top of page

ভ্রমণ মূলক গল্প - ইচ্ছেপূরণ

  • শ্রাবস্তী সেন
  • Dec 24, 2019
  • 14 min read

ছোটবেলায় বাবা –মা নাম রেখেছিলেন অঞ্জলি। কলকাতার উপকণ্ঠে খুবই সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সে। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতই তার বড় হয়ে ওঠার মধ্যে কোনও বৈচিত্র্য ছিলনা। বাবা, মা আর ভাইকে নিয়ে তার জীবন। বাবা চাকরি করতেন একটা সরকারি কলেজে, “নন-টিচিং” স্টাফ। ছোটবেলা থেকে অঞ্জলির চোখে ছিল একটাই স্বপ্ন, নানান জায়গা ঘুরে বেরানোর। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হয়ে দু-একবার সে বেড়াতে গেছে তার অভিভাবকদের সঙ্গে। তা সে ওই বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় জায়গা দীঘা, পুরী বা আরেকটু দূরে দার্জিলিং-এর মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ। কিন্তু এই ভ্রমণগুলো তার বেরানোর খিদে টাকে দিয়েছিল ভীষণভাবে বাড়িয়ে। অঞ্জলির একটাই নেশা, ভ্রমণ সংক্রান্ত কোন বই বা পত্রিকা হাতে পেলেই সে হুমড়ি খেয়ে পড়তো। মানসচক্ষে সেও যেন পৌঁছে যেত সেই জায়গাগুলোতে। ঘুরে বেড়াতো কখনও পাহাড়ের চুড়োয়, ভেসে যেতো কোন অজানা সাগরে, বা হারিয়ে যেত গভীর জঙ্গলে। বাড়ীর লোকজন বা আত্মীয়স্বজন এই নিয়ে কত হাসাহাসি করেছে, কিন্তু অঞ্জলি অটল থেকেছে তার নিজের স্বপ্নের জগতে।


গ্র্যাজুয়েশন পড়াকালীন একদিন হঠাৎ ই খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। “ ট্র্যাভেল এন্ড ট্যুরিজিম” এর ওপর একটা কোর্সের। অঞ্জলি আর দ্বিতীয়বার ভাবেনি। সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি হয়ে যায়। দুবছরের কোর্সের শেষে ছমাস হাতে কলমে কাজ করতে হয়েছিলো কলকাতারই এক ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে। যদিও অঞ্জলির কাজটা ছিল মূলত তাদের অফিসে বসে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে তথ্য আদান প্রদানের। দুবছরের কোর্স শেষ হওয়ার পরেই সে বিভিন্ন জায়গায় চাকরির আবেদন করতে থাকে। অবশেষে ‘নোম্যাডিক লাইফ’ বলে এক ভ্রমণ সংস্থাতে সে চাকরি পায়। এখানেও প্রথম ছমাস বিশেষ প্রশিক্ষণ চলে। যেহেতু নোম্যাডিক লাইফের মাধ্যমে বহু বিদেশী পর্যটক ভারত ভ্রমণে আসে , তাই তাদের সঙ্গে সাবলীল ভাবে মিশতে পারার জন্য ‘স্পোকেন ইংলিশ’ এর একটা কোর্সও করতে হয়। আর একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয় তার – পর্যটকরা তার অঞ্জলি নামটা অনেকে বদলে ‘এঞ্জেল’ বলে ডাকতে শুরু করে। প্রথম প্রথম অঞ্জলির খুব অস্বস্তি হত, খারাপও লাগত, কিন্তু কিছুদিন পর থেকে অভ্যেস হয়ে যায়।


প্রথম পাঁচবছর তার একরকম ভালই কাটল। এই কয়েকবছরে সে ঘুরে বেড়িয়েছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায়। ছোটবেলায় যে জায়গাগুলোর নাম শুনেছিলো বা যে জায়গাগুলো সম্বন্ধে পড়েছে বিভিন্ন বইতে, সেই জায়গাগুলো নিজের চোখে দেখার উত্তেজনাই আলাদা। এর সঙ্গে তাকে শিখতে হয়েছেও আরও অনেককিছু। এতজন দেশী বিদেশি পর্যটক, তাঁদের থাকা, খাওয়ার সুবন্দোবস্ত করা, টিকিট, পাসপোর্ট বা ভিসা সংক্রান্ত কোনও সমস্যা হলে তা সামলানো, বিভিন্ন জায়গায় দেশী ও বিদেশী পর্যটকদের আলাদা দর্শনীর হিসাব রাখা, স্থানীয় দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর ব্যপারে জ্ঞান অর্জন করা, স্থানীয় হস্তকলা বা অন্য জিনিস কোথায় সুলভ মূল্যে পাওয়া যায় দেখা, কিছু লোকাল অটো বা ট্যাক্সিওয়ালাদের সঙ্গে ব্যবস্থা করে রাখা, এই সবই তাকে করতে হয়েছে। কালক্রমে সবই অভ্যেস হয়ে গেছিলো। তবে আসল কথা হলো, অঞ্জলি তার কাজটা ভালবেসেই করছিলো। কিন্তু এইবারের ব্যাপারটা আলাদা। এইবার কোম্পানি থেকে ওকে মনোনয়ন করা হয়েছে ইউরোপে একটা গ্রুপ নিয়ে যাওয়ার জন্য। গ্রুপ লিডার অবশ্য অন্য একজন। নাম ভিক্টর প্যাটেল ওরফে ভিকি।


