গল্প - শিকড়ের সন্ধানে
- তন্ময় মালিক
- Jun 21, 2020
- 5 min read
Updated: Dec 16, 2020
জগতে যে কি হতে পারে আর কি হতে পারে না, তা মনেহয় শুধু আমার কেন, আমার মতো আরো অনেকেরই চিন্তাভাবনার অতীত। মনে হয় এটা কি সম্ভব? আর কি করে এটা হতে পারে? অবাস্তব বা অকল্পনীয় মনে হলেও আজও ঘটে চলেছে এরকমই কিছু ঘটনা। তাই দেখতে পাই, কোন সুদূর বিদেশ থেকে মানুষ আজও শুধুমাত্র শিকড়ের সন্ধানে, তার জন্মদাত্রী মায়ের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়, সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটের সাহায্য নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যায় তার তার অতীত জানার। কোন ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতী হয়তো বা সেই সন্ধান পেয়েও যান, কিন্তু সবার ক্ষেত্রে তো আর তা সম্ভব নয়। আজ না হয় ইলেকট্রনিকস মিডিয়া , সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইট অনেক সক্রিয়, তার দৌলতে কিছু কিছু মিরাকল হয়তো বা সম্ভব। আর DNA টেস্ট করে এটাও বলে দেওয়া সম্ভব যাঁকে মনে করা হচ্ছে, তিনিই আসল কিনা? কিন্তু এসবের আগে, তখন তো এসব কিছুই ছিল না, ছিলো না তেমন যোগাযোগ ব্যবস্থাও। তাই সেসময় ইচ্ছে হলেও এসব অজানাই থেকে যেত।
কোন সুদূর অতীতে হয়তো বা অভাবের তাড়নায় নিজের সন্তানকে মানুষ করা তো দূরের কথা, শুধুমাত্র তার মুখে অন্ন তুলে দিতে পারবে না বলে, নিজ সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দেয় বা দিতে বাধ্য হয়। কেউ জানতেও পারে না, সেই মায়ের বুক ফাটা হাহাকার আর যন্ত্রনার কথা। আস্তে আস্তে হয়তো বা তার সন্তানের মন থেকেও ফিকে হয়ে যায়, তার জন্মদাত্রী মায়ের স্মৃতি। কিন্তু সত্যিই কি তাই হয়? না বারে বারে স্বপ্ন হয়ে ফিরে ফিরে আসে সেই স্মৃতি? এর উত্তর আমার জানা নেই। আর এ নিয়েই আমার আজকের ছোট্ট প্রয়াস।
আজ আমি যে ঘটনাটা বলছি, সেটা আমি শুনেছিলাম, আমার দূরসম্পর্কের এক ঠাকুমার কাছে। তিনি একলা মানুষ, একাই একটা শ্মশানে থাকতেন। লোকজন যা চাল, ডাল, আলু দিত, তাই দিয়েই তিনি কোনরকমে ফুটিয়ে নিয়ে তাঁর ক্ষুধা নিবৃত্তি করতেন। তিনি মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতেও আসতেন আর সেদিন দুপুরে তিনি আমাদের সাথেই খেতেন। এমনই একদিন, দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে , তাঁর সাথে গল্প করতে বসেছিলাম। তখন তিনি এই ঘটনাটা বলেছিলেন।
