top of page
  • পার্থ সেন

বড়গল্প - মহাযুদ্ধের বার্তা – একটি রুপকথা


মানসের পথে



হোটেলেই আলোচনাটা শুনেছিলাম। রাস্তায় বেরিয়ে সেটা স্বচক্ষে দেখলাম। গত রাতে নলবাড়ির কাছে নাকি একদল হাতি বেরিয়ে পড়েছে, আর তাতে জনজীবন স্তব্ধ আর রাস্তায় নাকি বেশ জ্যাম লেগে গেছে। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে আমরা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আর আমাদের সামনে একটা ট্রাক ‘নো হর্ন’ আর ‘টাটা’ লেখা, আর পাশে একটা ‘হাসি মুখ’ কোন নড়া চড়া নেই। আমাদের ড্রাইভার অবশ্য অনেকক্ষণ থেকেই বলছিল ‘বরপেতা’ হয়ে যাবার কথা। তাতে সময় হয়তো একটু বেশী লাগবে, কিন্তু রাস্তায় জ্যাম হওয়ার চান্স কম। শেষ পর্যন্ত সুযোগ বুঝে আমাদের গাড়ী ঘোরাতেই হল। প্রায় তিন কিলোমিটার পিছিয়ে এসে ডানদিকের রাস্তা ধরে বরপেতার দিকে এগোলাম আমরা। আমাদের গন্তব্য ‘রয়্যাল ন্যাশানাল পার্ক’ ছাড়িয়ে মানস নদীর যেখানে উৎস তার কাছাকাছি ‘দরগা’ গ্রাম। ভৌগলিক গত অবস্থানের ভিত্তিতে জায়গাটা ভুটানে আসে, আর ভারত সীমানা থেকে তার দূরত্ব প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার। দেওসিড়ি পেরোনোর পর বনগাঁইগাও রোডের ওপর একটা চেকপোস্ট আসে। সেখানে পাসপোর্টটা দেখাতে হয়।


আমার এখানে আসার কারণ বলার আগে বলতে হয় আমার সঙ্গীর কথা, যিনি আমার সঙ্গে এক গাড়িতেই রয়েছেন। নাম ‘সেবি সালগাওকার’। সালগাওকার সাহেবের জন্ম, বড় হওয়া গোয়ায় পানজিমে, এখন বেশীর ভাগ দিনগুলো মুম্বাইতেই থাকেন। আগে সেখানে কলেজে পড়াতেন, এখন রিটায়ার করে বই লেখেন। হিমালয়ের পাদদেশের নানান পশু পাখিকে নিয়ে পড়াশোনা আর গবেষণা, এটাই তাঁর নেশা। তিন-চার খানা বইও লিখে ফেলেছেন। আর আমি হলাম ‘প্রতীক বসু’, পেশায় একজন ‘ফ্রি ল্যান্স’ ফটোগ্রাফার, দিল্লীতে থাকি। আমার আগে লেখা কিছু আবর্জনায় আমি আমার কথা বলেছি, তাই আর সেই এক কথা বলে সময় নষ্ট করব না। যাহোক, আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে ওনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। অনেকেই জানেন ‘ভিগওয়ান’ নামে পুনের কাছে একটা জায়গা আছে, পাখির ‘অবজারভেটরি’ হিসেবে ‘ভরতপুর’ যেমন খুব বিখ্যাত, ‘ভিগওয়ান’ হয়তো তেমন নয়। তবে পাখির বৈচিত্রে এবং সৌন্দর্যে ‘ভিগওয়ান’ কিন্তু অনবদ্য। সেবারে আমি সেখানে গেছি পাখির ছবি তুলতে। সে বছর শুনেছিলাম দক্ষিন আফ্রিকা থেকে কালো-ডানা যুক্ত ‘স্টিল্ট’ পাখি এসেছে বাংলায় আমরা বলি ‘লাল ঠেঙ্গি’, আসলে পা গুলো খুব লম্বা আর লাল রঙের, তাই নামটাও সেই রকম। আমি সদ্য রনথম্বোর থেকে ফিরেছি, আর আমার পরনে একটা টি-শার্ট সেটার সামনে একটা বাঘের ছবি আর পেছনে ‘রনথম্বোর ন্যাশানাল পার্ক’ লেখা। আসলে আমি তখন সবেমাত্র ‘ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার’ হিসেবে কাজ শুরু করেছি, ক্যামেরা নিয়ে নানান আঙ্গেলে ছবি তুলছি, এমন সময়ে পেছন থেকে একটা গলার আওয়াজ পেলাম,

“আপনি কি প্রফেশনাল?”

“হ্যাঁ, ঐ আর কি?”

“আপনি ফটো বিক্রি করেন?”

আমার ইন্টারেস্ট ছিল, আমার তোলা ছবি গুলোর একটা গতি হতে পারে সেই ভেবেই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিলাম। আমার তোলা ছবি দেখলেন, ওনার ভালো লাগল, তারপরেই ঘনিষ্ঠতা। আমার চেয়ে বছরে প্রায় পনের বছরের বড়, খুব অমায়িক, পণ্ডিত মানুষ। প্রথমেই শুনেছিলাম কলেজে পড়ান, আর সে কারণে ‘স্যার’ বলা ছাড়া আর কোন ভালো সম্ভাষণ আমার মনে আসেনি। তারপর থেকে ওনার সঙ্গে অনেক জায়গায় গেছি।


প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার উত্তরাখণ্ড থেকে সিকিম ধরলে হিমালয়ের পাদদেশের মোটামুটি সব কটা অরণ্যই ‘সালগাওকার স্যার’ চষে ফেলেছেন, খালি এই আসাম ছাড়া। কুমায়ুন, গাড়োয়াল, পিলভিট, পালিয়াকালান, নেপালগঞ্জ, চিটুয়ান, সিঙ্গলীলার অরণ্যে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন সালগাওকার সাহেব। প্রতিটা জায়গায় আলাদা আলাদা বিশেষত্ব, পশু পাখিদের বিভিন্ন রূপ সব দেখেছেন, পড়াশোনা করেছেন আর সেগুলোকে লিপিবদ্ধও করেছেন। সালগাওকার সাহেবকে দেখে বুঝেছি একটা মানুষ প্রানীবিজ্ঞানকে কতোটা ভালোবাসতে পারেন। আমার সঙ্গে মাঝে মাঝেই কথা হয়। মুম্বাইতে গেলে আমি ওনার কাছেই থাকি। হিন্দী, ইংরাজি দুটো ভাষাই খুব ভালো বলেন। হ্যাঁ, পশুপাখি ছাড়া আর একটা নেশা ওনার আছে, সেটা হল সিগার। দিল্লীর কোন দোকান থেকে নিয়মিত সিগার সাপ্লাই হয় তাঁর মুম্বাইয়ের বাড়ির ঠিকানায়। যাহোক, দিন দশেক আগে কথা হলো ওনার সঙ্গে। রবিবার ছিল, সকালের দিকে তেমন কোন কাজ নেই, ফোন এল,

“তুমি ভারত-ভুটান সীমানায় দরগা গ্রামের নাম শুনেছ?”

“কোন জায়গা এটা?”

“এটা হচ্ছে আসাম আর ভুটান বর্ডারের কাছে। আসামে মানস ন্যাশানাল পার্কের সীমানা পেরিয়ে ভূটানে ঢুকলে তুমি পাবে বিশাল এলাকা জুড়ে তিনটে অরণ্য। একটা হল ওয়াংচুক ন্যাশানাল পার্ক, দ্বিতীয়টা ফিপসু অভয়ারণ্য আর তিন নম্বর রয়্যাল ন্যাশানাল পার্ক। দরগা এই তিনটের থেকেই মোটামুটি এক দূরত্ব!”

“না স্যার, ওদিকটায় আমার যাওয়া হয়নি। আমি মানস গেছি তবে ভারতের বর্ডার পেরোই নি কখনো”

“যাবে? আমি একটা প্ল্যান করছি”

“ঘুরতে?”

“ডম্বিভেলীতে সেদিন একটা পুরোনো বইয়ের দোকানে গেছি, মাঝে মাঝে যাই সেখানে। সেখানে একটা বই পেলাম, লেখক ডেনমার্কের এক প্রানীবিজ্ঞানী ‘অ্যারন অ্যান্ডারসেন’। আগে নাম শুনিনি, তারপর চেনা জানা সূত্রে জানলাম বেশ নামকরা বিজ্ঞানী, নেপাল, ভুটান, উত্তর ভারতে প্রচুর ঘোরাঘুরি করেছেন। যাহোক সেই বই থেকেই জানলাম ‘দরগা’র গ্রামের কথা। আসাম – ভুটান সীমানায় হিমালয়ের কোলে ঘন অরণ্যে পরিবেষ্টিত এক গ্রাম। নানান প্রজাতির প্রজাপতি এবং নানান পাখির কথা লিখেছেন। তো সেসব পড়ে আমার তো যেতে খুব ইচ্ছে করছে। আবার সেখানে নাকি একটা লেক আছে, কাচের মতো স্বচ্ছ জল সেখানে। একটা পাতা পড়লেই কোথা থেকে পাখি এসে তুলে নিয়ে পালিয়ে যায়, নাম ‘ডোরাডো’ লেক’।

“ডোরাডো?” ডোরাডো বলতেই মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠল, সেই কোন কালে পড়া বইতে ছবি, ব্রিটিশ গায়নার নদীপথের ছবি। আর সেখানে জলের মাঝে লাফিয়ে ওঠা সোনালী ডোরাডো মাছ। ছোটবেলায় পড়েছি সে বই। তার আগে পর্যন্ত গায়না মানে জানতাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ক্লাইভ লয়েড, কিন্তু সেই বইতে প্রথম পড়েছিলাম ‘ডোরাডো’ হল এই গ্রহের সবচেয়ে বড় মাছ, আট থেকে দশ ইঞ্চি লম্বা প্রায় পঁচিশ থেকে তিরিশ কেজি ওজনের, কেউ কেউ মজা করে ‘ডলফিন ফিস’ বলেন। পড়ে জেনেছি অ্যামাজন এবং প্যারাগুয়ের নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে ‘ডোরাডো’ দেখা যায়!

“ডোরাডো দেখা যাবে নাকি?” জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম।

“সেটা সম্ভব নয়! যেটা বুঝলাম দরগা হল মানসের উৎসের কাছে। সেখানে নদী তো গভীর হবেনা, তাই আর কিছু না হোক ডোরাডো পাবে না!”

ঠিক কথা, ধারনা সঙ্গত ভুল হয়ে গেছিল, ডোরাডোর মতো বড় মাছ পেতে গেলে আমাদের মোহনায় যেতে হবে। খরস্রোতা নদীতে সে কি করে থাকবে? আমি কিছু বলার আগেই উনি বললেন, “যাহোক, সে ছাড়ো, যাবে? দরগা?”

“কবে?”

“জুলাইয়ের শুরুতে! আর এমনি কোন প্রবলেম নেই, ভূটান যেতে গেলে ভিসা লাগে না! খালি পাসপোর্টটা সঙ্গে রেখো!”


