top of page

গল্প - বুধন খোঁটার প্রান্তর

  • রুমি
  • Dec 22, 2020
  • 3 min read



কবে থেকে বসে আছি এখানে, কত বছর পেরিয়ে গেল! সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, রোদ ঝড়,আপন পর সব দেখলাম। কিন্তু বুধন খোঁটার মত কাউকে দেখলাম না।


এই কুয়োটা বুধনই কেটেছিল, নিজে হাতে। যে বছর আশপাশের গাঁগঞ্জ, গাছপালা, মাঠ , নদী, নালা শুকিয়ে ধরিত্রীর জীবকুল ঊর্ধ্বমুখি হয়ে করজোড়ে প্রকৃতির আশীর্বাণীর প্রত‍্যাশায় দিনরাত এক করে ফেলেছিল, বুধন তখন একলা হাতে দিনরাত এক করে এই কুয়োটা কেটেছিল। তখন সূর্য উঠছিল ভয়ংকর রক্তচক্ষু দেখিয়ে। পুরো দিনটা যে কী করে কাটবে, ভেবে পেত না মানুষ বা অন‍্য জীবজন্তুর দল। গাছপালা তো শুকিয়ে মরেই যাচ্ছিল। রাতটুকুর আশায় দিন শুরু হত। তার সঙ্গে শুরু হয়েছিল আকাল। খাবার ছিল না কারো ঘরে। মাটির বুক যখন ফুটিফাটা হয়, সে যন্ত্রণা মৃত্যু যন্ত্রণার কাছেও হার মানে। সেই সময় বুধন পণ করেছিল মৃত্যু যদি আসে আসুক কিন্তু যে কাজ সে হাতে নিয়েছে তার শেষ দিনে যেন আসে। না, বুধন হার মানে নি, জয়ী হয়েছিল সে। অতবড় কুয়ো একার খাটুনিতে পঁয়তাল্লিশ দিনের আমরণ প্রচেষ্টায় তৈরী করেছিল। জল পেয়ে যে কটা আধমরা প্রাণীসকল ধুক ধুক করছিল , বেঁচে গিয়েছিল সে যাত্রায়।


আমার তিনপাশ গ্রাম দিয়ে ঘেরা। সামনে সুবিশাল বুধন খোঁটার প্রান্তর। পাতকুয়ো তৈরী হওয়ার পর বুধনই আমাকে এখানে এনে বসিয়ে দিয়েছিল তৃষ্ণার্ত জীবকুলের সেবায়। আমার ও দিনে দিনে ক্ষয় হচ্ছিল। 'প্রাণ থাকতে আমি বিশ্রাম নেব না', সে প্রতিজ্ঞা বুধন প্রথম দিনেই গাঁয়ের হাট থেকে সাতটাকা দিয়ে কিনে এনে, আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়ে ছিল। পাতকুয়ো কাটা শেষ হওয়ার পর বুধন শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে ছিল, অমানুষিক পরিশ্রম আর অপর্যাপ্ত খাদ্য পানীয়ের কারণে । গ্রামের মানুষ বেইমানী করে নি, তাকে উপযুক্ত সেবায় সুস্থ করে তুলেছিল। সুস্থ হয়ে ওঠার পর, একদিন আমার পাশে বসে বলল,


―আমি আজকেই একটা কাজে বের হব। আদৌ কবে ফিরবো কিংবা হয়তো কখন ফিরবোই না! তুমি থেকো অতীত - বর্তমান- ভবিষ্যতের যোগসূত্র হয়ে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে শিখিও, 'প্রকৃতিকে যেন আপন অঙ্গে ধারণ করতে শেখে।'


তারপর বুধন চলে গেল । হাতে নিয়ে গেল শুধু একটা খোঁটা। বুধন বলেছিল,


―একদানা খাবার বা একফোঁটা জল ও সঙ্গে নেব না নিজের জন্য , সব তোমাদের জন্য রেখে গেলাম। শুধু ঐ বন্ধ্যা প্রান্তরে প্রথম চাষের জন্য এই পাতকুয়ো থেকে একটু জল এই বাঁশের খোঁটার ভিতর পুরে নিয়ে যাচ্ছি । আজ থেকে চেষ্টা করব নিজে প্রকৃতিকে নিজ অঙ্গে ধারণ করে ভবিষ‍্যতের জন্য খাদ্য পানীয়ের আধার তৈরি করবার।


তারপর শুরু হল নিরন্তর বেঁচে থাকার আর বাঁচিয়ে রাখার কৌশলী প্রচেষ্টা। যাওয়ার সময় বুধন সঙ্গে নিয়েছিল ঋতুকালীন ছ'টা বীজ, আর একমুঠো শষ্যদানা। খাদ্য হিসেবে নয়, ফসল ফলানোর উদ্দেশ্যে। তারপর একমুঠো জায়গায় শষ্যদানা ছড়িয়ে আর বীজ লাগিয়ে বাঁশের খোঁটায় আনা সামান্য জল, একটু একটু করে ছড়িয়ে দিয়ে অপেক্ষা করেছিল নতুন প্রজন্মের অঙ্কুরোদ্গমের প্রত‍্যাশায়। তখন বুধনের খাদ্য ছিল ধূ ধূ প্রান্তরে যেটুকু ভক্ষণ যোগ্য সেটুকুই।


ধীরে ধীরে বছরের পর বছরের সুকৌশলী ব‍্যবস্হাপনায়, ছবির মত ফুটে উঠল বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ঘন সবুজ বনানী আর তার বুকে মাতৃস্তন‍্যের মত চাষ যোগ্য জমির উৎকর্ষতা । একটা করে বৃক্ষ যখন প্রথম ফলবতী হয়েছে, সেই প্রথম ফলগুলো বুধন নিজে খেয়েছে আর তার বীজ দিয়ে নতুন বৃক্ষ রোপণ করেছে। আর নির্দিষ্ট দিকে এগিয়ে গেছে বনভূমি সৃষ্টি করতে করতে।


আর কখনও কেউ বুধন কে দেখে নি। আজ বন্ধ্যা প্রান্তরও ফলবতী। চারিদিকে সবুজের সমারোহ , অনাবৃষ্টির করাল গ্রাসে পড়তে হয় না নতুন প্রজন্মকে। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আছে সেই মন্ত্র, যা বুধন শেষবার বলে গিয়েছিল, আজ তা প্রমাণিত। শুধু মাঝে মাঝে নতুন বৃক্ষের অবলম্বনের জন্য খোঁটা দিয়ে লাঠি পোঁতার ক্ষীণ আওয়াজ দূর থেকে কানে আসে। আজও আসে আমি শুনতে পাই। আমি আজও বুধনকে দেওয়া কথার খেলাপ করিনি। দীর্ঘ তপ্ত গ্রীষ্ম দুপুরেও আমি এভাবেই বসে থাকি। শুধু যখন কোন তৃষিত মানুষ, তৃষ্ণা নিবারনের জন্য আমাকে দড়ি ধরে অমৃত সাগরে ক্ষণিকের জন্য ছুঁড়ে ফেলে অমৃত আহরণ করে তুলে নিয়ে আসে আপন হৃদয়ের কাছাকাছি, আঁচলা ভরে অমৃত পান করে প্রাণ ফিরে পায়, আমার জন্ম সার্থক হয় তখন।।





Comentários


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page