top of page

নাটক - সন্ধ্যা নামার পর

  • পার্থ সেন
  • Dec 27, 2020
  • 27 min read


শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের রচনা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে

(আগাথা ক্রিস্টির ‘মাউসট্র্যাপ’ অবলম্বনে)

পথিকৃৎ নাট্যদলের সকলের জন্য

চরিত্রায়াণে

সুলতা

অনিমেষ

জয়তী ধর

বাতিক বাবু

রুদ্রশেখর

বিপ্লব

অমরনাথ

সন্দীপ সান্যাল


নাটকের লেখনীতে আলো এবং শব্দ প্রয়োগের কোন উল্লেখ নেই। যদি কখনো কোনদিন এই নাটক মঞ্চস্থ হয় নাট্যপ্রেমীরা নিজেরাই সে ব্যবস্থা তাঁদের সুবিধা মতো করে নিতে পারবেন।





প্রথম দৃশ্য

(হোটেলের রিসেপশন, একটা বড় ডেস্ক, পাশে তিন-চার খানা চেয়ার পাতা। সুলতা সেখানে বসে খাতায় কাজ করছে, অনিমেষের প্রবেশ)



অনিমেষ – আমার মনে হচ্ছে না, শনিবারের আগে এই বৃষ্টি ধরবে বলে

সুলতা – আবহাওয়া দপ্তর কি বলছে?

অনিমেষ – বলছে নাকি মুম্বাই আর সংলগ্ন এলাকায় গভীর নিম্নচাপ, এখনো দুইদিন এই রকম ভারী বর্ষণ নাকি চলবে।

সুলতা – কালকের মধ্যে বৃষ্টি না কমলে আমাদের একতলার প্যাসেজে কিন্তু জল ঢুকে যাবে

অনিমেষ – তা তো বটেই। আমি বলি কি, রান্না ঘর আর খাবারের ঘরের ব্যবস্থাটা কিছু দিন ওপরে করলে কেমন হয়?

সুলতা – এতে জিজ্ঞাসা করার কি আছে? কালকে সকালে বাহাদুরের সঙ্গে কথা বলে নেব।

অনিমেষ – আর তুমি বরং আজ থেকে ওপরের ঘরটাতে থাকো, এমনিতে চার আর পাঁচ নম্বর ঘর তো খালি থাকবেই। ও হ্যাঁ, আর একটা কথা

সুলতা – আবার কি হল?

অনিমেষ – আচ্ছা ঐ জয়তী ধর তো জ্বালিয়ে খাচ্ছে! আর কি মেজাজ! সেই রকম কথাবার্তা! ওনাকে বরং দোতলার কোনার ঘরটা দিয়ে দাও!

সুলতা – না যাঃ! বুড়ি মানুষ! বার বার সিঁড়ি ভেঙে ওপর নিচ করতে কষ্ট হবে না! তোমার যতো বাজে কথা!

অনিমেষ – আচ্ছা, তোমার কাছে টাকা পয়সা কেমন আছে? এখন যে কোন সময়ে কিন্তু এটিএম বন্ধ হয়ে যেতে পারে

সুলতা – আছে কিছু, কত লাগবে?

অনিমেষ – না এখুনি কিছু লাগবে না! ঘরে কিছু ক্যাশ আছে, সেই দিয়ে এই তিন চারদিনের বাজারটা হয়ে যাবে। আর আমি দেখি এটিএম থেকে কতটা টাকার ব্যবস্থা করা যায়। এই বৃষ্টি তার ওপর আমাদের এই এলাকা, এটিএমে টাকা শেষ করে যেতে কতক্ষন? তার ওপর সেই বিপ্লববাবু, তিনি আসছেন আজ! পানভেল যেতে হবে!

সুলতা – পানভেল? কেন?

অনিমেষ – ম্যাডাম, কোহিনুর নিবাস পিক আপ সার্ভিস! স্টেশন থেকে নিয়ে আসতে হবে।

সুলতা – এই বৃষ্টিতে তুমি আবার অতো দূর যাবে?

অনিমেষ – কি করব বলো! হোটেল যখন খুলেছি অতিথি সেবা তো করতেই হবে।

সুলতা – কেন ড্রাইভার কি দোষ করল? তাকে পাঠিয়ে দাও।

অনিমেষ – ড্রাইভার! তিনি ফোন করেছিলেন একটু আগে! জ্বরে কাবু হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন, নড়ার ক্ষমতাটুকুও নেই। খালি কোনমতে ফোনটা করেই আবার ঘুমিয়ে পড়বেন।


(কোন অনুমতি ছাড়াই জয়তী ধরের প্রবেশ)


অনিমেষ – এই তো ম্যাডাম! কি ব্যাপার? আবার কিছু সমস্যা নাকি?

জয়তী ধর – হ্যাঁ, আমাকে দেখলে তো সমস্যার কথাই মনে হবে! পয়সা তো কিছু কম নেবেন না! তা এদিকে গেস্টদের কি সে সুবিধা অসুবিধা সেসব দেখবেন না!

অনিমেষ – না না আই অ্যাম সরি! বলুন!

জয়তী ধর – আগে থেকে জানলে আগাম টাকা পাঠিয়ে এখানে আসতাম না! শুনেছিলাম নাকি লেকের ধারে বাড়ি, লেক ছাড়ুন সারা রাস্তাই তো সমুদ্র হয়ে আছে!

অনিমেষ – দেখুন ব্যাপার টা হচ্ছে কি বন্যাটা আসলে এমন হঠাৎ করে বেড়ে যাবে এটা তো ঠিক আগে থেকে বুঝিনি!

জয়তী ধর – যাক ! বুঝেছি! দেখুন খাওয়া দাওয়া যা দিচ্ছেন সে তো আর বলার নয়! জলার মধ্যে জেল যেন! চা দিতে আপনাদের অসুবিধা কি আছে?

সুলতা – কেন আপনাকে চা দেয়নি!

জয়তী ধর – প্রত্যেক দিনে চার বার করে চায়ের কথা বলা হয়েছিল! সেও ভুলে গেছেন দেখছি! ভোর পাঁচটা, তারপর সকাল আটটা, তারপর বিকেল তিনটে আবার সন্ধ্যে সাতটায়। বিকেল চারটে হয়ে গেল চা কখন আসবে?

সুলতা – প্রথম দিন তো! তাই বোধহয় ভুল হয়ে গেছে!

অনিমেষ – এক্ষুনি গিয়ে খাতায় লিখে নিচ্ছি!

জয়তী ধর – তাহলে মনে থাকবে! সকাল পাঁচটা, আটটা, তারপর বিকেল তিনটে, সন্ধ্যে সাতটা! কি বললাম?

সুলতা – আজ্ঞে! সকাল পাঁচটা, আটটা, তারপর বিকেল তিনটে, সন্ধ্যে সাতটা!

জয়তী ধর – আর ঘরে এতো মশা কেন? এই বড় বড় মশা! ম্যালেরিয়া হলে দেখবে কে?

অনিমেষ – কিন্তু ম্যাডাম! আমরা তো এতদিন ধরে আছি, কই তেমন তো মশার উপদ্রব দেখিনি!

জয়তী ধর – আমি কি তাহলে মিথ্যে কথা বলছি?

সুলতা – না না ছি ছি! সেকি ? মিথ্যে বলবেন কেন? তুমি যে কি বলো না!

জয়তী ধর – বিশ্বাস না হয়, ঘরে গিয়ে দেখে আসুন! একেবারে ছেঁকে ধরছে!

সুলতা – ম্যাডাম আমি গিয়েই আপনার ঘরে গুডনাইট পাঠিয়ে দিচ্ছি!

জয়তী ধর – এসব কেন চাইতে হয়? হোটেল চালাচ্ছেন! বেসিক অ্যামিনিটিস বোঝেন না!

সুলতা – তুমি গিয়ে একটু বাহাদুর কে বলো না! গুডনাইট দিয়ে আসবে!


(অনিমেষের প্রস্থান)


জয়তী ধর – দেখো বাপু, তোমাকে আমি আপনি, আজ্ঞে এসব করতে পারবো না।

সুলতা – বেশ তুমিই বলবেন!

জয়তী ধর – তা তোমার পরিচয়টা আমার জানা দরকার। কি নাম যেন বললে তোমার?

সুলতা – সুলতা!

জয়তী ধর – ও! আর এক্ষুনি যিনি চলে গেলেন তিনি তোমার কে হন?

সুলতা – কেউ নন! আমার বন্ধু, আর এই হোটেলের অংশীদার!

জয়তী ধর – বন্ধু? ও! তা কতদিন ধরে জানাশোনা?

সুলতা – তা বেশীদিন নয়!

জয়তী ধর – তা দুদিনের বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে হোটেল চালাতে তোমার ভয় করে না!

সুলতা – কি করব বলুন! বাড়িতে অসুস্থ বাবা! টাকা পয়সাতো কেউ বসিয়ে বসিয়ে দেবে না!


(অনিমেষের প্রবেশ, হাতে মশা মারার ধুপ)


অনিমেষ – চলুন ম্যাডাম, আপনার ঘরে এটা লাগিয়ে দেবো!

জয়তী ধর – এই টা!

অনিমেষ – হ্যাঁ ম্যাডাম, এটা খুব এফেক্টিভ!

জয়তী ধর – ধূপের ধোঁয়ায় আমার খুব অস্বস্তি হয়! এইসব চলবে না!

অনিমেষ – আসলে ম্যাডাম, লিকুইডটা ফুরিয়ে গেছে! আর এতো বৃষ্টি, পাশের দোকানটাও বন্ধ! আমি বাজার থেকে এক্ষুণি নিয়ে আসছি! ততক্ষণ যদি কাইন্ডলি এইটা দিয়ে চালান!

জয়তী ধর – আপনারা এখনো এইসব ইউস করেন? জানেন না, এতে পলিউশন হয়!

অনিমেষ – কিন্তু ম্যাডাম, পলিউশন তো লিকুইডেও হয়! খালি এই পলিউশনটা আপনি চোখে দেখতে পান আর ঐটা পাননা!

জয়তী ধর – আবার জ্ঞান দেওয়া হচ্ছে! হলেও, ওতে অনেক কম হয়!

সুলতা – ম্যাডাম এটা দিয়ে একটু চালিয়ে নিন, উনি গিয়ে নিয়ে আসছেন! প্লীজ!

