ধারাবাহিক (জীবনের পাতা থেকে) - একলা পথে
- ধীমান চক্রবর্তী
- Jun 25, 2020
- 9 min read
Updated: Dec 16, 2020
পর্ব - ১
সত্যিই এবার আস্তে আস্তে একটু একটু করে নিজেদের দিকে তাকানোর দরকার..!
সত্যিই কি দরকার আছে?
সেরা সময় টা কি এসেছি পেরিয়ে? হয়তো তাই.. আবার হয়তো তা নয়ও বা।
সেরা তো আপেক্ষিক..
সারা দিন ধ্বস্ত-সংগ্রাম.. রুটির সঙ্গে একটু মাখনের আশায় আশায়। আরেকটু ভালো করে বাঁচার ও বাঁচানোর জন্যে লড়াই। রণ-ক্লান্ত দিনান্তে ফেরার বাসের জানালা দিয়ে.. বর্ষায় ভিজে ছাতা সামলাতে সামলাতে.. পশ্চিম আকাশ ছড়িয়ে দিয়েছে রঙের মাধুকরী.. কাঙাল মনের ঝুলি ভরে যায় ভালোলাগা.. হয়তো বা তারই মধ্যে খুঁজে পাবো এককণা ভালোবাসাকেও।
এটাই কি সে-মুহূর্তে সেরা সম্পদ? হতেই তো পারে.. আমার আপত্তি নেই তাতে।
জীবন এক আশ্চর্য জাদুকরী ছোঁয়ায় বেঁচে থাকার নানান সামান্য তুচ্ছ মুহূর্তের মধ্যেও এনে দিয়েছে অনির্বচনীয়ের স্বাদ।
জীবন তো তার স্বাভাবিক মন্দাক্রান্তা ছন্দে অনিবার্য দেড় হাত জমি কিংবা একমুঠো ছাইয়ের দিকে একমুখী হাঁটা লাগিয়েছে.. যেদিন আমি প্রথম চীৎকারে পৃথিবীর হাওয়া ভরে নিয়েছিলাম ফুসফুসে.. সেদিন থেকেই।
আজ চল্লিশ পার করে হাঁটা লাগিয়েছি.. পঞ্চাশ করতেই হবে যে। এ হাঁটার পথে অনেক অনেক পদাতিক থামিয়ে দিয়েছে তার হাঁটা.. জ্ঞাত বা অজ্ঞাত কারণে।
আমাদের হেঁটে যেতে হবে। জীবন টা বেশ ছোটো... আবার ছোটো নয় ততোটাও..!
এই যে চলা.. এককোষী অস্তিত্বের থেকে বহু স্তর পার হয়ে হয়ে অনিবার্য পরিণতি লক্ষ্য করে.. এই কি জীবন? হয়তো বা, হয়তো নয়।
"আকাশস্থ নিরালম্ব বায়ু-ভূত নিরাশ্রয়", যেখানে পঞ্চ ইন্দ্রিয় থামিয়ে দেবে সব কলকাঠির নাড়াচাড়া.. সে আমি আকবর বাদশাই হই বা হরিপদ কেরানি.. সকলেই কি পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে?
প্রায় সকলেই যায় .. কিন্তু কেউ কেউ নয়। এই মুষ্টিমেয় জীব.. যাঁরা মৃত্যু পার হয়ে গিয়ে জীবনের জলছবি আঁকতে থাকেন সৃষ্টির জলরঙে, তাঁদের জীবন.. তেমন তেমন হাতে পড়লে গল্প হয়ে ওঠে। আরও কম মানুষের জীবন হয় বড়ো গল্প,..আর..
এক বা দুটি জীবন হয়ে থাকে উপন্যাসোপম.. জেগে থাকে বাতি-স্তম্ভ হয়ে। আমার বা আমাদের মতো কিছু হালভাঙা পালছেঁড়া নৌকোর সওয়ারি কে তীরের সন্ধান দিতে হবে যে তাঁদের।
এইসব হাবিজাবি চিন্তারা যখন মনে মনে জাল বুনে পাকে পাকে বেঁধেছে আমাকে.. আর তো সময় নেই,.. এক চোরা ভয় শিরশির করে চলাচল মেরুদণ্ড বেয়ে.. জেগে উঠি কার নির্ভয় নির্ভার ডাকে?