‘জুলাইয়ের শুরু’ মানে আর তিন সপ্তাহ, কাজ একটা ছিল কিন্তু তবু রাজী হয়ে গেলাম। সস্তায় টিকিটও পেয়ে গেলাম। ‘সালগাওকার সাহেব’ মুম্বাই থেকে কলকাতা হয়ে তারপর গুয়াহাটি আর আমি দিল্লী থেকে সোজা গুয়াহাটি। একদিন সেখানে থেকে পরের দিন গাড়িতে রওনা হব সেটাই ঠিক হল।


গুয়াহাটি থেকে একটা গাড়ি পাওয়া গেল তবে শেয়ার করতে হল। সঙ্গে আরো তিনটি ছেলে, অল্পবয়স্ক, আমাদের চেয়ে বয়সে অনেকটাই ছোট, তারা যাচ্ছে ‘মোঙ্গার’। বলল ওরা নাকি সিনেমা বানায়, তা সেই সিনেমার লোকেশন ঠিক করতে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে বড় বড় তিনটে ব্যাগও রয়েছে। তবে একদিকে ভালো হল, পাহাড়ি রাস্তায় সঙ্গী থাকা সবসময়েই ভালো। মানস পেরোনোর পর পাহাড়ি রাস্তা শুরু হবে আর তারপর সকাল থেকেই আকাশ যেন থমকে আছে। একে জুলাই মাস, বুঝতেই পারছিলাম যে কোন সময়ে বৃষ্টি শুরু হবে। দেওসিড়ির চেকপোস্ট পেরোনোর পরই বৃষ্টি শুরু হল। তেমন জোরে নয় তবে গাড়ির ওয়াইপার চালু করতে হল। ড্রাইভারটি ডুয়ার্সের ছেলে, নাম জিজ্ঞাসা করতে বলল ‘খুব বড় নাম সেটা মনে রাখা নাকি খুব শক্ত’ তাই সংক্ষেপে ‘ডিকে’। একেবারে নতুন টয়োটা ইনোভা ‘ক্রিসটা’ মডেল, সামনের মানে ড্রাইভারের পাশের আর মাঝের দুটো সীট ওরাই নিল, আমরা দুজনে পেছনের সীটে। আমাদের সঙ্গে মালপত্তর বিশেষ ছিল না, যেটুকু ছিল আমাদের পায়ের নিচে আর সীটের পেছনে আটকে গেল। হাতে জিনিস বলতে খালি আমার ক্যামেরাটা আর সালগাওকার স্যারের কাঁধে একটা ব্যাগ। আমি জানি ওনার কাঁধের ব্যাগে আছে কম করে দুই-তিন খানা বই, আর আছে গাদাগুচ্ছের কিছু পুরোনো খাতা।


যাহোক পাহাড়ে ওঠার ঠিক আগেই একটা জায়গা আসে নাম ‘গেলেফু’। সেখানে আমাদের চা খাওয়ার একটা বিরতি নেওয়া হল। সকালে হোটেল থেকে বেরোনোর পর প্রায় এক ঘণ্টা আমরা ট্র্যাফিক জ্যামের জন্য নষ্ট করেছি, তাই এখানে বিরতিটা খুব লম্বা হয়নি। আবার গাড়ি চলা যখন শুরু করল তখন কিন্তু বৃষ্টি বেশ জোরে এসে গিয়েছে। পাহাড়ে উঠছি, তার ওপর আবার বৃষ্টির মরশুম, এটাই স্বাভাবিক। পাহাড়ের বৃষ্টি আমি আগে অনেক দেখেছি আমার কাছে নতুন নয়। গাড়ির ভেতরে জোরালো এসি ঠাণ্ডা হাওয়ার ধাক্কা, গাড়ির ভেতরে কাঁচে জমে যাওয়া বিন্দু বিন্দু বাষ্পায়িত জল, যেটাকে আঙ্গুল দিয়ে ঘষে তুলতে এখনো সেই বাচ্চা বয়সের মতোই ভালো লাগে। তার ওপর হালকা আওয়াজে অনবদ্য কণ্ঠে কিশোর কুমারের গান, আর পাশে থেকে থেকে সালগাওকার স্যারের নানান অভিজ্ঞতার গল্প। আমাদের সঙ্গে ফ্লাস্কে কফি ছিল, হোটেল থেকে বেরোনোর সময় নিয়ে নিয়েছিলাম। এই বৃষ্টির মধ্যে চলমান গাড়িতে চিনি ছাড়া কালো কফি যেন এক নতুন স্বাদ নিয়ে আসে। এই সব মুহূর্তগুলোর জন্যই তো ওঁর সঙ্গে যাওয়া। সামনের তিনটি ছেলে তন্দ্রাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। পাহাড়ের বাঁকে যখন গাড়ি বাঁক নিচ্ছে ওদের ঘুমন্ত শরীর গুলো হেলে পড়ছে, আর বেঁধে রাখা সীট বেল্ট ওদের দেহগুলো আবার সোজা করে দিচ্ছে। এটা নতুন নয়, কিন্তু আমার কেমন যেন অবাক লাগে। প্রকৃতি যখন পেখম মেলে ধরেছেন, বৃষ্টির অঝোর ধারা যখন মনের কোণে জমে থাকা জীবনের ‘না-পাওয়ার সব দুঃখ, অভিমান, রাগ, হতাশাকে অনায়াসে বারেবারে ধুইয়ে দিয়ে যাচ্ছে সেখানে আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ব?


মানসে ঢুকে পড়েছি, প্রায় চার-পাঁচ কিলোমিটার চলে এসেছি। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে, যদিও গাড়ির কাচ দিয়ে পাশ ভালো করে দেখা যায়না, তবে সামনের কাচ দিয়ে দেখা যায়। ঘন গাছ দুপাশে তার মাঝ দিয়ে মসৃণ রাস্তা, অবশ্য গাছের উচ্চতা তেমন নয়। আমরা পাহাড়ে উঠছি, সামনে থেকে থেকে পাহাড় উঁকি দিচ্ছে, কখনো ঘন মেঘ এসে যাচ্ছে গাড়ির সামনে তখন কিছু দেখা যায়না। আমাদের ড্রাইভার ‘ডিকে’র তুখোড় হাত, দারুন চালাচ্ছে। ধূসর মেঘের ঘনত্ব ক্রমেই বাড়ছে, মেঘের আস্তরণ আমাদের চারদিক থেকে ঢেকে ফেলছে, এবারে স্পীড কমাতেই হল। আমাদের গাড়ির এমারজেন্সি লাইট চালু হল। এতে সামনে বা পেছনের গাড়ির পক্ষে আমাদের গাড়িকে দেখতে পাওয়াটা তুলনামূলক ভাবে সহজ হয়ে যায়। এবারে হঠাৎ করেই একটা ঘটনা ঘটল। এই বৃষ্টির মধ্যেই কেমন যেন দুটো সাদা পাখি আমাদের উইন্ড স্ক্রীনের ওপর এসে ধাক্কা মারল, আমাদের গাড়িটা ব্রেক কষল, কিন্তু পিচ্ছিল রাস্তা আর ব্রেক তেমন জোরে না হওয়ার জন্য গাড়ি সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়ায়নি। স্পীড কমে গেলেও গাড়ি কিন্তু এগোতে লাগল, এবারে আরো তিনটে সাদা পাখি আমাদের গাড়িটার সামনে এসে পড়ল। এবারে ব্রেকটা আরো জোরে করতে হল, আর গাড়িও দাঁড়ালো রাস্তার ধারে। কয়েক সেকেন্ডের বিরতি, কিন্তু সমস্যা হল, এবারে আর গাড়ি চালু হয়না। স্টার্ট করার চেষ্টা করলেই কেমন একটা বিশ্রী আওয়াজ হতে লাগল। ডিকে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে চলে গেল। সামনের উইন্ড স্ক্রীনের ওপর বৃষ্টির ফোঁটা দেখে বুঝতে পারছি বৃষ্টির বেগটা একটু কমেছে, তবে শরীর ভিজিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। ইতিমধ্যে আমার সঙ্গের তিন সহযাত্রীর ঘুম ভেঙে গেছে, তবে তাঁরা কেউ নামতে চাইলেন না। আমি যদিও গাড়ির যান্ত্রিক ব্যাপার কিছুই বুঝিনা, তবু নামলাম, সালগাওকার স্যার আমার পিছু পিছু।


গাড়ি থেকে নেমে ডিকের মুখ দেখেই বুঝেছি কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে! ডিকে নিজের জ্যাকেটের সঙ্গে লেগে থাকা টুপিটা মাথায় তুলে দাঁড়িয়ে আছে আর গাড়ির বনেট খোলা। কাছে গিয়ে দেখি, গাড়ির ইঞ্জিন থেকে কেমন ধোঁয়া বেরোচ্ছে, আর গাড়ির বনেটের মধ্যে সাদা পালকের ছড়াছড়ি। তবে তাতে অনেক লাল ছোপ ও রয়েছে, বেশ মিনিট দুই তিন বাদে বুঝলাম একটু আগে উড়ে আসা একটি পাখি কোন ভাবে গাড়ির তলায় ঢুকে যায়, আর তারপর তার শরীর গাড়ির ফ্যান বেল্টে জড়িয়ে যায়। চাপা পড়লে হয়তো এটা হতো না, গাড়ির বনেটে ঢুকে পড়াতেই যত বিপত্তি! আমার একটা জিনিস ক্লিয়ার হচ্ছিল না, নিচ থেকে গাড়ির বনেটে ঢোকার জন্য একটা সামান্য জায়গা থাকে সেখান দিয়ে এতো বড় আকারের একটা পাখি ঢুকলই বা কেমন করে? ডিকে বলছিল, পাখির শরীরের চর্বি হয়তো ইঞ্জিনে ঢুকে গেছে, আর সে কারণে ইঞ্জিন হয়তো এখুনি স্টার্ট হবে না। সালগাওকার স্যার নিজের ব্যাগের মধ্যে থেকে একটা রুমাল বার করলেন তারপর তার ওপর মৃত পাখিটার পালক, রক্ত, কেটে পড়ে থাকা মাংসের খন্ড গুলো তুলে রাস্তার একটা পাশে নিয়ে গেলেন। পাখিটার দেহ একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছিল, তাও যতটা সম্ভব উদ্ধার করা যায় সেগুলোকে নিয়ে রাস্তার ধারে এক কোণায় রেখে দিলেন। তারপর গাছপালা আর রাস্তার ধারে পড়ে থাকা মাটি আর পাথর দিয়ে এমন ভাবে চাপা দিয়ে দিলেন যাতে আর কোন পশু বা পাখি এসে সেটাকে চেখে না দেখতে পারে। পশু পাখি এতো ভালবাসেন, চোখের সামনে এই রকম একটা রক্তাক্ত পাখির মৃতদেহ পরিষ্কার করা সত্যি যন্ত্রণাদায়ক। মুখে কিছু বলেননি, খালি একটা কথাই বললেন, “গ্রেট ইগ্রেট মানে আমরা যাকে ‘হোয়াইট হিরন’ বলে থাকি, খুব সম্ভব সেই পাখি। কিন্তু এতো গুলো এক সাথে ধেয়ে এলো তারপর সেগুলো গেল কোথায়?”