“ ইউরোপ” – যেকোনো ভারতীয়র কাছে এক স্বপ্ন। এ যেন অঞ্জলির কাছে এক স্বপ্নপুরন। যে স্বপ্ন দেখতে ছোটবেলা থেকে সে দেখতেও দ্বিধা করতো, তা যেন আজ পূর্ণ হতে চলেছে। এই চাকরীতে যখন সে প্রথম জয়েন করে, তার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে অনেকেই শুনে হেসেছিলেন। কিছু তির্যক মন্তব্যও শুনতে হয়েছিলো তাকে ও তার বাবা-মাকে। প্রথমটায় মাও একটু সন্দিহান ছিলেন। বিদেশ- বিভূঁইএ একা মেয়ে টো টো করে ঘুরে বেড়াবে, কোথাও কোনও বিপদ হলে কে দ্বায়িত্ব নেবে? কিন্তু অঞ্জলিকে উৎসাহ দেন তার বাবা। বলতে গেলে বাবার উৎসাহেই অঞ্জলি এতোটা এগোতে পেরেছে। আজ তার সবচেয়ে অবাক লাগে যে আত্মীয় বন্ধুরা তার পেশা নিয়ে অনেক কটূক্তি করেছে, তারাই আজ এই পেশার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ইউরোপ ভ্রমণের কি মহিমা, সেটাই ভাবে অঞ্জলি।


নির্দিষ্ট দিনে কলকাতা থেকে দুপুরের একটা ফ্লাইটে মুম্বাই আসে অঞ্জলি। মুম্বাইতে ওর এক সহপাঠিনী থাকে আন্ধেরিতে। সোজা চলে যায় তার কাছে। কয়েকটা ঘণ্টা বন্ধুর বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে তারপর রওনা হবে। মুম্বাই থেকে রাত দুটোর ফ্লাইটে যাবে আবুধাবি। সেখানে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করে লন্ডনের ফ্লাইট ধরবে। বন্ধুর ফ্ল্যাটে এসে প্রথমেই ফোন করে “ ভিকি” বা ভিক্টরকে। প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য আদান-প্রদান হয় দুজনের মধ্যে। ভিকি তাকে সাড়ে দশটার মধ্যে এয়ারপোর্টে চলে আসতে বলে। অঞ্জলি খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রাত্তির দশটা নাগাদ রওনা হয় “ মুম্বাই আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টের” দিকে। আন্ধেরি থেকে জায়গাটা যেহেতু খুব দূরে নয়, তাই মিনিট পনেরোর মধ্যেই সে পোঁছে যায় এয়ারপোর্টে।


জীবনে এই প্রথমবা্র সে কোন ও আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে প্রবেশ করলো। ঝাঁ – চকচকে এই এয়ারপোর্ট দেখে সে সত্যিই অবাক। ভিকি তার জন্য অপেক্ষা করছিলো এয়ারপোর্টের ভেতরেই। ভিকি বয়স বছর ৩৭ -৩৮ হবে, প্রানবন্ত এক যুবক। “নোম্যাডিক লাইফের” সঙ্গে আজ প্রায় বছর দশেক হল সে যুক্ত। তার আগে দুএকটা ছোটখাটো সংস্থায় কাজ করলেও প্রথম বড় চাকরি এটাই। ভিকি এদের গ্রুপ নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় এর আগেও ট্যুর করেছে, দুবার আমেরিকাতেও গেছে। ভিকির আন্তরিক ব্যবহারে অঞ্জলি তার প্রথমবার বিদেশ যাত্রার যে আড়ষ্টতা ছিল তা সহজেই কাটিয়ে উঠলো। এখনও প্যাসেঞ্জাররা সেরকম কেউ আসেনি। ভিকি অঞ্জলিকে নিয়ে সিকিওরিটি চেক, ইমিগ্রেসনের কাজ গুলো সেরে নিলো। যদিও এখানে এয়ারপোর্টের মধ্যে প্যাসেঞ্জারদের নিয়ে তাদের খুব একটা কাজ ছিলনা, তবু তারা ইমিগ্রেসনের কাউন্টারের কাছাকাছি অপেক্ষা করতে লাগল। এর মধ্যেই প্যাসেঞ্জার লিস্ট মিলিয়ে নেওয়া ইত্যাদি প্রাথমিক কাজগুলো তারা সেরে নিলো। আস্তে আস্তে লোকজন আসতে শুরু করেছেন। যদিও সবাই মুম্বাই দিয়ে যাবেন না, কিছু লোক দিল্লী ও চেন্নাই দিয়েও যাবেন। আবুধাবিতে গিয়ে সবাই একসাথে মিট করবেন।


যাইহোক এখানের কাজকর্ম ভালোভাবেই মিটে গেল। যাত্রীদের সবার সঙ্গে ওরাও বোর্ডিং গেটে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। যথাসময়ে বোর্ডিং শুরু হোল। এর আগে বহুবার দেশের মধ্যে সে বিমানে উঠেছে, কিন্তু এ যেন এক অন্য অভিজ্ঞতা। ভিকি বোধহয় আগেই আঁচ করেছিলো অঞ্জলির অবস্থা , তাই তাদের দুজনের সিট পাশাপাশি নিয়েছিলো। ভিকিকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওরা যে যার সিটে বসলো।


