top of page

“চুরি গেছে শৈশব”

  • সৌরভ ব্যানার্জী
  • Sep 22, 2021
  • 4 min read



(আজকের লেখা সেইসব শিশুর জন্যে যাদের শৈশবের অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে এই অতিমারি। )


সুজন পেশায় শিক্ষক । স্ত্রী ইরা আর কন্যা তিন্নি কে নিয়ে তার বেশ ছিমছাম ছোট্ট সংসার । তিন্নি এখন ক্লাস ফাইভ । কোভিট কেড়ে নিয়েছে তার স্কুলে যাবার অধিকার , গত বছর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তিন্নিকে ভর্তি করা হয়েছিল এই শহরের নামী মিশনারি স্কুলে । বেচারা তিন্নি নতুন স্কুলে একদিনও ক্লাস করতে পারে নি । অনলাইনে ক্লাস চলছে বটে কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই সুজন লক্ষ্য করছে যে তিন্নির পড়াশুনোতে একদম মন নেই কেমন অমনযোগী হয়ে যাচ্ছে তাদের তিন্নি আর ঠিক এই কারনেই ইরার মেজাজটাও আজকাল বেশ চরমে চড়ে থাকছে । এই তো সেদিনের সকালের কথা বেশ কিছুক্ষণ থেকেই একটা কবিতার প্রশ্ন উত্তর ঠিক করে বলতে পারছে না তিন্নি ...


- ওঠ পড়তে হবে না । উঠে যা ।

- সরি মাম্মা । বলছি ...

- কিসের সরি ওঠ , সকাল থেকে পড়ে আছি একটা কবিতা নিয়ে । তোকে পরীক্ষা দিতে হবে না এইবছর । তোকে এই ক্লাসেই রেখে দেব আমি । যা ওঠ । তোর কিছু হবে না আমি বুঝে গেছি ... ওঠ ।।


তিন্নি গুটিসুটি মেরে বসে থাকে , তবু উঠে যায় না। ইরা এইবারে তিন্নির বই গুলো নিয়ে উঠে যায় । সুজন নিজের স্কুলে অনলাইন ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত ছিল । ক্লাসের মাঝেই সে একবার ঘুরে দেখে যায় পরিবেশ গরম । ইরার মেজাজ আজকে একদম সপ্তমে উঠে আছে । দুপুরের খাওয়াটাও সেদিন ঐ বাড়িতে তেমন জমল না তিন্নি যে মাছ টা খেল না ভালো করে সেটা দেখেও ইরা গুম হয়েই থাকল । খাওয়ায় পরে বিছানায় অন্য দিন তিন্নি ছটফট করে সেদিন বিছানার এককোণে কেমন ভয় পেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সাত তাড়াতাড়ি । ইরা অন্য দিন তিন্নির পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সেদিন বেডরুমে গেলই না । ড্রয়িং রুমের সোফায় আধশোয়া হয়ে চোখ বুজে শুয়ে থাকল । সুজন আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিজের স্টাডি ছেড়ে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ায়।

- কি গো ঘুমাবে না আজকে ?

ইরা চোখ বুজেই মাথা নাড়ে তার চোখের কোল বেয়ে টপ টপ করছে গড়িয়ে পড়ছে জল ।

- ঐ দ্যাখ মন খারাপ করে । ওঠ ওঠ উঠে বস ।

তবু চোখ বন্ধ করে থাকে ইরা । সুজন এবার ইরার হাতে আলতো করে চাপ দেয় ।

- ওঠ ... উঠে বস । শোনো না একটা কথা জিজ্ঞেস করি তোমায় ...

ইরা উঠে বসে এখনো তার চোখ লাল ।হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে সে চোখের জল মুছে নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সুজনের দিকে ।


- ইরা তোমার মনে পড়ে এই আমাদের তিন্নি এখন যে বয়সের সেই সময়ের তোমার ছোটবেলাটা কেমন আনন্দের ছিল ??

- হুমম ...

- আমাদের তিন্নিকে কি আমরা সেই আনন্দ দিতে পারছি ইরা ?

- কি কম রেখেছি আমরা ওর ? এত ব্যবস্থা আমার ছোটবেলায় ছিল ?

- ওকে আমরা অনেক স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছি ইরা সেটা কোনভাবেই ও আনন্দে থাকবে এই গ্যারান্টি দিতে পারে না । আচ্ছা আমরা ওকে স্কুলে যেতে দিতে পারছি ?

- সেটা কি আমাদের দোষ ?