আমাদের সঙ্গে যে তিন সহযাত্রী ছিলেন তাঁদের সঙ্গে এবারে ভালো করে পরিচয় হল। তিনজনের মধ্যে প্রথমজন যিনি ড্রাইভারের পাশে বসে এতক্ষণ এলেন, তার নাম আশিস, আর দুজনের একজন পরমজিত আর তৃতীয় জন যোগেশ, এরা আসছে দিল্লী থেকে। আস্তে আস্তে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে, আমরা দুজনেও গ্রেট ইগ্রেটের মৃতদেহ পরিষ্কার করে আবার গাড়ির মধ্যেই ঢুকে পড়েছি। জলভরা মেঘ ভেসে আসছে চারদিক থেকে, গাড়ির কাচ খোলা ছিল, সেখান দিয়েও মেঘ ঢুকে পড়ে থেকে থেকে। আমাদের সঙ্গের তিনটি ছেলে, তারা অবশ্য গাড়ি থেকে নামেনি একেবারে। আমার একটা হুডি ছিল তা দিয়ে মাথা এবং শরীর দুটোই বেঁচেছে, ভেজা হুডিটাকে গাড়ির পেছনে চালান করে দিলাম। সালগাওকার স্যারের পরনে একটা কালো জ্যাকেট ছিল, সেটা কিন্তু বেশ ভিজে গেছে, তাতে ওনার অবশ্য তেমন কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। যাহোক, মিনিট দশ পনের বাদে যেটা বুঝলাম, এই গাড়ি এক্ষুনি ঠিক হবে না। গাড়ির ইঞ্জিন পরিষ্কার করতে হবে আর তাতে সময় লাগবে। বনগাঁইগাও এর সার্ভিস সেন্টার থেকে লোক আসছে, তারা হয়তো এই গাড়িকে ‘টো’ করে নিয়ে যাবে। ঘড়িতে প্রায় দেড়টা হয়ে গেছে, পাহাড়ের ওপর বিকেল শুরু হয়ে গেলে সন্ধ্যে নামতে আর সময় লাগে না। চট করে অন্ধকার হয়ে আসে চারপাশ। বনগাঁইগাও থেকে আসা গাড়ি হয়তো আমাদের কাছেপিঠে কোথাও পৌঁছে দিতে পারে। তবে আমাদের গন্তব্য ‘দরগা’ অথবা বাকিদের গন্তব্য ‘মোঙ্গার’ পৌঁছে দেবে না। সুতরাং আজ রাতটা কাছাকাছি কোথাও থাকার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ডিকে বলছিল, এখান থেকে এক কিলোমিটার এগোলে একটা ফরেস্ট কটেজ আছে, সেখানে জায়গা পাওয়া যায়। কাল সকালের মধ্যে হয়তো গাড়ি ঠিক হয়ে যাবে তখন সে আবার এসে আমাদের জয়েন করবে। তাতে আমাদের তেমন কোন অসুবিধা ছিল না। তাছাড়া আমাদের কোন হোটেল বুকিং ছিল না, সুতরাং আমাদের কাছে মানসের ফরেস্ট কটেজে রাত কাটাতে কোন সমস্যাই ছিল না। তবে সমস্যা হল আমাদের তিন সহযাত্রীকে নিয়ে। তাঁদের বোধহয় মোঙ্গারে হোটেল বুকিং আছে, এখন পৌঁছতে না পারলে টাকা তো মার যাবেই, বুকিংটাও না ক্যান্সেল হয়ে যায়। পাহাড়ের ওপর তারপর চারদিকে ঘন জঙ্গল, মোবাইল সিগন্যালও বেশ দুর্বল! যদিও তাঁরা সমানে চেষ্টা চালাচ্ছেন মোঙ্গারের হোটেলে যোগাযোগ করার!


ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত একটা হলো। ফরেস্ট বিভাগের একটা পুরোনো বাংলো, সেটা পাওয়া গেল। ফোন করে একটা পারমিশানের দরকার ছিল। সালগাওকার স্যার কথা বললেন, বনবিভাগও রাজী হয়ে গেলেন। বর্ষার সময় বেশীর ভাগ সময় বন্ধই থাকে। মূলত ফরেস্ট অফিসারদের ব্যবহার করার জন্য। দ্বিতল কটেজ যার দোতলাটা বন্ধ, এক তলায় চারটে ঘর, সেখানে পাশাপাশি দুটো ঘর খুলে দেওয়া হলো। একটা ব্যাপার দুটো ঘরের মাঝেও একটা দরজা আছে, সেটা অবশ্য দুদিক থেকেই বন্ধ করা যায়। কারণ জিজ্ঞাসা করতে আমাদের কটেজের কেয়ার টেকার বলল, “অনেকে এটাকে টুইন রুম হিসেবে ব্যবহার করেন, সেক্ষেত্রে মাঝের দরজাটা খুলে দিলেই হল”। যাহোক, একটু দেরী হল অবশ্য, আমরা যখন কটেজে ঢুকলাম তখন প্রায় তিনটে বেজে গেছে। আমাদের গাড়ী ‘টো’ করে বনগাঁইগাও নিয়ে গেল। ডিকের সঙ্গে কথা হয়েছে, কাল সকালে গাড়ি নিয়ে এলে আমরা ‘দরগা’র উদ্দেশ্যে এগোবো।


ঘরটা বেশ বড়, দুটো বেশ বড় সাইজের বেড, মাঝেও বেশ খানিকটা জায়গা, পাশেই সংলগ্ন টয়লেট। আলাদা করে খাবার জায়গা নেই, ঘরে ঘরেই খাবার দেওয়া হবে সেই রকম শুনলাম। আমাদের কটেজের কেয়ারটেকারের নাম ‘ওমি’, মধ্যবয়স্ক, এখান থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরে বিতানা গ্রামে তার বাড়ি। ভুটানি, কিন্তু হিন্দী ভালো বলতে পারে, ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলাও বলছিল, অবশ্য অসমিয়া একটা টান আছে। গ্রামে তার একটা দোকান আছে এই কাজটা পার্ট টাইম। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি, পাহাড়ের লোকেরা এমনিতে খুব ভালো হয়ে থাকেন, ‘ওমি’ তার ব্যতিক্রম নয়। মিনিট দশেকের মধ্যেই চা এসে গেল। সারাদিন গাড়িতে জার্নি তারপর জঙ্গলে গাড়িতে বন্দী হয়ে থাকা ক্লান্ত হয়ে পড়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। আমিই সালগাওকার স্যারকে একটু রেস্ট করে নিতে বললাম, আমি কিন্তু ঠিক করেছিলাম জেগেই থাকবো। গত দুদিন ধরে একটা ইংরাজি নভেল পড়ছিলাম, সেটাই পড়ব ঠিক করেছিলাম কিন্তু কখন যে চোখ লেগে গেছে বুঝতে পারিনি।



ফরেস্ট কটেজে এক রাত



ঘুম যখন ভাঙল তখন বিকেল হয়ে গেছে, আলো কমে আসছে কারণ পাহাড়ের আড়ালে সূর্যের ঢলে পড়া শুরু হয়ে গিয়েছে, তবে বৃষ্টি এখনো হচ্ছে। সালগাওকার স্যার আগেই উঠে পড়েছিলেন, আমি ঘর থেকে বাইরে এসে দেখলাম সালগাওকার স্যার ওমির সঙ্গে সামনের বারান্দায় বসে গল্প করছেন, হাতে একটা কাপ ধরা, খুব সম্ভব চায়ের দ্বিতীয় রাউন্ড চলছে। আমি যেতেই ওমি উঠে দাঁড়ালো, ভাঙ্গা বাংলায় জিজ্ঞাসা করল “আপনি চা খাবেন?”

“হ্যাঁ, খেতে পারি! কিন্তু এতো বৃষ্টিতে আনবে কি করে?” আমি ভেবেছিলাম কিচেনটা ওপাশে, মানে সামনের লনটা পেরয়ে যেতে হবে। ওমি বলল, “না স্যার, কিচেন তো এখানে, ঐ দিকে তো আমার থাকার জায়গা। করাই আছে, নিয়ে আসছি, একটু বসুন”

বৃষ্টির বেগ বাড়ছে, থেকে থেকে আকাশের বুক চিরে আলোর ঝলকানি দেখা দিচ্ছে, চারদিক যেন ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে, তবে কোন শব্দ নেই। আস্তে আস্তে আলো কমে আসছে, আর তাতে ব্যালকনিতে একটা খুব কম পাওয়ারের আলো আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। এই আলো আঁধারিতে জায়গাটা কেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে। আমরা যেখানটায় বসে আছি তার ওপর একটা চালা রয়েছে, সেটা থেকে অঝোরে জলের ধারা এসে সামনের লনটার ওপর পড়ছে। স্বল্প জলের ছিটেও এসে লাগছে, সালগাওকার স্যার সিগার ধরালেন। ওমি চা নিয়ে এলো, এখানে আসামের চা। যদিও আমার দার্জিলিং চা বেশী ভালো লাগে, তবু এটাও ভালো। সে চায়ের স্বাদ সেটা আবার পাহাড়ে এই বৃষ্টির সন্ধ্যায় প্রাণ ভরে উপভোগ করছি। আমাদের পাশের ঘরের দরজা যেটা এতক্ষণ ভেজানো ছিল, সেটা এবারে খুলে গেল। আশিস, পরমজিত এবং যোগেশ তিনজনেই বাইরে এল, আর একবার ওমির জন্য চায়ের হুকুম। “বসতে পারি কি আপনাদের সঙ্গে?” পরমজিত জিজ্ঞাসা করল।

“হ্যাঁ নিশ্চয়ই” আমাদের আপত্তির কোন কারণ ছিল না।


একটা – দুটো এদিক ওদিক কথার পর ওদের সিনেমার প্রসঙ্গে এসে পড়লাম। যেটা জানলাম, এরা একটি ফিল্ম বানাচ্ছে, শর্ট ফিল্ম, এদের তিনজনের মধ্যে পরমজিত হল ডাইরেক্টর, আশিস ডায়লগ লেখে আর যোগেশ হল ক্যামেরাম্যান, ফিল্মের ভাষায় যাকে ‘ডিওপি’ বলে। হিমালয়ের কোলে এক অসাধারণ লোকেশন হল এই ‘মোঙ্গার’। একটা দুটো ছবি দেখলাম, পাহাড়ে ঘেরা জলাশয়ের ধারে ছবিতে অনবদ্য লাগছিল। সালগাওকার স্যার গল্পটা জানতে চাইছিলেন, ওরা বলছিল। সাসপেন্স, থ্রিলার বেশ ভালো তবে শেষে ব্যাপারটা কেমন ভৌতিক লাগল আমার। তার ওপর এই রকম পরিবেশ! গল্পটা বেশ জমে উঠেছিল, বেশীক্ষণ এগোল না কারণ হঠাৎ করেই অনেক ছোট ছোট পোকা কেমন যেন আমাদের মাথার ওপর এসে উড়তে শুরু করল। মশার মতো, তবে মশা নয়, ওরা মাথার ওপর উড়ছিল তবে কামড়াচ্ছিল না, কিন্তু প্রথম আশিস বলল, ওকে নাকি কামড়াচ্ছে! সেই প্রথম বলল, “স্যার, ভেতরে চলুন, পোকাগুলো বড্ড জ্বালাচ্ছে!”