এই ট্রাভেল টাইমটাতে ওরা মোটামুটি ফ্রি থাকবে,কারন এখানে খাওয়া-দাওয়া সবই এয়ারলাইন্স থেকে দেবে। ওদের আসল কাজ শুরু হবে লন্ডনে নামার পর। চার ঘণ্টার জার্নি ওদের গল্প করে ভালই সময় কাটতে লাগলো। ভিকি মুম্বাইয়ের ছেলে, ভাসিতে ওদের বাড়ি। পড়াশোনা সবই ওখানে, ইন্টারন্যাশানাল ট্র্যাভেলে ওর অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। নানান রকমের মজার মজার অভিজ্ঞতার গল্পে মাতিয়ে রেখেছিলো। মুম্বাই থেকে ওদের সঙ্গে যারা ট্র্যাভেল করছেন, তারা হলেন মিঃ প্রসাদ ও মিঃ সাউ। এঁরা দুজনেই আদতে পাটনার লোক, কিন্ত এখন আমেদাবাদে থাকেন। এছাড়া পুনে থেকে যাচ্ছেন মিঃ গোখলে তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলে। ব্যাঙ্গালোর থেকে রয়েছেন মিঃ সেনগুপ্ত, তাঁর স্ত্রী ও ছেলে। এঁরা আসলে কলকাতার লোক ,ব্যাঙ্গালোরে কর্মরত। ব্যাঙ্গালোর থেকে এছাড়াও রয়েছেন মিঃ ও মিসেস সুন্দর , মিঃ শেখর তাঁর স্ত্রী ও ছোট্ট ছেলে। নাগপুর থেকে রয়েছেন মিঃ ও মিসেস সুলে, এঁরা আবার হনিমুন কাপল। আরও দুজন হনিমুন কাপল আসছেন ওদের সঙ্গে, তারা দিল্লী থেকে এসে যোগ দেবেন আবুধাবিতে। দিল্লী ও চেন্নাই থেকে যে ফ্লাইটগুলো আসছে সেগুলো মোটামুটি একই সময়ে এসে পৌঁছবে আবুধাবিতে।


আবুধাবি এয়ারপোর্টটা বেশ বড়। এখানে আরও একপ্রস্থ সিকিউরিটি চেক ইত্যাদি সেরে, টার্মিনাল চেঞ্জ করে সবাই এসে বসলেন বোর্ডিং গেটের কাছে। এখনও দু ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। এরমধ্যেই অঞ্জলি ও ভিকি দিল্লী ও চেন্নাই থেকে আসা বাকি যাত্রীদেরকে মিট করে সবাইকে এনে বসায় একই জায়গায়। দিল্লী থেকে এসেছেন ওদের এবারের গ্রুপের সবচেয়ে সিনিয়র দম্পতি মিঃ ও মিসেস শর্মা। এছাড়াও রয়েছেন মিঃ গুপ্তা, মিসেস গুপ্তা ও তাদের ছেলে। রয়েছেন হনিমুন কাপল মিঃ ও মিসেস চক্রবর্তী ও জৈন দম্পতি। এছাড়াও কলকাতার মিঃ ঘোষ, মিসেস ঘোষ, ও তাঁদের মেয়ে, আর গুয়াহাটির তিনটি ফ্যামিলি মিঃ দাসের পরিবার, মিঃ চ্যাটার্জির পরিবার, ও মিঃ বাগচির পরিবার। চেন্নাই থেকে মিঃ পিল্লাইরা সতেরো জনের দল নিয়ে এসে পরেছেন।

যথাসময়ে লন্ডনের ফ্লাইট ছেড়ে দিলো। এয়ারবাস ৩৮০ সিরিজের বিশাল প্লেন। অঞ্জলির এই প্রথম এত বড় প্লেনে চড়ার অভিজ্ঞতা হল। ওদের গ্রুপের লোকজন সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছেন। সাত ঘণ্টার ফ্লাইট টাইমটা একটু বেশিই। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে, সিনেমা দেখে সময় কাটানো ছাড়া কিছু করার নেই। এর আগে অনেকের মুখে শুনেছে ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে সময় কাটানোটা খুব বিরক্তিকর হয়ে ওঠে, আজ নিজেও সেটা বুঝতে পারছে। যাইহোক একসময় প্লেন ল্যান্ড করলো হিথরো এয়ারপোর্টে।


ছোট থেকে যে হিথরো এয়ারপোর্টের নাম শুনেছে, সেখানে পা দিয়ে সব কিছু যেন স্বপ্নর মত লাগছে। যাইহোক প্রচুর ফর্মালিটি সেরে আস্তে আস্তে ওরা লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে আসে। ভিকি এরমধ্যেই কথা বলে নিয়েছে ওদের বাস ড্রাইভারের সঙ্গে। ওদের গ্রুপের সব লোকজন এসে গেলে অঞ্জলি সবাইকে নিয়ে গিয়ে বসায় ওয়েটিং এরিয়াতে।


দুটো বাসই এর মধ্যে এসে গেছে, আস্তে আস্তে সবাইকে নিয়ে ওরা রওনা হয়। এবার ওদের গন্তব্য হোটেল। শহরে বাসটা ঢোকার পর অঞ্জলির যেন ঘোর কাটতেই চাইছেনা। এত সুন্দর সাজানো শহর। সবচেয়ে প্রশংসনীয় এদের নিয়মানুবর্তিতা। প্রত্যেক গাড়ি, বাস সব নিজস্ব ‘বে’ মেনে চলেছে। রাস্তাঘাতে লোকজন থাকলেও তা যেকোনো ভারতীয় শহরের থেকে অনেক কম। চারিদিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এ যেন এক স্বপ্নের জগত। বাস এসে থামল হোটেলে। এবার ওদের আসল কাজ শুরু হল। প্রথমেই হোটেলের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ওদের জন্য বুক করে রাখা ঘরগুলোর চাবি গুলো ওরা নিয়ে নিল। প্রত্যেক ফ্যামিলি চাইবে তাদের যেন আলাদা না থাকতে হয়। সবাই যেন পাশাপাশি ঘর পায়। ব্যাপারটা খুব সহজ নয়। যাইহোক কথাবার্তা বলে সুষ্ঠু ভাবে ব্যপারতা মিটিয়ে নিলো ওরা। ঠিক হল ঠিক দেড় ঘণ্টা পড়ে সবাই ফ্রেশ হয়ে লাউঞ্জে এসে মিট করবে। আজ সন্ধ্যেবেলা ‘লন্ডন আই’ দেখতে যাওয়া হবে।