সে আমারই কণ্ঠে ডেকে যায় আমায়। এদিক ওদিক খুঁজি.. কিন্তু কেউ তো নেই আশেপাশে। তাহলে কার ডাক.. আমার তীব্র গতিতে ছুটে চলা টালমাটাল বর্তমানের রেলগাড়িকে চেনের হ্যাঁচকা টানে কে চাইছে থামাতে?..
অবচেতন স্তর থেকে কে পাঠাচ্ছে খবর ?
সে কি আমার অতীত.. যেখানে ভুবন জোড়া চাওয়া আর আঙুল ভরে পাওয়ার খেদ?
নাকি অনাগত ভবিষ্যৎ..
যার পরতে পরতে মিশে আছে অসংখ্য আশঙ্কা আর ভয়, যাদের প্রিয় দুটো শব্দ হলো.. 'যদি' আর 'পাছে' .. ?
প্রতিটি জন্মদিনে জীবন গাছের সুঠাম ডাল থেকে একে একে ঝরতে থাকছে পাতা। মাথার চুলের সাথে সমানুপাতিক হারে হারিয়ে যাওয়া শুরু চেনা মুখের।
তাহলে আমায় ডাকলো কে?
পাতা ঝরা গাছের নিচে শুয়ে শুয়ে দেখছি.. আরও কিছু পাতার ঝরে পড়া।
সেই ঝরা পাতার দলে মিশে হঠাৎ করেই মুখের ওপর পড়লো কয়েকটা কুঁড়ি...।
শ্রান্ত ক্লান্ত.. "আর বেশি দিন বাকি নেই".. শুনতে শুনতে অভ্যস্ত কানের কাছে মুখ এনে তারা বললো..
"আমরা, আমরা ডেকেছি তোমাকে.. তোমার ছেলেবেলা! আমরাই চেন টেনে থামিয়ে দিয়েছি ছুটন্ত রেলগাড়ি!
আমাদের সাথে যাবে বেড়াতে?"
ভাবছিলাম. যাওয়া কি ঠিক হবে? কতো কতো কাজ আছে পড়ে.. সেসব এড়িয়ে..
হঠাৎ খেয়াল হলো.. সেই রেলগাড়ি চড়ে ছোটো ছোটো ছেলেবেলা নিয়ে.. কখন যে পড়েছি বেরিয়ে।
পর্ব - ২
ট্রেনের দুলুনি তে কেমন যেন একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
প্রথম বার যখন ট্রেনে চড়ে ছোটোপিসির বাড়ি যাচ্ছিলাম.. সেইরকম ঘুম।
জানলার পাশেই সিট.. যেদিকে গাড়ি ছুটছে সেইদিকে ফিরে। পান সুপুরি কলা বাবলা খেজুর আর তালগাছ.. এগুলো চিনিয়ে দিয়েছিলো বাবা। আরও কতো কতো নাম না জানা গাছের সারি।
বাঁশ ঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে হয়তো একটা দুটো মাটির বাড়ি। নিকানো উঠোনে ন্যাংটো কালো বাচ্চা.. কোমরে তার ঘুনসি। দুধসাদা ছাগলছানার সঙ্গে মেতেছে খেলায়। পাশেই ছোটো দালান.. খড়ের ছাউনি। সেখানে ঠাকুর তৈরি হচ্ছে খড়ের ওপর মাটি লেপে.. সামনেই তো পুজো। সবার পিসির বাড়ির রাস্তাই কি এতো সুন্দর!
মাঝে মাঝেই জানলার লোহার রেলিং এ নাক ঠেকিয়ে দেখছি.. সাপের মতো চকচকে কালো লাইনগুলো নিজেদের মধ্যে কাটাকুটি খেলছে.. আমরা ইশকুলে যেমনটা খেলি সেভাবে নয়। বাবা বকে দিলো..
.." উঁহু। নাক ঠেকাস না.. খুব জার্মস!"