জয়তী ধর – ঠিক আছে, তাহলে লাগান, চলুন হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন কি? আর হ্যাঁ, আমি স্কুল ইনস্পেক্টর মিস জয়তী ধর! আমাকে ম্যাডাম ম্যাডাম করে ডাকবেন না! মিস ধর বলবেন! বুঝলেন!

অনিমেষ – হ্যাঁ, বুঝেছি!


(জয়তী ধরের প্রস্থান, পিছুপিছু অনিমেষের প্রস্থান)


সুলতা – বাবা! কি দজ্জাল মহিলা! এই রকম জানলে আগে থেকে ইন্টারভিউ করে বোর্ডার আনতে হয়! সত্যি আর বৃষ্টির ও বলিহারি! এতো বৃষ্টি হবে জানলে এই কদিন হোটেল বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করতাম!


(সুলতা গুনগুন করে গান গাওয়া শুরু করবে, অনিমেষের প্রবেশ)

অনিমেষ – উফ! কি মহিলা! বাপের জন্মে এমন দেখিনি!

সুলতা – কেন আবার কি বলছিল?

অনিমেষ – আরে একদম কমপ্লেন বক্স! টিভি ছোট কেন? খাট ডাবল বেড নয় কেন? এসেছেন একা! সেখানে ডাবল বেড কি হবে? আচ্ছা শোন, লিস্ট টা করে ফেলি। দাও দেখি একটা কাগজ দাও! পেন টা আবার কোথায় গেল?

(সুলতা কাগজ, পেন এগিয়ে দিল)

সুলতা – লেখ! চাল, ডাল, আলু, তিন রকমের সব্জী, চিনি

অনিমেষ – দাঁড়াও দাঁড়াও, কতটা করে নেব, সেটা বল!


(বাতিক বাবুর আগমন)

বাতিক বাবু – আসতে পারি?

অনিমেষ – হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন! বসুন, বলুন!

বাতিক বাবু – খুব সমস্যায় পড়লাম জানেন!

অনিমেষ – কেন আবার কি হল?

বাতিকবাবু – রানিং হট অ্যান্ড কোল্ড আছে বলেছিলেন, সেটা তো আসছে না! এবারে চান করতে গিয়ে দেখি গরম জল আসছে না! এই বেলায় ঠাণ্ডা জলে চান করে শরীর টা বড্ড খারাপ লাগছে!

অনিমেষ – খারাপ লাগছে মানে? কি হচ্ছে? বুকে ব্যাথা?

বাতিকবাবু – গলাটা কেমন ধরা ধরা লাগছে! ঠাণ্ডা লেগে গেল না তো!

অনিমেষ – আপনি কিছু ওষুধ নেবেন?

বাতিকবাবু – ওষুধ? কি ওষুধ?

অনিমেষ – প্যারাসিটামল আছে। নেবেন?

বাতিকবাবু – আমার না আবার প্যারাসিটামলে কেমন অ্যালার্জি আছে, মানে প্যারাসিটামল খেলেই কেমন বদহজম হয়ে যায়! বুঝলেন না!

অনিমেষ – তাহলে সঙ্গে একটা অ্যান্টাসিড নিয়ে নেবেন! আনবো?

বাতিকবাবু – কিন্তু অ্যান্টাসিড দিলেই আবার খাবার ইচ্ছেটা একদম মরে যায়! কি যে করি?

সুলতা – তাহলে তো মহা মুশকিল?

বাতিকবাবু – অ্যাঁ? মহা মুশকিল বললেন কেন?

সুলতা – না মানে, কোন মেডিসিন যদি না চলে তাহলে শরীরটা সারবে কেমন করে?

বাতিকবাবু – আচ্ছা ইয়ে, মানে আপনারা কোন তেলে রান্না করেন?

সুলতা – তেল?

বাতিকবাবু – না মানে, সর্ষে তেল থাকলে একটু রসুন দিয়ে ফুটিয়ে গলায় মাখলে গলা ধরাটা একটু কমে, এই আর কি?

অনিমেষ – তা সেই তেল কি এখন মাখবেন?

বাতিকবাবু – হ্যাঁ মানে, সূর্যাস্তের আগে মাখলে জিনিসটা বেশী কাজ দেয়! নাহলে আবার কাল যদি শরীর টা বেশী ডাউন হয়ে যায়!

অনিমেষ – ঠিক আছে, দেখছি!

সুলতা – আমি বলি কি, একটু আদা দিয়ে চা খান, তাহলে দেখবেন শরীর বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

বাতিকবাবু – চা?

সুলতা – কেন আপনি চা খান না?

বাতিকবাবু – না, চা টা আমার আবার চলে না! গরম জলে লেবু আর তার তাতে আড়াই চামচ চিনি আর ওয়ান হাফ চামচ নুন, সে রকম পাওয়া যাবে?


(সুলতা আর অনিমেষ অবাক হয়ে তাকাবে!)


সুলতা – বেশ তার ব্যবস্থা হবে!

বাতিকবাবু – দেখবেন চিনির আর নুনের পরিমান টা যেন কমবেশী না হয়ে যায়! আসলে নুন বেশী হয়ে গেলেই প্রেসারটা এফেক্ট করবে আর চিনি মানে শর্করা তো! নানা বিপদ।

সুলতা – ঠিক আছে, যে রকম বললেন হবে! কোন চিন্তা নেই।

বাতিকবাবু - আর জলটা যেন ফুটন্ত না হয়! মানে সিপ করে যেন খাওয়া যায়!

অনিমেষ – আপনি একবার কিচেনে যাবেন! সেখানে যে রকম নির্দেশ দেবেন ওরা সেই রকম করে বানাবে!

বাতিকবাবু – কিচেন?

অনিমেষ – হ্যাঁ, ওখানেই তো জিনিসটা বানানো হবে।

বাতিকবাবু – কিচেনে ঢুকলে আবার আমার কেমন যেন স্প্যাসম হতে থাকে। শ্বাসকষ্ট! বুঝলেন না!

সুলতা – ঠিক আছে, যেতে হবে না। আপনি ঘরে যান, আমরা পৌঁছে দেব!

বাতিকবাবু – আর তেল? সেটা পাওয়া যাবে?

সুলতা – ঠিক আছে তাও দেখছি! যত তাড়াতাড়ি করা যায়!

বাতিকবাবু – ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, এক কাপ তেলে পাঁচটা মিডিয়ম সাইজের রসুনের কোয়া! ছোট হলে সাতটা আর বড় হলে তিনটে! আসলে রসুন কমবেশী হয়ে গেলে

অনিমেষ – ঠিক আছে সেটা আর বলতে হবে না! ঐ রকম হবে, ছোট হলে তিনটে, মিডিয়ম হলে পাঁচ আর বড় হলে সাত

বাতিকবাবু – না না! ছোট হলে সাত, মিডিয়ম হলে পাঁচ আর বড় হলে তিন!

অনিমেষ – ও হ্যাঁ, ভুলে গেছি! বুঝে গেছি, আপনি যান, আমরা করে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

বাতিকবাবু – ঠিক আছে আসছি তাহলে! (বাতিকবাবু বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, আবার ফিরে এলেন) দেখেছেন আসল কথাটাই বলা হয়নি, ওয়ার্ম লাইম ওয়াটারটা কাঁচের গ্লাসে পাঠাবেন, স্টীলে আমার আবার

অনিমেষ – অ্যালার্জি?

বাতিকবাবু – ঠিক অ্যালার্জি নয়। তবে মেডিসিন তো! কাঁচের গ্লাসে খেলে সাইকোলজিক্যাল এফেক্টটা ভালো হয়!

অনিমেষ – আর তেলটা কিসে করে পাঠাবো? সেও কাঁচের বাটিতে?

বাতিকবাবু – আমার একটা ছোট পাত্র আছে, সেটাতে করে পাঠানো যাবে?

অনিমেষ – ঠিক আছে, বাহাদুর গিয়ে নিয়ে আসবে! আপনি ঘরে যান, বিশ্রাম করুন।


(বাতিক বাবু বেরিয়ে গেলেন)


(সুলতা, অনিমেষ দুজনে হাসবে)

সুলতা – কি করবে বলো! হোটেলের বোর্ডার তো নিজে বাছাই করে নেওয়া যায়না! এই দেখেছো, পাঁচটা বেজে গেল, রেডিওর খবর চালানো হলো না, উফ! যা ভুলো মন হয়েছে আমার!

অনিমেষ – ওয়েদার চ্যানেলটা দাও।


(রেডিওর খবর নেপথ্যে – আগামী তিন দিন মুম্বাই পুনে সংলগ্ন এলাকায় বজ্র বিদ্যুৎ সহ ভারী বর্ষণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। রাজ্যবাসীর কাছে অনুরোধ প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করুন। বিভিন্ন রাস্তা জলমগ্ন হয়ে পড়ায় অযথা যানজটের সম্ভাবনাও রয়েছে। একটি বিশেষ ঘোষণা, গত সপ্তাহে চেম্বুর এলাকায় যে নৃশংস খুন হয়েছিল পুলিশ এখনো পর্যন্ত তার কোন কিনারা করতে পারেননি। গত দুইমাসে এই নিয়ে এটি চতুর্থ খুন। মুম্বাই পুলিশ রাজ্যবাসীকে সতর্ক থাকতে অনুরোধ করেছেন। কোন অচেনা, অজানা ব্যক্তিকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেবেন না। কোন রকম সন্দেহ দেখলে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। যোগাযোগ করার নম্বর)


অনিমেষ – এ আবার কি সমস্যা হলো বলো তো! হোটেল খুলে বসেছি, অতিথি এলে কি ঢুকতে দেবো না?

সুলতা – পুলিশ নিজের কাজ করছে, সতর্ক করে রাখছে সবাই কে! খুনের একটা কারণ থাকবে তো! আমি কিছু না করলে আমাকে কেন শুধু শুধু কেউ মারতে যাবে, কেন বলো তো! (কয়েক সেকেন্ডের বিরতির পর) আচ্ছা শোনো না, অনেক সময়ে শুনেছি সিরিয়াল কিলাররা নাকি বিনা কারণেও মার্ডার করে থাকে!

অনিমেষ – ধ্যাত! তোমার সব তাতেই বেশী ভয়! শোন আমাদের তো ভয় পেলে চলবে না! চলো, লিস্ট টা শেষ করো তাহলে? মশলা সব কিছু আছে তো! আর তেল লাগবে তো? আমি তাহলে চারটে পাঁচ লিটারের টিন নিয়ে নিচ্ছি। ও হ্যাঁ, গুডনাইট, দেশলাই, সাবান, টুথপেস্ট আর আর? আর চাল, ডাল, আলু, চিনির অ্যামাউন্ট গুলো বললে না তো!