এখানে এখন গ্রীষ্মকাল বলে সূর্যাস্ত হচ্ছে অনেক দেরীতে। রাত্তির প্রায় সাড়ে আটটা অবধি দিনের আলো থাকছে। বাসে করে ‘লন্ডন আই’ দেখতে যাওয়ার সময় লন্ডন শহরটা একটু দেখা হয়ে গেল। আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের এমন মিলবন্ধন চট করে অন্য কোথাও দেখা যাবেনা। ক্রমে বাস এসে পৌঁছল টেমস নদীর ধারে। টেমস নদীর দক্ষিণ পারেই তৈরি হয়েছে ‘লন্ডন আই’। ছোটবেলা থেকে এর অনেক ছবি দেখেছে অঞ্জলি, আজ সামনে থেকে দেখে সে অভিভূত। এর মধ্য থেকে শহরের এক আলাদা ভিউ দেখা যায়। প্রতিটা ক্যাপ্সুল কাঁচে ঢাকা। সেখান থেকে একে একে দেখা যাচ্ছে ‘ বিগ বেন’, ‘ ওয়েস্টমিনিস্টার আবে’, ইত্যাদি বিখ্যাত জায়গা গুলো। পুরো আধঘণ্টা লাগে ওপরে উঠে নিচে নেমে আস্তে। এই আধঘণ্টার মধ্যে যেন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুরো লন্ডন শহরের দর্শনীয় সব স্থানগুলো। এবার আবার হোটেলে ফেরার পালা। ডিনার করে সবাই বিশ্রাম নেবেন।


প্রথম ঝামেলাটা ওদের আজই মুখোমুখি হতে হয়। মিঃ চ্যাটার্জিদের একটা লাগেজ এসে পৌঁছয়নি। স্বাভাবিক কারনেই ওনারা একটু চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু ভিকি এয়ারপোর্টে কথা বলে সমস্ত ব্যবস্থা করে নেয়। এয়ারলাইন্সের লোক এসে সন্ধ্যেবেলার মধ্যেই সেই লাগেজ হোটেলে পৌঁছে দিয়ে যায়। অঞ্জলিরা যখন হোটেলে ফিরল, তখন সেই লাগেজ হোটেলে এসে গেছে। ভিকিকে যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে অঞ্জলি। এত প্রাণচঞ্চল একজন মানুষ, সারাদিন হই হই করছে, প্রত্যেকের খুঁটিনাটি প্রয়োজনের দিকে সজাগ দৃষ্টি, এমনকি অঞ্জলির ব্যাপারেও ভীষণ সজাগ সে। অঞ্জলি যে প্রথমবার ভারতবর্ষের বাইরে এসেছে, অথচ তার জন্য যেন ট্যুরিস্টদের সামনে অঞ্জলিকে বিব্রত না হতে হয়, ভিকি সে ব্যপারে ভীষণ সজাগ। প্রত্যেকটা কাজ একদম ছকে বেঁধে করে রাখছে সে। ভিকিকে জিজ্ঞেস করলে বলে সবই অভ্যাসের ব্যাপার। সারাদিন বাসে বসেই সমস্ত প্ল্যান করে নেয় সে, সেইসঙ্গে দরকারি ফোন গুলো সেরে রাখে। হোটেলের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে সমস্ত কিছু ঠিক করে রাখা, পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে দীর্ঘদিন ঘুরে অনেক লোকের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেছে,তাদের সঙ্গে কথা বলে আগে থেকে টিকিট বুকিং করে রাখা সবই সে করে বাসে বসে। হাসিমুখে সে অঞ্জলিকে আশ্বস্ত করে তারও সব অভ্যেস হয়ে যাবে। পরেরদিনের প্রোগ্রাম নিয়ে আলোচনা করে ওরা যে যার রুমে চলে আসে। সারাদিনের ক্লান্তির পর এবার বিশ্রামের পালা।


পরের দিন সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে চেক আউট করা হল। যদিও ভিকি বলেছে অঞ্জলি এই ট্যুরে ‘ট্যুরিস্ট’, তবু সকালে উঠে ভিকির সঙ্গে সে হোটেলের হিসেব পত্তর মেটানো অবধি সব কিছুই করে। আজ থেকে একটাই বাস থাকবে, তাই আমাদের ভারতীয় অভ্যেসে সবাই অপেক্ষা করতে থাকে বাস এলেই উঠে প্রথম দিকের সিটগুলো দখল করার জন্য। আজ সারাদিনে ঠাসা প্রোগ্রাম। একে একে রয়্যাল আলবার্ট হল, টাওয়ার ব্রিজ, ট্রাফ্যাল্গার স্কোয়ার, পিকাডিলি হয়ে বাকিংহ্যাম প্যালেসে এসে পৌঁছয় ওরা। ওখানে ‘চেঞ্জ অফ গার্ড’ দেখে ওরা মাদাম ত্যুসোর মিউজিয়ামে যাবে ওরা। এবার বাসে উঠতেই অল্প বয়স্ক ছেলে মেয়ে গুলো আবদার করে বাইরে থেকে হলেও তারা একবার লর্ডস গ্রাউন্ড দেখবে। অতএব ভিকিকে একটু ঘুরপথে হলেও মাদাম ত্যুসোতে আসতে হয়। এই মওকায় ক্রিকেটের মক্কা লর্ডস বাইরে থেকে হলেও দেখা হয়ে গেলো। মাদাম ত্যুসোতে পৌঁছে যখন সবাই মিউসিয়াম দেখতে গেলো, ভিকি ওকে বলল আগে একটু দূরেই শারলক হোমসের বাড়ি ২২১ বি, বেকার স্ট্রীটে একবার ঘুরে যাওয়ার জন্য। এটা একটা দারুন অভিজ্ঞতা।


