গল্প - গারো পাহাড় আর একলা মেয়ের গল্প
- শর্মিষ্ঠা বসু
- Jul 5, 2020
- 9 min read
Updated: Feb 19, 2021
স্কুল থেকে বেরিয়ে হনহন করে হাঁটছিলো ঝিমলি ! সন্ধ্যে হয়ে এলো ! দূরে গারো পাহাড়ের মাথার ওপরে টকটকে লাল সূর্য যেন ঝিমলিকে আরো বিচলিত করার জন্য তার লাল রশ্মি ছড়িয়ে চারপাশটা কেমন সিঁদুর রঙের আভায় ভরিয়ে রেখেছে ! ঝিমলির অবশ্য প্রকৃতির শোভা দেখার সময় বা মন কোনোটাই ছিল না ! স্কুলে পেরেন্ট টিচার র মিটিং আর সামার কনসার্ট এর মহড়া সেরে বেরোতে বেরোতে অনেক দেরি হয়ে গেছে আজ !ব্যাগ থেকে মোবাইল টা বের করে দেখলো ঝিমলি! ঠিক যা ভেবেছিলো তাই ! রনির তিনখানা মিসড কল! মায়ের দেরি দেখে নির্ঘাত বায়না জুড়েছে ! ঝিমলি দ্রুত পায়ে হাঁটছিলো ! মাঝপথে দোকান থেকে কিছু কিনতে হবে , কাল বনির হিস্ট্রি টেস্ট , বাড়ি ফিরে মেয়েটাকে নিয়ে পড়তে বসতে হবে! ভাবনাগুলো কেমন যেন ঝিমলির মনের মধ্যে জট পাকিয়ে যাচ্ছিলো ! বাড়ির ঠিক কাছে আসতেই দপ করে রাস্তার আলোটা নিভে গেলো ! বিরক্তিতে মুখটা কুচঁকে ফেললো ঝিমলি! শিলং শহরে লোডশেডিং টা আজকাল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে!
গেট এর আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে এলো রনি ‘ কি এনেছো মাম্মি? ‘ রোজকার প্রশ্ন ! ব্যাগ থেজে একটা কেক এর বাক্স বের করলো ঝিমলি!’ এখন নয় , কাল টিফিনে খেও ! ঘরে চলো এবার ! রনি ভীষণ উৎসাহে স্কুল টিমে ক্যাপ্টেন হওয়ার গল্প শোনাচ্ছিল , বনি অনর্গল বকে যাচ্ছিলো কি যেন! দুজনকে চুপ করিয়ে ঝিমলি যখন এসে সোফায় বসলো তখন ক্লান্তিতে ওর শরীর ভেঙ্গে আসছে ! ঘরে ঢুকে ব্যাগটা রাখতেই মারিয়ান এগিয়ে এলো!’ খেয়ে নাও দিদি ‘ মারিয়ানের হাতের ট্রেতে ধোঁয়া ওঠা ব্ল্যাক কফির কাপ ! ঝিমলি হাসলো , এই মেয়েটা না থাকলে যে কি হতো , নিজের মনে ভাবছিলো ঝিমলি! গেটএর আওয়াজ শুনেই মারিয়ান সুপটু হাতে বানিয়ে ফেলেছে ঝিমলির প্রিয় পানীয়টি ! পরম তৃপ্তিতে কফির. পেয়ালায় চুমুক দিলো ঝিমলি! ও ঘরে রনি বনি তখন উচ্চস্বরে গান গাইছে ! ‘মাথা ধরেছে দিদি? টিপে দেব ?' মারিয়ান ঝিমলিরপাশে এসে দাঁড়িয়েছে , হাতে একটাছোট্ট চিরকুট ! ‘ ওটা কিসের কাগজ রে ? ‘জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ঝিমলির! ‘ এক ভদ্রলোক তোমার খোঁজ করছিলেন দিদি, অনেকবার ফোন করেছেন ! এইনম্বরটা লিখে রেখেছি তুমি একটু ফোন করো !
