top of page

গল্প - দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড প্যাসেজ

  • শোভন কাপুরিয়া
  • Jul 6, 2020
  • 8 min read

Updated: Feb 19, 2021

কালকেই খবর এলো অ্যামকো কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হবে। অ্যামকো অর্থাৎ অ্যালুমিনিয়াম ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি। কোম্পানি নাকি অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে শেষ কয়েক মাসে। তার ওপরে মালিক বলবিন্দর কৌর খুন হয়ে গিয়েছেন, তাই আর ম্যানুফ্যাকচারিং চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সাল ১৯৮৪এর ডিসেম্বর মাস, দমদমের মল রোডের দিকটা বেশ শুনশান....পাকা বাড়ি বলতে দুই একটা, দোকান পাট-ও সেরকম নেই। বেশ কয়েক মাস আগেই কেরানির চাকরি পেয়ে জয়েন করেছিলাম, ভেবেছিলাম মা বাবার একটু সাশ্রয় করতে পারবো। কিন্তু দেড় মাস আগে দেশের প্রধানমন্ত্রীর হঠাৎ মৃত্যুতে দেশে এমন অচলাবস্থার সৃষ্টি হলো যার জেরে পুরো দেশে শিখদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা শুরু হয়েছিলো। অল ইন্ডিয়া রেডিও তে শুনেছিলাম দুই জন শিখ বডিগার্ডের গুলিতে নাকি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে....অতর্কিতে আক্রমণ...বিশ্বাসঘাতকতা, প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্বের মূল্য দিচ্ছে ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ। কোলকাতায় তার জের অনেকটা কম থাকলেও প্রাণের ভয় তো আছেই। একজন শিখের কোম্পানিতে কাজ করছি শুনে আমাকে আবার কেউ আক্রমণ করে কিনা সেই ভয়ে সারাক্ষণ ধরে বুকের ভেতরটা দপদপ করে, মা তো বলেই "শীতল রে, ও চাকরি ছেড়ে দে!! তোর যদি কিছু হয়?" তবে সেই ভয়ের কোনো কারণ হয়তো থাকবে না কারণ অ্যামকোর অস্তিত্ব আর থাকবেনা। ভবিষ্যতে হয়তো এই কোম্পানি এক জলজ্যান্ত ভূতের বাড়ির মতো দাঁড়িয়ে থাকবে মল রোডে।


****


ম্যানেজার হারাধন বাবুর নির্দেশে আমি এসেছি একদম নিচের তলার পুরোনো ঘরটাতে, যেখানে সমস্ত পুরোনো দরকারি ফাইল তাকের ওপরে রাখা আছে। কোম্পানি বন্ধ হওয়ার আগে কয়েকটা দরকারি কাগজপত্র আর ফাইল সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ আছে আমার ওপরে। ঘরটায় ধুলোর আস্তরণের গন্ধ ছড়িয়ে আছে, ধুলো নাকে মুখে ঢুকে অসুবিধার সৃষ্টি হলো। আদেশ অনুসারে ঘরটার শেষের দিকের তাকের কাছে গিয়ে ফাইল গুলো ঘাটতে লাগলাম। ঘাটতে ঘাটতে একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম যে এই ঘরটার সাথে অফিসের বাকি ঘরগুলোর ধাঁচের ঠিক মিল নেই। ঘরটা গঠনমূলক দিক দিয়েই আলাদা...অনেকটা নবাবী মহলের ছাপ রয়েছে যেন ঘরটায়। কই বাকি ঘরগুলো তো এরকম দেখতে না! যদি এই ঘরটা আমাদের অফিসের অংশই হয়, তাহলে এতটা পার্থক্য থাকবে কেন? যদিও এই চিন্তা বেশিক্ষণ মাথায় না রেখে আবার কাজে মন দিলাম।


