top of page

গল্প - জ্যোতিষশাস্ত্র

  • প্রদোষ সেন
  • Dec 24, 2019
  • 9 min read



।। ১ ।।



রবিবারের সকালবেলা।

বাজার করে ফিরছিল অতীন।

আজ মেজাজটা বেশ ভাল। ভাল ইলিশ মাছ পাওয়া গেছে, তাও একটু ঠিক দামে। অনেকদিন পরে ছেলে এসেছে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে। সব মিলিয়ে দুপুরের খাওয়াটা জমবে ভাল।

অনেকে এখন মাছ অনলাইনে অর্ডার দিয়ে কেনে। সেখানে নাকি দাম সস্তা। আর মাছের বাজারে ভিড়ের মধ্যে যাওয়াও তাদের পোষায় না।

অতীনের এসব কথা শুনলে হাসি পায়। এইরকম মাছ অনলাইনে পাওয়া যায়?

তাই ঠিক করেছে আজ দু-তিন জন বন্ধুকেও লাঞ্চে বলবে। দেখা যাক তারা কি বলে।

চিন্তায় ছেদ পড়ল। মোবাইল ফোনটা বাজছে।

পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখল। অ্যাডভোকেট রীতেশ আগরওয়াল।

রবিবার সকালে এর ফোন! একটু আশ্চর্যই হল অতীন। “হ্যালো”, গলার স্বর বোধহয় একটু অন্যমনস্ক শোনাল।

“ব্যস্ত আছেন? পরে রিং ব্যাক করুন আমাকে।“ রীতেশের গলায় অন্যদিনের সেই ব্যস্ততাটা এখন নেই।

তবু রীতেশের ফোন অতীন পরের জন্য ফেলে রাখতে চায় না। রাস্তার একপাশে একটু সরে দাঁড়িয়ে বলল “না বলুন, আপনার জন্য আমার সব সময় টাইম আছে।“

“আচ্ছা, শুনে ভাল লাগল।“ রীতেশ সরাসরি প্রসঙ্গে চলে এল। “আপনাদের কেসের হিয়ারিং-টা মঙ্গলবার পড়েছে। বারোটা নাগাদ। আপনারা সাড়ে এগারোটা নাগাদ কোর্টে চলে আসবেন।“

অতীনবাবু কিছু জিগ্যেস করতে যাচ্ছিলেন। তার আগে রীতেশই বলল “হ্যাঁ লাস্ট টাইমের মত। অলীক থাকবে আপনাদের সঙ্গে মিট করার জন্য। আর আমার সঙ্গে আপনাদের হিয়ারিং-র আগে দেখা হবে।“

অলীক জুনিয়র উকিল। রীতেশের সঙ্গে কাজ করে।

অতীনবাবুর আরও দুএকটা কথা বলার ইচ্ছে ছিল।

কিন্তু রীতেশ লাইন কেটে দিয়েছে। একটাও বেশী কথা বলে না। খুব প্রফেসনাল।

তা সে হোক প্রফেসনাল। উকিলের কাছে তো আর কেউ গল্প-গুজব করতে যায় না। কাজ নিয়ে সম্পর্ক। আর সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ অতীনের মনে নেই। এই কেস যদি কেউ জিততে পারে সেটা হল ওই রীতেশ আগরওয়াল। এই শহরের নামকরা সিভিল ল-ইয়ার।

আবার এটাও ঠিক কোর্ট কেস নিয়ে আগে থেকে বলা খুব মুশকিল, সে যত বড় উকিল-ই লাগানো হোক না কেন। তার ওপর এটা আবার বাড়ি নিয়ে মামলা। কতদিন যে চলবে এই সব ঝামেলা।

চিন্তাগ্রস্তভাবে বাড়ীর দিকে বাড়ায় অতীন।


………



প্রায় দু-সপ্তাহ পরের কথা।

শনিবার সন্ধ্যেবেলা। অফিস, স্কুল-কলেজের তাড়াহুড়ো নেই। তার ওপর এটা অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের একটা কোঅপারেটিভ হাউসিং।

