গল্প - শিউলিকথা
"বাবা, নিন চা খেয়ে নিন। আজ মালী কাকাকে বলেছি ওই আপনার শিউলি গাছটা এসে কেটে দেবে। ওখানে বরং শীতের ফুলের বাগান করবো আমরা।" - বলতে বলতে চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে হনহন করে হাঁটা লাগায় পিয়ালী।
"বৌমা, শোন।" - বলে ডেকেও মুখটা ফিরিয়ে নেন শরৎবাবু। বলেন -"না, থাক্।" ভাবেন -"কি লাভ ওর হাতে পায়ে ধরে। ওনার কথার মান তো রাখবে না। বলে শুধু মুখ খারাপ হবে।"
চায়ের কাপটা টেবিলেই রেখে, সামনে রাখা বাড়ির চপ্পলটায় পা গলিয়ে শরৎবাবু এসে দাঁড়ান বাগানে। একদম শিউলি গাছটার কাছে। গাছের একটা ডাল আজকাল ঝুঁকে পড়ে ওনার কাঁধে। বেশ লাগে কিন্তু ব্যাপারটা। যেন একাত্ম হতে চাইছে ওনার সঙ্গে সে। জানাচ্ছে হৃদয়ের হৃদ্যতা।
ধীরে গাছটার গুড়িতে হাত দেন। একসঙ্গে অনেক স্মৃতি ভিড় করে আসে তাঁর মনে। চশমাটা ঝাপসা হয়ে আসতে চায়। এ গাছটা যে অনেক মুহুর্তের সাক্ষী তাঁর জীবনের। আর শুধু তাঁর নয়, মীরার, তাঁর মীরার জীবনের।
মনে পড়ে যায় সেই বিয়ের আগের কথা। মীরাকে দেখতে যেদিন ওদের বাড়িতে গিয়েছিলেন, তখন এক দেখায় পছন্দ হয়ে যায় তাঁর মীরাকে। একটু দুজনে আলাদা কথা বলার অনুরোধ জানালে, রাজি হয়ে যায় মীরার পরিবার। তখন মীরাই ওনাকে নিয়ে গিয়েছিল পেছনের বাগানে। কথা বলতে বলতে বলে মীরা -"শুনুন, একটা কথা বলবো, যদি কিছু মনে না করেন।"
অবাক হয়ে শরৎবাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন -"নিশ্চয় বলবেন। তাই জন্য তো বাইরে আসা।"
কথাটা বলেও মনের মধ্যে কেমন যেন দুন্দুভি বাজছিল সেদিন শরৎবাবুর -"এখন কি বলতে চলেছে মীরা তাকে।"
মীরা তখন ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়েছে একটু। শরৎবাবুও যায় পেছন পেছন।
এই কচি শিউলি চারা গাছটার কাছে এসে, মুখটা নামিয়ে যেমন মা শিশুকে আদর করে তেমন করেই গাছটার কাছে মুখ নিয়ে মীরা বলে, "এই গাছটা আমার বড় প্রিয়। এর সঙ্গে আমার আত্মার যোগাযোগ। আমি কি এ গাছটা সঙ্গে করে আপনার বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি?"
শরৎবাবু একটু ফিক করে হেসে ফেলেছিলেন সেদিন মীরার এ প্রস্তাবে। তারপর হেসে বলেছিলেন -"নিশ্চয় পারেন। ওটা তো এখন আপনারও বাড়ি হবে। আপনার যা গাছ ইচ্ছে নিয়ে যাবেন।"
গাছটাও যেন এই উত্তরে আনন্দে নেচে উঠেছিল। মীরা শরৎবাবুর দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করে বলেছিল -"দেখুন, আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে।"
শরৎবাবু ঈষৎ হেসেছিলেন। কিন্তু সেদান বোঝেননি গাছের কথা।
সত্যিই যেদিন মীরার গৃহপ্রবেশ হল প্রথমবার ওনার বাড়িতে, ওর হাতে যত্ন করে মোড়া ছিল ওই শিউলি গাছের চারা, যা ওর সঙ্গে যেন সেদিন বিয়ে হয়ে এল শরৎবাবুর এই বাড়িতে।বিয়ের অনুষ্ঠানের পরে ক্লান্ত শরৎবাবু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তাড়াতাড়ি। পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে দেখেন সামনের বাগানে গেটের এক পাশে যত্ন করে মীরা লাগাচ্ছে তার আগের দিন আনা ছোট শিউলি গাছটা। সামনে গেলে চমকে তাকায় মীরা।
"তুমি এত ভোরে ওঠো রোজ?" - হেসে জিজ্ঞেস করে মীরা।
"হ্যাঁ এ আমার ছোটবেলার অভ্যাস। আর তুমি? নতুন জায়গায় ঘুম হয়েছিল রাতে?" - জিজ্ঞেস করেন শরৎবাবু।