একটা ফাইলের ওপরে চাপড় মারতে বেশ কিছুটা ধুলো উড়ে এলো, চোখটা চুলকোতে যাবো হঠাৎ একটুক্ষণের জন্য মনে হলো কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো, মুখ দিয়ে অজান্তেই একটু চিৎকার করে বলে ফেললাম "কে? কে ওখানে?" না, কেউ নেই সেখানে। ধুলোয় আর অন্ধকারের মিশেলে কি ভুল দেখলাম? হতে পারে। নিচে এসেছি অনেকটা সময় হয়ে গেছে, ফাইল গুলো নিয়ে ওপরে না উঠলেই নয় এবার নাহলে হারাধন বাবু আবার বকাবকি করবেন। হাতের টর্চ টা ব্যবহার করে বেরোনোর জন্য আমি চলতে শুরু করলাম, , হঠাৎ মনে হলো কোথাও থেকে একটা গলা শোনা যাচ্ছে। কথাগুলো ঠিক পরিষ্কার না...ওপর থেকে তো এই শব্দ আসছে না! তাহলে? একটু ভয় ভয় করতে লাগলো আর সঙ্গে কৌতুহল-ও হলো। কান পাতলাম....মনে হচ্ছে এই ঘরটার নিচে থেকে যেন সেই চিৎকার আসছে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব! মাটির নিচ থেকে তো মানুষের আওয়াজ আসবেনা। তবে? সেই আওয়াজের উৎস ধরে ধরে এগোতে এগোতে ঘরটার এমন এক কোণে এলাম, যা দেখে আমার বিস্ময়ের অন্ত রইলো না। দেখি একটা ছোটো সিঁড়ির ধাপ নিচে নেমে গেছে, অন্ধকারের অতলে যেন এগিয়ে গেছে সেই সিঁড়ি। অন্ধকারের কোথায় গিয়ে তার শেষ তা জানিনা, কিন্তু কিছু তো রয়েছেই এই সিঁড়ির শেষে।


চাপা চিৎকারটা ওই দিক থেকেই আসছে। বুকের মধ্যে কেউ যেন হাতুড়ি পিটছে আমার....আমি অশরীরীতে বিশ্বাস করি না, কিন্তু আমার সেই বিশ্বাস হয়তো ভাঙতে চলেছে। এবার মনে হলো চিৎকারটা শুধুই চিৎকার না, কিছু কথাও মনে হয় ভেসে আসছে অন্ধকার গহ্বরের অতল থেকে। দুরু দুরু বুকে শোনার চেষ্টা করলাম সেই কথা গুলো, যা শুনে গায়ে রীতিমতো কাঁটা দিলো "ওদের আটকাতে হবে!!! আমায় মুক্তি দাও....নবাবকে জানাতেই হবে, নাহলে সমূহ বিপদ। মুক্তি দাও আমায়!! বাঁচাও!!!" কথাগুলো যেন অন্য কোনো জগত থেকে হাওয়ার সঙ্গে ভেসে আসছে। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আমি দৌড়ে পালিয়ে ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে টা দিনের আলোয় ঝলসে যাচ্ছে, কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম যে এখন দিনের বেলা। মনে অসংখ্য প্রশ্ন আর চোরা ভয় নিয়েই আমি ওপরে যেতে লাগলাম, যদিও কাউকে এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসও হলোনা আমার।


****


কাজ শেষ করতে করতে রাত প্রায় ৮টা বেজে গেলো। সারাদিনের কাজের চাপে সকালের ব্যাপারটা কিছুটা হলেও ভুলে গিয়েছিলাম। আমি তৈরী হচ্ছিলাম বেরিয়ে যাওয়ার জন্য, ঠিক সেই সময়েই হারাধন বাবু আমার কাছে আসলেন। কাঁধে তাঁর ব্যাগ দেখে বুঝলাম যে তিনি বেরোনোর উপক্রম করছেন। তিনি যা বললেন সেটার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না।

- শীতল, সকালে তোকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আরো একটা ফাইল নিয়ে আসতে হবে নিচের ঘর থেকে। - আচ্ছা স্যার, কাল সকালে গিয়ে নিয়ে আসবো। - না না, ওটা কালকে সকালে আমি টেবিলে দেখতে চাই। এখন গিয়ে নিয়ে আয় ওটা। - (আমি একটু ইতস্তত করলাম) কিন্তু স্যার! এখন তো রাত হয়ে গিয়েছে। বাড়ি যেতে হবে। কাল এনে দেবো। - রাত হয়েছে তো কি? ফাইলটা রেখে চলে যাস!! এই নে এই নামের ফাইলগুলো নিয়ে আয়! ৫ মিনিটের তো কাজ। মেলা বকছিস, যা কাজ টা কর!! - স্যার, কোম্পানি তো বন্ধ হয়েই যাবে। তাহলে এসব কেন করতে হবে? - (হারাধন বাবু একটু রেগে গেলেন) তোর এই মাসের পয়সা চাই কি চাই না? ফাল্তু বকিস না।