এখানে সব কিছু সেরে ওরা রওনা হয় পোর্ট হারুইচের উদ্দেশে। ওখান থেকে ক্রুজ সিপে করে ওরা যাবে আমস্টারডমে। কিন্তু পোর্ট হারুইচে পৌঁছে ওদের অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। যার ফল হলো যাত্রীদের মধ্যে অনেকেই বিরক্ত হয়ে পরে। অনেকেই বলতে থাকে ভিকি ও অঞ্জলির উচিৎ ছিল আগে থেকে সময় জেনে আসা। সবাইকে বোঝানোর দুরহ কাজটা সেরে ওরা যখন ক্লান্ত, তখনই ওদের টার্ন আসে জাহাজে ওঠার। একের পর এক গাড়ি ও বাস গুলো যাত্রীদের নিয়ে ওঠে জাহাজের মধ্যে। বিশাল ক্রুজ সিপ, অঞ্জলিদের নিয়ে ওদের বাস গিয়ে দাঁড়ায় জাহাজের তৃতীয় তলায়। একে একে লাগেজ নামিয়ে ওরা ওপরে উঠে আসে। ওদের কেবিনগুলো পড়েছে নয় ও দশ তলাতে। সবাইকে নিজের নিজের কেবিনের চাবি দিয়ে ওরা নিজের নিজের কেবিনে আসে। ফ্রেশ হয়ে অঞ্জলি আবার এলো জাহাজের আট তলাতে। এখানেই ডাইনিং হল। অঞ্জলিরা ছাড়াও আরও কয়েকটা ট্যুরিস্ট কোম্পানির লোক এসেছে। তাই খাওয়ার সময়টা ভাগ করে দিয়েছে জাহাজের লোকেরা। হাতে একটু সময় থাকায় অঞ্জলি এসে দাঁড়ায় জাহাজের ডেকে। চারিদিকে দিগন্ত বিস্তৃত জল, আর সেই জল কেটেই এগিয়ে চলেছে তাদের জাহাজ। জাহাজের ডেকে কিছু চেয়ার টেবিল পাতা রয়েছে, অনেক লোকজনই সেখানে বসে ড্রিঙ্ক করছে। এর মধ্যে বিদেশিদের সংখ্যাই বেশি। নিজের মনেই হেসে ওঠে অঞ্জলি, বিদেশিরা যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে প্রাকিতিক শোভা উপভোগ করছে, আমরা ভারতীয়রা ডাইনিং হলে খেতে যাওয়ার সময় একটুও যেন দেরি না হয়, তার জন্য পনেরো মিনিট আগে থেকে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করছে।


সকালবেলা ব্রেকফাস্ট সেরে ওরা জাহাজ থেকে নামে আমস্টারডামে। যদিও ভিকি আগেই বলেছিল জাহাজে খুব একটা ভালো খাবার পাওয়া যাবেনা, তবু লোকজন অনেক কিছু আশা করেছিলো। খাবার ভাল না হওয়াতে অনেকেই দেখা গেল বেশ বিরক্ত। এখানে পোর্টে বাস অপেক্ষা করছিলো, ওরা সবাই রওনা হল ‘কিউকেনহফ’ – পৃথিবী বিখ্যাত টিউলিপ গার্ডেনে। চোখের সামনে এ যেন এক স্বপ্নের জগত। এতরকম রঙের যে টিউলিপ হতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। যেদিকে তাকাও শুধু যেন রঙের মেলা বসেছে। লোকজন এখানে এসে শুধু ছবি তুলেই যাচ্ছে, তবু পুরো বাগানটা ঘুরে শেষ করতে পারবে না। প্রায় দু ঘণ্টা এখানে কাটিয়ে ওরা এবার রওনা হল চিজ ফ্যাক্টরি দেখতে। অ্যামস্টারডামের চিজ ভীষণ ভালো। ওরা এখানে চিজ তৈরির পুরো প্রসেসটা ধাপে ধাপে দেখল। অনেকে চিজ কিনলও। এই অবধি ব্যাপারটা ভালই চলছিলো। গোল বাধল লাঞ্চের সময়। এখানে ভেজ খাবার কিছুই পাওয়া যাচ্ছেনা, ফলে লোকজন বিরক্তি দেখাতে শুরু করলো। মিঃ পিল্লাইদের মধ্যে কিছু লোক তো এমনভাবে ওদের বলতে শুরু করলো, অঞ্জলির মনে হল ওনারা যেখানে ঠিক মতন খাবার পাননি, সেখানে ওরা কেন খাবার খেলো?