(রুদ্রপ্রসাদের প্রবেশ)


রুদ্রপ্রসাদ – আসতে পারি?

অনিমেষ – কি ব্যাপার? কে আপনি?

রুদ্রপ্রসাদ – অসময়ে জ্বালাতন করার জন্য মাফ চাইছি। অধমের নাম শ্রী রুদ্রপ্রসাদ রায়বর্মা! আমার নাম শুনে আবার ভেবে বসবেন না আমি নাটকের জগতের মানুষ! আমার বাবা মা রেখেছিলেন! কি ভেবে রেখেছিলেন জানা নেই। যাক সে কথা! আসল কথাটাই জিজ্ঞাসা করা হয়নি। আমি ঠিক জায়গায় এসেছি তো?

সুলতা – কোথায় আসতে চেয়েছিলেন সেটা না জানলে ঠিক বা বেঠিক বলব কেমন করে?

রুদ্রপ্রসাদ – কোথায় আবার? কোহিনুর নিবাস! আসলে এত ঝড় বৃষ্টির মধ্যে সাইন বোর্ড দেখা যাচ্ছিল না!

সুলতা – না, তাহলে ভুল করেন নি। আর দশ মাইলের মধ্যে আর কোন হোটেল নেই।

রুদ্রপ্রসাদ – তাহলে চোখ বন্ধ করেও আসতে পারতাম বলছেন!

অনিমেষ – হ্যাঁ, আপনার আসার তো কোন সংবাদ পাইনি!

রুদ্রপ্রসাদ – পাবেন কি করে? আমি তো আর এখানে আসব ঠিক করে বেরোই নি!

অনিমেষ – মানে?

রুদ্রপ্রসাদ – ভয় লাগছে? ভয় নেই! আমি এক নিরীহ মানুষ, কি ক্ষতি করি বলুন? আসলে আমার বাবা শ্রী শশাঙ্ক রায়বর্মা মনে করেন সিনেমার লাইন নাকি একেবারে অপদার্থ, অকর্মণ্য কিছু মানুষের জন্য। তা বাবার সঙ্গে পরশু এই নিয়ে ফাটাফাটি হয়ে গেল। মা কিছুতেই ছাড়বেন না, আমাকে। আর আমার ও গোঁ! সে একেবারে দেয়ানেয়ার সিন। উত্তমকুমার কমল মিত্রের ঝগড়া আর মাঝে ছায়া দেবী! এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়লাম, মুম্বাই তে সিনেমা করে তারপর বাবার মুখ দর্শন করব।

অনিমেষ – বেশ! বুঝলাম! কিন্তু এটা তো সিনেমা পাড়া নয়! তাছাড়া এই ঝড় বৃষ্টিতে এখানে এলেন কেমন করে?

রুদ্রপ্রসাদ – পুনে যাচ্ছিলাম, বাসটা গেল খারাপ হয়ে গেল। তা একজনে বললে এই রাস্তায় আপনি কোহিনুর নিবাস পেয়ে যাবেন, সেখানে থাকার একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তা আপনাদের এখানে দিন সাতেকের জন্য জায়গা হবে? ঘর আছে?

অনিমেষ – অ! তা আপনার আর সব জিনিস পত্র কোথায়?

রুদ্রপ্রসাদ – আর সব জিনিস আসবে কোথা থেকে? আমার যা কিছু সব এই সুটকেসের মধ্যেই। ঐ যে বললাম এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েছি!

অনিমেষ – আচ্ছা! (সুলতার দিকে তাকিয়ে) তা ঘর রেডি কিছু আছে?

সুলতা – আছে, সাত নম্বর ঘর আছে তো! আসুন! কিন্তু খাবার তো সে রকম কিছু নেই!

রুদ্রপ্রসাদ – না না ঠিক আছে! আমার খাবারের জন্য ব্যস্ত হবেন না! এই পোলাও, কালিয়া দুমুঠো দিলেই চলে যাবে।

সুলতা – কিন্তু অতো সস্তার খাবার তো আমরা রাখি না!

রুদ্রপ্রসাদ – তাহলে? কি পাওয়া যাবে?

সুলতা – রুটি, মাখন, জেলি – চলবে?

রুদ্রপ্রসাদ – চলবে না! দৌড়বে! সত্যি বলতে কি এতো রাতে যে আহার আশ্রয় জুটবে সেটাই আশা করি নি! আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ

সুলতা – (স্বল্প হেসে) কিছুই বলতে হবে না! সাত নম্বরের চাবি, তুমি কি যাবে একবার ওনার সঙ্গে

অনিমেষ – হ্যাঁ নিশ্চয়ই!

রুদ্রপ্রসাদ – ধন্যবাদ! আর টাকা পয়সা কত দিতে হবে?

অনিমেষ – আপনি সাত দিন থাকবেন তো! এখন হাজার দুয়েক অ্যাডভান্স করে দিন, বাকিটা চেক আউট করার সময়। আপনি ফ্রেস হয়ে নিন, তারপর না হয় এসে টাকাটা দিয়ে যাবেন!


(অনিমেষের প্রস্থান, পিছুপিছু রুদ্রপ্রসাদের প্রস্থান)

(সুলতা খাবারের অর্ডার দিয়ে দেন, অনিমেষ ফিরে আসে, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে)


অনিমেষ – সিনেমায় না নেমেই নিজেকে সিনেমার নায়ক মনে করছে! সিনেমায় নামলে আর দেখতে হবে না!

সুলতা – শোনো তুমি আর দেরী কোর না, অতো দূরে যেতে হবে।

অনিমেষ – হ্যাঁ লিস্টটা ফাইনাল করে ফেলি। হ্যাঁ চাল কি দশ কেজি নেব? ডাল কতোটা? আর কি ডাল?

সুলতা – ডাল, মুগ মুসুর মিশিয়ে নিও, চার কেজি হলেই হবে। ও হ্যাঁ, পাউরুটি নিতে ভুলো না। একটু বেশী করেই নিও চা একটু নিয়ে নিও,

অনিমেষ – চিনি কতটা নেব?

সুলতা - দু কেজি

অনিমেষ – আর?

সুলতা – মাখন, জ্যাম, মিল্ক পাউডার আর ডিম! একটু বেশী করে!


(সহসা রুদ্রপ্রসাদের প্রবেশ)


রুদ্রপ্রসাদ – আসতে পারি! আপনি কি কাজ করছেন? আমি কিন্তু আপনাকে সাহায্য করতে পারি!

সুলতা – সাহায্য? আমাকে?

রুদ্রপ্রসাদ – হ্যাঁ, আসলে এই রকম হঠাৎ করে এসে পড়লাম তারপর লাটসাহেবের মতো জোর করে খাবার চেয়ে বসলাম। তাই কি রকম একটা বিবেকের দংশন হল! ভাবছিলাম যদি একটু সাহায্য করতে পারতাম তাহলে হয়তো আপনার ও ভালো লাগতো!

অনিমেষ – সাহায্য করার অতো আগ্রহ থাকলে চলুন আমার সাথে! স্টেশন যেতে হবে, তারপর বাজার যাওয়া আছে। সারা রাস্তায় আপনি অনেক কিছু সাহায্য করতে পারবেন।

রুদ্রপ্রসাদ – ওরে বাবা, এই বৃষ্টিতে সেই স্টেশন, বাজার? তারপর যদি গাড়ি খারাপ হয়ে যায়! না বাবা, ওর মধ্যে বীরত্বের মধ্যে আমি নেই।

অনিমেষ – আচ্ছা বুঝেছি, আপনার বীরত্ব খালি আপনি মহিলাদের কাছেই দেখিয়ে থাকেন। ঠিক আছে, সুলতা দেবীর আপনার সাহায্যের প্রয়োজন হয়তো হবে না। আপনি ঘরে যান, বিশ্রাম করুন।

সুলতা – হ্যাঁ আপনি আপনার ঘরে যান! বিশ্রাম করুন! বাহাদুর খাবার নিয়ে যাচ্ছে আপনার ঘরে।

রুদ্রপ্রসাদ – তা এতো বড় হোটেলের সব কাজ আপনি নিজে হাতে করেন?

অনিমেষ – উনি একা করেন না! আমিও আছি ওনার সাথে!

রুদ্রপ্রসাদ – অ! (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) ঠিক আছে এখন আসি! যদি কোন দরকার হয় আবার আসব!

সুলতা – বেশ!


(রুদ্রপ্রসাদ ঘরে চলে গেলেন)


অনিমেষ – বাবা! সুলতাদেবীর ওপর ইনি যে বড্ড বেশী সহৃদয়।

সুলতা – (হাসতে হাসতে) যাও আর দেরী কোর না, বেরিয়ে পড় এবারে!

(অনিমেষ বেরিয়ে পড়ে স্টেশন আর বাজারের জন্য)

[[এখানে প্রথম দৃশ্য শেষ]]



==================


দ্বিতীয় দৃশ্য



[হোটেলের রিসেপশন। সুলতা স্টেজে রয়েছে, অনিমেষ ঢুকছে স্টেজে, পেছনে দুই ভদ্রলোক। দুজনের মধ্যে একজন লাঠি নিয়ে হাঁটছেন]



অনিমেষ – সুলতা, ইনি হলেন বিপ্লববাবু, আমাদের চিঠি পাঠিয়েছিলেন!

সুলতা – নমস্কার!

বিপ্লব – হ্যাঁ, নমস্কার! আমার চিঠি হয়তো আগেই পেয়েছেন, তা এই রকম দুর্যোগ হবে জানলে কি আসতাম?

সুলতা – সত্যি আপনার খুব কষ্ট হল!

বিপ্লব – কষ্ট? সে তো আপনাদেরও কিছু কম নয়! আসলে এই অথর্ব শরীর নিয়ে আরো ক’দিন যে অন্যদের ভোগাবো, তা আর কে জানে?

সুলতা – না না সেকি বলছেন? আপনি আমাদের অতিথি!

অনিমেষ – সুলতা, আর ইনি হচ্ছেন অমরনাথ কাঞ্জিলাল!

অমরনাথ – নমস্কার! আমি অতিথি নই, আমি হলাম একেবারে অনাহুত উপদ্রব!