হারাধন বাবু গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন। সকালের সমস্ত ঘটনা আবার মনে ভয়ের ভাব জাগিয়ে তুলতে লাগলো। হারাধন বাবুকে কিভাবেই বা বলতাম যে অশরীরী কার্যকলাপের ভয়ে আমি যেতে চাইছিনা ঘরটায়। আমার আগে যিনি ওই ঘরটার দায়িত্বে ছিলেন, তিনি তো আমায় সেরকম কিছুই বলেননি। তাহলে পুরোটাই কি আমার কল্পনা! মনের ভয়ে শুনেছি মানুষ অনেক কিছু ভুল দেখে বা শোনে। না, এই ভয় মনে রাখবো না। তাড়াতাড়ি ফাইলটা নিয়ে এসে হারাধন বাবুর টেবিলে রেখে বেরোতে হবে।


****


আবার সেই পুরোনো ধুলো ভরা অন্ধকার ঘরটার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমি। পা যেন এগোচ্ছেই না, মন থেকে কু ডাকছে আমার। ঘরটায় আলো থাকেনা, তাই হাতের টর্চটা শক্ত করে ধরে ঘরটায় ঢুকলাম। ভয়ে ভয়ে একটার পর একটা তাক অতিক্রম করতে লাগলাম। দুর্ভাগ্যবশত এই ফাইলটা রয়েছে সেই তাকটার কাছে যার ঠিক পেছন থেকেই সিঁড়ি নেমে গেছে গভীর অন্ধকারের দিকে। কোথাও কোনো আওয়াজ নেই, রাত হলেই লোকজনের যাতায়াত কমে যায় এই রাস্তা দিয়ে। মাঝে মধ্যে বাসের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি আমি। টর্চটা ডান হাতে ধরে বাম হাতে একটা একটা করে ফাইল সরাচ্ছি , কোনোরকমে ফাইল গুলো নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারলেই হলো। টর্চের আলোয় ধূলিকণাগুলোর গতিবিধি খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ আমার সারা শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেলো, অন্ধকারের অতল থেকে আবার সেই চাপা আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে -- "ওদের আটকাতে হবে!!! আমায় মুক্তি দাও....নবাবকে জানাতেই হবে, নাহলে সমূহ বিপদ। মুক্তি দাও আমায়!! বাঁচাও!!!"


অনেক হয়েছে, এবার আমি নিচে নামবোই। কেউ কোনো বদ মতলবে হয়তো এরকম ভয়ের সৃষ্টি করছে। টর্চের আলোটা বাগিয়ে ধরলাম সিঁড়িটার ওপরে দাঁড়িয়ে। বুঝতে পারলাম সিঁড়িটা বেশ কিছুটা নিচে নেমে গেছে, আলোর সুবাদে বুঝতে পারলাম যে সিঁড়ির শেষ প্রান্তে একটা কিছু রয়েছে। সুড়ঙ্গ নাকি? সুড়ঙ্গের মধ্যে সত্যিই কেউ আটকে নেই তো? সেই চাপা আর্তনাদের রহস্য উদঘাটনের জন্য আমি সিঁড়ি ধরে নিচে নামতে শুরু করলাম। নিচে নামতেই একটা ভয় ঘিরে ধরলো আমায়, একটা সরু সুড়ঙ্গের মতো পথ এগিয়ে গেছে একটা অজানা দিকে। টর্চের আলো ফেলে এগোতে থাকলাম আমি, ডানদিকে চোখ যেতেই বুঝলাম কয়েকটা ঘর তালাবন্ধ অবস্থায় রয়েছে। সুড়ঙ্গের নিচে ঘর! সুড়ঙ্গ কোথায় শেষ হচ্ছে সেটা জানতেও খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, একটা অ্যাডভেঞ্চারের নেশা যেন পেয়ে বসেছে আমায়। হঠাৎ একটা ঘরের সামনে আসতেই দড়াম করে একটা শব্দ হলো, বুঝলাম দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ। কিন্তু সেই শব্দ আসছে ভেতর থেকে আর দরজায় তালা দেওয়া, শরীরের রক্ত যেন জল হয়ে গেলো আমার। কিছু অলৌকিক ব্যাপার রয়েছে এখানে, এখান থেকে বেরোতেই হবে। পেছন ফিরলাম সেই সিঁড়ির ধাপের খোঁজে, কিন্তু একজন লোকের চেহারা দেখেই আমি প্রচন্ড ভয়ে পাথরের মতো হয়ে যাই। লোকটা যেন সৈন্যের বেশে রয়েছে, স্কুলে ইতিহাসের বই তে যেমন দেখতাম নবাবদের সৈন্যদের বেশভূষা... অনেকটা সেরকম। আমার মাথা দপদপ করতে লাগলো, দমদমের এই অফিসে মাটির নীচের প্যাসেজে এ কি অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে আমার সাথে? লোকটা অনেকক্ষণ ধরেই কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে...এবার অদ্ভুত এক কাতর গলায় সে বললো "ওরা নবাব সিরাজউদ্দৌলা কে খুন করার পরিকল্পনা করছে!! ওদের আটকাতেই হবে নাহলে সকলের অজান্তেই বাংলা এই লাল মুখো ব্রিটিশদের কবলে চলে যাবে.... ক্লাইভের পা চাটা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবেনা আমাদের!!" মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো, অজ্ঞান হয়ে যাবো মনে হচ্ছে। অজ্ঞান হবার আগে দেখতে পেলাম লোকটার গলাটা ফালা ফালা করে কাটা, রক্ত জমাট বেঁধেছে সেখানে, সে মৃত!