ওদের পরবর্তী গন্তব্য হল প্যারিস। প্যারিসে ওরা দুরাত্তির থাকবে। সন্ধ্যেবেলা আইফেল টাওয়ারটা দেখতে যায় ওরা। আলোয় সাজিয়ে রেখেছে টাওয়ারটা। আলোর মুরচ্ছনায় কি রকম মায়াবি লাগে পরিবেশটা। বেশ কিছুক্ষণ ওখানে কাটিয়ে এবার ওরা পুরো দলটা দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। একদল ফিরে যায় হোটেলে, আর এক দল যায় ‘লিডো’ তে। লিডো প্যারিসের এক বিখ্যাত ক্যাবারে শো। এটা অপশনাল ছিল, যারা যেতে চান তারা আলাদা করে টিকিট কেটে যান। ফেরার পথে রাতের প্যারিসের রূপটা দেখতে পায় ওরা। বড় বড় ফ্যাশন আউটলেট রয়েছে, আর প্যারিসকে কেন ‘ফ্যাশন ক্যাপিটাল’ বলা হয় এর থেকেই বোঝা যায়। পরের দিন ওরা আবার দিনের বেলা প্যারিস ঘুরে দেখতে গেল। আর্ক ডি ট্রিম্ফ, ল্যুভার মিউসিয়াম (বাইরে থেকে) ,চ্যাম্পস এলিসিস ইত্যাদি দেখে আবার আইফেল টাওয়ারে আসে তারা। এবার সবাই টিকিট কেটে আইফেল টাওয়ারের ওপরে ওঠে। এখান থেকে প্যারিস শহরের খুব সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। সবশেষে ছিল শেন নদীতে নৌকা বিহার। নদীর দুপাশে বহু লোক রং তুলি ক্যানভাস নিয়ে বসে ছবি এঁকে যাচ্ছে। চারপাশে কি হচ্ছে টা নিয়ে যেন ওদের কোন মাথ্যা ব্যথা নেই।


পরবর্তী গন্তব্য ওদের স্যুইটজারল্যান্ড। বাসে যেতে যেতে ভিকির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ভিকির তার মোবাইল এ ওর স্ত্রী ও মেয়ের ছবি দেখাচ্ছিল অঞ্জলিকে। ভিকির স্ত্রী প্রিয়া একটা স্কুলের টিচার। বেশ মিষ্টি দেখতে তাকে। মেয়ে রিকিয়ার বয়স সবে দুবছর। এখন সে তার আধো আধো কথায় আর দুষ্টুমিতে সবাইকে পাগল করে দেয়। ভিকি দুঃখ করে বলছিল মেয়ের এই বেড়ে ওঠার সময়টা বেশীর ভাগটাই সে দেখতে পাচ্ছে না। অবশ্য দেখতে পাচ্ছে না একদম বললে ভুল হবে, সে যা দেখছে বেশীর ভাগটাই স্কাইপের মাধ্যমে। এই ট্রিপ শেষ করে অঞ্জলি ফিরে গেলেও, ভিকি এখন চারমাস এখানে থাকবে। পরপর ট্রিপ আছে তার। সামারে চার মাস ইউরোপে কাটিয়ে দুমাসের জন্য ওরা বাড়ি ফেরে। কিন্তু তখনও তাদের দেশের মধ্যেই বিভিন্ন সেমিনার, ওয়ার্কশপ এ যেতে হয়। তারপর ডিসেম্বর মাস থেকে আবার যেতে হয় অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডে ট্রিপ করাতে। সেখানেও আবার তিন মাসের ধাক্কা। যার ফলে বাড়ীর লোকের সঙ্গে সময় কাটানো ওদের কপালে হয়ে ওঠে না। ভীষণ মিস করে ও প্রিয়া ও রিকিয়াকে। আরেকটা জিনিস ওর খুব খারাপ লাগে, সে যে এত ভালো ভালো জায়গাতে ঘুরে বেড়ায়, অথচ বাড়ীর লোক কে নিয়ে আসতে পারে না। ওর খুব ইচ্ছে করে একবার প্রিয়া ও রিকিয়াকে নিয়ে স্যুইটজারল্যান্ডে যেতে। কিন্তু প্রথমত তারা অফিসিয়াল ট্রিপে নিজের ফ্যামিলিকে নিয়ে যেতে পারেনা, আর সবাইকে নিয়ে আলাদা ট্রিপ করা বেশ খরচ সাপেক্ষ ব্যাপার। ফলে এই মুহূর্তে তা সম্ভব না।


তবে এই চাকরীতে শুধু যে খারাপ দিক আছে তা নয়, অনেক ভালো দিক ও আছে। এত লোকের সঙ্গে আলাপ হয়, এই কদিনে, যা পরবর্তী সময় খুব কাজে দেয়। কতরকম মানুষ আর প্রত্যেকের স্বভাব ও আলাদা হয়। যেমন এই ট্রিপেই একদিকে রয়েছেন মিঃ ও মিসেস সুন্দর। এত শিক্ষিত, মার্জিত স্বভাবের দম্পতি এরা। সবসময় সবার সঙ্গে হেসে গল্প করছেন, রোজ রাতে অঞ্জলি ও ভিকি খেয়েছে কিনা খোঁজ করা ইত্যাদি নানান ব্যাপারে সবাই এঁদের বন্ধু হয়ে গেছেন। আবার অন্যদিকে মিঃ পিল্লাইদের নিয়ে অনেকের মধ্যেই ক্ষোভ রয়েছে। অঞ্জলির কাছে অনেকেই নালিশ করেছেন ওনারা সকালে বাচ্ছা গুলো কে আগে বাসে উঠিয়ে দিয়ে সামনের দিকের সব সীট গুলো দখল করে নেন। এম্নকি বয়স্ক মানুষ শর্মা দম্পতিকেও এরা সীট ছাড়েন না। আবার এই মিসেস শর্মা যিনি হিন্দি সাহিত্যের কবি, তিনি যখন আজ জ্যুরিখ লেকের ধারে বসে স্বরচিত কবিতা পরছিলেন, তখন সেখানে গ্রুপের অনেকেই একাগ্রতার সঙ্গে টা শুনছিল ও প্রশংসাও করছিলো।