সে অনেক দিন আগের ঘটনা, আজ থেকে প্রায় একশো পঁচিশ বছর আগের। রাস্তা দিয়ে দুই ছেলেকে সাথে নিয়ে হেঁটে চলেছেন এক মা। কোথায় যাচ্ছেন কি উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন, তা হয়তো তিনি নিজেও জানেন না। গ্রীষ্মের প্রখর রোদ, উদভ্রান্তের মতো তিনি এগিয়ে চলেছেন। মাথায় প্রখর রোদ , তার ওপর ক্ষিদের বড়ো জ্বালা , তাই সাময়িক বিশ্রামের জন্য তিনি তাঁর ছেলেদের নিয়ে এক বাড়িতে ঢোকেন। আজকের দিনে এটা বিরল মনে হলেও, আগেকার দিনে গ্রাম বাংলায় এরকম ঘটনা হয়তো একটা সাধারণ ঘটনাই ছিল। সকাল থেকে কিছু না খেয়ে থাকার জন্য আর সাথে পথ শ্রমের ক্লান্তির জন্য বাচ্ছা দুটো খিদের জ্বালায় কাঁদতে থাকে। বাচ্ছা দুজনের তখন আর কতই বা বয়স, বড়ো জনের বয়েস ছয় সাত, আর ছোটছেলের বয়েস তিন চার। তখন মা , সেই বাড়ীর কর্তামাকে , তাঁর বাচ্চাদের কিছু খেতে দিতে অনুরোধ করেন। তিনিও তো একজন মা, বাচ্ছা গুলো অভুক্ত জেনে, তাঁদের বাড়ীতে যা ছিলো, তাই তিনি তাদের মুখে তুলে দেন, আর দেখতে থাকেন কি তৃপ্তি নিয়ে তারা তা খাচ্ছে। তাদের তৃপ্তি দেখে , অভুক্ত দুই শিশুকে খাওয়াতে পেরে তাঁর দুচোখে জল চলে আসে। খাওয়ার পর পথ শ্রমের ক্লান্তিতে বাচ্ছা দুজনের চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে, তখন সেই কল্যাণময়ী মা, বাচ্চাদের তাঁর ঘরে নিয়ে যান, আর সেখানেই তাদের শোবার ব্যবস্থা করেন। তাদের মা বাইরেই বসে থাকেন। তিনি যখন ঘরে যান, তাদের মা তখনও বাইরেই রয়ে যান। কিন্তু কিছু পরে, ঘরের বাইরে এসে দেখেন, সেই মা আর সেখানে নেই। ভাবেন পাশেই হয়তো কোথাও গেছেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন। এদিকে মাকে না পেয়ে ছোট ভাই সমানে কেঁদে চলেছে, বড়ো ভাইয়েরও কান্নায় বুক ফেটে যেতে থাকে, কিন্তু সে কাঁদতে পারে না, উল্টে সে তার ভাইকে সান্ত্বনা দিতে থাকে। দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে যায়, বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হয়ে যায়, কিন্তু সেই মা আর ফিরে আসেনি। দুই ভাই তখন অসহায় আর দিশেহারা, আর সেটাই তো স্বাভাবিক। দুই ভাই কি করবে, কোথায় থাকবে কিছুই বুঝতে পারে না। বুকের ভিতরটা কেবল মাঝে মাঝেই দুমড়ে মুজরে ওঠে, একদিকে অচেনা অজানা পরিবেশ তার ওপর একেবারে সহায় সম্বল হীন। দুই বাচ্চার এই করুন পরিণতি দেখে তাদের খুব কষ্ট হয়। ঠিককরে বলতেও পারে না, কোথায় তাদের বাড়ী আর কোথা থেকেই বা তারা এসেছে, তাই কোনোভাবে তাদের বাড়িতেও পৌঁছে দিতে পারবে না। এমতাবস্থায় গৃহকর্তা আর সেই কল্যাণময়ী মা দুই ভাইকে তাদের বাড়িতেই রেখে দেন, আর খেয়াল রাখেন অচেনা পরিবেশে যেন তাদের কোনও অসুবিধে না হয় । দুই ভাই একসাথে তাদের আশ্রয়দাতার বাড়িতেই তাদের অন্য সব ছেলে মেয়ের সঙ্গে একসাথে মানুষ হতে থাকে। মায়ের জন্য মাঝে মাঝেই বুকের ভিতরে ডুকরে কেঁদে ওঠে, কিন্তু সময়ের সাথে আস্তে আস্তে হয়ে যায় তাদেরই বাড়ির ছেলে। ছোট ভাই তখন খুবই ছোট , তাই তার অতীত স্মৃতি একটু একটু করে মুছে যেতে যেতে একসময় তা বিলীন হয়ে যায়, কিন্তু বড়ভাই , সে সবার সাথেই মেশে সবকিছুই করে, কিন্তু সে কিছুতেই তার মাকে ভুলতে পারে না, মাঝে মাঝেই মনে পড়ে তার ছোটবেলার কথা, মায়ের আদরের