****


যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখি মাটিতে শুয়ে আছি আমি। কিছুটা কষ্টে নিজেকে ওঠানোর চেষ্টা করলাম, হঠাৎ পড়ে যাওয়ায় হাত-পা একটু ছড়ে গেছে। মাথাতেও যে খানিকটা ধাক্কা খেয়েছি সেটাও বুঝতে পারলাম। তাও অনেক কষ্টে নিজেকে তোলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু উঠতে গিয়ে আমার বিস্ময়ের অন্ত রইলো না। দেখি আমি এমন একটা ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছি, যেখানে নবাবী কায়দার অনেক আলো দেওয়ালে লাগানো আছে। ঘরটা আমি চিনি না, কোনো পুরোনো যুগের ঘর মনে হচ্ছে এটা। কিন্তু কোথায় এ? ঘরটার কায়দা ঠিক সেই ঘরটার মতো যেখানে আমি প্রথম বার সেই গোপন সিঁড়ি আবিষ্কার করেছিলাম। আমাদের অফিসে এরকম কোনো ঘর তো আমি দেখিনি, ভয়ে আমার কপালে ঘামের বিন্দু দেখা দিলো। ওই লোকটা.... হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই লোকটাকে দেখার পরেই এসব হচ্ছে। কোথায় সেই লোক?


হঠাৎ মনে হলো কেউ বা কারা নিজেদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা বলছে। আমি এবার উঠে দেখতে গেলাম, দেখি একটা পাটাতনের ওপরে বসে আছে দুজন লোক। মোমের আলোয় পরিষ্কার না হলেও বুঝতে পারলাম যে একজন মনে হয় সাহেব গোছের মানুষ আর আরেকজনের শরীরে নবাবী পোশাক। এ তো অসম্ভব!! সাহেবটার দিকে দেখে আমার মনে হলো ঠিক এর মতোই দেখতে কাউকে যেন দেখেছি আগে কিন্তু কোথায় দেখেছি কিছুতেই মনে করতে পারছিনা। আমি কি অন্য কোনো সময়ে চলে এসেছি? হঠাৎ সাহেব সেই নবাবের উদ্দেশ্যে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলে উঠলো -

- মীর জাফর! তুমি তৈয়ার আছো তো!

আমার ভিড়মি খাওয়ার পালা এবার! মীর জাফর? মানে তো নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেই সেনাপতি যিনি পলাশীর যুদ্ধে ওনাকে বিশ্বাসঘাতকতা করে হত্যা করেছিলেন। আমি কি সত্যি দেখছি? না কি ভোজবাজি?

- জি জনাব লর্ড ক্লাইভ! আমি প্রস্তুত আছি। কিন্তু ভয় একটাই! - হোয়াটস দ্যাট? - বেগম লুৎফান্নেসার একজন গুপ্তচর নাকি আমার পেছনে লেগেছে। সে যেন নবাবকে আগে থেকে কিছু না বলে দেয়। তাহলে বাংলার মসনদে বসার স্বপ্ন চুরচুর হয়ে যাবে। - নাথিং টু ওয়ারি। এই হাউজ অফ মীর জাফরে আমার গার্ড রা নজর রেখেছে। হু এভার ট্রাইজ টু এন্টার, হি শ্যাল বি কিল্ড। আমাদের চুক্তি মনে আছে তো! - জি জনাব। আমরা আজই সই সাবুদ করবো যে সুবে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা কে খুন করা হবে পলাশীর যুদ্ধের প্রাক্কালে। তার পরে বাংলার মসনদে বসবো আমি আর বাংলার বিপুল ধনসম্পত্তি সমস্ত কিছুর মালিক হবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। - ফেয়ার এনাফ!