সুলতা – তা এদিকে? কি কোন দরকারে?

অমরনাথ – হ্যাঁ আসলে আমার ভাইপোর সঙ্গে ব্যবসা – ভাইপো ওয়াসীতে থাকে। সেখানেই ফ্যাক্টরি, তা আমার যাওয়ার কথা ওয়াসীতে, কিন্তু এই বৃষ্টিতে পানভেল থেকে কিছু পেলাম না! ট্রেনে পরিচয় হল এঁর, তারপর উনি (অনিমেষ কে দেখিয়ে) বললেন আর চলে এলাম। তা ঘর হবে তো!

সুলতা – হ্যাঁ হ্যাঁ হবে, আগে কিছু খাবেন তো!

বিপ্লব – স্টেশনে তো খেয়ে এলাম, একেবারে রাতেই খাব! আপনার খিদে আছে নাকি?

অমরনাথ – একটু চা হবে নাকি?

সুলতা – হ্যাঁ হবে, বসুন।

অমরনাথ – বাঃ, বেশ বেশ!

বিপ্লব – হ্যাঁ চা চলতে পারে! চা হলো গিয়ে, মানে বুঝলেন না! হলো গিয়ে এনার্জি ড্রিঙ্কস!


(সুলতা নেপথ্যে বাহাদুর কে ডাকবে, চায়ের অর্ডার পাঠাবে)


অনিমেষ – আসলে এমন বন্যা এসে গেল সব কিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। এদিকে আমাদের এখানে খাবারের কিন্তু একেবারে যৎকিঞ্চিত ব্যবস্থা!

অমরনাথ – তাতে কি হলো! রাতে যে থাকার জায়গা পেয়ে গেছি এই অনেক! খাওয়া তো পরের কথা!

বিপ্লব – হ্যাঁ, ভাত ডাল পাওয়া যাবে তো! ব্যাস আর কি?


(জয়তী দেবীর প্রবেশ)


জয়তী – সুলতা, রাতে খাবারের কি ব্যবস্থা হয়েছে?

সুলতা – খাবার রাত নটার মধ্যে রেডি হয়ে যাবে, ম্যাডাম, সরি মিস ধর!

জয়তী – সময় জানতে চাইছি না, মেনু কি আছে?

সুলতা – আজ্ঞে, ভাত, ডাল, একটা সব্জী আর অমলেট!

জয়তী – তোমাদের বুদ্ধি শুদ্ধি আর করে হবে! এই বর্ষার সময়, খিচুড়ী হলো না কেন?

অনিমেষ – না মানে, আসলে খিচুড়ি তো লাঞ্চে ভালো চলে, আর বৃষ্টিও আজ রাতে শেষ হয়ে যাচ্ছে না! তো কাল সকালে খিচুড়ি! সুলতা, তুমি একটু কিচেনে বলে রেখো!

জয়তী – শোনো, আমি কিন্তু রাতে ভাত রুটি মিশিয়ে খাই, তার বন্দোবস্ত যেন থাকে। আমাকে যেন শুনতে না হয় রুটির ব্যবস্থা তো নেই!

সুলতা – না না কোন অসুবিধা হবে না! আপনার খাবার ঠিক সময়ে ঘরে পৌঁছে যাবে!


(এবারে বাতিকবাবুর প্রবেশ)


বাতিকবাবু – আসতে পারি!

অনিমেষ – হ্যাঁ নিশ্চয়ই! রাতের খাবার এক্ষুণি রেডি হয়ে যাবে! আমরা ঘরে পৌঁছে দেব!

বাতিকবাবু – অ্যাঁ, রাতের খাবার?

অনিমেষ – হ্যাঁ ডিনার! খাবেন তো !

বাতিকবাবু – না আমি এসেছিলাম অন্য কারনে! আচ্ছা এখানে আপনারা কতদিন ধরে হোটেল চালাচ্ছেন?

অনিমেষ – এই তো কয়েক মাস হলো, বছর হয়নি এখনো!

বাতিকবাবু – আচ্ছা এই বাড়িতে কি ভূত আছে?

(সবাই একসাথে বলে ওঠে ‘ভূত’!)


অনিমেষ – কি যা তা বলছেন? আপনার কাছে কি প্রমান আছে যে বলছেন এখানে ভূত আছে! আর তাছাড়া এখানে এতো মানুষ রাত কাটিয়ে গেছেন কখনো কেউ এসব বলেনি!

অমরনাথ – আহা এক সেকেন্ড! এক সেকেন্ড! ভূত কি আপনি নিজের চোখে দেখেছেন?

বাতিকবাবু – অ্যাঁ নিজের চোখে? না, আসলে কেমন যেন মনে হচ্ছে কেউ দরজা খোলার চেষ্টা করছে।

সুলতা - কিন্তু এ বাড়ির দরজা জানলা যে রকম মজবুত ভূতের হাতে কুড়ুল না থাকলে তো খোলা অসম্ভব।

অমরনাথ – কিন্তু দরজা খোলার চেষ্টা যিনি করেন তিনি তো ভূত নন, বরং তাঁর মানুষ হবার সম্ভাবনাই বেশী!

বিপ্লব – ঠিক! ভূত তো অশরীরী, তাঁর আর দরজা খোলার দরকার কি? তিনি তো ছায়ার মতো বিচরণ করেন।

জয়তী – কিন্তু কুড়ুল দিয়েই যদি বা কেউ খোলে!

সুলতা – দেখুন এখানে আমি, উনি আর আমাদের দুজন কর্মচারী, এখানে আর তো কেউ নেই যে দরজা ভেঙ্গে ধনরত্ন নিয়ে যাবে! আর বর্তমানে অতিথি বলতে এই তো আপনারা ক’জন! আর একজন আছেন! বিকেল বেলা এলেন, সাত নম্বর ঘরে আছেন। বাইরের লোক তো আর কেউ নেই।

অমরনাথ – আমার কি মনে হয় জানেন! খুব ঝড় জল হচ্ছে তো! হয়তো সেই ধাক্কাই আপনার মনে হয়েছে কেউ দরজা ধাক্কা দিচ্ছে!

জয়তী – আপনি কি শুনেছেন সেই ধাক্কার আওয়াজ?

অমরনাথ – না তা শুনিনি!

জয়তী – তাহলে আপনি বুঝলেন কি করে? মানুষে ধাক্কা দিচ্ছে নাকি হাওয়ায় ধাক্কা দিচ্ছে!

বিপ্লব – আহা অতো তর্কাতর্কির কি আছে? আমরা তো রয়েছি এতোজন! কোন বিপদ এলে নাহয় দেখা যাবে!

জয়তী - আর এই রকম মনুষ্যহীন জায়গা, একদল ডাকাত এসে যদি সবাইকে খুন করে যায় তাহলে রুখবে কে? আপনি?

অমরনাথ – আমি অন্তত নয়!

জয়তী – থামুন আপনি! আপনার এখন হাসি ঠাট্টা করতে ইচ্ছে করছে? এই তো চারদিন আগে চেম্বুরে ভর সন্ধ্যায় একজনকে কি নৃশংস ভাবে খুন করে গেছে! শুনেছেন?

সুলতা – কিন্তু সে তো কোন পাগলের কাজ! নইলে সেই নিরীহ মহিলাকে অকারনে গলায় ফাঁস দিয়ে কেউ মারতে পারেন?

অমরনাথ – ঠিক! নাহলে হয়তো বুড়ির ঘরে মোহরের ঘড়া লুকোনো ছিল!

জয়তী – না, পুলিশ সে রকম কোন প্রমান পায়নি!

অমরনাথ – আরে! পুলিশ যা পায় তা কি সবাইকে জানায়? আমার তো মনে হয় নির্ঘাত বুড়ির ঘরে লুকোনো সোনাদানা, পয়সা কড়ি ছিল আর নয়তো বুড়ি কোন চোরাই ব্যবসার মালিক! নাম ভাঁড়িয়ে সেই মুম্বাইয়ে কোন চলে ঘাপটি মেরে ছিল, তারপর শত্রু পক্ষের কেউ এসে দিয়েছে খতম করে! যাক গে! আপনার তো আর চোরাই ব্যবসা নেই, লুকোনো সোনাদানা ও নেই, তাহলে ভয় পাওয়ার কি আছে?

বিপ্লব – ঠিক! আমার ঘরে ডাকাত পড়লে বলব, যা আছে বাবা সব কিছু নিয়ে যাও আর পারলে আমাকেও নিয়ে চলো!

বাতিকবাবু – আসলে আমি একটা অন্য কথা ভাবছিলাম!

অনিমেষ – আবার অন্য কথা? সেটা কি?

বাতিকবাবু – না মানে,

(ঠিক এই সময়ে ফোন বেজে উঠবে)


অনিমেষ – এই সময়ে আবার কার ফোন?

(অনিমেষ গিয়ে ফোন ধরবে)


অনিমেষ – হ্যালো, হ্যাঁ, কোহিনুর নিবাস থেকে বলছি, বলুন। ম্যানেজার? (সুলতার দিকে তাকিয়ে) ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে চায়,

সুলতা – কোথা থেকে ফোন করছেন?

অনিমেষ – আপনি যা বলার আমাকে বলতে পারেন। আমার নাম অনিমেষ লাহিড়ী! সুলতা? হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন, আমি আর উনি আমরা দুজনে এই হোটেলের পার্টনার! আপনি কোথা থেকে কথা বলছেন? আচ্ছা ঠিক আছে, আমি ওনাকেই দিচ্ছি! ধরুন! (সুলতার দিকে তাকিয়ে) থানা থেকে ফোন, তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে!

সুলতা – থানা থেকে? কি দরকার?

অনিমেষ – জানি না! আমাকে কিছু বলল না!

সুলতা- আচ্ছা দাও! (হাতে ফোন নিয়ে) হ্যাঁ আমি সুলতা ঘোষ, বলুন! হ্যাঁ, সি আই ডি অফিসার মিঃ ঘোষাল কে পাঠাচ্ছেন? কিন্তু কেন? হ্যাঁ বুঝলাম কিন্তু কিসের বিপদ? কিন্তু এখানে তো! হ্যাঁ কি বললেন আর একবার বলুন! ফোনে বলতে চান না! আচ্ছা, কিন্তু মিঃ ঘোষাল এখানে আসবেন কি করে? বন্যায় তো সব ভেসে গেছে! আমাদের বাড়িটা এক রকম দ্বীপের মত ভাসছে বলতে পারেন। আর বন্যা ক্রমশ বাড়ছে! হ্যাঁ, কি বললেন? আর একবার বলুন, হ্যালো হ্যালো, যাঃ কেটে দিল!