কাগজটা নিয়ে নম্বরটা ভুরু কুঁচকে দেখছিলো ঝিমলি, অচেনা নম্বর ! কে হতে পারে? হঠাৎ বুকের ভেতরে কেমন করে উঠলো ঝিমলির! সুবীর নয়তো ? মনে মনে নিজেই হাসলো ঝিমলি! কি আশ্চর্য ! আজ ও কি সে সুবীরের ফোনের প্রতীক্ষায় থাকে !সুবীর কি করেযে হবে? সে তো এখন সুদূর আমেরিকায় ! হয়তো বা নতুন করে সংসার সাজিয়েছে চিরদিনের মতন ঝিমলি কে ভুলে গিয়ে ! কিআশ্চর্য! চির স্বার্থপর মানুষটা? রনি বনিকেও ভুলে গেলো! সন্তানকে এতো সহজে ভোলা যায় ? হয়তো সুবীর পারে! তার মতন আত্মসর্বস্ব মানুষরা এমনটাই হয় হয়তো! মনের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠা ঝড়টাকে এক লহমায় সরিয়ে দিয়ে কাগজে লেখা নম্বরটা ডায়াল করলো ঝিমলি, মনে বেশ কিছুটা কৌতূহল আর বিরক্তিটা চেপে রেখে হ্যালো , ‘আমি সপ্তপর্ণা বলছি , ঝিমলি নিজের কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব গম্ভীর রাখার চেষ্টা করছিলো, ! ‘ আপনি আমার বাড়িতে ফোন করেছিলেন শুনলাম ‘ ! ঝিমলির পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই ওপাশ থেকে হৈহৈ আওয়াজ ‘ কি রে ঝিঁঝিঁপোকা, এতক্ষনে ফোন করার সময় হলো তোর ‘! একটু থতমত খেয়ে হেসে ফেললো ঝিমলি! তাকে ঝিঁঝিঁপোকা ডাকার মতন মানুষ একজনই আছেন ! ‘ ভাস্কর দা তুমি ? কোথায় আছো ? আমার বাড়ির নম্বর পেলে কি করে? ‘ ওপাশের পুরুষকণ্ঠ তখন হৈচৈ বাঁধিয়ে দিয়েছেন ‘উঃ আমি সপ্তপর্ণা বলছি! তোর ওই বিটকেল নামটা আবার কবে থেকে হলো রে, আমি তো আজীবন জানি যে তোর নাম ঝিঁঝিঁপোকা’!
ঝিমলি হাসছিলো ! স্কুল জীবনের দিনগুলো আবার এক ঝটকায় তার চোখের সামনে ! ফোনের ওপ্রান্তে ভাস্কর তখনও অনর্গল বকে চলেছে! ঝিমলি খানিকটা শুনলো তারপর মাঝপথে কথা থামিয়ে বললো, ‘তারপরে, তুমি শিলং এ কিমনে করে? বৌদিকে নিয়ে বেড়াতে এলে বুঝি ?’ ওরে বাবা ,না না, ভাস্কর যথারীতি সপ্রতিভ , তোর বৌদির বেরোবার সময় কোথায় রে ? সে তো তার মায়ের বাতের ব্যাথা নিয়ে জেরবার ! আমাকে কোম্পানি একবছরের জন্য একটা প্রজেক্টের কাজে শিলং পাঠিয়েছে ! তাই এলাম ! নাহলে এই পাহাড়ে পর্বতে কি আর কেউ শখ করে আসে ? সবাই তো আর তোর মতন উন্মাদিনী নয় ! ঝিমলি ম্লান হাসলো ! মনের মধ্যে যে খুশির জলতরঙ্গটা নতুন সুরে বাজছিলো সেটা যেন হঠাৎ থেমে গেলো ! সত্যিই কি আর শখ করে শিলং এ চলে এসেছে ঝিমলি? কাকে বোঝাবে সে একথা ! কলকাতা তার কাছে কতটা দুঃসহ হয়ে