হু হু করে হাওয়া.. চোখ ভালো করে খুলে দেখতেই পাচ্ছি না যে। এদিকে আমার ছোট্ট ছোট্ট চোখের খিদে মেটানোর এইসব নিমকি-জিবেগজা গুলো রেলের চাইতেও জোরে জোরে ছুটছে.. কিন্তু ছোটো পিসির বাড়ির উল্টো দিকে! খুব রাগ হচ্ছিলো! এতো কীসের তাড়া?. . পিসির বাড়ি এসে পড়বে যে!
হাওয়ায় চোখের পাতা বুজে এসেছে কখন.. টের পাইনি।
বাবার ধাক্কায় ঘুমটা ভেঙে গেলো.. "ওঠ ওঠ.. এবার নামতে হবে!"
ঘুম আর ঘুম থেকে ওঠার মাঝামাঝি অবস্থায় কানে ভেসে আসছে মায়ের গলা.. আমাদের দেশের বাড়ির পুজোয় অষ্টমীর সন্ধেবেলায় সন্ধিপুজোর মন্ত্রের মতো.. "এক্ষুনি ডাকছো কেন? সবে ঘুমিয়েছে বেচারা.. পরের স্টেশনে তো নাববো!"
.. কানে যেতেই চোখ খুলে ধড়মড় করে উঠে বসেছি!
ট্রেন আস্তে আস্তে ঢুকছে প্ল্যাটফর্মে..
..কামরায় কেউ নেই! আমার হঠাৎ ভ্যাঁ করে কান্না পেলো.. ছোটোপিসির বাড়ি যাবো কী করে?
ট্রেন থামলে নামলাম। কিন্তু এই স্টেশনে নেমে তো পিসির বাড়ি যেতে পারবো না.. হলুদ রঙের বোর্ডের ওপর কালো রঙের লেখা..
... ' দিকশূন্যপুর '...!
ওদিকে ট্রেন বাজিয়ে দিয়েছে ভোঁ!.. ছুটে গিয়ে আবার উঠে পড়লাম। ধীরে ধীরে ছেড়ে চলে যাচ্ছি অদ্ভুত নামের স্টেশনটা.. রেলগাড়ি গতি বাড়িয়েছে।.. জানলার বাইরে শরতের কাশবন.. আর তার আলপথ ধরে ছুটে আসছে খেঁটো ধুতি পরা আদুড় গায়ের এক শ্যামলা ছেলে.. পেছন পেছন তার দিদি!
অনেকক্ষণ ধরে মুখ বাড়িয়ে দেখার চেষ্টায় ছিলাম.. দিদিটাকে খুব চেনা চেনা লাগছে! কিন্তু ট্রেনটাই যতো নষ্টের গোড়া.. এগিয়েই চলেছে! আবার সেই একই দুলুনি.. কামরায় আমি একা। বিরক্তিকর একটা একঘেয়ে শব্দের সাথে এগিয়ে যাচ্ছে আমার জীবনের রেলগাড়ি..
.. " ছুউউউউট.. নরক থেকে নরকে, নরক থেকে নরকে.."
আমি তার একলা সওয়ার।
মনে হচ্ছে একটা বৃত্ত আঁকতে শুরু করেছি।.. আর ক্লাস ফোর এর সেই ছেলের টলোমলো হাতের কাঁটা-কম্পাস কিছুতেই আর বৃত্তের দুটো মুখ ঠিকঠাক করে জুড়ে উঠতে পারছে না!
বারবার ভেসে উঠছে দিদিটার মুখ.. খুব চেনা.. খুউব চেনা! আমার নিজের তো কোনো ভাইবোন নেই। একা একা চলা.. আর নিজের সঙ্গে একা একাই কথা বলা।
তবে হ্যাঁ.. একজন মানুষ ছিলো যার সঙ্গে সবরকম কথা বলে উঠতে পারতাম।..আমার মেজকা।
বাবারা ছিলো চার ভাই তিন বোন। মাস্টারের বংশ। বাবা কাকা জ্যাঠা সকলেই মাস্টার মশাই.. কেউ প্রাইমারি.. কেউ বা সেকেন্ডারি ইশকুলের। ঠাকুরদাও মাস্টার ছিলেন.. তবে স্টেশন মাস্টার।
ভেলুলাল দাশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেডস্যার আমার মেজকা আবার চুনীলাল স্মৃতি পাঠাগারের বিনি-মাইনের লাইব্রেরিয়ান। সেই সুযোগে দেদার বই এনে দিতো। আমি তখন ভালো করে পড়তেও শিখিনি.. আমায় 'পথের পাঁচালি' বলে বই টা পড়ে শুনিয়েছিলো। শুধু তাই নয়.. পথের দেবতার সঙ্গে দেখা করিয়েও দেবে বলেছিলো! সেই দেবতা বালকের দিকে চেয়ে কীরকম করে প্রসন্ন হাসি হাসেন.. সেটাও হেসে দেখিয়েছিলো মেজকা!