সালগাওকার স্যার প্রথমটায় বলেছিলেন, “মনে হচ্ছে মিজেস, এরা মশার মতো তবে কামড়াবে না। পশ্চিম হিমালয়ে এরা বেশী আছে”


কিন্তু হয়তো সালগাওকার স্যার চিনতে ভুল করেছিলেন, আশিসের বাঁ হাতের কবজীর কাছে একটা কামড় পড়েছে, জ্বালাও করছে, আর জায়গাটা লাল হয়ে স্বল্প ফুলে উঠেছে, ঠিক পিঁপড়ের দংশনে যেমন হয় তেমন! অগত্যা উঠতেই হল। সালগাওকার স্যার চুরুটের আগুন নিভিয়ে উঠে পড়লেন, আশিস, পরমজিত এবং যোগেশ চায়ের কাপ নামিয়ে ভেতরে চলে গেল, আমি সবে মাত্র একটা সিগারেট ধরিয়েছিলাম সেটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। ইতিমধ্যে বৃষ্টি কিন্তু ধরে এসেছে, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন তবে বৃষ্টির ধারা কমে এসেছে, হাল্কা জলের ফোঁটা গায়ে পড়েই কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে। একমনে নিবিষ্ট হয়ে সিগারেট টান দিচ্ছি হঠাৎ একটা কেমন কাঠ ভাঙ্গার চেরা আওয়াজ পেলাম। “কি হল?” “ভুল শুনলাম”। প্রথমবারে যা শুনেছিলাম সেটা ভুলও হতে পারে। মন নিবিষ্ট করে শোনার চেষ্টা করলাম, তবে ব্যালকনি থেকে নিচে নামিনি, বরং কয়েক ধাপ পিছিয়ে এলাম, আবার একবার সেই শব্দ এল, সেই কাঠ-কাটার আওয়াজ আর সঙ্গে যেন একটি তেজিয়াল কাকের কর্কশ স্বরে চিৎকার। দ্বিতীয়বারেও কি ভুল শুনলাম, সূর্যের আলো এখন একেবারে কমে এসেছে, হাতের ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে সাড়ে ছটা, আবার একবার আওয়াজ টা পেলাম! একজন বনকর্মী কিন্তু আমাদের হিন্ট দিয়ে গেছিলেন। তাহলে? সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছি, ওমিকে দেখলাম, সে বারান্দার আর এক প্রান্ত থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ওর দিকে তাকাতে আমাকে মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করতে বলল। কয়েক সেকেন্ড চাপা গলায় কথা হল, বুঝলাম আমার বুঝতে ভুল হয়নি। তিনটে ডাক কিন্তু লঙ্গুরের, উপস্থিতি বুঝেই যারা আগে ভাগেই জানান দেয়। আমার অনুমান সঠিক, কাছেই আছে হাল্কা হলুদের ওপর কালো দাগ ওয়ালা প্রায় আড়াইশো কেজি ওজনের সেই চতুষ্পদ, যার ছবি তোলার জন্য আমার মতো ফটোগ্রাফাররা জলে জঙ্গলে জীবনের অর্ধেকটা সময় অনায়াসে কাটিয়ে ফেলেন। ওমি বলল, “স্যার আপনি ঘরে যান! আমি না ডাকলে বেরোবেন না! কাছেই আছে, এখনো কটেজ টা পেরোয়নি! আর এই আলো জ্বলুক!”


কেমন একটা থমথমে ব্যাপার বিরাজ করছে চারদিকে। বৃষ্টিও থেমে গেছে, ব্যালকনির চালা থেকে চুইয়ে পড়া জল নিচে পড়ে একটা শব্দ করছে। আর সেই শব্দ যেন চারপাশের নিস্তব্ধতাকে আর বেশী করে ফুটিয়ে তুলছে। সালগাওকার স্যার ঘর থেকেই লঙ্গুরের ডাক শুনতে পেয়েছেন, তিনিও বেরিয়ে এসেছেন তবে কোন শব্দ না করে। ওমি আবার বলল, “স্যার ভেতরে যান, চলে যাবে! তবে এদিক টা বড্ড ফাঁকা তো! জনবসতি একদম নেই।”

“তুমি কোথায় যাচ্ছ? তুমি এখন একা ও ঘরে যেও না! তুমি আমাদের সঙ্গে এসো” সালগাওকার স্যার ওমিকে আমাদের ঘরে আসতে বললেন।

“স্যার, আমাদের অভ্যেস আছে, চিন্তা করবেন না! আমি দেখি একটা মশাল জ্বালিয়ে রাখি, তাহলে আর এদিকটায় আসবে না”

সালগাওকার স্যার আমাদের পাশের ঘরের দরজায় দুটো টোকা দিলেন, দরজা খুলে যোগেশ বেরোল। সালগাওকার স্যার সংক্ষেপে তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন, “একদম বাইরে বেরোবে না, যদি কিছু লাগে ভেতরের দরজা খুলে আমাকে বলবে। আর একদম প্যানিক করো না, ও কিছুক্ষন বাদে এমনিই চলে যাবে!”

আমরা সবাই ঘরে ঢুকে পড়লাম, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করতে হল। আমাদের ঘরে দরজার পাশেই একটা কাচের জানলা আছে, সেটা বন্ধই ছিল। সেটার কাছে বসে ছিলাম, সজাগ চোখে যদি তার দেখা মেলে। ঘরের আলো নিভিয়ে রেখেছি, তাতে বাইরের দৃশ্যটা তুলনামূলক ভাবে পরিষ্কার লাগে। আস্তে আস্তে রাত বাড়ছে, নিশ্ছিদ্র অন্ধকার বাইরে, সামনের দিকে দৃষ্টি একটু প্রসারিত হয়, আমাদের কটেজে ঢোকার গেট পর্যন্ত বেশ দেখা যায়। তারপরেই ঘন জঙ্গল, পেছনে পাহাড়। সালগাওকার স্যারও আমার পাশেই বসে, উনি অবশ্য পীথরাগোড়ে বাঘ দেখেছেন, ঠিক সামনে থেকে নয় তবে দেখেছেন। আমাকে বলেছিলেন আগে, তবে আমার জন্য এইরকম অভিজ্ঞতা কিন্তু এই প্রথম। আরো দুবার লঙ্গুরের ডাক শুনেছি, সুতরাং এটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি আমাদের কটেজের চত্বর এখনো বিপদমুক্ত নয়। মিনিট দশেক বাদে একটা পোড়া গন্ধ নাকে এলো, বুঝলাম ওমি আগুন জ্বালিয়েছে। আরো আধা ঘণ্টা আমরা আলো নিভিয়ে বসেছিলাম, কিছু দেখতে পাইনি, তবে লঙ্গুরের ডাক আর শুনিনি।


খাওয়া দাওয়া শেষ হল তখন রাত সাড়ে নটা। রুটি, অড়হড় ডাল সঙ্গে ফুলকপির চচ্চড়ি। এক এই রকম কোন প্রস্তুতি ছাড়াই হঠাৎ করে এসে পড়লাম, তারপর সন্ধ্যেবেলায় যা আতঙ্ক ছিল! যাহোক, এর মধ্যেও যে ওমি এতো রকম আয়োজন করে ফেলল, কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। খাওয়ার পর বাইরে এসে সিগারেট ধরিয়েছি, সালগাওকার স্যার চুরুট ধরালেন। বৃষ্টি এখন আর হচ্ছে না, তবে আকাশ এখনো পরিষ্কার হয়নি, ভালোই মেঘ রয়েছে। আমাদের পাশের ঘরের দরজা একেবারেই বন্ধ, সালগাওকার স্যার সন্ধ্যেবেলা তাদের ভালোই ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন! তবে সেটা একদিক দিয়ে ভালো! একে তো অজানা জায়গা তারপর এই বৃষ্টির রাত, চারদিক অন্ধকার, জঙ্গল, সেখানে ঘরে থাকাই ভালো! এদিকে ওদিকে ঘুরে বিপদ ডেকে আনলে আমরা সবাই সমস্যায় পড়ব। আমরা দুজনে আরো মিনিট দশ-পনের মতো বাইরে ছিলাম, ওমির খাওয়া হয়ে গেছিল। ঘরে যখন ফিরছি তখন প্রায় রাত দশটা। ঘরে ফেরত আসার আগে ওমি একটা কথা বলল আর সেটা আমাদের অ্যাড্রিনালিনের একটু অতিরিক্ত নিষ্ক্রমণের জন্য যথেষ্ট ছিল। “স্যার, আপনারা ঘর থেকে একদম বেরোবেন না! আমার ঘরটাতে ছাগল বাঁধা আছে, সেই যে সন্ধ্যে থেকে ছটফট করা শুরু করেছে এখনো করছে! মনে হচ্ছে এখনো কাছে পিঠেই আছে! আমি সন্ধ্যাবেলায় রেঞ্জার অফিসে খবর করে দিয়েছি। দরকারে ওঁরা এসে যাবেন!”

“ওঁরা কি এখানেই আসবেন?”

“না এখানে নয়, আর একটা কোয়ার্টার আছে কাছেই আর সেখানে একটা ওয়াচ টাওয়ারও আছে! সেখান থেকে নজর রাখতে সুবিধা হয়”

“ঠিক আছে, আমরা ঘরে গেলাম, কোন দরকার হলে জানিও!”

সেদিন রাতে ঘুম হবে না জানতাম। প্রথম রাতটা জেগেই ছিলাম, কিন্তু তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। ঘুম ভাঙল সালগাওকার স্যারের গলার আওয়াজে। উঠে পড়লাম, “কি হলো স্যার?”

“বাইরে একটা গন্ধ পাচ্ছ?”

ঠাহর করতে একটু সময় লাগল, তবে বুঝলাম কেমন যেন একটা তীব্র গন্ধ, বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। একটু স্থিত হতে বুঝলাম আমাদের দুটো ঘরের মাঝের দরজাটা খোলা। প্রথমটায় মাথা কাজ করছিল না, সালগাওকার স্যার ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন। মিনিট পনের-কুড়ি আগের কথা, আমাদের মাঝের দরজাতে আওয়াজ হতে সালগাওকার স্যারের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি দরজা খুলতে দেখেন অন্য ঘরের পরমজিত দাঁড়িয়ে, ভীত, সন্তস্ত, চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। “কি ব্যাপার?”

“কেউ মনে হচ্ছে আমাদের দরজায় নক করছে! প্রথমটায় ভেবেছিলাম ওমি, আমরা দুবার জিজ্ঞাসা করতে কোন সাড়া পেলাম না। ওমির নাম ধরে ডাকলাম, কিন্তু সাড়া পেলাম না। তাই দরজা খুলি নি। তারপর আবার মিনিট পাঁচেক বাদে দরজায় ঠক ঠক করে আওয়াজ হচ্ছে! জানিনা কিসের?”