অনিমেষ – কি বলল?

সুলতা – সদর থানা থেকে ফোন এসেছিল! আমরা কেউ যেন হোটেল থেকে বেরোই আর যারা অতিথি আছেন তাঁরাও যেন হোটেল থেকে না বেরোন। নাহলে নাকি আমাদের চরম কোন বিপদ আসতে পারে! সি আই ডি অফিসার মিঃ ঘোষাল আসছেন! তিনি নাকি নিজে এসে বাকী সব ডিটেলে বলবেন!

অমরনাথ – কিন্তু একটা কারন তো থাকা চাই। নয়তো পুলিশ কি কোন কারন ছাড়া আসে? তার ওপর এই ঝড় বৃষ্টির রাতে,

অনিমেষ – জ্ঞানত হোটেল চালাতে গিয়ে আমরা কোন অন্যায় করিনি!

অমরনাথ – তাহলে এখানে এমন কি কেউ এসেছেন যাকে ধরার জন্য পুলিশ উদগ্রীব!

বাতিকবাবু – তাহলে কি পুলিশ এসে আমাদের সবাইকে জেরা করবে?

অমরনাথ – করতেও পারে।

জয়তী – আচ্ছা আপনারাই বা উল্টোপাল্টা সবাইকে হোটেলে থাকতে দেন কেন?

অনিমেষ – একি বলছেন মিস ধর? আমাদের কাছে যে থাকতে চাইবেন তাঁকেই তো আমাদের থাকতে দিতে হবে। আর রুম দেওয়ার সময় তিনি সে নাম বা পরিচয় দেন আমরা সেটাই লিখে রাখি!

অমরনাথ – এই ধরুন, এই যে আপনি যখন হোটেলে এলেন এঁরা কি আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করেছিল? করেনি তো! এখন ধরুন পুলিশের খাতায় আপনার নাম আছে,

জয়তী – মানে?

অমরনাথ – না, মানে ধরুন পুলিশের খাতায় আপনার নাম আছে, সেটা এঁরা কি করে জানবেন?

জয়তী – আপনি থামবেন! তখন থেকে খালি বাজে কথা বলে যাচ্ছেন!

বিপ্লব – কেন মিছিমিছি আপনারা ভাবছেন বলুন তো! আগে সেই সিআইডি অফিসার কে তো আসতে দিন! দেখাই যাক না তিনি কি চান?

জয়তী – উফ! কি কুক্ষনে যে এখানে টাকা অ্যাডভান্স পাঠিয়ে বুক করেছিলাম, এখন পুলিশ এসে উপদ্রব শুরু করবে!

সুলতা – মিস ধর, আমি বলি কি, মিছিমিছি রাগ করবেন না! হয়তো পুলিশ আমাদের ভালোর জন্যই আসছে!

অমরনাথ – পুলিশ তাহলে আজকাল মানুষের ভালোও করছে। আমি তো জানতাম পুলিশ মানেই, যাক গে! মিঃ লাহিড়ী তাহলে আমাদের ঘরটা দেখিয়ে দিলে ভালো হতো, একটু ফ্রেস হয়ে নিই। এখনতো আবার পুলিশ আসছে। দেখুন আমরা আবার কখন সবাই ছাড়া পাই!

(সকলের প্রস্থান)

===============


তৃতীয় দৃশ্য


(রিসেপশন সংলগ্ন একটি ঘরে সুলতা এবং অনিমেষ কথা বলছে।)



সুলতা – কি ঝামেলায় পড়া গেল বলো দেখি? এখন কখন পুলিশ আসবে, সে আশায় এখন তীর্থের কাকের মতো বসে থাকো!

অনিমেষ – কি আর করবে? আমাদের দিক থেকে কোন ভুল হয়নি, তাহলে এতো ভাবছো কেন?

সুলতা – আচ্ছা শোন না! একটা জিনিস, সেদিনে ঐ রেশন থেকে কম দামে চাল নিয়েছিলাম, সেটা তো খাতায় দেখাই নি, সেজন্য আবার পুলিশ কিছু গন্ডগোল করবে না তো?

অনিমেষ – তোমার কি মাথা খারাপ হলো? কবে কি চাল কিনেছিলে সেজন্য এই বন্যায় পুলিশ আসবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে? কেন শুধু শুধু ভেবে মরছো বলো তো?

সুলতা – না গো! কোনমতে একটু লাভের মুখ দেখেছি, তারপর যদি ... জানিনা,

অনিমেষ – খাতায় যখন কিছু প্রমান নেই, স্রেফ চেপে যাবে, বুঝলে

(দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ)

অনিমেষ – কে?

বাইরে থেকে আওয়াজ আসে, “দরজা খুলুন, পুলিশ”



(অনিমেষ দরজা খুলতে যাবে, সন্দীপ সান্যাল প্রবেশ করলেন)

সুলতা – আসুন অফিসার!

সন্দীপ – নমস্কার, আমি সি আই ডি অফিসার, সন্দীপ সান্যাল। সরি এই বৃষ্টির রাতে আপনাদের খুব সমস্যায় ফেললাম, কিন্তু কি করি বলুন! অপরাধ তো আর ঝড়, বৃষ্টি মেনে হয় না,

অনিমেষ – কিন্তু স্যার, এতো বৃষ্টিতে এলেন কি করে? গাড়ি আসার রাস্তা তো বন্ধ!

সন্দীপ – এসে যখন পড়েছি, তখন কি করে এলাম সেটা বরং থাক! একটু জল খাওয়াবেন প্লীজ!

সুলতা – নিশ্চয়ই, (সুলতা গিয়ে জল নিয়ে আসে)

সন্দীপ – আচ্ছা আপনার এখানে কতজন গেস্ট রয়েছেন এখন?

অনিমেষ – ঐ তো পাঁচজন, জয়তী ধর স্কুল ইনস্পেক্টর, বাতিক বাবু কোন স্কুলে পড়ান, বিপ্লব বাবু উনি খুব অসুস্থ, অমরনাথ কাঞ্জিলাল বলে এক ব্যবসায়ী আর রুদ্রপ্রসাদ নামে একটি চ্যাংড়া ছোঁড়াও আছে। কাজের লোক বলতে দুজন আছেন, তারা প্রথম দিন থেকেই আমাদের সঙ্গে আছে, আর আমরা দুজন।

সন্দীপ – সকলে ঘরে আছেন তো!

অনিমেষ – হ্যাঁ স্যার আমরা তো বলেই রেখেছি। আপনি কি সবার সাথেই কথা বলবেন?

সন্দীপ – হ্যাঁ, আগে আপনাদের সাথে হয়ে যাক, তারপর ওঁদের সাথে!

অনিমেষ – স্যার কি ব্যাপার বলুন তো! আমরা কি কোন অন্যায় করেছি।

সন্দীপ – না না, আপনাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নিয়ে আমি এখানে আসিনি। আপনাদের যাতে কোন বিপদ না হয় সেজন্যই আমাকে পাঠানো হয়েছে।

সুলতা – বিপদ? আমাদের আবার কি বিপদ?

সন্দীপ – বিপদ কনিকা দেবীর খুন হওয়ায় সঙ্গে জড়িত।

অনিমেষ – কনিকা দেবী?

সন্দীপ – হ্যাঁ, গত সপ্তাহে মুম্বাইতে তিনি খুন হন! চেম্বুরে থাকতেন, নিশ্চয়ই শুনেছেন।

সুলতা – হ্যাঁ শুনেছি, কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের কি বিপদ?

সন্দীপ – পুরো ব্যাপার টা বলতে গেলে আগে দশ বছর আগের একটা ঘটনা জানতে হবে।

অনিমেষ – কি রকম?

সন্দীপ – ২০০৮ সাল, মজফরপুর, স্টেশন থেকে প্রায় পনের কিলোমিটার দূরে একটা অনাথ আশ্রম, নাম কল্যানেশ্বরী সেবা সদন। প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরোনো সেই অনাথ আশ্রম, সেই সময়ে সেই আশ্রমের দায়িত্বে তখন মহেন্দ্র সিং, আর সাত জন ট্রাস্টি! তা গত চার পাঁচ বছর ধরে সেখানে তখন শুরু হয়েছে এক ভয়ঙ্কর নির্যাতন। শিশুদের ওপর, আট থেকে বারো – এই গ্রুপটাকে মূলত টার্গেট করা হচ্ছিল। স্কুলের ব্যাগে পাঠানো হচ্ছে গর্হিত ড্রাগস, আর তার সঙ্গে চলছে শিশুদের ইন্টারন্যাল অরগ্যান নিয়ে এক জঘন্য ব্যবসা। নেপাল থেকে ড্রাগস আসত, আর সেটা পাঠানো হতো নানান ব্যবসায়ীদের কাছে। আর তাঁরা সেগুলো কয়েক লক্ষ টাকার বিনিময়ে ভারতের নানা জায়গায় পাচার করে চলেছেন।

অনিমেষ – এতো দিনের পুরোনো ঘটনার সঙ্গে আজ কি লিঙ্ক?

সুলতা – আহা পুরো ব্যাপারটা আগে শোনোই না! মাঝখানে বাধ সাধো কেন?

সন্দীপ – মাঝে মাঝে একটা দুটো ঘটনার খবর বাইরে আসে, কিন্তু কোন প্রমান নেই। লোকাল এম এল এ, আমলা সবাই মিলে রয়েছে, আর পুলিশ তাদের পকেটে। এবারে যদি একটা আখতার, বা একটা ফ্রান্সিস বা একটা সুরজ কোনমতে সেখান থেকে পালিয়ে যায় তবে দুচার দিন বাদে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়, কখনো ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু, কখনো আবার হাসপাতালে অসুস্থতার কারনে মৃত্যু! এই রকম সময়ের ঘটনা এটা!

সুলতা – তারপর?

সন্দীপ – এই রকম সময়ে একটি একুশ বছরের মেয়ে এসে পড়ে সেই অনাথআশ্রমে। তার নামটা না হয় নাই বললাম এখন! শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী মেয়ে, অ্যাকাউন্টসে চাকরী করে, আশ্চর্য তার অনুমানক্ষমতা, আর সেই রকম জোরদার তার অব্জারভেশন! সে কিন্তু মাস খানেকের মধ্যে ব্যাপারটা বুঝে যায়, আর এও বুঝতে পারে সবাই মিলে আছে ব্যাপারটার মধ্যে! এখন প্রশ্ন হলো সে কার কাছে যাবে?

