ছোট্ট ভুল
- আবীর গুপ্ত
- Oct 5, 2021
- 5 min read
Updated: Oct 11, 2021
১
সুমিত পাহাড়ি রাস্তায় অত্যন্ত দেখেশুনেই গাড়ী চালাছিল।ওর পাশে ওর স্ত্রী তপতী বসে আছে। তপতীকে মনে প্রানে ঘৃণা করে। তাও সহ্য করে আছে।মুখে কখনও ওর মনের ভাব প্রকাশ করে না।এর একটাই কারন টাকা ।শ্বশুরের অগাধ সম্পত্তির মালিক ও। শ্বশুরমশাই মাস চারেক আগে চলে গেছেন।সমস্ত সম্পত্তি তপতীর হাতে এসে গেছে।কারণ ও একমাত্র সন্তান। ওর মা বছর দুয়েক আগে দেহ রেখেছেন ।কাজেই সম্পত্তি পেতে কোন অসুবিধা হয়নি ।সুমিত ও উকিলের কাছে দৌড়াদৌড়ি করে ওকে সব রকম ভাবে সাহায্য করেছে । মনে তীব্র ঘৃণা চেপে মুখে প্রেমের বুলি আওড়ে গেছে। আর সুযোগের অপেক্ষায় থেকেছে । মনে নানান প্ল্যান করে চলেছে । তপতীকে সরিয়ে দিতে হবে । সমস্ত সম্পত্তি তাহলে অর হাতের মুঠোই চলে আসবে। ওদের অল্টো গাড়িটার ও একটা মোটা অ্যামাউন্টের অ্যাকসিডেন্ট পলিসি করিয়ে রেখেছে। কিছু মেয়ে থাকে তারা একজনের সাথে সম্পর্ক রাখতে পছন্দ করে না।তারা বহু ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলে ।তাদের সঙ্গে ডেটিং করে, দৈহিক সম্পর্ক তৈরি করে। তপতী এধরনের মেয়ে।সুমিতের সঙ্গে বিয়ে পরও আরও বারো চোদ্দ জনের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক রেখে চলেছে ।সুমিত সবই জানে কারন ও যে ডিটেকটিভ এজেন্সিকে তপতীর খোঁজখবর নেওয়ার জন্য তারাই এ খবর দিয়েছিল।সুমিত অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর তপতীও বেরিয়ে যায়।প্রতিদিনই চলে যায় কোন না কোন লাভারের কাছে।হয় ওদের ফ্ল্যাট যায় অথবা হোটেলে গিয়ে ওঠে ।সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফেরে।লাভার দের নাম ঠিকানা ছবি সবই সুমিতকে ওই ডিটেকটিভ এজেন্সি যোগাড় করে দিয়েছে।প্রথমে ভেবেছিল তপতীকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে।পরে ভেবে দেখেছে তাতে ওরই ক্ষতি।তার জায়গায় তপতীকে খুন করতে পারলে ওর হাতে সব সম্পত্তি চলে আসবে। খুন এমনভাবে করতে হবে যাতে খুন টা খুন বলে মনে না হয়।গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট এ তপতীর মৃত্যু হলে কেমন হয় ? যেমন ভাবা তেমনি কাজ। প্ল্যান ছকে ফেলল । গাড়িতে করে সিকিম যাওয়ার প্রস্তাব করল তপতীকে।তপতী রাজি হয়ে গেল।ব্যাস এবার প্ল্যান এক্সক্লুসিভ করার পালা।তপতীকে পাশে বসিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে এল গ্যাংটকে।ওর প্ল্যান ছাঙ্গু লেক দেখতে যাওয়ার পথে ফেরার সময় অ্যাকসিডেন্ট টা ঘটাবে ।কোথায় অ্যাকসিডেন্ট টা হবে সে টা ও আগে এসে দেখে গেছে।এখন অফ সিজন চলছে ।ছাঙ্গুর রাস্তায় এখন গাড়ি চলাচল খুব কম তাই ওর মনে হয়েছে তাই ওর মনে হয়েছে কোন অসুবিধা হবে না।
২
ছাঙ্গু লেক থেকে ফেরার পথে যে জায়গা টা ও অ্যাকসিডেন্ট ঘটানোর জন্য পছন্দ করেছে সেখানে রাস্তা টা বেশ চওড়া।বাঁ পাশে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে।পাহাড়ের গায়ে রাস্তার গা ঘেঁসে একটা বড় বোল্ডার পড়ে আছে। জোরে গাড়ি চালিয়ে এসে ধাক্কা মারবে।গাড়ি যদি এই ধাক্কায় ঘুরে ও যায় তাহলে রাস্তার ডানদিকে থাকা খাড়া দেওয়ালে প্রতিহত হয়ে আটকে যাবে।গাড়ির খাঁদে গড়িয়ে পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই।ছাঙ্গু থেকে ফেরার সময় প্রথমে দেখে শুনেই গাড়ি চালাছিল ,পরে গাড়ির গতি বাড়াল।তপতীকে বলল বিকাল হয়ে আসছে,অনেক টা পথ যেতে হবে,অন্ধকারে গাড়ি চালাতে অসুবিধা হবে তাই স্পীড বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে।তপতী যে ওর গাড়ি চালান দেখে ভয় পাচ্ছে তা সুমিত ওর মুখ দেখে বুঝতে পারল।ও মনে মনে খুশিই হল।গাড়ি পাহাড়ি রাস্তাই আশি মাইল বেগে চালাতে চালাতে নির্দিষ্ট জায়গায় বাঁ দিকে থাকা পাথরে ধাক্কা লাগল ।ওর সিট বেল্ট লাগান ছিল বলে স্টিয়ারিং এর সঙ্গে কোনোরকম ধাক্কা না লাগলে ও বাঁ দিকে ওর পাশে বসা তপতীর আঘাত লাগল।বাঁ দিকে দরজা ভেঙ্গে খুলে তপতী ছিটকে পরে গেল রাস্তার পাশে জল যাওয়ার ড্রেনে । ডানদিকের দরজা কিন্তু অক্ষত আছে ,সমস্ত চোট টা বাঁ দিকের উপর দিয়ে গেছে।সুমিত ধীরে সুস্থে গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেল তপতীর পরে থাকা দেহের দিকে।যেভাবে দেহ টা পড়ে আছে তাতে ও নিশ্চিত যে তপতী আর বেঁচে নাই। খুশি মনে এগিয়ে গিয়ে উপুর হয়ে থাকা শরীর টা উল্টে দিল।নিশ্চল শরীর টা পা দিয়ে একটা লাথি কষালো ।মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার জন্য নাকের কাছে হাত টা নিয়ে যেতে ই আঁতকে উঠলো, নিশ্বাস পড়ছে।অর্থাৎ তপতী বেঁচে আছে ,ভাল করে দেহের দিকে তাকিয়ে দেখল,মাথায় অল্প চোট পেয়েছে,অল্প রক্ত ও বেরচ্ছে।সুমিত কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না।খেয়াল করল তপতীর ধীরে ধীরে সেন্স ফিরছে।ধীরে ধীরে চোখ খুলল,অকে সামনে দেখে বহু কষ্টে বলল- “ মাথায় অসহ্য ব্যাথা হচ্ছে “।সুমিত প্রথমে ভাবল টেনে একটা লাথি কষাবে,নিজেকে বহু কষ্টে সামলাল।টেনশনে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরাল।ধোঁয়া ছাড়ার সময় তপতীর দেহের পাশে পড়ে থাকা একটা পাথরের উপর চোখ পড়লো।সঙ্গে সঙ্গে মাথায় আইডিয়াটা মাথায় এল।হাতের সিগারেট টা ফেলে পাথর টা তুলে নিল।অত্যন্ত জোরে পাথর টা দিয়ে যখন আঘাত করতে যাচ্ছে তপতীর বিস্ময় ভরা মুখ টা দেখে খুশি হল।এক আঘাতেই তপতীর মৃত্যু হল।
৩
অ্যাকসিডেন্টের খবর টা লোকাল থানায় ইনফরম করতে হবে।ওর কাছে গ্যাংটকের থানার নম্বর আছে।সেখানেই ফোন করে অ্যাকসিডেন্টের খবর জানিয়ে সাহায্য চাইল। ওরা ওকে জানাল ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই সাহায্য আসছে। ওরা একজন অফিসারকে পাঠাচ্ছেন।এই সময় টা টেনশনে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে কাটিয়ে দিল।অবশেষে পুলিশ জিপে একজন অফিসার আর দুজন কনস্টেবল পৌঁছল।সুমিত জানতে পারলো অফিসারের নাম অর্জুন থাপা । উনি প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে সুমিতকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। তপতীর দেহ খুঁটিয়ে দেখলেন।বডি পোস্টমর্টেমে পাঠানোর ব্যাবস্থা করে ডেড বডির আশেপাশের সব কিছু খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলেন।সুমিত অল্পবয়সী এই পুলিশ অফিসারের অ্যাক্টিভিটিস দেখতে দেখতে ভাবছিল ও যে তপতীকে খুন করেছে তা কারর পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। অবশেষে বডি পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে সুমিত কে বললেন “ আপনাকে আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে ,আপনার কাছ থেকে আর ও অনেক কিছু জানার আছে”।