মনে আছে.. অনেক বছর ধরে পথের দেবতার কাছে নিয়ে যাবার জন্য বলেছি।.. আর প্রত্যেক বার মেজকার সেই এক উত্তর.. "ডাকবে ডাকবে। এখন অন্যদের নিয়ে ব্যস্ত আছে। আরেকটু বড় হ.. নিজেই ডেকে নেবে। তখন আর আমায় নিয়ে যেতে হবে না।.. তুই একাই যেতে পারবি।"
একটা গান মেজকা খুব গাইতো.. বেসুরো গলাতেই।
.. " আমার মনের ভেতর আরশিনগর.. সেথা এক পড়শি বসত করে..।"
সেটাই গুনগুন করতে করতে ক্লান্ত মাথাটা একটু এলিয়ে দিলাম।
সময়ের রেলগাড়ি ছুটে চলেছে.. " নরক থেকে নরকে.. নরক থেকে নরকে!"..আওয়াজ তুলে!
পর্ব - ৩
ট্রেনের শব্দটা মাথার মধ্যে ক্রমাগত পাক খেয়ে চলেছে। কেবল কি এক নরক থেকে আরেক নরকের দিকেই ছুটে চলা?.. তাহলে দিকশূন্যপুরে কাশবন ঝাঁপিয়ে ছুটন্ত সেই ভাইবোনকে দেখে কেন মনে হয়েছিলো.. একখণ্ড স্বর্গ যেন সেই মুহূর্তে নেমে এসেছে! কেনই বা বন্ধ চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে সেই দিদিটার মুখ?
এইসব নানান ভাবনা হাত ধরাধরি করে ঘুরে ঘুরে নাচতে শুরু করে দিলো!
কখনো কাশের গুচ্ছ.. কখনো অসম্ভব সুন্দর স্বপ্নের মতো নীলরঙা কিন্তু চৌকো একটা আকাশ..
নয়তো একটা গভীর চেনা গলায় গাওয়া গান "পথে চলে যেতে যেতে কোথা কোনখানে, তোমার পরশ আসে কখন কে জানে".... সব মিলে মিশে আমার চিন্তা চেতনা আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগলো!..
স্বর্গ কেমন জায়গা.. আর সেটা আছেই বা কোথায়?.. নরকটাই বা কী? কোনখানে.. কীরকম সেই আরশিনগর?.. আর কোন পড়শি ই বা থাকে সেখানে?
এলোমেলো ভাবনাগুলো.. আর তার সাথে রেলগাড়ির জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া দামাল হাওয়া মিলে আবার চোখটা কেন জানি না বুজে এলো।.. আর সেই ঘুম আর জেগে থাকার আশ্চর্য গোধূলির মধ্যেই চোখের ওপর নেমে আসছে নানা ছবি!..
মেজকা আমার দিকে হাসি হাসি মুখ করে বাড়িয়ে দিয়েছে একটা স্লেট, সরু শক্ত চক-পেনসিল আর জল-ন্যাকড়া। আমাদের তালপুকুরের মতো গভীর আর তার জলের মতোই চকচকে মেজকার চোখের দৃষ্টি!..
আমি কাঁপা কাঁপা হাতে কাঁচা অক্ষরে কালো স্লেটের ওপরে লিখলাম.. ' অ '..!
বহুযুগের ওপার থেকে ভেসে এলো মেজকার গলা.. " তারপর?"
চক-পেনসিল আর আমার হাতের শাসন মানছে না.. ' আ ' এর বদলে অন্য একটা শব্দ জ্বলজ্বল করছে স্লেটের ওপর!.. .... ' আরশিনগর!'