ছিমছাম। বাহুল্যবর্জিত। কিন্তু সুন্দর।

জায়গাটাও ভাল। বড় রাস্তা থেকে একটু ভিতরে। একটু দূরে একটা পার্ক চোখে পড়ে, যা কোলকাতা শহরে এখন বিরল।

এই আবাসনের নিচে একটা ছোট ঘরে একটু আড্ডার আসর বসেছে। যারা রোজ আসে তারা সবাই রয়েছেন। নতুনদের মধ্যে বিকাশ। বিকাশ অধিকারী। বাকিরা ওনাকে বিকাশ-দা বলে। বয়সে অন্যদের তুলনায় একটু বড়।

কথা প্রসঙ্গে বিকাশ বলল “আজ অতীনকে দেখছি না?”

“এসে পড়বে হয়ত যে কোন সময়ে।“ রঞ্জিব বলল।

“ও একটা কোর্ট কেস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে শুনলাম।“

“হ্যাঁ আমিও শুনেছি। ডিটেলস কিছু জানি না।“

“কোর্ট কেস? অতীনদার? জানতাম না তো?” মৃগাঙ্ক বলে।

একথা সেকথা করে আড্ডা যখন প্রায় শেষ হওয়ার মুখে, অতীন এসে হাজির।

“কি হল? এত দেরি?” প্রশ্নটা এল ২-৩ জনের মুখ থেকে প্রায় একইসঙ্গে।

“কি বলব বল। একটা কোর্ট কেসে জড়িয়ে পড়েছি।“

“জড়িয়ে পড়েছো মানে?“ রঞ্জিব জিগ্যেস করে।

“আমাদের পৈতৃক বাড়ি নিয়ে একটা মামলা চলছে। এখন একটু উকিলের কাছে গিয়েছিলাম। তাই দেরি হল।“ অতীন এটুকু বলে চুপ করে যেতে আর কেউ কিছু কথা বাড়াল না।

এর মধ্যে ব্যাক্তিগত কিছু থাকতে পারে তাই অতীন হয়ত আর কিছু বলতে চায় না।

মুখে কিছু না বললেও অতীনের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে মৃগাঙ্ক।

বাকিদের তুলনায় ও একটু বেশী ভাল করে চেনে অতীনকে। আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগের পরিচয়। তারপর কাজের সূত্রে অনেক জায়গায় একসঙ্গে কাটিয়েছে। সেই ধানবাদ থেকে শুরু, তারপর কিছুদিন ছাড়াছাড়ি। তারপর আবার সম্বলপুর।

পরে একবার জিগ্যেস করে দেখবে।

অতীনকে ও বরাবর আমুদে সহকর্মী আর বন্ধু হিসেবে জানে। ওকে এইরকম চিন্তাগ্রস্ত দেখে একটু অবাকই লাগে মৃগাঙ্কর।


।। ২।।


মেয়ে অজন্তার সঙ্গে স্কাইপে কথা হচ্ছিলো অনেকদিন পর। সাধারণত সপ্তাহে একবার কথা হয়। কিন্তু গত সপ্তাহে কোন কারণে হয়ে ওঠেনি।

অজন্তা জিগ্যেস করে “বাবা, গত সপ্তাহে তুমি ছিলেনা। মা বলল উকিলের বাড়িতে না কোথায় গেছ।“

“হ্যাঁ, উকিলের বাড়িতেই গিয়েছিলাম। আমাদের বাড়ীর কেসের ব্যাপারটা নিয়ে। তা কেমন আছিস তুই?”

“আমি তো ভালই আছি। তুমিও এবার ওই কেস কাছারি থেকে সরে এস। তোমার শরীর-ও ভাল নয়। তার সঙ্গে এই দৌড়ঝাঁপ, বাড়তি টেনশন।“

এই ধরণের কথাবার্তা অতীন আগেও শুনেছে। ছেলে-মেয়ে দুজনের কাছ থেকেই।

এই ধরণের কথাগুলো একদমই পছন্দ নয়।

ওর বরাবরই মনে হয় এখনকার জেনারেশন খুব নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত। নিজেদের কাজটা হয়ে গেলে এরা শুধু লেকচার দিতে অভ্যস্ত।