সালগাওকার স্যার ওদের ঘরে যান, বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। আবার দরজায় আওয়াজ, তবে ঠিক ঠক ঠক করে নয়, কেমন যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে যেন কেউ! খুব জোরে নয়, তবে এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে কেউ যেন বাইরে থেকে দরজায় নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। আমাদের ঘরের জানলা দিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে কিছু দেখা যায়নি। মোবাইল কানেকশন দুর্বল হলেও বনবিভাগের ফোন নম্বরে লাগালে ফোন বাজছে, কিন্তু মুশকিলটা কেউ ধরছে না সে ফোন। এরপরেই আমাকে ডাকা, আমি সাথে সাথেই উঠে পড়েছি। চোখ থেকে ঘুম উধাও হতে সময় লাগেনি। আমি ওনার পিছু পিছু পাশের ঘরে গেলাম। আশিস, পরমজিত এবং যোগেশের চোখে মুখে আতঙ্কের ছায়া, আশিস ঘরের একটা কোণায় সোজা হয়ে বসে আছে, পরমজিত আর যোগেশ এদিক ওদিক করছে বটে তবে একেবারেই উদ্দেশ্যহীন ভাবে। বরং সালগাওকার স্যার অনেকটা স্টেডি। এদিকে দরজাটা তেমন শক্ত পোক্ত নয়, এরা একটা বেডকে সাঁটিয়ে দিয়েছে দরজার সঙ্গে। অবশ্য যদি বাইরে থেকে তেমন জোরে ধাক্কা দেওয়া হয় আমি জানিনা দরজায় লাগানো খাট সেটাকে কতক্ষণ প্রতিরোধ করতে পারবে। আমরা সবাই সবাইয়ের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। যদিও আমার মাথা ঠিকঠাক কাজ করছিল না, তবে দরজার ওপর যে আঘাতটা আসছে সেটা কিন্তু একেবারে মোলায়েম নয়। কেমন যেন বাইরে থেকে কেউ দরজাটাকে কেউ আঁচড়াচ্ছে! দরজার কাছে সেই তীব্র গন্ধটা আবার পেলাম। আমাদের পাঁচ জনের কারুরই বুঝতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না, আমাদের দরজার বাইরে কি আছে আর কিসের শব্দ এই গুলো? সালগাওকার স্যার প্রথম বললেন, “ওমির কি হল বলো তো?”

মশালের পোড়া গন্ধে এবারে আমার মাথা এবারে কাজ করল, “স্যার, মশালটা কিন্তু জ্বলছে! গন্ধ আসছে”

“ওমি কে কি মেরে দিল নাকি?”

আমার মুখে কোন কথা আসেনি। তবে পাশ থেকে যোগেশের গলা শুনলাম “মনে তো হচ্ছে! নাহলে ও নিশ্চয়ই এতক্ষণে কিছু একটা করত”

যোগেশ আবার বলল, “স্যার, একটা রাস্তা আছে। পেছনে একটা দরজা আছে, সেটা দিয়ে কিচেনে যাবার একটা রাস্তা আছে! সেখান থেকে মশাল টা আনতে পারলে”

সালগাওকার স্যার সাথে সাথে প্রস্তাবটা নাকচ করে দিলেন, “তুমি কি ক্ষেপেছ নাকি? তারপর যদি তোমাকে মুখোমুখি পায়”

“তাহলে উপায়?”

“আমাদের এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। শব্দ কোরো না, আওয়াজ না পেলে ও চলে যাবে” পরক্ষণেই আবার নিজেই বললেন, “কিন্তু সেই সন্ধ্যে থেকেই আমাদের দুটো ঘরে শব্দ বলতে খুব কমই হয়েছে, কিন্তু তাহলে এখনো গেল না কেন?”

সবাই মিলে আমরা সেই রকমই ঠিক করলাম, যদি দেখা যায় দরজার অবস্থা সঙ্গীন মানে যে কোন মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে, আমরা তৎক্ষণাৎ সবাই আমাদের ঘরে চলে যাবো এবং মাঝের দরজাটা বন্ধ করে দেব। মাঝের দরজাটা একটা অতিরিক্ত নিরাপত্তা। আর তার মধ্যে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছিলাম যদি কোন ভাবে বনবিভাগের ফোন নম্বরটা লাগানো যায়।

প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে আমাদের বিনিদ্র রজনী এবং উৎকণ্ঠা শেষ হল। বাইরে একটা শব্দ হল, মনে হল গুলির আওয়াজ। তবে এখন তো জীব জন্তুকে গুলি মারা হয়না, এটা তাদের ভয় পাওয়ানোর জন্য। তার ঠিক পরেই একটা প্রচন্ড ভারী জিনিস যেন সামনের জমে থাকা ঘাসজমির এসে পড়ল। তারপরেই একটা ভারী আওয়াজ আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে জানলায় চোখ পাতলাম, কিছু দেখতে পেলাম না। আমরা দরজা খুলিনি, সেই বন্ধ দরজার সামনে আমরা পাঁচ জনে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছি, বেশ মিনিট পাঁচেক বাদে প্রথমে জিপের শব্দ তারপর মানুষের গলার শব্দ পেলাম। এবারে আমাদের ঘর থেকে দেখা গেল, তিনজন লোক দেখে বনবিভাগের কর্মী মনে হল, দুটো জোরালো টর্চ সমস্ত অন্ধকার এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে। আমাদের ঘরের দরজা খুলে সালগাওকার স্যার প্রথমে বেরোলেন, পেছনে আমি। ওনার হাতেও একটা টর্চ, চেঁচিয়ে জানান দিলেন, ‘আমরা এখানে’। তিনজনের একজন আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন, বাকী দুজন পেছনে। কথাবার্তা হিন্দীতেই হচ্ছিল।

“কি ব্যাপার অফিসার?” সালগাওকার স্যার জানতে চাইলেন।

“বাঘ এসেছিল! সন্ধ্যে থেকেই এদিকে ছিল, যাক এখন চলে গেছে”

“কিন্তু এটা তো কোর এরিয়া নয়! তাহলে বাঘ কেন?”

“চলে আসে মাঝে মধ্যে!

“আচ্ছা, আমাদের কেয়ারটেকার ওমি, ও কোথায় গেল?”

“এখানে ঢোকার সময় ওকে ইঞ্জিওরড করেছে।”

“ইঞ্জিওরড?”

“হ্যাঁ, তবে আঘাত তেমন গুরুতর নয়, চিন্তা নেই বেঁচে যাবে। ওর ঘরে একটা ছাগল বাঁধা রয়েছে তাকেও কিছু করেনি”

সালগাওকার স্যার আরো কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলেন, এমন সময়ে পেছন থেকে আর একজন ফরেস্ট অফিসার বললেন, “আপনাদের সঙ্গে আর কে আছে?”

“তিনটি অল্প বয়স্ক ছেলে, সিনেমা বানায়! দিল্লী থেকে আসছে”

“আপনারা আর কতদিন আছেন এখানে?”

“কাল সকালে বেরিয়ে যাচ্ছি, এখান থেকে”

“ঠিক আছে, আপনারা এখন শুয়ে পড়ুন। আজ রাতে ও আর আসবে না, পালিয়ে গেছে। আমরা আশেপাশেই আছি”

একটু ইতস্তত ভাব থাকলেও আমি বললাম “কোন দরকার হলে যদি কাইন্ডলি আপনাদের ফোন নম্বর টা একটু দেন”

ফোন নম্বর নিয়ে ঘরে এলাম তখন ঘড়িতে তিনটে পাঁচ। ঘরে ফিরে সালগাওকার স্যার চুরুট ধরালেন। একটু অবাক লাগল এই মধ্য রাতে তাঁকে চুরুট ধরাতে দেখে। তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আমার উদ্দেশ্যে নয়, তবে যেহেতু আমি ছাড়া আর কেউ সেখানে ছিল না, আমাকে শুনতেই হল, "ব্যাপারটা অদ্ভূত তাই না! ওমির ঘরে একটা ছাগল বাঁধা আছে, কিন্তু বাঘ তাকে কিছু না করে সোজা কটেজের দরজায় হানা দিল! আবার ওমিকেও খালি একটা ধাক্কা মেরেছে, ওকে তো মেরে দিতে পারতো! ওকে কিছু করল না! কেন?”

কথা গুলো একটাও ভুল নয়, আগে মনে আসেনি কিন্তু ভেবে দেখলে সব কটাই সঠিক প্রশ্ন, “আপনার কি মনে হচ্ছে?”

“কেমন একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি! তাহলে অ্যারন কি ঠিক সন্দেহ করেছিল?”

অ্যারন মানে সেই প্রানীবিজ্ঞানী, অ্যারন অ্যান্ডারসেন, যার লেখা পড়েই এই ‘দরগা’র কথা জেনেছেন সালগাওকার স্যার। “কি লিখেছিলেন অ্যারন অ্যান্ডারসেন?”

সালগাওকার স্যার আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না, খালি বললেন, “কি করে সম্ভব হতে পারে, সেই অবাস্তব তথ্য?” আমি আর কিছু জানতে চাইনি, তবে একটা জিনিস বেশ বুঝতে পারছিলাম, খালি প্রজাপতি, পাখি আর ‘ডোরাডো’ লেক দেখতে সালগাওকার স্যার আসেননি। আরো কিছু পড়েছিলেন অ্যারন অ্যান্ডারসেনের ডাইরিতে, সেগুলোর সত্যতা যাচাই করাও বোধহয় তাঁর আর একটা উদ্দেশ্য আছে।




