ছড়াক্কা-গাথা - ডালিমকুমার (’ঠাকুমা’র ঝুলি’)
- সতীশ বিশ্বাস
- Dec 24, 2019
- 4 min read
এক রাজার এক রানি ছিল,---একজন রাজপুত্র।
একটি জোড়া পাশার উপর
করতো রানির আয়ু নির্ভর।
রাজপুরীর এক তালগাছে
এক রাক্ষসীর বাসা আছে।
সে জানত রানিমায়ের মরণের কী সূত্র।
#
একদিন রাজা মৃগয়া গেলেন,রানিমার কী ফূর্তি!
ভিখারিনী সাজল খাসা
কাতরস্বরে চাইলো পাশা,
যেই দিল তা,রাজার কুমার,
রাক্ষসী কি দেরি করে আর?
রানিকে খেয়ে নিখুঁৎভাবে ধরল রানির মূর্তি।
#
রাজা এলে রানি করেন সেবাও যত্ন তার।
রাজপুত্র দেখেন কেবল--
খাবার দেবার সময় রানির
জিভের থেকে এক ফোঁটা জল
পড়ল। দেখেই রাজার কুমার
উঠে দাঁড়ালেন। এ কথাটি জানল না কেউ আর।
#
কেটে গেল কয়েক বছর। রাজার পুত্র সাত।
বড় হয়ে খুব যতনে;
বলল, ‘যাব দেশভ্রমণে।’
রাজাও হলেন খুশি তাতে।
বলেন, ‘তোদের দাদাও সাথে
যাবে।’ সাত আর এক মিলে হয় রাজার কুমার আট।
#
বড়কে দেখে কৌটা খুলে রানি সাপকে বলে, ‘সূতাশঙ্খ,সূতাশঙ্খ
শাঁখের আওয়াজ।
কুমারের আয়ু কিসে
বল দেখি আজ?’
শাঁখের মতো আওয়াজ সাপের,সূতোর মতো চলে।
#
রানির প্রশ্ন শুনে সে সাপ শঙ্খের মতো কয়,
‘তোর আয়ু কিসে রানি
মোর আয়ু কিসে?
ডালিমকুমারের আয়ু
ডালিমের বীজে’।
রাক্ষসী বলে, ‘এবার ডালিম হবে নিশ্চিত ক্ষয়।’
#
হাত পা ছুঁড়ে,বলেন আরো, ‘আর চিন্তা নাই।
‘যাও ওরে সূতাশংখ
বাতাসে করি ভর,--
যম-যমুনার রাজ্য শেষে
পাশাবতীর ঘর।
এই লিখন দিও নিয়া পলাশবতীর ঠাঁই।
#
সাত ছেলের জন্যে আমার সাত কন্যে চাই।
রিপু অরি যায়,সূতা,
চিবিয়ে খাবে তারে,
সতীনের পুত্র যেন
পাশা আনতে নারে।’
উড়ল সাপ পৌঁছে দিতে এই লিখনটাই।
#
রাক্ষসী তখন মন্ত্র পড়ে,ডালিম নিয়ে হাতে
‘পক্ষীরাজ,পক্ষীরাজ,
উঠে চলে যা
পাশাবতীর রাজ্যে গিয়া
ঘাস জল খা।’
ধংস শুধু খেলা করে রাক্ষসীর মাথাতে।
#
রাজপুরীর হাজার সিঁড়ির ধাপে উঠে বলে,
‘সিড়ি তুমি কার?’
সিঁড়ি বলল নিজের স্বরে,
‘যে যখন যায়,তার।’
‘তবে সিঁড়ি দু’ ফাঁক হও’
রাক্ষসী কয়, ‘ডালিমের বীজ থাক তোমার ফাটলে।’
#
নিশ্চিন্তে রানি গিয়ে ঘুমালো শয্যায়।
ডালিমের বীজ হতেই বন্ধ
ডালিমকুমার হলেন অন্ধ।
যেন সূর্য ডুবল হঠাৎ
নীল আকাশে কী বজ্রপাত!
বড়-কে ফেলেই ছোট ভায়েরা তীরের বেগে ধায়।
#
ক্লান্ত হয়ে সূতাশঙ্খ এক ফলের মধ্যে ঘুমায়।
রাজকন্যা খায় তা কেটে
সূতাশংখ গেল পেটে
লিখনটিও সঙ্গে গেল।
ভায়েরা হঠাৎ দেখতে পেল—
দাদাতো নেই সঙ্গে। তবে দাদা গেল কোথায়?
