বা প্রাকৃতিক  কারনেই নয়, আমাদের প্রতিদিনের চলার পথও পাল্টে যায় সময় ভেদে। সাড়াবছর ধরে চলে ছয় ঋতুর আনাগোনা, আর তারই সাথে  সামঞ্জস্য বজায় রেখে বদলে যায়, আমাদের চেনা এই পথটাই, তারই  সাথে বদলায় পথ চলার অনুভূতিও। গ্রীষ্মের প্রখর রোদে যেমন প্রতি পদক্ষেপে অনুভূত হয় পথচলার ক্লান্তি,  বর্ষায় জমা জল আর কাদার মধ্যে দিয়ে পথ চলার প্রতিটি পদক্ষেপে থাকে বিড়ম্বনা, শরতের  নীল আকাশ আর কাশফুলের সমারোহ সাথে শিউলির মনমাতানো সুগন্ধে  আকাশে বাতাসে থাকে পূজো পূজো আমেজ, সেই আমেজ পথ চলাতেও আনে আলাদা উন্মাদনা, হেমন্তের হালকা হিমেল হাওয়ায় বড়ই  মানোরম এই পথ চলা, শীতে  সারাদিন পথচলাতেও  থাকে না একফোঁটা ক্লান্তি আর বসন্তের আগমনে রাস্তার দুধারের নানান ফুলের সমারোহ, তাদের অপরূপ সৌন্দর্য ও মিষ্টি সুবাস, সাথে  কুহু সুরে কোকিলের কাকলি, পথ চলায় আনে বাড়তি উদ্দীপনা।


 এতো গেল আমাদের চলার পথের কথা, আমাদের জীবন পথের দিকে তাকালেও দেখা যাবে, সেটাও একই রকম বৈচিত্রময়। প্রতিটা মানুষের বিভিন্ন সময়ের জীবন পথ যেমন ভিন্ন, তেমনই তা ভিন্ন একের সাথে অন্যের। চলার পথের যেমন এক রাস্তার সাথে অন্য রাস্তার কোন মিল নেই,- কোন ক্ষেত্রে কিছু মিল থাকলেও, পথের প্রতিটা বাঁক,  তার দুই ধারের চিত্রপটের কোন মিল থাকে না, প্রতিটা জীবনের ক্ষেত্রেও তাই, সেখানেও কোনও কোনও ক্ষেত্রে কিছুটা মিল থাকলেও, হুবহু মিলের সম্ভাবনা খুবই কম।  চলার পথের মতোই, জীবন পথও সবাইকেই অতিক্রম করতে হয়।  দুই পথেই যেমন থাকে ছন্দের লালিত্য, ছন্দের মাদকতা, তেমনই থাকে ছন্দপতনে পথভ্রান্ত উদভ্রান্তের হতাশা।


কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, জীবনের প্রথম অধ্যায় সকলেরই প্রায় একই রকম। অর্থনৈতিক অবস্থা যেমনই হোক না কেন, মা বাবার স্নেহের মধ্যে দিয়ে শৈশব,  কোন কোন ক্ষেত্রে কৈশোরও পার করে ক্রমান্বয়ে জীবনের কুরুক্ষেত্রে এসে উপনীত হয়, আর সেখান থেকেই শুরু হয় প্রতিটা মানুষের জীবনের বৈচিত্র্য ... শুরু হয় জীবনের পথ চলা... যে পথ একেকজনের একেকরকম, আর সেই  পথেই  পাড়ি দিতে হয় জীবনপথ। চলার পথের মতোই জীবন পথেও দেখা যায়, কারও পথে থাকে ফুলের কুসুম বিছানো, কারও পথ আর পাঁচটা পথের মতোই সাধারণ।  কারও জীবনে  দেখা যায় সেই সাধারণ পথও হটাৎ করেই  কোথাও জাতীয় সড়কের মতো প্রগতির উচ্ছল স্রোতধারায় মিশে  যায়, কারও আবার মাঝে মাঝে চলার গতি সাময়িক রুদ্ধ করার অভিপ্রায়ে  হঠাৎ করেই উদয় হয় স্পীডব্রেকার , কারও আবার চলার পথের মতোই জীবন পথও  হটাৎ করেই খানা খন্দে ভরে গিয়ে, পথ চলাটাই  হয়ে যায় বিলম্বিত এবং বিভীষিকাময়। চলার পথ যেমন কোথাও চরম সঙ্কটময়, বিপদসঙ্কুল,  আবার কোথাও হটাৎ করেই  প্রাকৃতিক কারণে অবরুদ্ধ হয়ে যায়,  জীবন পথও তাই। তবুও চলার পথের মতোই জীবন পথেও মানুষ এগিয়ে চলে মনের কোনে ক্ষণিক আশা নিয়েই, কারও কারও সেই আশা পূর্ণ হয়, নতুন করে জীবনের পথ খুঁজে পায়, কেউবা অন্ধগলিতেই আজীবন শুধু পথই খুঁজে যায়, আর তখনই প্রয়োজন হয়  আলোর, যে আলো অন্ধকারে হয়তোবা  নতুন কোন দিশা দেয়,   যা দিয়ে সেই অন্ধগলি থেকে  বেরোনোর কোন পথের নিশানা পাওয়া যায়। কেউ আবার দেখা যায় চলার পথের মতোই জীবন পথেও  কাম্য বস্তুর উদাত্ত আহ্বানে বিহ্বলিত হতে হতে , হটাৎ করেই জীবনের চোরাগলিতে এসে পরে,- আর নিজেই নিজের পথ হারিয়ে ফেলে। আবার এমনও হয়, চলার পথের মতোই দুর্গম কণ্টকাকীর্ণ পথ পার করে,নিজেই নিজের পথ তৈরী করে ধীরে ধীরে সেই পথকেই কুসুমাবৃত করে অদম্য জেদ, মেধা আর সাহসকে অবলম্বন করে। 


চলার পথে যেমন কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য একাধিক পথ থাকে, তার মধ্যে থেকে নিজের পছন্দমতো একটা পথ বেছে নিতে হয়,- জীবন পথেও ঠিক তেমনই,  আর সেখানেও একটা পথ নিজের মতো করে বেছে নিয়ে, এগিয়ে যেতে হয় জীবনের লক্ষ্যে বা গন্তব্যে। চলার পথে অবিরাম চলতে চলতে যেমন মাঝে মাঝে একঘেয়েমি লাগে, ক্লান্তি আসে, জীবন পথেও তেমনই, সেখানেও মাঝে মাঝে  আসে ক্লান্তি , আসে একঘেয়েমী, আর এসব মেনে নিয়ে এগিয়ে চলার নামই জীবন।


এতো গেল, আমাদের চলার পথ আর জীবন পথের কথা। এবার যদি আমরা ফিরে তাকাই ধর্মের পথের দিকে, সেখানেও দেখি, ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কথায় "যত মত তত পথ"। সত্যিই তো তাই, সারা বিশ্বজুড়ে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, ইহুদী, .... আরও যে কত ধর্ম আছে, আমার নিজেরই  তা জানা নেই। সব ধর্ম সম্বন্ধে সেভাবে জানা না থাকলেও  হিন্দু ধর্মে দেখতে পাই, সেখানে অসংখ্য দেবদেবী, আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও দেখা যায় সেখানেও নানান বিভাজন, কেউ বৈষ্ণব, কেউ শাক্ত, আরও কত কি! এদের সবারই লক্ষ্য কিন্তু এক, আর এটা শুধু মাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নয়, সব ধর্মমতের মূল লক্ষ্যই  কিন্তু এক, আর তা  হল আত্মোপলব্ধি। 


শুধুমাত্র গৃহী মানুষের নয়, যারা সন্ন্যাস জীবনযাপন করেন, তাদেরও আছে ভিন্ন পথ, যার একটা পথ হল, অজাগরি অর্থাৎ অজগর সাপের মতো একজায়গায় স্থির হয়ে বসে সাধনা করে যাওয়া, সেখানে যদি কেউ কিছু দিয়ে যায়, তা দিয়েই খুন্নিবৃত্তি করা, আর  আগামী  দিনের জন্য কিছুই জমা না রাখা, অর্থাৎ পেলে খাওয়া  আর  না পেলে না।  আর একটা পথ হল, মাধুকরি অর্থাৎ মধুকর বা মৌমাছির মতো দ্বারে দ্বারে ঘুরে ভিক্ষা করে ,- শুধুমাত্র  সেদিনের আহারের মতো সংগ্রহ হলেই ফিরে আসা, পরের দিনের জন্য আবার পরের দিন সংগ্রহে বের হওয়া, অতিরিক্ত গ্রহণ না করা।  এদের পথ ভিন্ন হলেও লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সেই একই, আর তা হল "আত্মোপলব্ধি"। 