স্মৃতি। সেও তো তখন খুবই ছোট সেরকম কিছু তারও মনে পরে না, তবুও সে যেন নিজেকে জানতে চায়। কেন তার এরকম হল, কি কারণ এর পিছনে? সে জানে , সে ছাড়া জ্ঞানত তার ছোট ভাইয়ের আপন বলে আর কেউ নেই। তাই সে যেন অপেক্ষায় থাকে কবে ভাই বড়ো হবে? একদিন যখন মনে হয়, ভাই এখন নিজেরটা নিজেই করে নিতে পারবে, আর আমার সাহায্যের খুব একটা প্রয়োজন হবে না, তখন সে তার প্রিয় ভাইকে ছেড়ে, তার আশ্রয়দাতার নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে সে বেড়িয়ে পড়ে তার উত্তর খুঁজতে।
বাড়ীর লোকজন এবং তার ভাই তার খোঁজ খবর নিতে চেষ্টা করে, কিন্তু সে সবই ব্যর্থ হয়। এর বেশ কয়েক বছর পর, তিনি একবার সেই বাড়ীতে আসেন। না তখন তিনি আর সেখানে ফিরে আসার জন্য আসেননি, কারণ তখন তিনি সন্ন্যাস ধর্ম নিয়ে নিয়েছেন, এসেছিলেন তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাতে, সেই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তিনিও যে সুস্থ আছেন, তিনিও যে ঠিকই আছেন, আর তার জন্য তাঁরা যেন দুশ্চিন্তা না করেন, সাথে তাদের না জানিয়ে তাদের যে দুশ্চিন্তায় ফেলে তিনি যে চলে গিয়েছিলেন, তার জন্য অপরাধ স্বীকার করতে। সাথে তার ভাইকে যে তাঁরা আশ্রয় দিয়েছেন, সমাজে স্বীকৃতি দিয়েছেন, সেজন্য যে তিনি যারপরনাই তাদের কাছে কৃতজ্ঞ তাও জানাতে ভোলেন না। তারা তাঁকেও তাঁর ভাইয়ের সাথে থেকে যেতে বলেন, কিন্তু দ্বিধাহীন ভাবে তিনি তাঁদের জানিয়ে দেন, আজ আর তা সম্ভব নয়, আজ তিনি ঘরছাড়া একজন সন্ন্যাসী।
ছোটভাই ওই বাড়িতেই আর সবার সাথে বড়ো হয় , তখন সে সেই বাড়ীরই একজন, তাদেরই ছেলে। তাঁরা শুধু তার জন্মই দেন নি, কিন্তু সেই ছোট্ট থেকে মানুষ করা থেকে শুরু করে , তাঁরাই তার মা বাবার সমস্ত দায়িত্ব কর্তব্য পালন করেন। সম্বন্ধ করে তার বিয়ে দিয়ে, তাকে সংসারী করে দেন। তিনিও তার সংসারের অবর্তে জড়িয়ে পড়েন, অতীতের স্মৃতি ফিকে হতে হতে একসময় তা দূরে সরে যায়, সেটাই হয়ে ওঠে তার নিজের বাড়ি। আর তাঁকে সংসারের আবর্তে জড়িয়ে ফেলা হয়েছিল বলেই , আজ আমি আছি, তাই আমিও তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ । কেননা সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলে, তিনি আর কেউ নন , তিনি আমারই পরম পূজনীয় প্রপিতামহ।

লেখক পরিচিতি - লেখক তন্ময় মালিকের ছোটবেলা কেটেছে হুগলী জেলার শিয়াখালা গ্রামে। সেখান থেকেই প্রাথমিক শিক্ষার পর বেঙ্গল ইঞ্জনিয়ারিং কলেজ, শিবপুর থেকে ইলেকট্রিনক্স এবং টেলিকমিউনেশনে স্নাতক এই লেখক বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনস্থ বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থায় কর্মরত। অলস সময়ে কখনও কখনও মাথার মধ্যে নানান কল্পনা উঁকি দিয়ে যায় আর তা নিয়েই নিছক সময় কাটানোর জন্য দু এক কলম লিখে ফেলা।
Comments