অনুবাদ গদ্য - অচেনা বাবা
- উজ্জল ঘোষ
- Jul 11, 2020
- 4 min read
Updated: Feb 19, 2021
Greek short-story of Γιώργος Παπαθανασόπουλος --------------------------------- অচেনা বাবা গিয়র্গস পাপাথানাসোপুলস ------------------------------------- ডায়েরিতে লেখা ছিল "অচেনা বাবা"। আবাসনের প্রতিবেশীদের সামনে দেখে আমার অসুস্থ ঠাকুর্দা বিছানা ছেড়ে কোনোরকমে উঠে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসল। উপস্থিত সকলেরই দৃষ্টি তার দিকে। কথাবার্তার মাঝে কেউ কেউ জানতে চাইল, ঠাকুর্দার বয়স কত? কারণ তার বয়সী মানুষ এ তল্লাটে আর কেউ ছিল না। সবাই একটা কিছু আশঙ্কা করছিল। তাই প্রতিবেশীদের কেউ কেউ তাকে শেষ দেখা দেখতে এসেছিল। ঠাকুর্দার যথেষ্ট বয়স হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাকে দেখতে আশ্চর্যরকমের কমবয়সী মনে হয়। তার শারীরিক গঠন, প্রাণবন্ত চলাফেরা, সদা হাস্যমুখ... আরও কিছু যা দৃশ্যমান নয়— সবই ছিল খুব আকর্ষণীয়। আমি বড় হওয়ার অনেক পরে কিছু ছড়ানো-ছিটানো কথামালা, যা আমি ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, তা থেকে উপলব্ধি করেছিলাম যে আমার ঠাকুর্দার ছিল অসহ্যরকমের যৌবন, বেপরোয়া যৌবন। খুব অল্প লোকই, আরও স্পষ্ট করে বললে, খুব অল্প মহিলাই জানত সেসব কথা। আর সেই অল্প কয়েকজনের মধ্যে প্রথম হলো আমার ঠাকুমা কিরাচা। তবে সান্ত্বনা এই যে, ঠাকুমাকে কেউ কোনোদিন অভিযোগ করেনি তার স্বামীর বিরুদ্ধে। টিপিক্যাল গ্রিকদের মতো ঠাকুর্দা কখনো মেয়েদের পিছন পিছন ঘুরঘুর করেনি, কিংবা ফাজিল ফরাসিদের মতো মেয়েদের পাছায় হাত বুলিয়ে প্রেম নিবেদন করেনি, কিংবা উজবুক জার্মানদের মতো কোনো মহিলার দিকে সারাক্ষণ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়েও থাকেনি। বরং এ সবের উল্টোটাই ঘটত ঠাকুর্দার সঙ্গে। তাই ঠাকুমার দিক থেকেও তার বিরুদ্ধে নারীঘটিত কোনো অভিযোগ ছিল না। আমি যতদূর মনে করতে পারি, যদিও তার দীক্ষান্তের নামটা আমি ভুলে গিয়েছি, সকলেই তাকে 'ঠাকুমা' বলেই ডাকত। ঠাকুর্দা একা শুধু ডাকত কিরাচা নামে। কিন্তু ঐ ডাকটুকু ছাড়া ঠাকুমার সঙ্গে আর বিশেষ কিছু কেউ কখনো দেখেনি। এমনকি বাড়ির লোকেরাও নয়। ঠাকুমা ডানাকাটা পরী ছিল না ঠিকই, তবে অসুন্দরও ছিল না। ঠিক কী কারণে যে তাদের মিলমিশ হলো না তা কেউ জানে না। একসঙ্গে খাওয়া, একসঙ্গে গল্প করা, একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়া— এসব ঠাকুমার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। ঠাকুমা তাই নিজের মতো করে কালযাপনের পরিকল্পনা করে নিয়েছিল। প্রতিদিন বিকেলে ঠাকুমা রাস্তার ধারের ঘরটায় গিয়ে ছোট জানলাটার পাশে একটা চেয়ার নিয়ে বসত। আর ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকত। অতীতচারণা করত হয়তো। সেই পঁচিশ বছর বয়সে এ বাড়িতে আসার পর থেকে ঠাকুমার জানলার ধারে বসা শুরু হয়েছে। তার গোটা যৌবন কেটেছে এই জানলাকে সাক্ষী রেখে, দু'দুটো শিশুকে লালন-পালন করতে করতে। শিশুদুটির একজন আমার বাবা, আর অন্যজন ঠাকুর্দা স্বয়ং। সত্যি বলতে কী এই দুটি শিশুকে ভালো বাসতে বাসতে তার নিজেকে আর ভালোবাসা হয়নি। ঠাকুমার ভাষায়: সারাদিন সংসারের হাজারটা কাজ আর শিশুপালন করতে করতেই বেলা গড়িয়ে গেল। সন্ধ্যায় যতক্ষণ না ঠাকুর্দা বাইরে থেকে এসে মাথা থেকে টুপি খুলে হাতে নিয়ে নখ দিয়ে খুঁটতে খুঁটতে ঠোঁটে রহস্যময় হাসি এনে ঠাকুমার দিকে চাইত, ততক্ষণ পর্যন্ত সে আনমনে বসে থাকত। এইভাবেই রুটিন মাফিক দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ঠাকুমা হঠাৎ একদিন ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়ল। বাড়িতে ডাক্তারের আসা-যাওয়া শুরু হলো। ঠাকুমা মারা যাবে এ বিষয়ে সকলেই একরকম নিশ্চিত হলো। কারণ তার শরীরী ভাষায় ফিরে আসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। ঠাকুমা নিজেই বলত: আমি আত্মা বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি। আত্মীয়-প্রতিবেশীরা আবার আসতে