যে কথাটা আজ থেকে বহু বছর আগে, খ্রিস্টপূর্ব  অষ্টম বা সপ্তম শতাব্দীতে গার্গী আর মৈত্রেয়ী , জাগ্যবল্ক  মুনিকে বলেছিলেন, "আমি সেই ঐশ্বর্য চাই না, যে ঐশ্বর্য অস্থায়ী,- আমি  সেই ঐশ্বর্য চাই, যা চিরস্থায়ী"। উপনিষদে ঠিক এই  কথাটাই চারটি বাক্য দ্বারা বলা হয়েছে, কখনও "অহং  ব্রহ্মাস্মি", কখনও "প্রজ্ঞানম ব্রহ্ম", কখনও "অয়ম আত্ম ব্রহ্ম" আর শুধুমাত্র  "তৎ  ত্বম অসি" কথাটাই  বার বার বলা হয়েছে, এই কথাটা ঋষি উদ্দালক তাঁর পুত্র শ্বেতকেতুকে বলেছিলেন। উপনিষদের এই চারটে বাক্যই হল "মহাবাক্য" আর  এই চারটি বাক্যেরই নির্যাস কিন্তু একই, আর সেটাই হল নিজেকে বা নিজের স্বরূপ উপলব্ধি, যাকে বেশ করেই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, "Each soul is potentially divine." এই একই কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর " স্পর্শমনি"   কবিতায়  বলেছেন, 

"যে ধনে হইয়া ধনী

মনিরে মানো না মনি

তাহারি খানিক মাগি আমি নতশিরে"।


ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এই কথাটাকেই বেশ সহজ করে একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন:

শ্রীরামচন্দ্র তাঁর ভক্ত হনুমানকে জিজ্ঞাসা করছেন, তুমি কে আর আমিই বা কে?

হনুমান তখন তিনবার তিনটে তিনরকম উত্তর দেন।

প্রথম উত্তর: তুমি প্রভু আর আমি তোমার ভক্ত।

দ্বিতীয় উত্তর: তুমি পূর্ণ আর আমি অংশ।

তৃতীয় উত্তর: তুমিও যে, আমিও সে।

আর এটাই হলো, সব ধর্মের মূল কথা বা মূল ভিত্তি । এই রূপকের মধ্যে দিয়ে এখানে ধর্মের তিনটে পথ,  অর্থাৎ দ্বৈত বাদ, বিশিষ্ট অদ্বৈত বাদ এবং অদ্বৈত বাদ সহজ করে বুঝিয়েছেন ।  তিনটি পথ আলাদা হলেও লক্ষ্য কিন্তু সেই একই অর্থাৎ এটাই উপলব্ধি করা যে "each soul is potentially divine"। শুধুমাত্র আত্মদর্শন বা আত্মোপল্ধির মাধ্যমেই যে সত্য উপলব্ধি সম্ভব। এই উপলব্ধি থেকেই এসেছে "শিবজ্ঞানে জীবসেবা"। 


আমাদের চলার পথ, জীবন পথ, ধর্মের পথ, গৃহীর পথ, সন্ন্যাসীর পথ, যে পথেই যাওয়া হোক না কেন, জীবনের মূল কথা কিন্তু এই আত্মদর্শন বা  আত্মোপলব্ধি, আর এটাই হল জীবনের আসল উদ্দেশ্য। এই উপলব্ধি হলেই আসবে একে অপরের প্রতি টান, থাকবে না কোন ভেদাভেদ, আপন পর বলে কোনও বাছবিচার থাকবে না, বিশ্বজগৎ  হয়ে উঠবে সত্যম শিবম সুন্দরম। বিশ্বকবির দুটো গানের লাইন ধার নিয়ে বলি :

"আমার এই   পথ-চাওয়াতেই   আনন্দ।

খেলে যায়   রৌদ্র ছায়া,   বর্ষা আসে   বসন্ত ॥




Comments


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page