- না ইরা একদম নয় । সেটা এই সময়ের অভিশাপ কিন্তু এর জন্যে যে ছোট শিশুগুলোর শৈশব অজান্তেই হারিয়ে যাচ্ছে । আচ্ছা তোমার মনে পড়ে স্কুলে আমরা কত আনন্দ পেতাম ? ক্লাসের ফাঁকে দুষ্টুমি প্রাণের বন্ধুদের সাথে আড্ডা রবিবার দিনটা কি করে পের হয়ে সোমবার আসবে তার অপেক্ষা করতাম । পড়াশুনো ছাড়াও বাচ্চারা স্কুলে একটা বিরাট জগৎ পায় ... সেটা ওদের নিজেদের জগৎ সেটা কি আমরা এই মুহুর্তে কোনভাবে আমাদের সন্তানকে দিতে পারছি ?

- তাই বলে তিন্নি পড়বে না ?

- একদম না নিশ্চয় পড়বে কিন্তু একটু পড়া না পারলে আমরা এরকম রাগ করলে ও বেচারা কোথায় যাবে ? হতেই পারে ওর পড়াশুনো একটু হোঁচট খাচ্ছে ... তাতে কিছু আসে যায় না বিশ্বাস কর ইরা । গোটা জীবনের কাছে একটা দুটো বা তিনটে বছরের অমনযোগিতা এমন কিছু ক্ষতি করতে পারে না ।

- দু তিন বছর পরে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে ?

- সেই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না ইরা ।আমিও না আমাদের শুধু এখন অপেক্ষা করতে হবে সুস্থ হয়ে ওঠা পৃথিবীর জন্যে এবং যতদিন সেইটুকু না হচ্ছে নিজের সন্তানের অমনোযোগিতা কে একটু ক্ষমা করে দিতেই হবে , ওর মন ভালো থাকার কথা নয় ইরা ... ও খেলতে পারছে না , কারুর সাথে মিশতে পারছে না । ঘরবন্দী অবস্থায় কি কারুর ভালো লাগে বলত ? আমরা এই অবস্থায় পড়লে কি ভালো থাকতাম একবার ভেবে দেখ তো।

- জান... আমারও আজকাল কিছুই ভালো লাগে না । এই অবস্থা থেকে আমরা মুক্তি পাব তো ?

- নিশ্চয় পাব আচ্ছা সেই মানুষ গুলোর কথা ভাব তো যারা সেই আগের মহামারীর গুলোর সময় ঘরবন্দী হয়ে জীবন কাটিয়েছে। তখন তো বিজ্ঞান জীবনকে এত স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারত না ইরা । তারা তো সেই কঠিন সময় পেরিয়ে আসতে পেরেছিল তাহলে আমরা পারব না কেন ?

- তুমি কি করে এত পজিটিভ থাক বলতে পারবে ? -এছাড়া তো আর কোন রাস্তা খোলা নেই ইরা ।আমি জানি আমরা কেউ ভালো নেই কিন্তু ভালো না থাকলেও ভালো থাকার চেষ্টা থেকে পালালে চলবে কি করে আমাদের ? মা বাবা হয়ে সন্তানের মন ভালো রাখতে না পারলে সে দায় কোথাও গিয়ে আমাদের উপরেই পড়ে .... যে।

- আজ থেকে তিন্নিকে তুমি পড়াও । আমি আর পারছি না ঠিক । - পড়াতেই পারি কিন্তু আজকের পরে তুমি পড়ানো ছেড়ে দিলে ওর মনখারাপ হয়ে যাবে । একটা শিশুর বাবা আর মা দুজনকেই তো সমান দরকার।তুমি পড়ানো টা ছেড়ে দিও না... দেখ না তিন্নি ঠিক পারবে । তুমি শুধু একটু মাথাটা ঠাণ্ডা রেখ ... প্লিজ।


সেদিন সন্ধ্যে বেলায় তিন্নিকে ইরাই পড়তে বসায়।এই বেলা সে একদম লক্ষ্মী মেয়ে খুব মন দিয়ে পড়াশুনো করছে তিন্নি । ইরাও সেই কারনে বেশ ফুরফুরে , পড়া প্রায় শেষের মুখে এমন সময় তিন্নি ...

- মাম্মা

- বল

- পোয়েমের কোশ্চেন আন্সার গুলো ট্রাই করি একবার ।

- কোনটা মাম্মা ?

- সকালে যেটা পারছিলাম না বলে ইউ গট আংরি ।

- করবে ... কর... ভয় নেই না পারলে বকব না ।


কি আশ্চর্য এইবারে তিন্নি সবগুলো উত্তর ঝরঝর করে বলে দিল কোথায় একটুও না হোঁচট না খেয়ে।

Comments


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page