হঠাৎ সেই ঘরটার দরজা ঠেলে ঢুকলো কয়েকজন রক্ষী, দেখতে পেলাম তাঁদের কবলে থাকা বন্দীকে। এই তো...এই তো সেই লোকটা যাকে আমি অফিসের নীচের সুড়ঙ্গে দেখেছিলাম। কয়েকজন রক্ষী বলে উঠলো "জনাব মীর জাফর! এই গুপ্তচর লুকিয়ে এসেছিলো সুড়ঙ্গের পথ ধরে আর আপনাদের সমস্ত পরিকল্পনা শুনছিলো। লুৎফান্নেসার গুপ্তচর-ই এই লোকটা।" লর্ড ক্লাইভ যতটা সম্ভব ঘৃণা দেখিয়ে বললেন "কিল দিস বাস্টার্ড!" লোকটা বলে উঠলো "মীর জাফর, তুমি ভুল করছো!! বাংলার মসনদে তুমি বসলেও বাংলা কিন্তু চালাবে এই ক্লাইভ আর কোম্পানি। একদিন তোমার এই বিশ্বাসঘাতকতার মাসুল গুনবে সমগ্র ভারতবর্ষ যখন পুরো দেশেই কোম্পানি রাজ চলবে!" প্রায় ২৫০ বছরের পুরোনো এক ইতিহাসের পাতা যেন কোনো এক যাদুবলে আমার চোখের সামনে ঘটে চলেছে আর আমি নির্বাক দর্শকের মতো দেখে চলেছি। মীর জাফর নিজের কোমর থেকে একটি ছুরি বের করে হঠাৎ সেই লোকটার গলার ওপর দিয়ে চালিয়ে দিলো, লোকটা মৃত্যু যন্ত্রণায় কাঁপতে লাগলো। মীর জাফর বললো "সুড়ঙ্গের কোনো একটি ঘরে বন্ধ করে রাখো এই মৃতদেহকে। কাক পক্ষী যেন টের না পায়! বাংলার মসনদে ঐ সিরাজদ্দৌলা কে সরিয়ে আমি-ই বসবো।" সেই লোকটাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো ব্রিটিশ সেনারা, লোকটার শেষ আর্তনাদে আমার কান যেন ফেটে যেতে লাগলো। গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে লেগেছে তাঁর, চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে লোকটার...সে যেন শুধু আমাকেই দেখে যাচ্ছে। "আমাকে বাঁচান নবাবকে জানাতেই হবে!" আবার এই কথা বলে লোকটা এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি আর দাঁড়াইনি, এই অলৌকিক ঘর আর এই অলৌকিক রাতের থেকে মুক্তি চাই আমার! আমি প্রাণপণে ছুটতে থাকলাম যেদিকে দুচোখ যায়! পেছন থেকে আবার শুনলাম সেই এক হৃদয়বিদারক আর্তনাদ। কতক্ষণ ছুটেছিলাম জানিনা, একসময় প্রচণ্ড হাঁফিয়ে আবার জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম।


যখন জ্ঞান ফিরলো, দেখলাম আমি শুয়ে আছি আমাদের অফিস ঘরের মেঝেতে। মনটা কেমন একটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার পেছনে ছিলো অন্তর্দ্বন্দ্ব। বিদেশী শক্তির কাছে তারপরে ২০০ বছর কার্যত পরাস্ত হয়েছে ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ। এই ১৯৮৪ তে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী খুনের পরে তো সেই সাধারণ শিখ ভাইদেরকেই মূল্য দিতে হলো জঘন্য এক বিশ্বাসঘাতকতার। অন্তর্দ্বন্দ্বের বলি এবারেও হল সেই সাধারণ মানুষই।। তবে আজকে আমি যা দেখলাম, যা জানলাম তা কি কাউকে বললে বিশ্বাস করবে? সে না করুক...আমার সত্যি আমি জানি। দেখলাম পূবের আকাশে রক্তিম আভা দেখা দিচ্ছে...ভোর হচ্ছে, এক নতুন ভোর।






লেখক পরিচিতি - লেখক শোভন কাপুরিয়ার জন্ম ৭ই জুলাই ১৯৮৭ তে, দমদমে। বর্তমানে পেশায় সফটওয়্যার ডেভলপার আর নেশা গল্প লেখা। ওনার বেশ কিছু লেখা বিভিন্ন পত্রিপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিছু পরিচিত গল্প হল - অন্ধকার চাঁদ, মহুয়াডহরীর মায়া, নেমেসিস, মুকুন্দপুরের জঙ্গলে।

Comments


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page