মাথার মধ্যে কী সব ঘটে যাচ্ছে আমি বুঝে উঠতে পারছি না! কে আমার হয়ে লিখে দিচ্ছে এসব?.. সে কি আমি.. না অন্য কেউ!
হু হু হাওয়ার মধ্যেও আমার কপালে বিনবিন করে ফুটে উঠছে ঘাম! আমি কি আমার মধ্যে আছি.. নাকি আমার খোলটাই আছে?.. আর সেই চেনা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে আমারই অচেনা আরেকটা আমি.. আমার অস্তিত্ব! মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে!..চোখের সামনে সেই লেখা..
হঠাৎ রিনরিনে গলায় কে যেন বলে উঠলো..
" এটা আবার কী লিখলি?.. বুদ্ধু কোথাকার! আরশি মানে তো আয়না! "
সরু সরু চুড়ি পরা একটা আরো সরু হাত.. শ্যামলা রঙের। আমার দিকে একটা আয়না এগিয়ে দিয়েছে.. ছোটো চারকোণা.. মেহগিনি বাহারি ফ্রেমের খাঁজে খাঁজে জমে আছে ধুলো। কাঁচটা কিন্তু দারুণ ঝকঝকে.. নতুনের মতো!
চমকে দেখি.. আরে! মিতু দিদি!.. এই তো সেই মুখ! ছুটন্ত রেলগাড়ির থেকে ঠিকমতো বুঝতে পারিনি। আমার ছোটকার মেয়ে.. বছর চারেকের বড়ো আমার থেকে!
আমার চলমান বর্তমান থেকে ফেলে আসা অতীতকে চিনে উঠতে পারিনি ছোটার তাড়ায়!
ছোটকা আর সেজকা থাকতো আমাদের দেশের বাড়িতে.. হুগলি জেলায়। স্টেশনমাস্টার ঠাকুরদা.. যাঁকে আমার দেখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না.. কর্মসূত্রে ঘুরেছেন অবিভক্ত ভারতের অনেক শহরেই। হুগলি জেলায় ছিলো তাঁর পৈতৃক বাড়ি।
আর হাওড়ার যে বাড়িতে আমার জন্ম.. সেটা তখনকার দিনে রেঞ্জার্সের লটারি পেয়ে ঠাকুরদার কেনা। বাবা আর মেজকা পড়াশোনার জন্য তাদের জন্মস্থান ছেড়ে এই বাড়িতেই থাকতো। তারপর দুজনেই চাকরি পেয়ে শহরেই থেকে গেলেও দেশের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রয়েই গিয়েছিলো.. শেকড়ের টান কি অতো সহজে ভোলা যায় নাকি ! দুজনের শৈশব আর কৈশোরের গন্ধ জড়িয়ে আছে যে !
সেই দেশের বাড়িতে ছুটিছাটায় যাওয়াটা শহরে জন্মানো আমার কাছে ছিলো এক পরম পাওয়া। বিশেষ করে পুজোর ছুটিতে। এক মুহূর্তের মধ্যে চোখে ভেসে উঠলো আলোর রোশনাই, ধুপধুনোর গন্ধ, ঢাক-ঢোল-কাঁসর-ঘণ্টা.. "আয়ুর্দেহি-যশোদেহি".. সঙ্গে লোকজনের নানান গলায় নানাসুরের শব্দমাখা এক আশ্চর্য জমকালো ছবি!
ছবিটা পুরোনো হলেও মনে হয় এইতো সেদিন।..
বাড়ির লাগোয়া দুর্গাদালান। মাথায় সাদাকাপড়ে লালরঙা ফুল আঁকা চাঁদোয়া.. ঝাড়লন্ঠন আর হ্যাজাকের আলোয় ঝলমল!
বাবা গরদের কাপড় পরে ভোগরান্নার তদারকিতে ব্যস্ত.. মুখে কাপড় বেঁধে মা-কাকি-পিসিরা আনাজ কুটছে মশলা বাটছে। মেজকা বেলগাছে উঠে একঝুড়ি বেলপাতা নিয়ে নেমে এসে একগাল হেসে আমায় বললো..
"বেম্মোদত্যির সঙ্গে একটা জরুরী কথা সেরে এলুম, তোকে একটা কথা বলে দিতে বলেছে। অঞ্জলি দেবার সময় 'পুত্রং দেহি' র বদলে 'মিত্রং দেহি' বলবি। পুত্র কন্যা সব সমান.. কিন্তু বন্ধু পাওয়া সোজা নয়!"