অনিমেষ – তো কি হল সেই মেয়েটির?

সন্দীপ – অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চাইল! আর দায়িত্বশীল, শিক্ষিত চারজন পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ মানুষ তার প্রতিবাদ করল! সেই একুশ বছরের মেয়েটিকে ব্রুটালি রেপ করে, পরপর নয় বার! মেয়েটি ঘটনাস্থলে মারা যায়! কিন্তু এই সমস্ত শিক্ষিত মানুষের শিক্ষা এতো জোরদার তাঁরা সেই রক্তে লতপত করা দেহটিকে চলন্ত ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেন! আধাপোড়া সিগারেটের মতো!

সুলতা – এঁরা কি মানুষ নাকি জানোয়ার?

সন্দীপ – অবজেকশন ম্যাডাম! আপনি কখনো দেখেছেন চারটি পুরুষ জন্তু একটি মহিলা জন্তুর ওপর শারীরিক নির্যাতন করে তারপর তাকে খুন করে চলে যায়! দেখেন নি তো? তাহলে এঁদেরকে জানোয়ার বলে জানোয়ার জাতটাকে অপমান করবেন না! এঁরা আমাদের দেশের শিক্ষিত পুরুষ মানুষ, যাঁদের অ্যাকচুয়ালী বাঁচানো দরকার, কিন্তু আমরা কি সব ফালতু “বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও” এর স্লোগান তুলি! “বেটা বাঁচাও, বেটা পড়াও” এসব বলি না! বললে হয়তো আমাদের মেয়েরা নিরাপদে থাকতে পারত!

(কয়েক সেকেন্ড বিরতি)


সন্দীপ – যাক গে, আমি ডাইগ্রেস করব না! পয়েন্ট হল, এই কনিকা দেবী ছিলেন সেই অনাথ আশ্রমের ম্যানেজার। এবারে গত তিনমাসে চারটে খুন হয়েছে, কিরনশঙ্কর খুন হন সেপ্টেম্বরে তিনি ছিলেন এক ট্রাস্টি, শ্রীকান্ত মাইতি যিনি ছিলেন অনাথ আশ্রমের আর একজন ম্যানেজার তিনি খুন হন অক্টোবরে, অশোক শর্মা খুন হন জানুয়ারী তে, যিনি ছিলেন সে সময়ের মজফরপুর থানায় ওসি আর এবারে কনিকাদেবী। এবারে কথা হল, আপনারা কেউ এঁদের চারজনকে চিনতেন কিনা? অথবা কোনভাবে সেই কল্যানেশ্বরী সেবা সদনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিনা?

সুলতা – কিন্তু আমাদের এসব কথা শোনাচ্ছেন কেন?

সন্দীপ – শোনাচ্ছি আপনারা বিপন্ন বলে!

অনিমেষ – আমরা বিপন্ন হব কেন?

সন্দীপ – আমাদের ইনফরমেশন বলছে এবারের টার্গেট এই কোহিনুর নিবাস।

অনিমেষ – তার মানে? এখানেও কেউ খুন হবে বলতে চান?

সন্দীপ – মাফ করবেন। আমি আপনাদের কোন ভয় পাওয়াতে চাইনি। তবে আমাদের অনুমান তাই। খুনীর অভিসন্ধি ব্যর্থ করার জন্য আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। আর আপনাদের সহযোগিতা পেলে আশা করি আমি ব্যর্থ হবো না।

অনিমেষ – কিন্তু এই দুর্যোগে, ঝড়, বৃষ্টিতে খুনীর পক্ষে এখানে আসা কি সম্ভব?

সন্দীপ – আপনি বুঝি সেই ভেবে আনন্দ পাচ্ছেন? এমন তো হতে পারে, খুনীর হয়তো আর আসার দরকার নেই!

অনিমেষ – তার মানে?

সন্দীপ – খুনী হয়তো অলরেডি এখানে এসে পড়েছেন।

সুলতা – তা কি করে সম্ভব? আমরা সবার পরিচয়পত্র চেক করে তবেই এখানে থাকার অনুমতি দিই।

সন্দীপ – বুঝলাম! কিন্তু খুনী যে কে সেটা তো আগে থেকে কারুর জানা নেই! তাহলে আপনারা বুঝবেন কি করে? আর একটা কথা ভুলবেন না, কনিকা দেবী খুন হয়েছেন গত শুক্রবার! আপনাদের বোর্ডারদের মধ্যে কেউ কি তার আগে থেকে আছেন?

অনিমেষ – কি বলছেন? তাহলে এই বোর্ডারদের মধ্যে কেউ খুনী রয়েছেন? কি ভয়ংকর?

সন্দীপ – শুনুন, মিছি মিছি ভয় পাবেন না! যাতে সে কাজ না হয় সে জন্যই তো আমার আসা এখানে!

অনিমেষ – আচ্ছা আপনি কি নিশ্চিত খুনী কল্যানেশ্বরী সেবা সদনের সেই ঘটনার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য একাজ করছে?

সন্দীপ – নিশ্চিত করে তো কিছু বলা যায় না, তবে পুলিশের অনুমান। (কয়েক সেকেন্ড বাদে) আচ্ছা আপনি কি কখন কোন ভাবে সেই কল্যানেশ্বরী সেবা সদনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

অনিমেষ – আমি? না না! আমি তো ইনফ্যাক্ট এই প্রথম নামটা শুনলাম!

সন্দীপ – তাহলে তো আপনার ভয় পাবার কিছু নেই! যাকগে, আমি একটু সকলের সঙ্গে কথা বলতে চাই। সবাই কে এখানে ডেকে আনা যাবে কি?

অনিমেষ – ঠিক আছে, আপনি বসুন, আমি সবাই কে ডেকে আনছি।


(সুলতা, অনিমেষ স্টেজ থেকে বেরিয়ে যাবে, সন্দীপ এই সময়ে স্টেজে একা থাকবেন। পাশে পড়ে থাকা কোন ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে পড়তে থাকবেন। কয়েক সেকেন্ড বাদে সকলের প্রবেশ)


সন্দীপ – নমস্কার, আমি সি আই ডি অফিসার, সন্দীপ সান্যাল। আপনাদের সকলের কথাই শুনেছি অনিমেষ বাবুর কাছে। অসময়ে এসে পড়েছি, কিন্তু কি করব বলুন আপনাদের নিরাপত্তার খাতিরে পুলিশ তো চুপ করে বসে থাকতে পারে না!

অমরনাথ – আমাদের জন্য নিরাপত্তা? কেন? আমরা কেউ কোন অপরাধ করেছি নাকি?

সন্দীপ – সে সব পড়ে হবে, তার আগে আমাকে একটা কথা বলবেন। আজ থেকে এই বছর দশ – বারো আগে আপনারা কে কে কি করতেন একটু বলবেন আমায়? (অমরনাথের দিকে তাকিয়ে) আপনি শুরু করুন!

অমরনাথ – দশ বছর আগে? বাবা! আমি তখন প্লাস্টিকের ব্যাগ বানাতাম, কলকাতায় থাকতাম। আমাদের একটা ফ্যাক্টরি ছিল, বছর পাঁচেক সে বন্ধ হয়ে গেল।

সন্দীপ – কোথায় থাকতেন?

অমরনাথ – দমদম! আর ফ্যাক্টরি ছিল বেলঘরিয়া!

সন্দীপ – বেশ! আচ্ছা, মজফরপুরের সঙ্গে কোন কানেকশন ছিল কি আপনার?

অমরনাথ – নো স্যার!

সন্দীপ – আচ্ছা আপনি তো মুম্বাই থেকে এলেন, কতদিন ছিলেন মুম্বাই তে?

অমরনাথ – এই তো গত মাসের ২২ তারিখ এসেছি। আমার তো ওয়াসীতে ফেরার কথা! বৃষ্টিতে আটকিয়ে গেলাম।

সন্দীপ – (বিপ্লবের দিকে তাকিয়ে) আপনি কি একটু বলবেন? দশ বছর আগের কথা!

বিপ্লব – আমি তো এখানে থাকতাম না! উগান্ডায় হাতির দাঁতের ব্যবসা করতাম!

অমরনাথ – অ্যাঁ? একেবারে হাতির দাঁতের ব্যবসা?

বিপ্লব – হ্যাঁ, তারপর বছর দুয়েক আগে দেশে ফিরলাম। শরীর আর দিচ্ছিল না, আর ঐ মজফরপুর বললেন, কখনো সেখানে যাইনি। কোন কানেকশন নেই।

সন্দীপ – বেশ! আচ্ছা আপনি যে এই এখানে এলেন কোথা থেকে এলেন?

বিপ্লব – আমি তো এমনিতে মুম্বাইতেই থাকি! আসলে এই মাঝে মধ্যে একটু রেস্ট নিতে এদিকটায় আসি। তা এনারা নতুন হোটেল খুলেছেন, ভাবলাম যাই একটু কাটিয়ে আসি। তাই তো পনের দিন আগে চিঠি দিলাম।

সন্দীপ – ম্যাডাম, এবারে আপনি একটু বলবেন?

জয়তী – দশ বারো বছর আগে আমি কি করতাম সে কথা বলতে আমি বাধ্য নই! তবে শুধু এইটুকু বলতে পারি, হ্যাঁ মজফরপুর আমি চিনি তবে সেখানে গেছি কি রাত কাটিয়েছি কি সেখানে কোন কাজ করেছি, সেসব কথা বলতে পারব না!

সন্দীপ – কেন ম্যাডাম? আপনার বলতে কি আপত্তি আছে?

জয়তী – কেন আপনাকে আমি বলব? আপনি কে?

সন্দীপ – ম্যাডাম আমার পরিচয় তো আপনি আগেই পেয়েছেন, আর আমি আগে বলেওছি আমি এখানে কেন এসেছি। তাহলে বলতে আপত্তি কি আছে?

জয়তী – আপনি যে সত্যি বলছেন তার কোন প্রমান আছে?

সন্দীপ – মানে?

জয়তী – মানে, আপনি যে পুলিশ তার কোন প্রমান আছে?