#
ভাবলো তারা হয়তো দাদা এসেছে এতক্ষনে। চলল আবার ঘোড়ায় উড়ে— থামল পাশাবতীর পুরে। পাশাবতী বলল দেখে, বলো তোমরা প্রথমে, বলল তারা,
‘রাজপুত্র,এলাম দেশভ্রমণে।’
#
জানো কি পণ? আমার সঙ্গে খেলতে হবে পাশা।
‘যে জিতে সে মালা পায়,
হারিলে মোদের পেটে যায়।’
‘লিখন দেখাও’ ‘লিখন নাই’।
তবে খেল। হারানো চাই।
সাত ভায়েতে হারল ও শেষ হল স্বপ্ন আশা।’
#
অন্ধ রাজারকুমার পিঠে,উড়ল পক্ষীরাজ
হাতের লাগাম ঢিলে হতেই
ডালিম কুমার পড়ল সেই
এক পাহাড়ের চূড়োর পর।
পক্ষীরাজও হল পাথর।
যে নগরে পড়ল কুমার,অদ্ভুত তার সাজ।
#
রাজপুরীতে সন্ধ্যার পর লক্ষ কাড়া ও লক্ষ সানাই ‘নগরটি ভরে ওঠে কোলাহলে
পথে পথে আলো জ্বলে।
ভোরে সব চুপ। শুরু হাহাকার
আনন্দ করে দুপুরে আবার।
যে কোন কাউকে রাজাকরেদেয়,পথথেকেতুলে সান্ত্রীসেপাই।
#
পরদিন রাজকন্যার ঘরে থাকেনা সে রাজা আর
এইভাবে এলো গেলো কত রাজা।
চলছে এমন খেলা রাজা-সাজা।
নিত্যনতুন এক রাজা চাই
কিন্তু ভোরে সে রাজা আর নাই।
রাজকন্যার ঘরের ভিতর পড়ে থাকে শুধু হাড়।
#
জ্ঞান ফিরতেই ডালিমকুমার দেখে—সে সিংহাসনে।
চার দিকে শুধু
‘রাজা’-‘রাজা’ রব
একটু পরেই
ঘুমে কাদা সব।
ডালিমকুমার একা জেগে শুধু,ভয় নেই তার মনে।
#
নীরব শীতল বাতাসে কে যেন ছড়ায় অলীক গান।
নগরে শহরে সাড়াটি নাই
কোন দরজায় পাহারা নাই।
কারণ থাকার নেই কোন মানে
কী হবে—সেটাতো সব্বাই জানে।
হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল ও রাজকন্যা হারাল জ্ঞান।
#
বেরোল সুতোর মতো এক সাপ কন্যার নাক থেকে
ঘরেতে তখন আলোর বন্যা
ডালিম কিছুই দেখতে পান না।
সুতো থেকে সাপ হল অজগর।
রাজপুরী যেন কাঁপে থর থর
হাঁটু গেড়ে বসে ডালিমকুমার তলোয়ার ধরে বেঁকে।
#
তরোয়াল হাতে ডালিম তখন নির্ভীকভাবে হাঁকে
জানি না কে তুমি যক্ষ,দানব
রক্ষ,দেবতা,মানুষ—সে সব।
যদি হয় আমার নিষ্পাপ দেহ,
তোমাকে বাঁচাতে পারবে না কেহ।
বলেই চালায় অসি ও টুকরো টুকরো করল তাকে।
#
ধ-ধ্বড়্-ধ্বড়্ শব্দে সিঁড়ির ধাপগুলো পড়ে ধ্বসে
ডালিমের আয়ু বাড়ে শতগুন
ভয়ে রানী হল আধখানা খুন।
খুশি হল রাজা আর প্রজারাও
সাপ দেখে বলে, ‘সাপকে পোড়াও’।
সাপের পেটেতে দেখাগেল আছে—লিখন দিব্যি বসে।
#
ডালিম বলল, ‘ হে রাজকন্যা, চলি—ভাইদের খোঁজে।
পক্ষিরাজ পেল একটি পাহাড়ে
ছুঁয়ে জীবন্ত করে দিল তারে।
বলে পক্ষিরাজ,এইবার চল।‘
ভায়েরা আমার বাঁচল না ম’ল—
ভায়ের জন্য কতটা ব্যাকুল,তুমি ছাড়া কে বা বোঝে।’
#
তীর বজ্রের মতো পক্ষীরাজ চলল সামনে ছুটে
‘যমযমুনার দেশ
অন্ধকার গায়ে ঠেক’,
বাতাসে পাথর উড়ে’
বহু প্রান্তর ঘুরে—
রাজপুত্র ও পক্ষিরাজ কড়ির পাহাড়ে উঠে।
#
কড়ির পাহাড়ে পক্সিরাজের পা যে চলে না আর।
ছট ফট ফট শব্দ
হয় বুঝি পক্ষি জব্দ।
‘পক্ষি’ বলে রাজার কুমার,
ভেবোনা কিন্তু কথাটি থামার।
সারাটা রাত্রি পায়ের নীচে চূর্ণ হল পাহাড়।