"হুম!! গাছটা রাখা ছিল বলে একটু চিন্তায় ছিলাম। আজ এটা পুঁতে দিয়ে বেশ নিশ্চিন্ত লাগছে।" - বলে মীরা।
একটু হাসেন শরৎবাবু গাছটার দিকে তাকিয়ে। এরপর প্রতিদিন মীরার তত্ত্বাবধানে এই গাছটাও বেড়ে ওঠে তাদের চোখের সামনে। মাঝে মাঝে শরৎবাবুর একটু হিংসে হতো গাছটার প্রতি। আসলে মীরার ভালবাসার স্পর্শ মনে হতো বুঝি ভাগ হয়ে যাচ্ছে। মীরার গাছের প্রতি ভালবাসা বড়াবড় মুগ্ধ করতো ওনাকে। আর এই শিউলি গাছটা তো যেন মীরার বন্ধু ছিল। মীরার সব সুখ দুখের কথা সে বলতো এই গাছটার কাছে এসে আর গাছটাও যেন সব শুনতো। মীরা যেন বুঝতো ওই গাছটার ভাষা। হাওয়ার দোলায় নেচে ওঠা কোমল পল্লবদল যেন মীরাকে শুনিয়ে যেত নানা কাহিনী। আর যখন শরৎকালে ফুলে ফুলে ভরে থাকতো ওর শাখা প্রশাখা, সে কি আনন্দ মীরার। বারবার বলতো -"দেখো শিউলি কিরকম সেজেছে!!"
উৎসাহ দিতে হাসতেন শরৎবাবু। মীরা রাতে শুয়ে ও বলতো -"পাচ্ছ, শিউলির সুবাস? খুব আনন্দে আছে ও আজকাল"
শরৎবাবু ও কবে যে মনে মনে শিউলিগাছটাকে বাড়ির সদস্য হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন নিজের অজান্তে, তা খেয়াল হয়না। একবার ঝড়ের রাতে ঘুম থেকে উঠে এসে গাছটার ওপরে একটা পলিথিন লাগিয়ে গিয়েছিলেন। মীরার সে কি আনন্দ তা দেখে পরেরদিন সকালে।
কিছু বছরের মধ্যে শরৎবাবুও ভালবেসে ফেলে ওই গাছটাকে। সত্যি কোন আনন্দের দিনে ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিত গাছটা তাদের। আর দুঃখের দিনে যেন ওই গাছের হাওয়া দিয়ে যেত একটু স্পর্শ। লক্ষ্য করে দেখেছে শরৎবাবু, কোন দুঃখে কেমন যেন সত্যি মুষড়ে পড়তো তাদের শিউলি গাছটা। মেয়ে বড় হয়ে যখন বিয়ে হয়ে গেল, খুব ইচ্ছে ছিল এই গাছটা সঙ্গে নিয়ে যাবে। শেষে মায়ের কথা ভেবে নিয়ে যায়না, কারণ এখন সে গাছ বড়, পাছে নিয়ে যেতে গিয়ে কোন ক্ষতি হয়। তাছাড়া মায়ের যে চির সঙ্গী এই গাছ।
মীরা যেদিন এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যায়, সেদিন শরৎ কাল না হলেও, বেশ কিছু ফুল ফুটেছিল গাছটাতে। শরৎবাবু নিজে গিয়ে ফুল কটা তুলে এনে তা দিয়ে দিয়েছিল মীরার হাতের মুঠিতে। শরৎবাবু জানে গাছটা সেদিন খুব কেঁদেছিল মীরার বিচ্ছেদে, ঠিক শরৎবাবুর মতই।তাইতো অসময়েও বন্ধুর বিদায়পথ সুবাসিত করতে ভুলে যায়নি সে। আর তারপর প্রায় একবছর কোন ফুল হয়নি গাছটায়। যেন প্লিয়জনের শোকে গাছটা অশৌচ পালন করছে, এমন বলতো সকলে।
তারপর থেকে নিজে হাতেই গাছটার যত্ন নেন শরৎবাবু। মীরার মত করে না পারলেও, চেষ্টা করেন যথাসাধ্য। গাছটা আজ ও যেন মাথা নত করে দাঁড়িয়ে তার সামনে। চোখটা মুছে গাছটার ওপরে হাত বোলায় শরৎবাবু। এতদিনের বন্ধুকে বিদায় জানাতে কি কারো মন চায়। কিন্তু গতকাল এই গাছের কোন পোকা লেগে যে তার নাতনির হাতে র্র্যাশ হয়েছে। তাইতো বৌমা এই গাছ কাটার বিধান আজ শুনিয়ে গেল তাঁকে সকাল সকাল এসে।
মাথায় হাত দিয়ে গাছটার নীচে বসে পড়েন শরৎবাবু। তখনই দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে ছোট্ট তিতলি। মেয়েটার মায়া মাখা মুখের আদল একদম মীরার মত। আর নাতনি ও তার ঠাম্মির মতই গাছ পাগল। নিজের জন্মদিনে পর্যন্ত প্রতিবার একটা করে গাছ কেনে আর লাগায় এই বাগানে।
শরৎবাবুর মেয়ে মজা করে বলে -"বাবা, তিতলি হয়ে মাই তোমার কাছে ফিরে এসেছে গো। তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না তো আর শিউলিকে ছেড়েও?"