উঠেছিল একথা সে কি করে বোঝাবে? চারদিকে শুধু সুবীরের স্মৃতি ! ডিভোর্সএর পরে তাই একটুও দেরি করে নি ঝিমলি! ভাগ্যিস শিলং এ বাবার তৈরী এই বাড়িটা ছিল ! কলকাতা থেকে রনি বনিকে সঙ্গে নিয়ে তাই সোজা শিলং! পুরোনো জায়গা তো পরিচিত পরিবেশে যাকে বলে সেটেলড হওয়া সেসবে খুব সময় লাগেনি তার! ঝিমলির তো এখানেই বড় হওয়া, এদের মাঝেই বেড়ে ওঠা! তাই পুরোনো পরিবেশে, চেনা লোকজনের মাঝখানে , কলকাতা শহর থেকে দূরে এসে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল সে! ভাস্করের সঙ্গে কথা শেষ করে ফোন তা রেখে দিলো ঝিমলি ভাস্করকে বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে ! কেমন যেন উদাস লাগছে আজ ! বড্ডো মন খারাপ করা মেঘলা একটা বিকেল !
বনির ক্লাসটেস্ট আর স্কুলের সামার কনসার্ট নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে সারা সপ্তাহটা কেটে গেলো! আজ শনিবার, ছুটির দিন ! একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছিল ঝিমলি! সকালে উঠে খবরের কাগজের হেডলাইন টায় চোখ বোলাচ্ছে , দরজায় হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ ! মারিয়ান দরজা খুলতেই হৈচৈ “ এসে গেছি বুঝলি , এবার দয়া করে একটু লুচি ভাজ , সঙ্গে একটু সাদা আলুর তরকারি কর ! ভীষণ খিদে পেয়েছে ! কি হলো ? হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ? ঘরে ময়দা ময়দা নেই নাকি ?"
“ভাস্কর দা , তুমি ? এখন ? তুমি যে আসবে আগে জানাবে তো? “ ঝিমলি অবাক খানিকটা অপ্রস্তুতও ! রাতপোশাকটা এখনো পরে আছে যে! ভাস্কর ঝিমলির কথার কোনো আমলই দিলো না! বললো “ দাঁড়িয়ে আছিস কেন বল দেখি ? লুচি তরকারি খাবো বললাম কথাটা কানে গেলো না বুঝি ? বাঙালির ছেলে , পাহাড়ে পর্বতে এসে না খেয়ে মরতে বসেছি ! , কি বিশ্রী খাবার এখানে ! ম্যাগো, কি যে স্যাপ ব্যাঙ খায় এরা কে জানে ! বুনো পাহাড়ি যত ! “
“সত্যি ভাস্করদা তুমি একেবারে বদলাও নি” ঝিমলি হাসছিলো ! ভাস্কর ততক্ষনে সামনের সোফায় বসে পড়েছে ! অসময়ে মায়ের হাসির আওয়াজ পেয়ে ছেলেমেয়ে দুটো ও গুটিগুটি পায়ে বিছানা ছেড়ে বসার ঘরে উপস্থিত ! আজ অনেক দিন পরে কিচেনে গেলো ঝিমলি! গরম তেলে ফোড়নের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে! মন দিয়ে ব্রেকফাস্ট এর আয়োজন করছে ঝিমলি! বসার ঘরে রনি বনি তখন ভাস্কর মামুর সঙ্গে গল্পে মশগুল !