(সন্দীপ নিজের আইডেন্টিটি কার্ড খুলে দেখায়)

জয়তী – অমন কার্ড দশ টাকা দিয়ে বানানো যায়।

রুদ্রপ্রসাদ – ম্যাডাম কথাটা মন্দ বলেন নি! এই ঝড় বাদলের রাত, চারদিকে এত জল, আপনি কিভাবে এলেন? সাঁতার কেটে? তা আপনার গায়ের জামা কাপড় তো বেশী ভেজেনি! তাহলে আপনি এলেন কিভাবে?

সন্দীপ – দেখুন আপনাদের সবার সেফটির কথা ভেবেই কিন্তু আমার এই প্রশ্ন! আমি চাইনা, গত শুক্রবারের মত আবার এখানে একটা মার্ডার হোক। আচ্ছা, যাকগে, ম্যাডাম আপনি এই এখানে যে এলেন কোথা থেকে এলেন?

জয়তী – আমার বাড়ি তো চেম্বুরে!

সন্দীপ – তাহলে আপনিও গত শুক্রবার মুম্বাইতেই ছিলেন! তারপর শ্রীমান? আপনি তো বাবার সাথে ঝগড়া করে চলে এসেছেন! গত শুক্রবার আপনার মুম্বাইতে যাওয়ার কি প্রয়োজন ছিল?

রুদ্রপ্রসাদ – মানে?

সন্দীপ – মানেটা আপনিই বলুন!

রুদ্রপ্রসাদ – আপনি জানলেন কি করে?

সন্দীপ – আপনার মনে আমাকে নিয়ে সন্দেহ ছিল না! যে আমি পুলিশ কি না? ইত্যাদি, ইত্যাদি! এবার বিশ্বাস হচ্ছে? আমাদের কাছে সব ইনফরমেশন আছে।

রুদ্রপ্রসাদ – আপনার কাছে যদি সব ইনফরমেশন আছে তাহলে জানতে চাইছেন কেন?

সন্দীপ – আপনার মুখ থেকে জানতে চাইছি।

রুদ্রপ্রসাদ – হ্যাঁ, গেছিলাম, আমার এক বন্ধুর কাছে। দিন তিনেকের বেশী থাকা হলো না, তাই সেখান থেকে চলে এলাম এই খানে।

সন্দীপ – থাকা হলো না নাকি বন্ধু থাকতে দিল না?

(রুদ্রপ্রাসাদ চুপ করেই থাকে)

অনিমেষ – কিন্তু হোটেলে ঢোকার সময় আমাদের তো অন্য কথা বললেন! কেন?

সন্দীপ – আসলে নাটক, সিনেমা নিয়ে থাকেন তো! তাই একটু আধটু গপ্প বানাতেই হয়। কি রুদ্রপ্রসাদবাবু? তাই তো? (বাকীদের দিকে তাকিয়ে) এবারে বিশ্বাস হচ্ছে কে পুলিশ? আর কে ভাঁওতা?

অমরনাথ – পুলিশের লোক না হলে এই সব তথ্য জানা যায় না বুঝি?

সন্দীপ – নিশ্চয়ই নয়, তবে এটা কি জানা যায় যে কাপড়ের ব্যবসায় ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে সেলস ট্যাক্সের কোন কর্তাকে আপনি ঘুষ দেওয়ার প্ল্যান করছেন?

বিপ্লব – অ্যাঁ? তার মানে?

সন্দীপ – মানেটা ওনাকেই জিজ্ঞেস করুন!

অনিমেষ – কই আপনি তো আগে কিছু বলেননি!

সন্দীপ – আগে তো উনি কিছুই বলেন নি! এবারে সব বলবেন আস্তে আস্তে!

অমরনাথ – বলতে আমি বাধ্য নই।

সন্দীপ – তাহলে আমি বলি! আগের মাসের ২২ তারিখে আপনি মোটেও আসেন নি। আপনি এসেছেন গত সপ্তাহে। আপনার ভাইপো ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা করছে, সেলস ট্যাক্সের কর্তাকে ম্যানেজ করতে আপনি এসেছেন। দেখা করার কথা ছিল গত কাল, দেখা হয়নি। দুই তিন বাদে আবার যখন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক হবে তখন আপনি এখান থেকে চলে যাবেন।

অমরনাথ – তাহলে কি এটা প্রমাণ হছে চেম্বুরের সেই বুড়িকে আমি খুন করেছি?

সন্দীপ – না হচ্ছে না! কিন্তু যার একটা মিথ্যে ধরা পড়ে গেছে তাতে কি আর বিশ্বাস করা যায়?

অমরনাথ – আপনি বিশ্বাস না করলে কি? আমার কিছু যায় আসে না!

অনিমেষ – কিন্তু আমাদের তো যায় আসে! আপনি এই রকম মিথ্যে বলে ঢুকলেন কেন?

সন্দীপ – মিথ্যে তো আপনি ও বলেছেন অনিমেষ বাবু!

অনিমেষ – মানে? কাকে? কি বলেছি?

সন্দীপ – গত শুক্রবার তো আপনি ও মুম্বাই গেছিলেন! বলেছিলেন সুলতা দেবীকে?

(অনিমেষ চুপ করে থাকে)

সুলতা – তুমি মুম্বাই গেছিলে? কেন?

অনিমেষ – এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার! এটাকে আপনি এর মধ্যে জড়াচ্ছেন কেন?

সন্দীপ – আমি কিছুই জড়াচ্ছি না! খালি এটাই বলছি বিশ্বাস তো আপনাকেও করা যায় না! সুলতাদেবী, আপনাকে জানিয়ে রাখছি অনিমেষ বাবু চুপি চুপি এক মহিলার সঙ্গে প্রেম করছেন! কি তাই তো অনিমেষবাবু?

অনিমেষ – সুলতা আর আমি পার্টনারশিপে হোটেল চালাই, আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার ও জানে না, ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার ও আমি জানি না, মানে জানতে চাইও না!

সুলতা – কিন্তু তুমি তো বলে যেতে পারতে! বললে পুনে যাচ্ছ, কলেজের বন্ধু নাটক করছে সেই নাটক দেখতে! মিথ্যে বললে কেন?

অনিমেষ – সুলতা তুমি আমাকে ঐ চেম্বুরের খুনটা নিয়ে সন্দেহ করছ? বিশ্বাস করো, সেই ব্যাপারটার আমি কিছু জানিনা!

জয়তী – আচ্ছা মিঃ ঘোষাল, খুনীর একটা, মানে কি বলে যেন, মোটিভ থাকবে তো! তাছাড়া খুন করবে কেন?

সন্দীপ – একটাই কমন লিঙ্ক এখনো পর্যন্ত! যারা খুন হয়েছেন তাঁরা সবাই মজঃফরপুরের কল্যানেশ্বরী সেবা সদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন!

জয়তী – তাই নাকি?

সন্দীপ – সেইজন্যই তো বলছি ম্যাডাম, আপনার যদি কোন রকম কানেকশন সেখানে থেকে থাকে সেটা বলে ফেলুন, তাহলে আমাদের সুবিধা হয়।

(সবাই চুপ করেই থাকে, একে অন্যের মুখের দিকে তাকায়)

সন্দীপ – কি ম্যাডাম? ছিল কি?

জয়তী – কল্যানেশ্বরী সেবা সদন? বাবার জন্মে নাম শুনিনি!

বাতিকবাবু – আচ্ছা আমি কি একটা কথা বলতে পারি?

সন্দীপ – নিশ্চয়ই পারেন!

বাতিকবাবু – আপনি কি প্রত্যক্ষ যোগসূত্র বোঝাচ্ছেন নাকি পরোক্ষ?

সন্দীপ – কোনটা হলে আপনার সুবিধা হয়?

(বাতিকবাবু চুপ করেই থাকেন)

সন্দীপ – আগের সপ্তাহে মুম্বাই গেছিলেন কেন?

বাতিকবাবু – আমাকে বলছেন?

সন্দীপ – হ্যাঁ আপনাকে বলছি!

বাতিকবাবু – আসলে মুম্বাইের জলহাওয়া নিয়ে আমি একটু গবেষণা করছি! তাই প্রতি মাসে মুম্বাই যাওয়াটা আমার খুব দরকার! সেই কারণে...

সন্দীপ – ঐ সব ছেলে ভোলানো কথা অন্য লোককে বলবেন, দেখুন একটা জিনিস পরিষ্কার, আগের সপ্তাহে আপনারা সবাই মুম্বাই ছিলেন। আর আমাদের কাছে খবর আছে খুনী কিন্তু এখানে মানে ‘কোহিনুর নিবাসে’ এসে পৌঁছে গেছে। সুতরাং দুয়ে দুয়ে চার করতে আর খুব সমস্যা হবেনা! আর সত্যি বলতে কি, আমার দৃঢ় ধারণা এখানে উপস্থিত এই ক’জনের মধ্যে কেউ একজন খুনী। সেটা কে এখনো জানিনা! তাই আমি চাই আপনারা সবাই নিজের নিজের ঘরে যান, আপাতত খিল এঁটে বসে থাকুন। যাইহোক, কোনমতেই দরজা খুলবেন না! কাল সকালে থানা থেকে বড়সাহেব আসবেন, তারপর ঠিক করা হবে কি করা হবে।


================


চতুর্থ দৃশ্য


হোটেলের রিসেপশন! সুলতা এবং অনিমেষ বসে কথা বলছে, ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে সাড়ে বারোটা।



অনিমেষ – সুলতা তুমি কি রেগে গেছ আমার ওপর?

সুলতা – আমি রাগ করলে কি কিছু আসে যায়? যায় না! তবে আমাকে মিছিমিছি মিথ্যেটা না বললেই পারতে! প্রেম করেছ অন্য কোন অন্যায় তো করনি! তাহলে? এতো লুকোনোর কি দরকার ছিল?

অনিমেষ – না, আসলে্‌... আমি ভাবছিলাম তুমি কি ভাববে? আমি বলতাম সব কিছু ... (অনিমেষকে মাঝখানে থামিয়ে দেয় সুলতা)

সুলতা – যাহোক, কি নাম তাঁর?

অনিমেষ – কার?

সুলতা – বুঝতে পারছো না? যার সঙ্গে দেখা করার জন্য এই ঝড় জল মাথায় নিয়ে তুমি মুম্বাই গেলে!

অনিমেষ – ছাড়ো তো ওসব! আরে এখনো কিছু ঠিক হয়নি!