এই অজন্তা যখন আমেরিকাতে পড়াশুনোর সুযোগ পেল, আজ থেকে আট-নয় বছর আগে, অতীন মোটেই প্রস্তুত ছিল না। ভর্তির টাকা, দু বছরের কোর্স ফি, থাকার খরচা, বছরে একবার যাতায়াত – সব মিলিয়ে ধাক্কাটা কম ছিলনা অতীনের পক্ষে। দৌড়ঝাঁপ, টেনশন এগুলো তখনো কম হয়নি।

আজ তাই মেয়ের কথাটা শুনে মনে মনে একটু হাসি পায় অতীনের। কিন্তু ফোনে এসব বলার কোন মানে হয়না। এখুনি তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যাবে।

শুধু বলে “হ্যাঁ জানি। দেখছি কি করা যায়।“

পাশ থেকে কাকলী বলে ওঠে “তোর বাবাকে তো চিনিস। যেটা ভাবে সেটাই করবে। কারুর কথা শুনবে না।“

মেয়ের গলা আবার শুনতে পায় অতীন। “না না মা, তুমি বাবাকে বারন কর। এইসব আজেবাজে ব্যাপারে আর যেন সময় নষ্ট না করে।“

আজেবাজে ব্যাপার?

অতীনের মাথার আগুনটা একবার দপ করে জ্বলে উঠেছিল। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে পাশের ঘরে চলে যায়।

কোনটা আজেবাজে আর কোনটা দরকারি সেটা অন্যরা বুঝবে কি করে? তাদের জীবনটা যে খুব মসৃণ ভাবে চলে যাচ্ছে। পৈতৃক বাড়িটা কোন কাজে আসবে না। পুরনো, শরিকী বাড়ি। সেটা বিক্রি করে কিছু টাকা হাতে এলে মন্দ কি? বিশেষত এই বয়সে, চাকরী থেকে রিটায়ারমেণ্ট নেওয়ার পর। বাড়িটা দক্ষিণ কোলকাতার অভিজাত অঞ্চলে। কোন শহরতলী এলাকা নয়। তাই বিক্রি হলে ভাল দাম পাওয়া যাবে। সেইরকম ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে ভুল কিছু দেখতে পায়না অতীন। টাকাটা হাতে এলে ছেলের বিয়েটা আর একটু বেশি জাঁকজমক করে দেওয়ার ইচ্ছেটাও পূরণ করতে পারে। আর গাড়ীটা - ওটা এবার বদলানো দরকার। প্রায় পনেরো বছর হতে চলল।

আবার এমনো নয় যে টাকাটা না পেলে ওদের চলবে না।

আর ঠিক এই কথাটাই কাকলী বলে। প্রায়ই। সেদিন যেমন বলল “দেখ তোমাদের কেস মিটতে কতোদিন লাগে। তারপর বাড়ী বিক্রি, তারপর টাকা। আর তুমি এখন ওই টাকা দিয়ে কী করবে ভাবছো! এ সেই গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল।“

অতীন মুখে বলেছিল “তুমি একটু বেশি নৈরাশ্যব্যঞ্জক কথাবার্তা বলছ”, কিন্তু জানত কাকলীর কথায় খুব একটা ভুল নেই।

কাকলী আবার বলল “এমন নয় যে ওই টাকা না পেলে আমাদের চলছে না। তাই ওটার কথা আপাতত ভূলে যাও। পেলে তখন প্ল্যান করো কী করবে।“

অতীনও মাঝে মাঝে ভেবেছে “এই টাকাটা কি প্রকৃত ওর দরকার নাকি সে একটু লোভের বশবর্তী হয়ে পড়ছে?”