এঞ্জেলবারগ, সুইটজারল্যান্ডের এক ছোট্ট জায়গা। সবকিছু যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতন সুন্দর একটা জায়গা। চারিদিকে একটা সবুজ, শান্ত পরিবেশ, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে আল্পস পর্বতমালা। এখান থেকে যে পিকটা দেখা যাচ্ছে তা হল মাউন্ট তিতলিস। আগাগোড়া বরফে মোরা শৃঙ্গটি যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। এখানে আজ পায়েল জৈন গ্রুপে অন্যতম হনিমুন কাপেল, এর জন্মদিন পালন করা হল। তাদের কোম্পানির তরফ থেকে ভিকি একটা কেক নিয়ে এসেছিলো। পায়েল সেটা কাটল, আর তার স্বামী উম্নগ সবাইকে আইসক্রিম খাওয়ালেন। সকলে মিলে হইহই করে সময়টা কেটে গেল। পরের দিন ওরা মাউন্ত তিতলিস বেড়াতে গেল। রোপওয়ে করে ওপরে উঠল ওরা। এখানে সরবোচ্চ পয়েন্টে উঠে চাইলে কেউ বরফে না গিয়ে সুস্বজ্জিত এক গ্যালারিতে বসেও সময় কাটিয়ে দিতে পারে। তবে বরফে গিয়ে ক্লিফ ওয়াক করা, গ্লেসিয়ার কেভ ঘুরে দেখা ও সবশেষে আইস ফ্লায়ার এ চড়ার মজাই আলাদা। বয়স্ক কয়েকজন কে বাদ দিলে মোটামুটি সবাই গেল সেই অ্যাডভেঞ্চার করতে।


পরেরদিন ওরা ইতালি রওনা হল। প্রথমে ওরা গিয়ে পৌঁছল ভেনিসে। ১১৮টি দ্বীপ ও ৪০০ টি ব্রিজ রয়েছে ভেনিসে। নতুন শহরে সবাই গেলেও আসল আকর্ষণ রয়েছে পুরোনো শহরে। ক্যাটামার‍্যানে চড়ে ওরা সবাই এসে পৌঁছল পুরনো ভেনিসে। সেন্ট মার্ক্স স্কোয়ার ,ভেনিসের মুখ্য আকর্ষণ। এত সুন্দর স্কোয়ার বোধহয় খুব কম জায়গাতে আছে। শুধু এইখানে বসেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু সময় নেই তাই ঘুরে ফিরে দেখে ওরা আবার ফিরে আসে ভেনিসের নতুন শহরে। এখানে চাকচিক্য হয়তো অনেক বেশি, কিন্তু আভিজাত্যের গরিমা যা থাকার তা রয়েছে পুরনো ভেনিসে।


এর পরের দিন সকালে ওরা আবার বেরিয়ে পড়ে ফ্লোরেন্সের উদ্দেশ্যে। আজ আবার বাসে সীট নিয়ে তুমুল গণ্ডগোল শুরু হয়। এবারে দেখা গেল মিঃ পিল্লাইদের ওপর সবাই ভীষণ বিরক্ত। রোজ রোজ ওনাদের এই সীট দখল করার ব্যাপারে কমবেশি সবাই বিরক্তি প্রকাশ করছেন। আজ তো মিসেস বাগচি বাসে উঠতে গিয়ে প্রায় পরে যাচ্ছিলেন। একটা সময় দেখা গেল মিঃ পিল্লাই রা একদিকে আর বাকি সবাই অন্য দিকে হয়ে তুমুল তর্কাতর্কি শুরু হয়েছে। শেষে বাধ্য হয়ে ভিকিকে পুরো ব্যাপারটা একটু কড়া হয়ে সামলাতে হল। ভিকি ও অঞ্জলি দুপক্ষের কয়েকজনের সঙ্গে আলাদা ভাবে কথা বলে অনুরোধ করে নিজেদের মধ্যে সব ঝামেলা মিটিয়ে নিতে। বেশ বুঝতে পারে মুখে কিছু না বললেও সবাই বেশ ঠাণ্ডা ব্যবহার শুরু করে নিজেদের মধ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা ফ্লোরেন্সে গিয়ে পৌছয়। এখানে লোকাল গাইড ‘মার্ক’ ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল।


ওরা প্রথমে গেল ‘সান্তা মারিয়া ক্যাথিড্রাল’ দেখতে। শুধু শিল্পের দিক দিয়ে দেখতে গেলেও এমন শিল্পকর্ম খুব কমই দেখা যাবে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের কিছু শিল্পকর্মর নমুনা দেখা যায় এখানে। গিবেরতি, গিয়ত্তু, মাইকেল এঞ্জেলো ইত্যাদি শিল্পীদের কাজ দেখা যায় এখানে। এখানে কিছ সময় কাটিয়ে ওরা আসে ‘পিয়াজে দেলা সিগ্নরিয়া’ নামে একটা স্কোয়ারে। ইউরোপ এর প্রায় প্রত্যেকটা বড় শহরে এই স্কোয়ার গুলো বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এই স্কোয়ারের ইতিহাস ও বেশ পুরনো, মার্ক সে সম্বন্ধে বিস্তারিত ভাবে বলছিল। স্কোয়ারের মধ্যিখানে রয়েছে ‘ নেপ্তুন ফাউন্তেন’ আর চারদিকে বিখ্যাত শিল্পীদের স্কাল্পতার দিয়ে সাজান, যার মধ্যে মাইকেল এঞ্জেলোর ‘ ডেভিড’ অন্যতম। এখানে আরও কিছু জায়গা দেখে ওরা আবার বাসে উঠলো, আজই ওরা পিসা দেখবে।