সুলতা – কিছু ঠিক হয়নি তাতেই এতো ডেডিকেশন! হলে তারপর কি হবে?

অনিমেষ – আচ্ছা শোনো, ছাড়ো ঐ সব কথা! আচ্ছা পুলিশের ব্যাপারটা কি বলো তো? তোমার কি সত্যি লাগছে?

সুলতা – কোন কথাটা?

অনিমেষ – ঐ যে বলছে খুনী এখানে এসে লুকিয়ে আছে! তোমার কি মনে হয় সত্যি?

সুলতা – হলে আর কি বলব বলো! তবে আমার সঙ্গে কল্যানেশ্বরী সেবা সদনের কোন লিঙ্ক ছিল না, কাজেই সেটাই যদি কমন যোগসূত্র হয়ে থাকে তাহলে আমার ওপর কোন আক্রমন হবে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত!

(অনিমেষ চুপ করেই থাকে)

সুলতা – তোমার কি সেখানে কোন যোগাযোগ ছিল?

অনিমেষ – কোথায়?

সুলতা – সেই কল্যানেশ্বরী সেবা সদন?

অনিমেষ – না না আমি কি করে চিনব? আমি জানি না!

সুলতা – তাহলে তুমিই বা ভয় পাচ্ছ কেন?

অনিমেষ – আচ্ছা সত্যি সত্যি এই রকম কিছু হয়েছিল নাকি সেখানে?

সুলতা – কি করে বলি বল? পুলিশ নিশ্চয়ই আগে তদন্ত করেছে, তারপর জানতে পেরেছে!

অনিমেষ – আমার কি মনে হয়য় জানো?

সুলতা – কি?

অনিমেষ – ঐ পুলিশ অফিসার আছে এর মধ্যে! ও আসলে পুলিশ – ফুলিশ কিছু নয়, ঐ মনে হচ্ছে খুনী, পুলিশের ছদ্মবেশে এখানে ঢুকে পড়েছে!

সুলতা – কিন্তু ওঁর কি স্বার্থ? পুলিশ অফিসার যদি খুনী হন তাহলে তো খুন করে ওঁর পালিয়ে যাওয়ার কথা! তাই না! আমাদের এখানে সারা রাত জেগে পাহারা দেওয়ার দরকার কি ছিল?

অনিমেষ – কিন্তু আমাকে একটা কথা বলো, এরকম পুলিশ হয় নাকি? বার বার থেকে নিজের আইডেন্টিটি কার্ড বার করে দেখায়, তারপর দেখো আমরা তো কিছু বলিনি কিন্তু নিজে থেকেই এখানে থেকে পাহারা দিচ্ছে!



(বিপ্লববাবুর প্রবেশ)

অনিমেষ – আরে আপনি?

বিপ্লব – ঘুম আসছে না! তাই নেমে এলাম নিচে।

অনিমেষ – কিন্তু মিঃ সান্যাল তো বারণ করেছেন ঘর থেকে বেরোতে।

বিপ্লব – কেন খুনী আমাকে খুন করবে?

অনিমেষ – তা জানিনা!

বিপ্লব – আমায় কেন করবে বলুন! আমি তো আর সেই কি সেবা সদনে ছিলাম না, আর আমার কাছে কানাকড়িও নেই। খুনী আমার পেছনে কেন পড়বে বলুন? কি সুলতা তাইতো?

অনিমেষ – সুলতা? আপনি সুলতাকে চেনেন নাকি?


(ইতিমধ্যে সন্দীপ সান্যালের প্রবেশ)

বিপ্লব – এইতো সন্দীপও এসে পড়েছ!

অনিমেষ – সন্দীপ?

সন্দীপ – অনিমেষবাবু তো দেখছি ভয়ে একেবারে শুকিয়ে গেছেন?

অনিমেষ – না মানে (বিপ্লববাবুর দিকে তাকিয়ে)! সুলতা সন্দীপ? আপনি এঁদের চেনেন?

সন্দীপ – আচ্ছা অনিমেষবাবু মজঃফরপুরে সত্যি আপনার কোন কানেকশন ছিল না?

অনিমেষ – মানে?

সন্দীপ – মানে, আপনি বলতে চাইছেন না নাকি মনে করতে চাইছেন না!

অনিমেষ – কি বলছেন স্যার?

সন্দীপ – সুলগ্না কে বেহুঁশ তো আপনিই করেছিলেন তাই না? জল চেয়েছিল আপনার কাছে, আর আগে থেকে ক্লোরোফর্ম মেশানো ছিল! তাই না?

অনিমেষ – সুলতা এ’সব কাকে নিয়ে এসেছ? কি বলছে এরা?

সন্দীপ – ভুল বলছি কি?

সুলতা – বেহুঁশ করেই তো মেরে ফেলতে পারতে! অত গুলো জানোয়ার কে অমনটা করালে কেন?

অনিমেষ – মানে?

সন্দীপ – মানে খুব সহজ অনিমেষ বাবু! ও সরি! আপনি তো তখন অনিমেষ ছিলেন না! ছিলেন ধূর্জটি ধর! তাই তো! তারপর সেই জয়সওয়ালের সাহায্যে নতুন আইডেন্টিটি বানিয়ে ফেললেন হয়ে গেলেন নিরীহ অনিমেষ। তাই তো?

অনিমেষ – সুলতা তুমিও আছো এদের সঙ্গে!

সুলতা – সেদিন যে মেয়েটার সর্বনাশ করেছিলে সেই সুলগ্না ছিল আমার বোন!

অনিমেষ – তোমার বোন?

সুলতা – হ্যাঁ অনিমেষ! আমরা সব জানতাম অনিমেষ! সাত মাস আগে যখন হোটেল খুলেছি তখন থেকেই প্ল্যান করেছি!

অনিমেষ – জানতে মানে? কি প্রমাণ আছে?

সন্দীপ – প্রমাণ! তার তো কোন দরকার নেই! আপনাকে আইনের সাহায্যে তো সাজা দেওয়া হবে না! বারো তেরো বছর আগেকার কথা, কোর্টে প্রমাণ করা কঠিন! তাই প্রমানের কোন দরকার নেই তো! এখানেই ফয়সালা হবে!

অনিমেষ – মানে কি করবেন আমার সঙ্গে?

সন্দীপ – ঐ তো দেখুন, প্রস্তুতি চলছে

(বিপ্লববাবুকে দেখায়। বিপ্লববাবু বন্দুকে গুলি ভরছেন)


অনিমেষ – আপনারা সবাই মিলে...

সন্দীপ – হ্যাঁ, আমরা সবাই মিলে। তাই তো প্ল্যান করে সবাই কে আগে ভাগে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি, যাতে করে আপনাকে সরানোর কাজটা সহজ হয়ে যায়।

সুলতা – অনিমেষ, তুমি হয়তো জানো না, হ্যাঁ সুলগ্না আমাদের সবার। আর সন্দীপ ছিল ওর ছোটবেলার বন্ধু, আমাদের বাবা আমাদের ছোটবেলায় মারা গেছিলেন। যাকে বিপ্লববাবু বলে জানো, তিনি আমাদের কাকা! আমাদের দুজনকে উনিই মানুষ করেছেন। আমাদের তিনজনের প্ল্যান করা ছিল।

সন্দীপ – কোন শেষ ইচ্ছা অনিমেষবাবু, থুরি ধূর্জটিবাবু?

(অনিমেষ হতভম্বের মতো বসে থাকে।)


সন্দীপ – নেই তাহলে! (বিপ্লববাবুর দিকে তাকিয়ে) নিন, এবারে আপনার কাজ শেষ করুন!

(বিপ্লববাবুর হাতের বন্দুক গর্জে ওঠে। অনিমেষ মুখ থুবড়ে পড়ে যায়)


বিপ্লব – তাহলে সব কাজ শেষ হল! এবারে হয়তো মেয়েটার আত্মার শান্তি হবে।

সন্দীপ – কাকাবাবু আপনি এখনি বেরিয়ে পড়ুন। এই রাস্তাটায় খুব জল হয়েছে, সেটা পেরোলে আপনি মেন রাস্তা পাবেন। সেখানে একটা কালো রঙের স্করপিও গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পাবেন। ওর ড্রাইভার আপনাকে চেনে, ও আপনাকে পানভেল পৌঁছে দেবে। কাল সকালে, আপনি ট্রেন পেয়ে যাবেন। আপনি চেন্নাই পৌঁছে আমাকে ফোন করবেন তারপর কথা হবে।

(বিপ্লব বেরিয়ে যান)

সুলতা – আর তুমি?

সন্দীপ – চিন্তা নেই! অন্য গুলো যেমন করে সাজিয়েছি এটাকে তেমন করেই সাজাবো! এখনো সাড়ে চার ঘন্টা সময় আছে, অনেক সময়! আর তোমাকে যেমন বলা আছে, সেই মতো তুমি দুই ঘণ্টা বাদে পুলিশ স্টেশনে ফোন করবে। হ্যাঁ, এই বডিটা যেমন আছে থাক, বন্দুকটা আমি নিয়ে নিলাম, তুমি পুলিশকে বলবে তোমাকে অজ্ঞান করে সন্দীপ সান্যাল পিছমোড়া করে বেঁধে রেখেছিল, আর তুমি কিছু দেখোনি! বাকীরা সবাই একই কথা বলবে, পুলিশের সন্দেহ সন্দীপ সান্যালের ওপর যাবে! তারপর দু-চার দিনে বাদে পুলিশ জানবে সন্দীপ সান্যালের কোন অস্তিত্বই নেই!

সুলতা – তুমি এখান থেকে কোথায় যাবে?

সন্দীপ – দেখি! খুব সম্ভব ব্যাঙ্গালোরে, তোমাকে জানাব! আমার টু-টু-নাইন নম্বরটা বন্ধ হয়ে যাবে আজ থেকে! আমার সিক্স-সিক্স-থ্রী তে ফোন করবে! আচ্ছা চলো পেছন ফেরো, হাতটা বাঁধতে হবে তো!

(সন্দীপ সুলতাকে চেয়ারে বসিয়ে বেঁধে ফেলে। তারপর পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে তাতে ক্লোরোফর্ম ঢালে)

সুলতা – এটা?

সন্দীপ – বাহ! ক্লোরোফর্ম করতে হবে তো! ঠিক আছে, জ্ঞান ফিরলে আমাকে ফোন করবে, কথা হবে!

(এইখানে স্থির হয়ে যাবে সবাই)




Opmerkingen


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page