কিন্তু লোভ সে বরাবর সামলে রেখেছে। চাকরী জীবনে লোভে পড়ার মতো ঘটনা আকছার ঘটেছে।

ভারত সরকারের গ্রেট ইন্ডিয়া কোলফীল্ড কোম্পানিতে চাকরিতে জয়েন করা থেকে অবসর নেওয়া অবধি মোটামুটি পরিষ্কার ইমেজ নিয়ে কাজ করেছে। সেই ধানবাদ দিয়ে শুরু, আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে। সেখানে বেশ কয়েক বছর কাটিয়ে তারপর সমবলপুর। চাকরী জীবনের অনেকটাই কেটেছে সমবলপুরে। ছেলে-মেয়ের বড় হয়ে ওঠা, পড়াশুনা, স্কুল – এসব প্রধানত ওখানেই। এরপর রাঁচি। সব জায়গাতেই মাফিয়া আর ঠিকেদার – এদের আঁতাত আর মারাত্মক দৌরাত্ম্য। আর ছিল মোটা টাকার খেলা। লোভ সংবরণ করা খুব মুশকিল। অতীন চোখের সামনে দেখেছে সহকর্মীরা কেউ কেউ কোটিপতি হয়ে গেছে। রাতারাতি। এছাড়া সুযোগ-সুবিধা নেওয়া তো ছিলই। ছেলে-মেয়ের জন্মদিন বা এই ধরণের অনুষ্ঠান কোন ঠিকেদার যদি স্পন্সর করে দেয় তাহলে কোন কথাই নেই।

অতীন এগুলো থেকে যথাসম্ভব দূরে থেকেছে। অনেক সহকর্মী এসব নিয়ে অনেক সময় ব্যাঙ্গাত্বক মন্তব্য করেছে। অনেকে বলেছে আরে এসব করার জন্য সাহস (ইংরাজিতে যাকে বলে Guts)দরকার।


..................



মৃগাঙ্ক কাল সন্ধেবেলা আসবে বলেছিল।

অতীন বলল “অনিন্দিতা-কেও নিয়ে এস। একটু টাইম নিয়ে এস, গল্প করা যাবে।“

মৃগাঙ্ক আর ওর ফ্যামিলির সঙ্গে ওদের যোগাযোগ চাকরি সূত্রে। সেই সম্বলপুর থেকে। তারপর মেলামেশা। আজ বছর পঁচিশ কি তার বেশী হল।

চাকরিতে অনেক সহকর্মীর সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু সবাই বন্ধু হয়ে উঠতে পারে না।

অতীন তখন সবেমাত্র বদলী হয়েছে ধানবাদ থেকে সম্বলপুর। কিছুদিন কোম্পানি গেস্ট হাউসে থাকার পর কোয়ার্টার পেল।

হঠাৎ কোলকাতা থেকে খবর এল বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। তখনো ওখানে বাড়ি গুছিয়ে উঠতে পারেনি। মেয়ে আর কাকলিকে রেখে কোলকাতা আসতে হল। একবার নয়। পরের দেড়-দুমাসে তিনবার। বাবা সে যাত্রা হসপিটাল থেকে বাড়ি এলেও পুরোপুরি সুস্থ আর হয়ে ওঠেননি।

সেই সময় মৃগাঙ্ক আর অনিন্দিতার সাহায্য ছাড়া খুব মুশকিল হত। সেকথা অতীন বা কাকলি কেউই ভুলতে পারবে না।

তারপর থেকে বাড়িতে যাতায়াত। পারিবারিক যোগসূত্র বাড়তে থাকে। ঘনিষ্ঠতাও।

কথা বলতে বসলে পুরনো কথা এসেই পরে।

এসে পড়ল একবার একসঙ্গে সিমলিপাল রিজার্ভ ফরেস্ট যাওয়ার গল্প।

সম্বলপুর থেকে প্রায় আট ঘণ্টা জার্নি করে জঙ্গলে গেস্ট হাউসে পৌছনোর পর ওথানে শুনল যে রাতের খাওয়ার রসদ নেই। ওদের কিনে দিতে হবে। গেস্ট হাউসে রাঁধুনি আছে। সে রান্না করে দেবে। এখানে নাকি এই রকমই রীতি।

খোঁজখবর নিয়ে ওরা বেরল রান্নার রসদ কিনতে। তার সঙ্গে চাই চিকেন। দিশি মুরগি কাছাকাছি কোথাও ভাল পাওয়া যায়।