#
যাচ্ছে যত ডালিম ততই চিন্তা বাড়ছে মনে
‘ঝড়ের গতি কোন ছার,
পক্ষিরাজে আসন যার।’
জীবন-মরণ তুচ্ছ করে
উড়ছে জোরে আরো জোরে
‘তারপরেই হাড়ের পাহাড়’ পৌঁছালো দুইজনে।
#
হাড়ের পাহাড়! মড়ার মুন্ড খট খটা খট সুর
নীচেতে বয় কলক্কল
রক্ত-নদীর রক্তজল
রাজপুত্র বলেন, ‘পক্ষি,
ভয় নাই চোখ বুজে চল।’
রাত্রিশেষে দেখল ডালিম—পাশাবতীর পুর।
#
পাশাবতীর পুর ফটকে নিশানে আছে লেখা
‘পাশা খেলিয়া যে হারাইবে
সাত বোনে মালা দিব।’
ডালিমকুমার তাতে হল রাজি;
বলল, ‘পাশা খেলিব’।
পাশা হাতে পাশাবতী ক্রুড় হেসে দিল দেখা।
#
শুরুহল খেলা পণ বাজি রেখে;ডালিমের মনে আশা—
জিতবে সহজে,কিন্তু খেলায়
রাজকন্যার কাছে হেরে যায়।
পণ দেয় ঘোড়া, আছে রহস্য
ডালিম দেখেছে গোপন দৃশ্য।
একটি ইদুর চুপি চুপি এসে উল্টিয়ে দেয় পাশা।
#
ডালিম মনেতে ভাবে এক মতলব
ঠিক এঁটে নেব সাচ্চা।
রাখব বিড়াল বাচ্চা।
খেলা হবে শুরু যখন আবার
ইদুর ভয়েতে আসবে না আর।
মনে মনে করে নিল ঠাকুরের স্তব।
ঘোড়া পেয়ে ওরা খেয়ে ফেলে।আর ডালিম মনেতে ভাবে-কৌশল এক আঁটব সাচ্চা
ধরে এনে এক বিড়ালবাচ্চা।
খেলা হবে শুরু যখন আবার
ইঁদুর ভয়েতে আসবে না আর।
যোগ্যতা অনুযায়ী ঠিক পাশাখেলায় সে জিতে যাবে।
#
ডালিমকুমার দান ফেললেন,জানেন জিতবে আজ।
‘এই হাতে ছিল পাশা,
পুনু এলো হাতে,-
এতদিন ছিলে পাশা—
কার দুধে ভাতে?’
পাশাবতী হারে। ডালিম বলল, ‘দাও সে পক্ষিরাজ’।
#
খেলারনিয়ম অনুযায়ী পরাজিত,পণ দিতেথাকে বাধ্য। ফেরাল ঘোড়াকে তাই পাশাবতী
স্বীকার করল বারবার নতি।
একে একে ফিরে পেল সাত ভাই
রাজ-রাজত্ব;আর কিছু নাই
এবার পাশা ও ইঁদুরটি চাই,ঠেকাও থাকেতো সাধ্য।
#
বলেই ছাড়ল ডালিমকুমার বিড়ালের সেই ছানা
বিড়াল অমনি দৌড়িয়ে যায়,
ইঁদুরটা ধরে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়।
ঘরের প্রদীপখানি নিবে গেল
রাজ-রাজত্ব কোথায় হারালো
মরে পড়েআছে সাত পাশাবতী কেঁচোহয়ে সাতখানা।
#
এভাবেই হল রাক্ষসহীণ রাক্ষসপুরী আজ যে।
পাশা বলে,চল যাই ফিরে ঘরে
রাজপুত্রেরা ঘোড়ার উপরে
চাপল,রানীমা উঠে ঘুম থেকে
‘কুমার,কোথায়,আয়’ ওঠে ডেকে।
তখনই রাজার কুমার আটজন পা রাখলেন রাজ্যে।
#
রাজপুত্রেরা নেমেই বলল,’মা আমার কোনখানে?’
প্রণাম করল রানীমাকে তারা,
দুঃখের দিন হল বুঝি সারা।
ফিরেছে রাজার কুমারেরা আট,
বসেছে পুরীতে আনন্দ-হাট;
রাজাহীন সেই প্রজারা সেখানে কীভাবেএল,কে জানে!
#
রাজাকে দেখেই উল্লাসে তারা জুড়ে দেয় হাঁকডাক।
এতো আমাদের সেই প্রিয় রাজা
সূতাশঙ্খকে দিয়েছিল সাজা,
কী সৌভাগ্য!রাজা মিলে গেল।
কন্যা রাজ্য তুলে নিয়ে এল।
এমন আজব কারখানা দেখে সব্বাই হতবাক।
#
পরদিন ফেটে চৌচির হল তালগাছ সহ মূল।
রাজপুরী হল রক্ষশূন্য,
সবাই বলল,’কুমার ধন্য’।
পুরীবাসী দেখে সে ডালিমগাছে
থোকা থোকা হাসি-খুশি ধরে আছে।
পুণ্য প্রভাতে,সোনার আলোতে ফুটেছে হাজার ফুল।

Comentarios