“এ বছর শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে বুঝলে ভাস্করদা“”, কফির কাপে চুমুক দিয়ে ঝিমলি তাকালো ভাস্করের দিকে “! হুম , তা যা বলেছিস “ অন্যমনস্ক জবাব ভাস্করের ! ঝিমলি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, খাটের ওপরে খোলা একখানা বাংলা পত্রিকা আর এক কোনায় ডাই করে রাখা বেশ কিছু বাংলা বই ! বইয়ের পাহাড় থেকে একখানা বই বের করে দেখছিলো ঝিমলি ! চকচকে নীল মলাটে মোড়া বাঁধানো নতুন বইটার গন্ধ নিলো সে! বইয়ের ওপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা “ সুকুমার রচনাবলী “! মলাটটা দেখে হেসে ফেললো ঝিমলি” সত্যি ভাস্করদা তোমার বাংলা প্রেমের পুরোনো রোগটা আর গেলোনা ! ভাস্কর এবার চোখ তুলে তাকালো তারপরে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো ”রোগ? রোগ আবার কি! বঙ্গসন্তান বাংলা শিখবে না? সুবিশাল ভান্ডার এই বাংলা সাহিত্যের , সবকিছু অজানা অচেনা রয়ে যাবে ? “ একরাশ বিরক্তি মাখা কণ্ঠস্বর ভাস্করের! আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো সে কিন্তু বনির কথায় বাধা পড়লো “ ভালো মামু , কিংকর্তব্যবিমূঢ় স্পেলিংটা দেখে দাও প্লিজ “| ভাস্কর ব্যস্ত হয়ে পড়লো, বনির খাতাটা টেনে নিয়ে বললো” কই দেখি, কতদূর লিখেছিস ? “ এভাবেই চলে প্রতি শনি- রবিবার ! রনি আর বনির বাংলা শেখা! ভাস্করদা অতি উৎসাহে সপ্তাহান্তে সাতসকালে এসে হাজির হয়ে যান ! প্রথমদিকে একটু আড়ষ্ট থাকতো ছেলেমেয়েদুটো ! কিন্তু স্নেহশীল ভালোমামুর সঙ্গে ওরাও যেন কিভাবে জড়িয়ে গেলো! কত যত্নে ভাস্কর বাংলা পড়াতেন ওদের ! শুরু করেছিলেন ঠাকুমার ঝুলির গল্প দিয়ে কিন্তু কি অসম্ভব দ্রুততায় এগিয়ে চলছিল রনি আর বনির বাংলা শেখা! ঝিমলি অবাক হয়ে দেখতো ! এই ফুটফুটে দুটো ছেলেমেয়ের কাছে নিজেকে যেন উজাড় করে দিতো ভাস্করদা! ডাকযোগে বই আনাতেন, কখনো নিজে পড়ে শোনাতেন কখনো বা ওদের পড়ে শোনাতে বলতেন ! দূর থেকে দেখতো ঝিমলি! কি যে ভালো লাগতো ওর ! পিতৃস্নেহ বঞ্চিত দুটো অবোধ শিশু যেন নতুন করে বাঁচতে শিখছিলো !নতুন একটা জগৎ খুঁজে পাচ্ছিলো ! ঝিমলি নিজেই কি বদলে যাচ্ছে না?