দ্বাদশ শতাব্দীতে এই টাওয়ার যখন তৈরি শুরু হয়, নরম মাটির জন্য তখনই হেলতে শুরু করে। চতুর্দশ শতাব্দীতে কাজ শেষ হওয়ার পর এটা ‘লিনিং টাওয়ার অফ পিসা’ বলে বিখ্যাত হয়ে যায়। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম এটা। ১৯৯৩ ও ২০০১ সালে কিছু রেমেডিয়াল কাজের পর এই টাওয়ারের হেলে যাওয়া কিছুটা রোধ করা গেছে। পিসার টাওয়ারের জায়গাটা থেকে বেরোলেই একটা বাংলাদেশীদের মার্কেট আছে। যদিও সকালে মার্ক এই মার্কেট সম্বন্ধে সবাইকে সাবধান করেছিল কারণ এদের ব্যবহার এর জন্য এরা কুখ্যাত, এখানে দেখা গেল মোটামুটি সবাই এখান থেকে জিনিস কিনে যাচ্ছেন।


ট্যুর প্রায় শেষের দিকে এখন। আজ রাতে পিসাতে থেকে কাল ওরা যাবে রোমে। কাল সারাদিন রোম ঘুরে পরশু রাতে আবার ফেরার ফ্লাইট ধরতে হবে সবাইকে। রোমে ওরা ভ্রমণ শুরু করে ভ্যাটিক্যান সিটি দিয়ে। যদিও ভ্যাটিক্যান আলাদা একটা দেশ , কিন্তু জায়গা টা রোমের মধ্যেই অবস্থিত। অসামান্য স্থাপত্যের ভাণ্ডার বলা যেতে পারে ভ্যাটিক্যানকে। সেন্ট পিটারস ব্যাসিলিকা, ক্রিসচিন চ্যাপেল, সেন্ট পিটারস স্কোয়ার, কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবে লোকে? বর্তমান পোপের বাসস্থানও এই ভ্যাটিক্যান সিটি। ভ্যাটিক্যানে থাকলে সপ্তাহে একদিন পোপ সেন্ট পিটারস স্কোয়ারে দর্শন দেন সাধারন মানুষকে। কিন্তু অঞ্জলিদের আর ঝামেলা পিছু ছাড়ছে না। ইতালিতে আসার পর থেকে বারবার সবাইকে সতর্ক করে যাচ্ছে ওরা এখানে চোর, পকেটমার এর ভীষণ উপদ্রব, সবাই যেন সাবধান থাকে। এমনকি এখানকার যারা লোকাল গাইড, তারাও বারবার বলেছে, তবু মিঃ বাগচির ছেলে নিরুপম ক্যামেরাটা একটা চেয়ারে রেখে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গেছে। আর দুমিনিটের মধ্যে সেই ক্যামেরা হাওয়া। আবার গিয়ে পুলিশে কমপ্লেন লেখাতে হল, যদিও ওরা জানে আদৌ তাতে কোন কাজ হবে না।


নিরুপমের মা রুপালি বাগচির একটাই আফসোস তখন কোনোভাবেই তো আর এই কয়েকদিনের স্মৃতি ফিরে আসবেনা। ক্যামেরা না হয় আবার নতুন আসবে কিন্তু সারাজীবনেও এই আফসোস যাবে না। প্রত্যেকটা মনুমেন্টের ছবি না হয় বাকিরা সবাই ওনাদের পাঠিয়ে দেবে বলছে, কিন্তু ওনাদের নিজেদের একটা ছবিও থাকল না এই পুরো ট্রিপের। ভদ্রমহিলা ভুল কিছু বলছেন না। কিন্তু ছেলেটা একটা ভুল করে ফেলেছে, তাই সে আরও মনখারাপ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভ্যাটিক্যান থেকে বেরিয়ে এবার ওরা এল কলোসিয়াম দেখতে। কলোসিয়াম এক বিশাল অ্যাম্পিথিয়েটার যেখানে একসঙ্গে প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোক বসে কোন অনুষ্ঠান দেখতে পারবেন। বর্তমানে জায়গাটার বেশ ভগ্নদশা, তবু দেশ বিদেশ থেকে নানা মানুষ ছুটে আসেন এটা দেখতে। ওদের শেষ গন্তব্য ‘ট্রেভি ফাউন্টেন’। পৃথিবী বিখ্যাত এই ফাউন্টেন দেখানো হয়েছে অনেক হলিউড সিনেমাতেও। বহু মানুষ বিশ্বাস করেন, এখানে জলে কয়েন ফেলে কিছু চাইলে সেটাই পাওয়া যায়। আর অন্ধ বিশ্বাসে মানুষ কত কি না করে থাকে।


এই কদিনের সমস্ত আলাপ, সখ্যতা, ঝগড়া, বিবাদ এবার সব শেষ। ম্যান্ডেটরি গ্রুপ ফোটো তোলা হল আজ সবাই মিলে। এবার যার যার ঘরে ফেরার পালা। শুধু ভিকি এখানে থেকে যাবে, অন্য গ্রুপ আসছে তাদের নিয়ে আবার ট্যুর করতে হবে। অঞ্জলি ফিরে যাচ্ছে গ্রুপের বাকিদের সঙ্গে, কলকাতায় ফিরে ঠিক তিন দিনের ছুটি, তারপর আবার বেরোতে হবে গ্রুপ নিয়ে হিমাচলে। এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক কোন ট্রিপ ওকে এখনই দিচ্ছে না, হয়তো আর কয়েক মাস পরে দেবে। জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রিপের অভিজ্ঞতাতে সে আগের থেকে অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। বাকিটা সময়ের অপেক্ষা, সময়ের সাথে সবটাই শিখে যাবে।



(আলোকচিত্র সৌজন্যে - প্রত্যয় সেন)

Comments


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page