" কিন্তু আমার তো এইখানে এতোগুলো ভাইবোন দাদাদিদি.."
একটা রহস্যময় হাসি হেসে বললো মেজকা.. " নাহ্! পথের দেবতার সঙ্গে তোর দেখাটা করিয়ে দিতেই হবে দেখছি!"
পর্ব - ৪
মেজকা টা ভারি অদ্ভুত তো! কী যে একটা কথা দুম করে বলে দিয়ে চলে গেলো!.. হুঁহ্! বন্ধু পাওয়া নাকি সহজ নয়!
পুজোর সময় এই যে আমাদের জ্যাঠতুতো খুড়তুতো মামাতো পিসতুতো ভাইবোনদের অ্যাত্তো গপ্পো আড্ডা হিহি হোহো হৈহৈ.. এটা কি কিচ্ছু নয়?.. যদিও এদের মধ্যে প্রায় সকলেই আমার চেয়ে বড়ো..!
মেজোপিসির কাছে শুনেছি যে বাবা নাকি সব বোনের বিয়ে দিতে গিয়ে নিজেই দেরিতে বিয়ে করেছে। যাগ্গে যাক। ওসব ভেবে লাভ নেই!
যদিও আমাদের পাড়ায় একটা কারখানাতে যখন খুব ঝগড়া হচ্ছিলো.. একটা লোক আরেকজনকে 'বাবার বিয়ে' দেখিয়ে দেবে বলেছিলো। সেবারও আমি মুস্কিলআসান মেজকা কে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাবার বিয়ে দেখানো যায় নাকি!.. কে দেখায়?
শুনতে পেয়ে রান্নাঘর থেকে মা গরম খুন্তি নিয়ে তেড়ে এসেছিলো। বাঁচিয়ে দিয়েছিলো মেজকা.. চোখ বড়ো বড়ো করে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো সদরঘরে।.. তারপর একটা ফিক্ করে হাসি দিয়ে কেবল বলেছিলো.. " সময়!"
কী যে বলে না মেজকা টা! এই পুজোর ভীড়েও হাসি পেয়ে গেলো। আমার ভাগ্নে ভোম্বল , সোনা.. কিম্বা ভাইপো পকাই.. তাচ্চেয়েও বড়ো মিতু দিদি.. বন্ধু নয় আমার?
আরতি হচ্ছে.. ঠাকুরের মুখ ধোঁয়ার মধ্যে অস্পষ্ট.. ঢাকের আওয়াজ.. সাত আটজন ঢাকি একসাথে বোল তুলেছে.. ঢাকের সঙ্গে লেগে থাকা পালকের লম্বা লম্বা চামর নাচছে সেই তালে তালে!
মিতু দিদির মুখটা সরস্বতী ঠাকুরের মতো লাগছে। কানের কাছে মুখ এনে বললো.. " চন্নোমেত্যো মানে কী বলতো?" ভ্যাবলার মতোন চেয়ে আছি.. মাথায় একটা গাঁট্টা মেরে খিলখিলিয়ে হেসে বললো..
" গবা কোথাকার! চন্নোমেত্যো হলো চরণামৃত! "
উফ্..মিতু দিদি কি জোর মারলো মাথায়! দাঁড়াও.. ছোটকাকে বলতে হবে! কিন্তু আশেপাশে ছোটকা তো নেই.. আর আমিও তো এখন একা একা বসে আছি ট্রেনের কামরায়! ট্রেনটা বেশ জোরেই ছুটছে!
মনটা কেন জানিনা খারাপ হয়ে গেলো। বেশ ভালোই তো ছিলো সে সব সময়.. কী দরকার ছিলো বড়ো হবার? সময়ের কথা মনে হতেই বাঁ হাতের কবজির দিকে তাকিয়ে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো!.. ঘড়িটা কোথায়?.. আর হাতটাই বা কার?
এটা তো একটা বাচ্চার হাত!.. আর সেই অচেনা হাতে ধরা একটা চেনা আয়না! মেহগিনি বাহারি ফ্রেমের মধ্যে চেয়ে দেখছি চল্লিশ পার করে পঞ্চাশের দিকে ছুটে চলা আমার মুখ। কিন্তু চিনতে পারছি না!.. চশমাটাই বা কোথায়?