শুরু করল। যারা ঠাকুর্দাকে দেখতে এসেছিল কয়েকদিন আগে, তারাই এল সবার আগে। আত্মীয়দের কেউ কেউ রাতেও থেকে যেতে লাগল। কারণ ঠাকুমাকে তারা ভালোও বাসত খুব। আর প্রতিবেশীদের দেখার সুবিধা করে দিতে মাঝে মাঝে আমার বাবা-মা ঠাকুমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিত। সবাই ভাবত এই বুঝি আত্মা বেরিয়ে এল। কিন্তু না, আত্মার কোনো খবর নেই। ডাক্তার আবার এলেন। ঠাকুমাকে ভালো করে পর্যবক্ষেণ করে বেশ গম্ভীর স্বরে বাবাকে বললেন: আপনি বড় অসময়ে ডাকলেন। এনাকে আর বাঁচানো যাবে না। বৃদ্ধ ঠাকুর্দা এসব শুনে বাবাকে পাশে ডেকে নিয়ে বলল: মনে হচ্ছে ডাক্তার ঠিকই বলেছেন। ক্রমে একে একে সবাই চলে গেলে পরিবেশটা একেবারে নিঃঝুম হয়ে গেল। কারোরই যেন শ্বাস-প্রশ্বাস বইছে না। এমন সময় ঘরে ঢুকল ঠাকুর্দা। কোনো কথা না বলে, কোনো দিকে না তাকিয়ে ঠাকুর্দা সোজা গিয়ে বসল ঠাকুমার পাশে। তারপর ঠাকুমার হাত-দুটো ধরে কচলাতে কচলাতে মুখের দিকে চেয়ে রইল একদৃষ্টে। হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঠাকুর্দা ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরল একেবারে বুকের মাঝে। উপস্থিত সকলের চোখেই অভাবনীয় এ দৃশ্য। গভীর প্রশান্তিভরা ঠাকুমার চোখে-মুখে ফুটে উঠল এক অদৃশ্য হাসির রেখা। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা সদ্য আগত এক বন্ধুর দিকে ঠিক তখনই আমার চোখ পড়ে গেল। যদি আমি মিথ্যে না বলে থাকি তাহলে বলব: আমি দম ছেড়ে বাঁচলাম। ঠাকুর্দা আস্তে আস্তে ঠাকুমাকে বাহুমুক্ত করে চিরনিদ্রায় শুইয়ে দিল। তারপর সারা মুখে বারবার হাত বুলিয়ে চোখ দুটো ভালো করে বন্ধ করে দিল। আর নিজের দু'চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দু'ফোঁটা অশ্রুবিন্দু। অতঃপর অমিতবিক্রম ঠাকুর্দা শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল: ক্রাচুলা ঘুমাও এবার। আমিও আসছি। সেই রাতে আমার বাবা কোনো এক ক্ষণে ডায়েরিতে লিখেছিল, আজ আমি এক "অচেনা বাবা" দেখলাম। পরিচিতি: গিয়র্গস পাপাথানাসোপুলস (Γιώργος Παπαθανασόπουλος) ১৯৫৫ সালে আথেন্স থেকে ২০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে আয়োনীয় সাগরের তীরে এতোনীয়া নামে এক ছোট্ট জনপদে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলশিক্ষা সেখানেই। এরপর পিরেয়াস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে উচ্চশিক্ষা শেষ করে তিনি যোগ দেন ব্যাঙ্কের চাকরিতে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ছোটগল্প লিখছেন এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তা প্রকাশ করছেন। এ বছরই প্রথম তাঁর গল্প সংকলন প্রকাশিত হতে চলেছে। অনূদিত গল্পটি তাঁর ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া।

লেখক পরিচিতি - পেশায় শিক্ষক কবি অনুবাদক উজ্জল ঘোষ গ্রীক ক্লাব KYKLOS (Ελληνική Λέσχη ΚΎΚΛΟΣ της Καλκούτας) এর সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং সক্রিয় সদস্য। পদার্থবিদ্যা, অংক এবং রসায়নবিদ্যায় স্নাতক উজ্জল ঘোষ সাহিত্যের টানে বাংলায় স্নাতোকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ছোটোবেলা থেকেই তাঁর গ্রীক ভাষা এবং সভ্যতার প্রতি গভীর অনুরাগ নতুন আশ্রয় পায় প্রখ্যাত বহুভাষাবিদ অসিত চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে। শুরু হয় গ্রীক ভাষা শিক্ষা এবং চর্চা। ১৯৯৫ সালে গ্রীসের বিদেশ মন্ত্রকের তরফ থেকে আমন্ত্রিত উজ্জল ঘোষ এথেন্স ইউনিভার্সিটিতে গ্রীক সভ্যতার সম্বন্ধে আরো গভীরে জানার সুযোগ পান। গ্রীসে কাটানো সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর লেখা 'পারাপারের পথে শেষ নির্দেশ' বইটি বিশেষ প্রশংসিত এক সাহিত্য সৃষ্টি। ১৯৯৭ - ৯৮ সালের ত্রৈমাসিক পার্থেনন পত্রিকার সম্পাদক উজ্জলবাবু অজস্র গ্রীক কবিতা ও গল্প বাংলায় এবং বাংলা কবিতা ও গল্প গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করেছেন; এখনও নিয়মিত অনুবাদ করে চলেছেন।
Comentarios