জঙ্গলের রাস্তায়




ওমি না থাকায় সকালে আমাদের কটেজে চায়ের কোন বন্দোবস্ত হয়নি। আর সেটা আমরা আশাও করিনি। আমাদের ড্রাইভার ‘ডিকে’ জানাল গাড়ি স্টার্ট হয়ে গেছে ওর এখানে পৌঁছতে প্রায় সাড়ে এগারোটা হবে। ততক্ষন কিছু না খেয়েই থাকার সম্ভাবনা ক্রমে বাড়ছিল। শেষ পর্যন্ত কালকের ফরেস্ট অফিসাররা আমাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করলেন। ওঁদের কোয়ার্টারে খাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল সেখানেই আমাদের আসতে বললেন। ওঁদের জীপও আমাদের জন্য ব্যবস্থা করে দিলেন। আমরা পাঁচ জনে একসাথেই গেলাম, কালকে রাতের পর থেকে এমন একটা আতঙ্ক শরীরে ঢুকে পড়েছে যে আমরা সবাই আঠার মতো একজন আর একজনের সঙ্গে সেঁটে আছি। যাহোক, সকালে আকাশ পরিষ্কার, চারদিকে সূর্য ঝলমল করছে। কালকে সারাদিন মেঘে ঢাকা ঝাপসা পাহাড় দেখেছি আর আজ দেখছি ঝকঝকে পাহাড়। আমরা সাড়ে নটার সময় পৌঁছে গেলাম, মালপত্তর জীপে তোলা ছিল। ডিকে কে বলা আছে সে ফরেস্ট অফিসার কোয়ার্টারে চলে আসবে, সেখান থেকেই আবার আমাদের পাহাড় চড়া শুরু হবে। আমাদের জলখাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল কোয়ার্টারের সামনে একটা মাথা ঢাকা জায়গায়, তার চারদিক খোলা। খাবারের আয়োজন তেমন কিছু নয়, তবে এর মধ্যেও ব্রেড টোস্ট আর চা পাওয়া গেল সেটাই অনেক। তার ওপর চারদিকের সৌন্দর্য তো বোনাস। আমরা খাওয়া শুরু করেছি ঠিক এই রকম বেশ কিছু প্রজাপতি চোখে পড়ল। সবই যে একেবারে নতুন ধরণের তা নয়। আগে দেখেছি, তবে খুব সুন্দর। ক্যামেরা সঙ্গেই ছিল, ছবি তোলা শুরু হয়ে গেল। মিনিট তিন চার বাদে বুঝলাম প্রজাপতির সংখ্যা যেন আস্তে আস্তে বাড়ছে। মানে আগে যেটা তিন চারটে ছিল, এই কয়েক মিনিটে সেটার সংখ্যা প্রায় দশ পনের হয়ে গেল। আর একটা অদ্ভূত কথা, বেশীর ভাগ প্রজাপতি কেমন যেন আশিসের মাথার ওপর একটা বৃত্ত বানিয়ে উড়তে শুরু করল। আমরা সবাই কাছাকাছি আছি, তবু যেন আশিসের দিকেই প্রজাপতিদের ভীড়। ব্যাপারটাকে পরীক্ষা করতে আমরা বাকি চারজন নিজেদের মধ্যে কথা বলে সেখান থেকে উঠে একটু দূরে চলে এলাম। আর আমাদের সন্দেহ যে ঠিক ছিল সেটা প্রমাণ হতে সময় নিল না। একটু আগে যে সংখ্যাটা পনের কুড়ির কাছাকাছি ছিল সেটা প্রায় তিরিশ পয়তিরিশ ছাড়িয়ে গেল, তার মধ্যে কিছু কিছু আশিসের গায়ে মাথায়ও বসতে শুরু করেছে। সালগাওকার স্যারের দিকে তাকালাম, তিনিও অবাক দৃষ্টিতে আশিসের দিকে তাকিয়ে আছেন। “কি ব্যাপার বলো তো! কালকে বিকেলেও মিজেসের মতো পোকাগুলো আমাদের কিচ্ছু করল না, কিন্তু আশিসকে কামড়ালো কেন? আবার এখানে প্রজাপতি আশিসকে কেন টার্গেট করছে?”


আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আশিসের জন্য ব্যাপারটা হয়তো খুব অস্বস্তিদায়ক হয়ে উঠছিল! সে উঠে পড়ল, কোন কথা না বলে সে সোজা গিয়ে জীপে গিয়ে বসল। এবারে যেটা দেখলাম সেটা দেখে আমরা সবাই অবাক হয়ে গেলাম। এতোক্ষন ধরে যে পঁচিশ তিরিশ খানা প্রজাপতি উড়ছিল আমাদের আশে পাশে তারাও কেমন করে কোথায় মিলিয়ে গেল।


আমরা হয়তো ব্যাপারটা নিয়ে আরো কিছু কথা বার্তা বলতাম কিন্তু হলো না কারণ আমাদের জীপটা এসে গেল। একেবারে সাদা চকচকে পরিষ্কার গাড়ী নিয়ে ডিকে চলে এসেছে। আগেই দেখেছি পাহাড়ে এই ড্রাইভাররা খুব সময় মেনে চলে। বলেছিল সাড়ে এগারোটা হবে, যখন এসে পৌঁছল সময় তখন এগারোটা সতের। বনবিভাগের জীপ থেকে মাল পত্তর নামিয়ে সে আমাদের গাড়িতে তুলে নিল। আমাদের ব্রেকফাস্ট মোটামুটি হয়ে গেছিল। ধূমপানের বিরতিটাই বাকী ছিল, সেটাও মিনিট সাত আটেকের মধ্যে হয়ে গেল। আজকে বসার সময় আমরা একটু পরিবর্তন করেছিলাম, ডিকের পাশে সালগাওকার স্যার, মাঝের সীটে আমি আর পরমজিত আর পেছনে আশিস আর যোগেশ। আসলে আশিস শুরু থেকেই বলছিল, ওর নাকি রাতে ঘুম হয়নি, আর ঘুমোনোর জন্য পেছনের বাঁ কোনের সীটটা একেবারে আদর্শ। ডিকে দেখলাম, কালকের ঘটনা জানে। সালগাওকার স্যার আমাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ, তিনিই কথা বলছিলেন আমরা শুনছিলাম। ডিকেও এক কথা বলল, “একটা ব্যাপার অদ্ভূত লাগছে, এটা তো কোর এরিয়া নয় তাহলে বাঘ এলোই বা কেন? যাহোক, আপনাদের কারুর কোন সমস্যা হয়নি সেটাই অনেক”

“আচ্ছা ওমি ছেলেটি কেমন আছে?”

“অনেকটা সুস্থ, কাল রাতেই জ্ঞান এসে গিয়েছিল! ওকে তেমন কিছু করেনি, খালি ঢোকার সময় একবার লাফিয়েছিল, তাতে একটা পা দিয়ে ওর কাঁধে লাগে। পড়ে যাবার সময় মাথায় একটু চোট পেয়েছে, তেমন সিরিয়াস নয়। আসলে ভয় পেয়েই অজ্ঞান হয়ে গেছে”

“যাক! হসপিটাল তাহলে এখানে কাছাকাছি আছে?”

“আছে স্যার! এই পাহাড় থেকে নেমে একটা হেলথ সেন্টার আছে। বেশি দূর নয়, তবে অনেকদিনের পুরোনো। আসলে জঙ্গলে বাঘ ছাড়াও আরো অনেক বিপদের সম্ভাবনা আছে, সেই সব ভেবেই এটা বানানো”



ঝলমলে সামনের রাস্তায় আলো ছায়ার মধ্যে রোদ লুকোচুরি খেলছে। রাস্তা এখানে খুব সুন্দর, দুপাশে ঘন গাছ, এক পাশে গভীর খাদ আর অন্যপাশ খুব উঁচু পাহাড় নয়, তবে জঙ্গলে ঢাকা উঁচু জমি। বুঝতে পারছি আমরা আস্তে আস্তে ওপরে উঠছি। রাস্তা খুব সর্পিল নয়, একটু বাঁকা চোরা আছে তবে তেমন শরীর তোলপাড় করে দেওয়ার মতো নয়। শেষ পনের মিনিট আমরা কেউ কোন কথা বলিনি। অনন্য প্রকৃতির ক্যানভাসে আঁকা সেই অপূর্ব ছবি দেখতে দেখতে চলেছি, গাড়ির স্পীড পঞ্চাশ থেকে ষাটের ঘরের মধ্যে ওঠা নামা করছে, সামনে পেছনে কোন গাড়ি নেই, ডিকের একটা হাত স্টিয়ারিং হুইলে আর একটা হাত জানলায়, জানলার কাচ স্বল্প নামানো, আমার পাশে বসে পরমজিৎ ঘুমিয়ে পড়েছে, পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আশিস এবং যোগেশ দুজনেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, সালগাওকার স্যার গলায় ঝোলানো একটা দূরবীন সকালেই দেখেছি, সেটা দিয়ে থেকে থেকে দূরের দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করছেন, আর আমি শরীরটা সীটে এলিয়ে দিয়েছি আর প্রতি মুহূর্তে পাহাড়ী রাস্তার সেই অসাধারণ ছবি আমার মনের স্মৃতির ডেটাবেসে জমা করার চেষ্টা করছি। হঠাৎই আমাদের গাড়িটা ব্রেক করল, তেমন জোরে নয় তবে কোন প্রস্তুতি ছাড়া ব্রেক তো! সামনের ড্রাইভারের সীটটা ধরে কোনমতে ব্যালেন্স করলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগে ডিকে বলল – “দেখুন স্যার সামনে তাকিয়ে”


উইন্ড স্ক্রীন দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম সেটা সিনেমার পর্দায় দেখেছি, কোনদিন চাক্ষুস দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ঠিক যেন একটা সিনেমার দৃশ্য। তিনটে বাঁদর তাদের চার পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, হয় আক্রমণ অথবা আত্মরক্ষার জন্য। আর ওদের থেকে চার ফিট দূরে দাঁড়িয়ে একটা সাপ, সেও কিন্তু ফনা তুলে ধরেছে। আর থেকে থেকে চকিতে ফনাটা এদিক ওদিক করছে। বেশ মিনিট খানেক লক্ষ করার পর যেটা বুঝলাম বাঁদরগুলোও কিন্তু আক্রমণের জন্য প্রস্তুত। বাঁদর তিনটে একটু চলাফেরা করছে, নিজেদের মধ্যে হয়তো জায়গা বানাচ্ছে সাপটাকে কাবু করার জন্য, একজন চট করে নিজের পজিশন পরিবর্তন করে সাপটার পেছনের দিকে চলে গেল কিন্তু সাপটাও সচকিতে ঘুরল পেছনের দিকে, ফনা উচিয়ে একবার সামনে আবার পেছনে, মানে জানান দিচ্ছে ‘যতটা সহজ ভাবছ ততটা নয়’। সালগাওকার স্যার পকেট থেকে মোবাইল ক্যামেরা বার করে ভিডিও করছেন, আমি বড় ক্যামেরাটা বার করছি এই দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দী করব বলে ঠিক এই সময়ে আমাদের গাড়িটাকে কেমন যেন পেছন থেকে কিছু ঠেলা দিল। অজানা বিপদের আশঙ্কায় আমরা সবাই পেছনে মুখ ঘুরিয়েছি আর যেটা দেখলাম আমার এই ষোল বছরের ফটোগ্রাফার জীবনে সে জিনিস কখনো দেখিনি।


তিন-চারটে প্রকান্ড আকারের হাতী আমাদের গাড়ির পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, আর তাদের মধ্যে একটি হাতি গাড়িটাকে থেকে থেকে ধাক্কা দিচ্ছে। আর তাতে আমাদের প্রায় ২০০০ কেজি ওজনের গাড়িটাকে আস্তে আস্তে রাস্তা থেকে সরে যাচ্ছে, নিচে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাস্তা থেকে আমাদের গাড়ি প্রায় নেমে পড়েছে আর দেড় ফুট বাদে সামনে গভীর খাদ। ডিকের আর্তনাদ শুনলাম “মহাকাল!” ইতিমধ্যে প্রানভয়ে আমরা চেঁচাতে শুরু করেছি, আর আমাদের চেঁচানিতে বাকী তিনজনের ঘুম ভেঙে গেছে। গাড়ির মধ্যে একটা দক্ষযজ্ঞ অবস্থা। সালগাওকার স্যারের গলা শুনলাম, “ডিকে হ্যান্ড ব্রেক লাগাও”

ডিকের গলা শুনলাম, “হ্যান্ড ব্রেক, লাগানো, কিন্তু গাড়ি দাঁড়াচ্ছে না” পেছনের দিকে তাকালাম, এবারে আরো তিনখানা হাতি আমাদের গাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে, বুঝতে পারছি না হাতির ব্রিগ্রেড আমাদের শুদ্ধু ‘ইনোভা ক্রিস্টা’ নিয়ে ফুটবল খেলা শুরু করবে কি না? শরীর, মাথা কিছু কাজ করছে না, আমার জানলার পাশেই একটা মস্ত হাতি শুঁড় উচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকল, জানিনা এই হত্যার পাশবিক আনন্দে আগাম চিৎকার কি না? আবার সালগাওকার স্যারের গলা শুনলাম, “সবাই গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়, এক্ষুনি!”