আজকাল কি আর আগের মতন সুবীরের স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায় তাকে ? ভাস্করদা আর সেটা হতে দেন কোথায় ? প্রতি সপ্তাহেই তো নতুন ফরমাশ থাকে এই ভোজনরসিক পাড়াতুতো দাদাটির ! একটু বৃষ্টি পড়লো কি না পড়লো ভাস্করদার ফোন ,”বুঝলি ঝিঁঝিঁপোকা, এই শনিবার দুপুরে স্রেফ খিচুড়ি , আলুভাজা , বেগুনি আর ডিমভাজা ! আর কোনো ঝামেলা নয় বুঝলি!" ঝিমলি হেসে ফেলে “ একটু কম করো ভাস্করদা! “ ফোনের ওপারে তখন আবার হৈচৈ “ কম মানে ? এর কমে আবার বাঙালির খাওয়া হয় নাকি ? তুই দেখছি পাহাড়ে পর্বতে থেকে একেবারে বুনো হয়ে উঠেছিস ! “
ঝিমলির মাঝে মাঝে উপদ্রব মনে হয় তারপরে ভাবে নাহ, এই তো বেশ ! শুক্রবার বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার সময় গুছিয়ে বাজার করে ঝিমলি! পরদিন দুপুরে হৈহৈ করে খিচুড়ি খাওয়া হয়! খাওয়ার টেবিলে চলে তুমুল আড্ডা ! ভাস্করদা তার অফুরন্ত গল্পের ভান্ডার থেকে অবিরাম গল্পের ফোয়ারা ছোটায়! রনি বনি অবাক কৌতহলে খাওয়া থামিয়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকে সেসব গল্প ! ঝিমলি খাবার পরিবেশন করে, বিকেলে কফির সঙ্গে স্ন্যাক্স বানাবার পরিকল্পনা করে! সারাদিন হৈহৈ করে কেটে যায় ! মাঝেমাঝে সপ্তাহান্তে বনভোজনের ব্যবস্থা করেন ভাস্করদা ! গাড়ি নিয়ে দলবেঁধে ওরা চলে যায় কাছাকাছি কোনো জায়গায় ! সেখানে সবুজ পাহাড় , আপন খেয়ালে বয়ে চলা ঝর্ণা , রং বেরঙের মরশুমি ফুল আর উড়ে বেড়ানো প্রজাপতি দেখতে দেখতে গান ধরেন ভাস্করদা! ছেলেমেয়েগুলো গলা মেলায় তাদের ভালো মামুর সঙ্গে! বেতের ঝুড়িতে গুছিয়ে আনা শুকনো খাবার কাগজের প্লেটে সবাইকে পরিবেশন করে মারিয়ান ! হৈহৈ করে খাওয়াদাওয়া হয়, তারপরে আবার গান, গল্প, মজা !
ভাস্করদা হাতে ধরে বাংলা শিখিয়েছিলো ঝিমলিকে ! শুধু বাংলা শেখায়নি ! বাংলাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলো! ভাস্করদার হাত ধরে ঝিমলি বাংলা শিখেছিল , বাংলাকে ভালোবেসেছিলো ঠিক আজকে রনি বনি যেমন করে ভালোবাসছে বাংলা ভাষাকে !
গরমকালে আজকাল শিলং এর মতন পাহাড়ি জায়গায় অল্প অল্প গরম বোধ হয় ! ঝিমলি যখন ছোট ছিল তখন শিলং এর কোনো বাড়িতে পাখা চালানোর প্রয়োজনই পড়তো না! গ্রীষ্মের শিলং বড়ো সুন্দর ! নরম রোদ, মিঠে হাওয়া , অজস্র ফুলের সমারোহ ! গরমের ছুটি পড়লেই অবশ্য ঝিমলির মন খারাপ হতো! গরমের ছুটি মানেই তোে বাবা মায়ের হাত ধরে কলকাতার বাড়িতে যাওয়া ! তখন অবশ্য কলকাতা মোটেই পছন্দের জায়গা ছিলনা ঝিমলির! ভ্যাপসা গরমে দরদর করে ঘামে ভিজতে কার ভালো লাগে ! তাছাড়া বাসে দমবন্ধ করা ভিড়. অসহ্য লাগতো ঝিমলির! সে শুধু দিন গুনত, শিলং এ ফিরে যাবার দিন! তবে সেই দিনটা যখন এসে পড়তো, তখন কেন জানি কলকাতার জন্য মন কেমন করতো তার! ঠাকুমার জন্য, বড়ো জেঠুর জন্য, নতুন কাকিমার জন্য! শিলঙে ফিরে ভাঙা ভাঙা বাংলায় সবাইকে চিঠি লিখতো সে! এর বেশ কিছু বছর পরে বাবা পাকাপাকি বদলি হলেন কলকাতায়! ততদিনে বাড়িটা অনেক বদলে গেছে!