থানায় ওকে বসিয়ে অর্জুন থাপা একি কথা বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করছিলেন- কিভাবে তপতীর মৃত্যু হয়েছে ? ওর উত্তরে যে অফিসার সন্তুষ্ট নন , তা সুমিত ওর মুখ দেখেই বুঝতে পারছিল না।সুমিত একই উত্তর বার বার দিতে দিতে বিরক্ত হয়ে উঠছিল।মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো।এই সময়ে উত্তেজিত হয়ে একটা বেফাঁস কথা বলে ফেললেই বিপদ।মাথা ঠাণ্ডা রাখা কষ্টকর হয়ে উঠছিল।বুঝতে পারছিল ওকে উত্তেজিত করে বেফাঁস কথা বলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন অফিসার।ফাঁদে পা দেওয়া চলবে না।ওদের কথাবার্তা যে টেপ রেকর্ডারে যে রেকর্ড করা হচ্ছে তা ও খেয়াল করেছে।অবশেষে ওকে হেসে বললেন,আপনি যতই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আঁটঘাট বেঁধে নামুন না কেন ,আমরা সবই বুঝতে পেরেছি। আপনার স্ত্রী কে খুন করার জন্য আমরা আপনাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হচ্ছি।
৪
সুমিত এরকম পরিস্থিতি যদি আসে তাই আগে থেকে এক ক্রিমিনাল ল’ইয়ারের সাথে যোগাযোগ করে রেখেছিল।তাকে ফোন করে জানাল যে পুলিশ ওকে ওর স্ত্রীকে হত্যা করার অপরাধে গ্রেপ্তার করছে।ও নির্দোষ। এটা নেহাতই একটা অ্যাকসিডেন্ট । ভদ্রলোক সব শুনে বললেন কেস তা উনি নেবেন।দু একদিনের মধ্যেই উনি গ্যাংটকে আসছেন ।গ্যাংটকে এসে যা যা করনীয় তা করবেন। শশধর সান্যাল একজন প্রতিষ্ঠিত ক্রিমিনাল লইয়ার ।জীবনে মাত্র দুটি মাত্র কেস তিনি হেরেছেন।সেটাও হারতেন না যদি তার ক্লায়েন্ট তাঁর কাছে বেশ কিছু তথ্য না লুকাত।গ্যাংটকে এসে সুমিতের সাথে কথা বলে, পুলিশের সাথেও কথা বললেন।স্বাভাবিক ভাবেই পুলিশ কিছু বলল না। উনি ঝানু উকিল। সুমিতের সঙ্গে কথা বলে বুঝে গেলেন ,সুমিত সব কথা ওনাকে খুলে বলেন নি ,বেশ কিছু কথা ওকে গোপন করেছে।সুমিত খুনটা করেছে বলেই ওর সন্দেহ।কেস টা হাতে নিয়ে ফেলেছেন ,এখন পিছানোর আর উপায় নেই।কেস টাকে জেতার জন্য যা যা করনীয় সবই উনি করলেন।সুমিতকে বার বার করে জিজ্ঞাসা করে নিজের মত করে বুঝে নিয়ে সুমিতকে বলে দিলেন আদালতে কি বলতে হবে।সুমিত শশধর বাবুর সঙ্গে কথা বলে অনেক টা নিশ্চিন্ত বোধ করছিল।
কোর্টে যেদিন শুনানি সেদিন সকাল থেকেই সুমিত বেশ টেনশনে ছিল।যথারীতি সওয়াল জবাব শুরু হল।সুমিতকে কাঠগড়ায় তোলা হল।সরকারি পক্ষের উকিলের প্রশ্নবাণ ওকে প্রায় নাস্তানাবুদ করে তুলল।ওর উকিলের পরামর্শ মত ঠাণ্ডা মাথায় ও সব প্রশ্নের উত্তর দিল।এরপরে ডাকা হল ইনভেস্টিগেটিং অফিসার অর্জুন থাপা কে।সরকার পক্ষের উকিলের সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর আসামী পক্ষের উকিল শশধর সান্যাল কে ডাকা হল।তিনি প্রথমেই প্রশ্ন করলেন ঠিক কিসের ভিত্তিতে আপনার মনে হচ্ছে যে সুমিত বাবুই ওর স্ত্রী কে খুন করেছেন ? অর্জুন থাপা জবাব দিলেন – “ স্যার মাটিতে পড়ে থাকা যেকোনো মাঝারি মাপের পাথরের দুটো দিক থাকে ।একটা নীচের দিক যেটা মাটির দিকে লেগে থাকে আর একটা উপরের দিক।সুমিতবাবুর স্ত্রী তপতী দেবী গাড়ি থেকে ছিটকে পাথরের উপরে পড়ে মাথায় চোট পেলে পাথরের উপরের দিকে রক্ত লেগে থাকত ।অথচ অ্যাকসিডেন্ট এর স্পটে একটা মাঝারি মাপের পাথরের নীচের দিকে রক্ত লেগে ছিল।এর অর্থ একটাই ,সুমিত বাবু ওই পাথর দিয়ে ওঁর স্ত্রীর মাথায় আঘাত করে খুন করেছেন।পাথরটায় মার্ডার উইপন।পাথরটার গায়ে সুমিতবাবুর আঙ্গুলের ছাপ ও পাওয়া গেছে।পাথরের নীচের দিকে লেগে থাকা রক্তের অ্যানালিসিস করে দেখা গেছে ওই রক্ত তপতী দেবীর ।
এরপর প্রশ্ন করার মত মানসিকতা শশধর বাবুর ছিলনা।উনি নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পরলেন।সুমিত সবই শুনছিল ।অর্জুন থাপার কথা শুনে ভেঙ্গে পরল।একটা ছোট্ট ভুল ই ওকে ফাঁসিয়ে দিল। ইশ! যদি পাথরটা তুলে আঘাত করার সময় উলটো দিক দিয়ে আঘাত করত, তাহলে হয়ত----।
Comments