একটা ছোট্ট ছেলে আয়নার ভেতর থেকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে! মুখে তার একচিলতে হাসি। সে হাসিতে সহজ সরল এক অনাবিল দুষ্টুমি।
চলন্ত রেলগাড়ির মতোই আয়নার মধ্যে কয়েকটা ছবি চলতে শুরু করেছে পরপর! ছোটবেলায় যেরকম টিভি তে চলতো.. ঠিক তেমনি করে!
আর.. অবাক চোখে আমি দেখে চলেছি! সেই সঙ্গে ট্রেনও চলেছে। জানিনা কোন দিকে!
আমি একদৃষ্টে আয়নায় তাকিয়ে আছি। আমি সেই ছেলেটাকে দেখছি।
সাদা জামা আর গ্যালিজ দেয়া নীল হাফপ্যান্ট পরে গুটিগুটি পায়ে বাবার হাত ধরে এগোচ্ছে একটা সাদা রঙের বাড়ির দিকে। বাড়িটার অনেক জায়গায় পলেস্তারা খসে খসে পড়েছে। দেখে মোটেও ভাল্লাগছে না। একটা সরু গলির মধ্যে এ কেমন ইস্কুল!
বাংলায় লেখা একটা বোর্ড..সেটা দেখে আমার বেশ মজা লাগলো। আমার মামার নামে ইস্কুলও আছে!.. যদিও পুরো নাম টা নয়.. শুধু 'ফণী' টা নিয়েছে। সে যাই হোক.. নিয়েছে তো!
আমার হাতে টিনের সুটকেস.. 'সমর' লেখা। পায়ে 'নটিবয়' জুতো.. মেজকার সাথে গিয়ে 'বাটা' বলে একটা আজব নামের দোকান থেকে কেনা।
জুতোর দোকানের অমন নাম কেন.. সেটা মেজকা কে জিজ্ঞেস করায় বলেছিলো..
"অনেক রকম জিনিস বাটা হয়। জুতোর দোকান, মশলা, মাছ.. এমনকি পানেরও বাটা হয়।"
ঢুকে পড়লাম সেই বিদঘুটে বাড়ি তে। বাড়িই তো.. নীলরঙা বোর্ডের শেষ শব্দটা তো ছিলো 'হোম।' হোম মানে যেমন বাড়িও হয়.. তেমনি পুজোও হয়। এটা আমি নিজে নিজেই জেনে গেছি সত্যনারায়ণ সিন্নির সময়.. মেজকার থেকে জানতে হয়নি। চন্নোমেত্যোর আসল মানে টা তো মিতু দিদি বলেই দিয়েছিলো।
বাড়িটা কিন্তু দেখলাম বেশ মজার.. একটা নয় অনেকগুলো বাড়ি! একটা আরেকটার সঙ্গে সিঁড়ি নয়তো ছোটো ছোটো সাঁকো দিয়ে জোড়া!ছোট্ট একটা সাঁকো পেরিয়ে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বাবা বললো.. "প্রণাম করো। ইনি ইন্দু বাবু.. ইন্দ্রনাথ মুখার্জি। এই স্কুল এঁর হাতেই তৈরি।"
পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। দুটো হাত মাথার ওপর ঠেকতেই কেন জানি না আমার গায়ে কাঁটা দিলো!
মিষ্টি একটা গলা শুনলাম.. "মানুষ হয়ে ওঠো.. বিদ্বান না হলেও চলবে।"
...... চলবে

লেখক পরিচিতি - লেখক ধীমান চক্রবর্তী, পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ইঞ্জিনিয়ার। জন্মসূত্রে হাওড়া নিবাসী। শিবপুর বি ই কলেজ ও খড়্গপুর আই আই টি তে ছাত্রজীবন। লেখালেখিরও শুরু সেখান থেকেই। কবিতা ও গদ্যসাহিত্যে বিচরণ। প্রিয় সাহিত্যিক সুকুমার রায়। লেখালেখি ছাড়াও গান, বাঁশি আর ছবি আঁকার চর্চা।
Comments