ঠাকুমা গত হয়েছেন , বড়ো জেঠুও মৃত্যুশয্যায় , নতুন কাকিমা কাকুর সঙ্গে কানাডায় পাড়ি দিয়েছেন !কলকাতায় এসে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিলো না ঝিমলি! সব কেমন যেন অন্যরকম ! তারপরে সব অভ্যেস হয়ে গেলো , যেমন হয় আর কি! আর সুবীরকে দেখার পরে শিলঙের কথা আর মনেই রইলো না! দুচোখে তখন অনেক স্বপ্ন !
আজ পুরোনো অনেক কথা ভিড় করে আসছিলো ! চোখ বুজে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবছিলো ঝিমলি! হঠাৎ বনির গলার আওয়াজে পেছন ফিরে তাকালো !” দেখো, মাম্মি , কি হয়েছে ? “ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বনি! খুশিতে ঝলমল করছে মুখ ! “ কি হয়েছে বনি? “ ঝিমলি উঠে দাঁড়ালো ! “ দেখো ছেলেবেলা ম্যাগাজিনে আমার গল্প ছাপা হয়েছে! আমি পেরেছি মাম্মি , আমি পেরেছি”! বনির কণ্ঠস্বরে খুশি ঝরে পড়ছিলো!
উচ্ছসিত ঝিমলি বনিকে জড়িয়ে ধরলো ! “ বনি , ভীষণ খুশি আমি ভীষণ! দাঁড়া ভালো মামুকে একটা ফোন করি !” ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আওয়াজ আসার আগেই ঝিমলি চেঁচিয়ে উঠলো “ভাস্করদা, দারুন খবর ! ছেলেবেলায় বনির লেখা ছাপা হয়েছে জানো! বনি পেরেছে ভাস্করদা! উফফ !! কি বলি বলতো !সব ক্রেডিট তোমার জানো ,সবটা তোমার ক্রেডিট! কি যে আনন্দ হচ্ছে আমার! চলো তো এই শনিবার গিয়ে কোথাও সেলিব্রেটে করি! একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছিলো ঝিমলি! এতো আনন্দ হচ্ছিলো তার!
“ ওরে দাঁড়া, রেলগাড়ি ছোটাচ্ছিস যে “ , ভাস্কর সস্নেহে মৃদু ধমক দিলেন ! “বনির লেখা ছাপা হবে এ আর এমন কি কথা , ভাগ্নিটা কার দেখতে হবে তো !!” বুঝেছি , বুঝেছি, “ ঝিমলির গলায় ফের উচ্ছাসের ছোঁয়া! এবার শনিবারের প্রোগ্রামটা ঠিক করে ফেলো দেখি , আজ তো বুধবার , মাঝখানে ঠিক আর দুটো দিন ! “ ঝিমলিকে কথা শেষ করতে দিলো না ভাস্কর! একটু থেমে বললো “ এই শনিবার হবেনা রে ! কোম্পানি থেকে ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে আমাকে ইমমেডিয়েটলি কলকাতা অফিসে রিপোর্ট করতে হবে! আগামী সোমবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে চললাম আমি “
ভাস্কর হাসছিলো , তবু কোথাও যেন একটা বিষাদের সুর শুনতে পাচ্ছিলো ঝিমলি ! “ ভাস্করদা তুমি চলে যাচ্ছ ? আমার কি হবে! নিজের অজান্তেই কথাটা বলে ফেলেছে ঝিমলি আর বলেই অবশ্য সামলে নিয়েছে ! সত্যিই তো ভাস্করদার এখানকার ঠাঁইটি যে পাকা নয় তা তো জানাই ছিল তার ! তবুও কেন যে এতো অসহায় লাগছিলো !