আর ভাবিনি, যা হবার হবে। চারটে দরজা খুলে গেল প্রায় একসাথে। সালগাওকার স্যার আর পরমজিত বাঁদিক দিয়ে, আমি আর ডিকে ডানদিক দিয়ে, কোনমতে ক্যামেরাটা বাঁচিয়ে রাস্তার ওপর ছিটকে পড়লাম, হঠাৎ করে গাড়ির দরজা খুলে রাস্তায় বেরিয়ে আসায় হাতিরা হয়তো কয়েক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে গেছিল, আর তাতে আমি অতিরিক্ত কয়েক সেকেন্ড সময় পেয়ে গেলাম। আমি সীটটা ভাঁজ করে দিলাম যাতে আশিস আমার দিক দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। তুলনামূলক ভাবে আশিস ছোটখাটো চেহারা, ও চট করে বেরিয়ে আসতে পারল। আর পরমজিত যোগেশ কে আগেই বের করে নিয়েছিল। সালগাওকার স্যার একটা বড়সড় পাথর কোনমতে গাড়ির সামনের চাকার সামনে নিয়ে আনলেন, যাতে গাড়িটার পাহাড় থেকে গড়িয়ে যাওয়াটা আটকানো যায়, আর সেটা আটকেও গেল। কেন জানিনা, এবারে হয়তো মহাকালের শুভবুদ্ধির উদয় হল, আর তারা সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ করে মনে পড়ল সামনে তো সেই বাঁদর আর সাপের রিয়েলিটি শো চলছিল, সেখান থেকে যদি নাগিন দেবতা আমাদের দেখতে পান! কিন্তু ঘুরে দেখলাম রাস্তা পরিষ্কার, হয়তো হাতির তান্ডবে বাঁদর আর সাপ গাছে বা ঝোপে লুকিয়ে আমাদের অসহায়তাকে উপভোগ করছে! ঘটনার আকস্মিকতা এবং ভয়াবহতা দুটোই আমাদের একেবারে অসহায় করে দিয়েছিল, ডিকে চাপা গলায় বলল, “স্যার, রাস্তার দিকে যাবেন না, পিছিয়ে আসুন, আস্তে আস্তে দেখে, এপাশে একটা ঢালু জায়গা আছে, মহাকাল ওখানে আসতে পারবে না”


ডিকের কথা মতো আমরা আস্তে আস্তে একপা, একপা করে পিছিয়ে যাচ্ছি, ঠিক এক সময়ে হাতিদের পালের মধ্যে থেকে একটা অপেক্ষাকৃত সাদা হাতি, তবে আকারে বিশাল, এগিয়ে এল আমাদের দিকে। জানিনা আমাদের দুরমুশ করার জন্য কি না, আবার অনেকগুলো ভয়ার্ত গলার আওয়াজ, আমরা বুঝতে পারছি না হাতিটার কি উদ্দেশ্য? হাতিটা আরো এগিয়ে এল, এবারে যেটা করল সেটার জন্য কারুর পক্ষে প্রস্তুত থাকা সম্ভব নয়। হাতিটা লম্বা শুঁড় বার করে আশিস কে জাপটে ধরল, তারপর সেই ‘কিংকং’ এর মতো সেই অনবদ্য স্টাইলে আশিসের শরীরটাকে ওপরের দিকে ছুঁড়ে দিল, আর তাতে আশিস পৌঁছে গেল সেই হাতির ঘাড় আর পিঠের কাছে। তারপর পিছু ফিরে হাঁটা দিল রাস্তার অন্যদিকে, বাকীরাও তার পিছু পিছু। একবারও আমাদের দিকে তাকানোর কোন প্রয়োজন মনে করল না। খালি একটা হাতি ছাড়া। এক চরম তাচ্ছিল্যে আমাদের সকলের দিকে চাইল তারপর আশিসকে নিয়ে হাতির পাল রাস্তার অন্য প্রান্তে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল।


আমরা পাঁচ জনে ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কি হল, কেন হল কিছু বোঝা গেল না! আমাদের বাকি পাঁচজনকে কিছু করল না, আর আশিসকে কেমন ‘হাইজ্যাক’ করে নিয়ে চলে গেল। ঘোর ভাঙল সালগাওকার স্যারের গলার আওয়াজে, “এ কি করে সম্ভব?”

“কি সম্ভব স্যার?”

“অ্যারন তাহলে যা লিখেছে সব সত্যি?”

আমার মুখ থেকে আপনা আপনি প্রশ্ন বেরিয়ে এল “স্যার, কি লিখেছিলেন অ্যারন?”

“একেবারে অবাস্তব কথা!”

“কি কথা?”

“অ্যানিম্যাল ইন্টেলিজেন্স!”

“মানে?”

“সে দেখেছে রয়্যাল ন্যাশানাল পার্কের পশু পাখীরা মানুষের দেওয়া নির্দেশ নাকি বুঝতে পারে। তাদের মধ্যে মানুষের মতো বুদ্ধি প্রয়োগ করার প্রবণতা দেখা গেছে”

“কি বলছেন?”

“হ্যাঁ, সে কথাই সে লিখেছিল”

“তাতে করে পশু পাখীরা কি করতে পারবে?”

“জানিনা! হয়তো এটাই! যেটা আমরা কাল থেকে দেখছি! আশিস না থাকলে হয়তো হোয়াইট হিরন আমাদের গাড়ীকে আক্রমন করত না!”

“কি বলছেন? সেই পাখিদের আসাটাও এর সঙ্গে লিঙ্কড?”

“মনে তো হয়, কিন্তু প্রশ্ন হল, আশিসই বা কেন? ওর মধ্যে কি আছে যেটা আমাদের নেই”

কয়েক সেকেন্ড লাগল পরের প্রশ্নটা ভাবতে, “স্যার, আশিসকে এখন পাবো কোথায়?”

“আমার অনুমান হাতি ওকে দরগা গ্রামেই নিয়ে গেছে”

“তাহলে?”

“আমাদের সবাইকে দরগা পৌঁছতে হবে, এখুনি!”

“দরগা? কেন?”

“যদি আমার অনুমান ঠিক হয় অ্যারন অ্যান্ডারসেন সেখানেই আছেন”

“হাতিরা সেখানে নিয়ে যাবে? তারপর? সেখানে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলবে?”

মাথা নাড়লেন সালগাওকার স্যার, “সেটা জানিনা! এখন সবাই হাত লাগাও, আমাদের তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে”




শেষ পর্ব



প্রবল উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা নিয়ে আমরা যখন দরগা পৌঁছলাম তখন দেড়টা মতো হয়েছে। যে ঘটনা টা আমাদের সঙ্গে একটু আগে হয়েছিল, সেটা পাহাড়ে ওঠার রাস্তায়। সেই পাহাড় থেকে অন্যদিকে নেমে গেলেই দরগা, কিন্তু গাড়ি নিয়ে এসে স্বাভাবিক ভাবেই ঘুরপথে আসতে হয়। দরগা যত কাছে এসেছে সালগাওকার স্যার তত চুপ হয়ে গেছেন। শেষের এক ঘণ্টা তো কোন কথাই বলেন নি। পাহাড় থেকে নেমে ছোট গ্রাম, ছবির মতো সাজানো। গ্রামে ঢোকার সময় সালগাওকার স্যার গ্রামের লোকেদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তাঁরা যেমন ডাইরেকশন দিয়েছিলেন সেই মত আমাদের গাড়ি এগোলো। স্থানীয় লোকেরা একে ‘সোনালী হ্রদ’ মানে ‘গোল্ডেন লেক’ বলে থাকেন, সূর্যের আলো পাহাড়ে পরে এখানে প্রতিফলিত হয় আর লেকটাকে একেবারে সোনালী দেখায়। অনবদ্য! হাজার উদ্বেগ, ভয় ছিল মনে, তবু প্রকৃতি আমাদের গাড়ি থামাতে বললেন। ক্যামেরা বার করতেই হল। আর যেটা শুনেছিলাম সেটাও সত্যি! অদ্ভূত শব্দে পাখি তীর গতিতে উড়ে আসে সেখানে, আর যতবার লেক থেকে ওঠে ততবার মুখে থাকে জলে পড়ে থাকা কোন গাছের পাতা। এতো বড় লেক, সাধারনত বড় লেকের ধার গুলোতে জলের স্রোত কমে আসায় ময়লা জমে। কিন্তু এ যেন তার ব্যতিক্রম। এক ফোঁটা নোংরা নেই কোনখানে, স্বচ্ছ, কাঁচের মতো সোনালী জল সেখানে। সে এক অনন্য সুন্দর লেক ডোরাডো।


যদিও সালগাওকার স্যার কিছুই বলছিলেন না, আমি কিন্তু বুঝতে পারছিলাম আমরা কোথায় যাচ্ছি। অ্যারন অ্যান্ডারসেন এখানে অরণ্যে কোথাও বাসা করে আছেন, আর আমাদের গন্তব্য সেটাই। ‘ডোরাডো লেক’ ছাড়িয়ে অ্যারন সাহেবের বাড়ি পৌঁছতে আরো মিনিট দশ লাগল। এদিকটাতেও জঙ্গল আছে তবে অত ঘন নয়। ন্যাশানাল পার্কে টুরিস্টদের জন্য যেমন ‘ট্রি হাউস’ থাকে, এই বাড়িটা অনেকটা সেই রকম। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হয়, থাকার জায়গা সেখানেই, একতলাতে কিছু নেই। আমাদের সবাইকে বাইরে দাঁড় করিয়ে সালগাওকার স্যার একাই গেছিলেন সে বাড়িতে। মিনিট চার পাঁচ বাদে সালগাওকার স্যার সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন, আর পেছনে একজন সাহেব, সাদা মুখ, মাথার চুল সাদা তবে আর বিশেষ অবশিষ্ট নেই বললেই চলে, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, পরনে একটা রঙ্গ ওঠা লাল রঙের টি-শার্ট আর শর্ট প্যান্ট। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, ইনিই অ্যারন অ্যান্ডারসেন।


সালগাওকার স্যারের মতোই অমায়িক অ্যারন অ্যান্ডারসেন। আমাদের সকলের সঙ্গে পরিচয় করলেন। আমাদের প্রত্যেককার নাম গুলো দুই-তিন বারের চেষ্টায় সঠিক করে উচ্চারন করে বললেন। তারপর আমাদের সবাইকে ভেতরে আসতে বললেন। আমরা ওনার পিছু পিছু দোতলায় উঠলাম। কাঠের তৈরি ঘর, বেশ বড়। সেখানেই আমরা সবাই বসলাম। সালগাওকার স্যারের সঙ্গে আমার চোখে চোখে কথা হয়ে গেছিল। একটা জিনিস বুঝে গেছিলাম, আমরা কিন্তু ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেছি। কাল রাত থেকে আমাদের সঙ্গে যে নানান ঘটনা ঘটে আসছে সেসব প্রশ্নের উত্তর যদি কেউ দিতে পারেন সেটা এই অ্যারন অ্যান্ডারসেন। আর নিচু গলায় আমাদের সকলকে জানিয়ে দিয়েছিলেন ‘আশিস ভালোই আছে’। যাহোক, ইতিমধ্যে অ্যারন সাহেব আমাদের জন্য ফিল্টার কফি বানিয়ে আনলেন। আমরা উৎসুক মুখে বসে আছে দেখে উনি বললেন, “কোথা থেকে শুরু করি বলুন?”