তিতলি এসে বলে -"দাদু, ও দাদু তুমি কাঁদছো কেন?"
"না, সোনা। কাঁদবো কেন? এমনি এখানে একটু বসে আছি। তোমার হাতটা এখন কেমন আছে?" - প্রশ্ন করেন শরৎবাবু।
"গতকাল ওষুধ লাগিয়ে সেরে গেছে একদম। দেখো।" - বলে নিজের হাতটা খুলে ধরে সে দাদুর কাছে।
"হ্যাঁ, তাইতো।" - বলে আস্তে হাত বুলিয়ে দেন শরৎবাবু নাতনির হাতে।
"তোমার কি শিউলির জন্য কষ্ট হচ্ছে, দাদু?" - এবার প্রশ্ন করে তিতলি।
"তা একটু হচ্ছে বৈকি, দিদিভাই। শিউলি যে এ বাড়িতে আমাদের সাথে আছে তোমার জন্মেরও অনেক আগে থেকে।" - বলেন শরৎবাবু।
"শিউলি তো আছে আর থাকবে আমাদের সাথে সবসময়। তুমি ভেবো না।" - বলে তিতলি।
"সেকি? তোমার মা যে বলল আজ মালী দাদু এসে কেটে দেবে গাছ।" - বলেন শরৎবাবু।
"না,না। তা হবে না। আমি হতে দেব না। আমি বলেছি মালীদাদুকে কিছু ওষুধ এনে আজ গাছে লাগিয়ে দিতে, তাহলেই সব পোকা মরে যাবে।" - বলে হাসে তিতলি।
"এবার তো হাসো তুমি। আসলে মাকে বললাম, আমার একদিনে এত কষ্ট হল ওই পোকাতে, তবে এই গাছটা কি করে এতদিন থাকছে এত কষ্ট সহ্য করে? আর পোকা মারাটাই এখানে সঠিক সমাধান, গাছ কেটে ফেলা না। আমাদের পায়ে ব্যাথা হলে কি ডাক্তার পাটা কেটে দেন?" - বলে চলে তিতলি।
আজ সকালের আলোতে শরৎবাবুর মনে হয় ছোট্ট তিতলি নয়, এ সত্যিই যেন তার সামনে বসে মীরা কথা বলছে তার সঙ্গে। সেই গাছের প্রতি টান তিনি স্পষ্ট অনুভব করছেন আজ তিতলির মধ্যে।
"তুমি তো ঠিক বলেছো, দিদিভাই।" - বলে হাসেন শরৎবাবু।
"দেখো দাদু কেমন পাতাগুলো নড়ছে। অন্য কোন গাছ কিন্তু নড়ছে না হাওয়ায়।" - অবাক হয়ে বলে তিতলি।
"হুম, দিদিভাই, ও যে তোমাকে ধন্যবাদ বলছে।" - হেসে বলেন শরৎবাবু।
"ওমা, তাই!! তুমি কি করে জানলে?" - জিজ্ঞেস করে তিতলি।
"তোমার মত আমার এক বন্ধু আমাকে যে শিখিয়েছিলো গাছেদের ভালবাসার কথা। তাই আমি সব বুঝতে পারি।" - বলে হাসেন তিনি। কোলে তুলে নেন তিতলিকে। বলেন -"চলো, এখন ভেতরে যাই। মালী দাদু এলে আবার আসবো বন্ধুর কাছে। আজ যে বন্ধুকে সুস্থ করতে আসছে মালীদাদু।"
"ঠিক আছে।" - হেসে বলে তিতলি।
コメント