ঝিমলির কথা শুনে ভাস্কর ও কিছুটা অপ্রস্তুত ! একটু চুপ করে রইলো কিছুক্ষন তারপরে সামলে নিয়ে বললো” দূর পাগলী , তোর আবার কি হবে! অমন হীরের টুকরো দুটো ছেলেমেয়ে যার তার আবার চিন্তা কিসের ? আর আমি তো রইলাম রে, শিলং কলকাতা কতটুকুই বা দূরত্ব , ছুটি পড়লেই চলে যাবি! তোর বৌদিকে বলে রেখেছি , তিনতলার ঘরটা এবার থেকে পাকাপাকিভাবে তোদের তিনজনের ! “
ঝিমলির কোনো কথা কানে ঢুকছিল না! চারপাশটা কেমন যেন শূন্য মনে হচ্ছিলো তার! ফোনটা রেখে সোফায় এসে বসলো ঝিমলি! সত্যিই তো ভাস্করদা কে ফিরে তো যেতেই হবে তার নিজের বাড়িতে !একটা বছর যে এর মধ্যে কি করে কেটে গেছে টেরই পায়নি ঝিমলি! এতটা আপন হয়ে গিয়েছিলো মানুষটা , যেন এই পরিবারেরই একজন ! ঘরের কত খুঁটিনাটি ভাগ করে নিয়েছিল সে ভাস্করদার সঙ্গে ! আর ভাস্করদাও পরম স্নেহে , পরম যত্নে আগলেছে তাদের ! হয়তো বা প্রবাসে একাকিত্বের কষ্ট ভোলার জন্য ! কিংবা হয়তো পিতৃস্নেহ বঞ্চিত দুটো ফুটফুটে ছেলেমেয়েকে ভালোবেসে ! কিন্তু এখন আবার সেই এক পথ চলা , ঠিক সেই আগের মতন !
স্কুল থেকে ফিরে দক্ষিণের জানালার কাছে বসে ছিল ঝিমলি ! কাল শনিবার, এ সপ্তাহে আর খাবার বানানোর ফরমায়েশ নেই ! ও ঘরে রনি বনি পড়াশুনা করছে ! ওরাও কেমন যেন বুঝে গেছে যে ওদের জীবনটা এখন থেকে অন্য খাতে বইবে ! পোশাক বদলাবার জন্য ওঘরে যাচ্ছিলো ঝিমলি, হঠাৎ বনি দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ালো ! “ মাম্মি , দেখো ভালো মামু ইমেইল এ বাংলা কোশ্চেন পেপার পাঠিয়েছে ! আমাকে এই উইকেন্ডেই কমপ্লিট করে পাঠাতে হবে ! আমাকে একটু বাক্য রচনায় হেল্প করো না প্লিজ “ , দুটো শব্দ বলছি , আমাকে একটু বলে দাও প্লিজ! রিক্ত আর নিঃস্ব ! এই দুটো শব্দের মানে কি মাম্মি ? “
ঝিমলি অপলকে তাকিয়ে ছিল বনির দিকে ! কি করে বোঝাবে ঝিমলি এ যেন তারই কথা ! রিক্ত না নিঃস্ব, কি সে ? চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো ঝিমলি বেশ কিছুক্ষন ! তারপরে বাবার কথাগুলো মনে হতেই এগিয়ে গেলো !
বাচ্চাদুটোকে জড়িয়ে ধরে বললো ‘হোমওয়ার্ক পরে হবে, চলো এখন গান গাইবো আমরা ! রনি- বনি অবাক চোখে ওদের মাকে দেখছিলো ! কোনো এক অজানা মন্ত্রবলে তাদের মা হঠাৎ এক অন্য মানুষ হয়ে গেছে! কি সুন্দর লাগছে আজ ওদের মাকে! ঝিমলি উদাত্ত কণ্ঠে গান গাইছিলো -
আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া
বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া

লেখক পরিচিতি - লেখিকা শর্মিষ্ঠা বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর । দূরদর্শন এবং আকাশবাণী কলকাতায় কাজের সূত্রে বহু গুণী মানুষের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছে । দেশবিদেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রয়েছে অনেক । জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল বই। শুধু বই পড়েই কাটিয়ে দিতে চান বাকি জীবন।
Comments