“শুরু থেকেই বলুন, সেই প্রথম ভারতে আসা থেকে” সালগাওকার স্যার বললেন।


অ্যারন সাহেব শুরু করলেন, ইংরাজিতেই বলছিলেন তবে দেখলাম হিন্দীও খানিকটা শিখে ফেলেছেন। “আমার জন্ম কোপেনহেগেনে, সেখানে পড়াশোনা শেষ করে কলেজে পড়ানোর চাকরী পাই। রিসার্চটা চলছিল, সেই সূত্রেই ভারতে আসা। প্রথম ভারতে এসেছিলাম সেই ১৯৯৭ সালে। প্রথমবার ভারতে এসেই এখানে অরণ্য, হিমালয় আর পশুপাখীদের ওপর প্রেমে পড়ে যাই। এতো বৈচিত্র্য এখানে, তার ওপরে হিমালয় তো এখানে বোনাস। তারপর থেকে প্রায় প্রতি বছরেই আসতে শুরু করি। ভগবানের দয়ায় টাকা পয়সার অভাব ছিল না। বাবার জমানো টাকা ছিল, বইটই একটু আধটু লিখেছিলাম, সেখান থেকেও ভালো পয়সাকড়ি পেলাম। এখানে আসার ফ্রিকোয়েন্সি টা বেড়ে যায়। আর সংসার করিনি কোনদিন, তাই কোন পিছুটানও ছিল না। তবে তখন আসতাম মূলত পশ্চিম হিমালয়, গাড়োয়াল আর কুমায়ুনে। বেশ কয়েক বছর কাটানোর পর ইচ্ছা হয় এখানেই থেকে যাওয়ার। কোপেনহেগেন হয়ে যায় আমার সেকেন্ড হোম। দুইতিন মাস ওখানে কাটাই, বাকিটা এখানেই। কিন্তু অভারতীয় হবার জন্য আমার পক্ষে উত্তরাখণ্ডে বাড়ি কেনার জন্য কিছু আইনি সমস্যা তৈরি হয়, তখন অন্য জায়গার সন্ধান করাটা খুব দরকার হয়ে পড়ে। তারপর আসামের সীমানা থেকে প্রায় বাহান্ন কিলোমিটার দূরে এই ‘দরগা’ গ্রাম আমার ভীষণ ভালো লেগে যায়। মানস ন্যাশানাল পার্ক ছাড়িয়ে জনবসতিহীন, পশুপাখি আর অরণ্যে মোড়া ভুটানের এই জায়গা আমাকে স্বর্গীয় অনুভূতি দেয়। ২০১১ সালে এই বাড়িটা তৈরি হয় তারপর থেকে এখানেই থেকে যাই”

“আর আপনার রিসার্চ?”

“সেটা বন্ধ হয়ে যায়। আসলে এখানকার বনের পশু পাখি তখন আমার বন্ধু হয়ে যায়! কিন্তু আমার খুব অসহায় লাগত যখন ওদের জন্য কিছু করতে পারতাম না! চোরা শিকারি হাতির দাঁত ছুরি দিয়ে কেটে নিয়ে যেত, বিষাক্ত মাংস খাইয়ে গণ্ডারকে অজ্ঞান করে তার খড়গ কেটে নিত। কতোটা যন্ত্রণা তাকে দিত ভাবুন! বাঘ, হরিন, নানান পাখি নির্দ্বিধায় গুলি করে মেরে ফেলত, কেন? বিনিময়ে কিছু টাকার জন্য। আর আমি কিছুই করতে পারতাম না!”

সালগাওকার স্যারের গলা শুনতে পেলাম এবারে, “আর তাই কি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইমপ্ল্যান্ট করলেন এদের মধ্যে?”

অ্যারন সাহেব একবার সালগাওকার স্যারের দিকে তাকালেন, অন্যদিকে তাকিয়ে কি একটা ভাবলেন তারপর প্রায় দশ সেকেন্ড বাদে বললেন “মানুষ যেখানে কোন কারণ ছাড়া পশু পাখীর ওপর নির্দয়, নির্মম সেখানে পশু পাখীকে একটু ইন্টেলিজেন্ট হতেই হবে! কি বলেন?”

“মানে?”

“মানে কিছুই না, ওরাও অনেক কিছু শিখেছে, জেনেছে। এই যেমন ধরুন, ওরা চিনতে শিখেছে মানুষের ব্লাড গ্রুপ। এবারে তাদের ওপর আদেশ ছিল, ‘বি নেগেটিভ’ ব্লাড গ্রুপের কাউকে পেলে তাঁকে যেন পাহাড় থেকে এই গ্রামে নিয়ে আসা হয়। নিয়েও এসেছে! এতোগুলো লোকের মধ্যে থেকে একজনকে, তাও আবার আপনাদের সকলের সামনে থেকেই। আপনাদের বন্ধুর গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি। খালি ভয় পেয়ে গিয়ে সে অজ্ঞান হয়ে গেছে! ওর জ্ঞান ফিরে আসবে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে”

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি। পরমজিত পকেট থেকে আশিসের আইডেন্টিটি কার্ডটা দেখালো, সেখানে পরিষ্কার লেখা আছে আশিসের ব্লাড গ্রুপ ‘বি নেগেটিভ’। সালগাওকার স্যারের গলা শুনতে পেলাম এবারে, “মানুষের ব্লাড গ্রুপ পশু পাখীরা বুঝতে পারে?”

“নিশ্চয়ই পারছে! তার প্রমাণ তো আপনারা পেয়েছেন!”

বলতে চাইনি তবু আমার মুখ থেকে কেমন করে যেন বেরিয়ে এল প্রশ্নটা, “দশটা হাতি মিলে একটা মানুষকে তুলে দশ কিলোমিটার দূরে নিয়ে এল, তাতে কি প্রমাণ হয়?”

“কিছুই প্রমাণ হয়না, আর ওরা কিছু প্রমাণ করতে চায়না। খালি এটাই দেখা, এরা নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেরা করতে পারে কিনা! আজকে ওরা ‘বি নেগেটিভ’ চিনতে পেরেছে কাল চোরা শিকারীকেও চিনতে পারবে! আর তখন জঙ্গলের আইন আর মানুষ ভাঙ্গতে পারবে না।”

“আর মশার মতো সেই পোকা? প্রজাপতি? হোয়াইট হিরন? তারা তো কাউকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না! বরং অকারনে মারা যেতে পারে!”

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে ভাবলেন অ্যারন সাহেব, তারপর মৃদু হেসে বললেন “কিন্তু ট্র্যাপ তো বানাতে পারে! আর সেই ট্র্যাপে মানুষ পড়তেও পারে!”

মুখে না বললেও বুঝলাম হোয়াইট হিরন মারা না গেলে আমরা কি আর জঙ্গলে আকটে পড়তাম?

আবার অ্যারন সাহেব বললেন, “শুধু এটুকু জানবেন, পশু পাখিরা কিন্তু বুদ্ধিমান হয়ে উঠছে মাই ব্রাদার! কাজেই অরণ্যগুলো ওদেরই থাক না !”

সালগাওকার স্যারের গলা কানে এলো, “আপনি কি করে করলেন এই অসম্ভব কাজটা?”

“আমি কিছুই করিনি। খালি এইটুকু বলা দরকার, এতোদিন মানুষ ভাবত, ১.৩৬ কেজির ব্রেন নিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতির তকমা পাবার পর পশুদের সঙ্গে যা ইচ্ছে করা যায়! বিষাক্ত মাংস দেওয়া হতো, যা খেয়ে পশুরা ঘুমিয়ে পড়ত। জালে আটকে ফেলা হতো নিষ্পাপ পাখীদের, এখন তো আবার আনারসের মধ্যে পটকা ঢুকিয়ে অন্তঃসত্ত্বা হাতিকে খেতে দেওয়া হয়! যাতে পাশবিক নির্মমতায় একটা ঐতিহাসিক মাত্রা যুক্ত হয়! কি তাই তো? কিন্তু আর না! এখন মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। এবারে বার্তা পাঠানোর সময় এসেছে! একটা কথা, এদের কিন্তু কোন কেমিক্যাল লাগেনা, রক্ত পরীক্ষার জন্য শিরিঞ্জ বা ল্যাবরেটরিও লাগে না, খালি শরীরের গন্ধই তাদের জন্য যথেষ্ট!”


অ্যারন সাহেব আর কিছু বলেননি, তবে ওনার ভাবভঙ্গী দেখে এটা বেশ বুঝতে পেরেছিলাম, যুদ্ধের ‘নায়ক’ আর ‘প্রতিনায়ক’ ছাড়াও আর একটা চরিত্র থেকে যায়, সেটা ছাড়া যুদ্ধ হয়না, হয়তো উনি সেটাই। মহাযুদ্ধের সেনাপতি!






এই কাহিনী একেবারেই কল্পনাপ্রসূত। দক্ষিন আফ্রিকা থেকে কালো-ডানা যুক্ত ‘স্টিল্ট’ পাখী, ক্লাইভ লয়েড, হোয়াইট হিরন ছাড়া বাকী কোন অংশেই সত্যতা নেই। আর অরন্যের সমস্ত পশুপক্ষীরা, যাদের সম্পর্কে নানান কাল্পনিক আর আজগুবী তথ্য লিখলাম তাদের সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম।









লেখক পরিচিতি - পার্থ সেনের জন্ম কলকাতায়। কলকাতায় পড়াশোনা শেষ করে শিবপুর বি ই কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংএ স্নাতক এই লেখকের কর্মজীবনের শুরু ঝাড়খন্ডের ইস্পাতনগরীতে। তারপর তথ্য প্রযুক্তিকে পেশা করে বর্তমানে মহারাষ্ট্রের পুনে শহরের স্থায়ী বাসিন্দা। ছাত্র জীবনে লিটল ম্যাগাজিনে লিখে লেখালেখির শুরু। গত চার বছর ধরে ‘নীড়বাসনা’ র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত রয়েছেন।


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page