কিনতে বেরিয়ে মুশকিল হল। দোকান বন্ধ হয়ে গেছে আর তাই আর একটু দূরে যেতে হবে।

অতএব গাড়ি নিয়ে আর কিছুটা দূরে। সেখানে গিয়ে একটা দোকানে সব জিনিস পাওয়া গেল।

কিন্তু মুরগি এখানে পাওয়া যাবে না।

জিগ্যেস করে জানা গেল তার জন্য আরও একটু দূরে যেতে হবে।

সেখানেও নেই। এইরকম খুঁজতে খুঁজতে ওরা এসে পড়েছে বেশ দূরে।

শেষে এক জায়গায় পাওয়া গেল। কিন্তু ফেরার সময় বুঝতে পারল রাস্তা ভুল করে অন্য দিকে চলে এসছে।

তারপর যা হয়। একে ওকে জিগ্যেস করে বহুক্ষণ পরে ওরা যখন গেস্ট হাউসে ফিরল কাকলি আর অনিন্দিতা তো ভেবেই অস্থির।

মৃগাঙ্ক বলল “ছোট শহর হলে কি হবে আমাদের সময়গুলো ভালই কেটেছে।“

“ছোট শহর আর তাছাড়া আমরা একসঙ্গে থাকতাম। বড় শহরে আরও অনেক আকর্ষণ আছে।“ কাকলি বলে।

অতীন বলল “এখন তো বড় জায়গায় রয়েছ। আসলে জায়গা ছোট বা বড় যাই হোক, তুমি জীবনটাকে উপভোগ করতে পারছ কিনা এটা ইম্পরট্যান্ট। আর সেটা অনেকটাই নির্ভর করে তোমার ওপর।“

একথা সেকথার মাঝে মৃগাঙ্ক মাঝে মাঝেই ভাবছিল কিভাবে কথাটা তোলা যায়। সকলের মধ্যে হঠাৎ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে কথাটা তুললে অতীন পছন্দ নাও করতে পারে। কিন্তু সুযোগটা এসে গেল।

বেশ খানিকক্ষণ গল্প করার পর কাকলি যখন সকলের জন্য একটু চা-জলখাবারের ব্যাবস্থা করতে রান্না ঘরে গেল, অনিন্দিতা ওকে বলল “চল, আমি তোমাকে একটু হেল্প করে দি।“

দুজনে চলে যেতে অতীনকে একা পেয়ে প্রসঙ্গটা তুলল। “আচ্ছা অতীনদা, যদি কিছু মনে না কর তো একটা কথা জিগ্যেস করছি।“

“ঐ কেসের ব্যাপারটা নিয়ে বলবে কি?”

“হ্যাঁ মানে ওটা কি খুব ট্রাবল দিচ্ছে তোমাকে?”

“ঠিক ট্রাবল কিনা জানিনা, তবে একটা চিন্তা তো আছেই। এতগুলো টাকা উকিলকে দিচ্ছি ফি হিসেবে, কেস হেরে গেলে পুরো টাকাটা তো জলে। অবশ্য আমি একা নয়, আমার দাদাও রয়েছে আমার সঙ্গে। আর কেসটা যদি আমরা জিতি আর বাড়িটা বিক্রি হলে, বেশ ভাল টাকা পাব। সত্যি কথা বলতে, প্রমটার অফারও করেছে। এই বয়সে অতগুলো টাকা কম নয়।“

মৃগাঙ্ক চুপ করে শুনতে থাকে। কিছু বলার মত নেই।

অতীন আবার বলল “সম্পত্তির মামলা তো, টাইম লাগবে। উকিল তো সেই রকম ইঙ্গিত দিচ্ছে।“

“ কেসের ফয়সালা কি হতে পারে কোন ইঙ্গিত দিচ্ছে না?” মৃগাঙ্কর এর থেকে ভাল কোন প্রশ্ন মনে এলনা।

“দ্যাখো কোন উকিল বলবে না তুমি কেস হারবে যদি সেই ব্যাপারে সিয়র থাকেও। আর এই ধরণের সম্পত্তির মামলায় তো আরও বলা মুশকিল। তবে হ্যাঁ, আমরা জিগ্যেস করেছি। বলছে আমাদের জেতার চান্স খুব বেশী।“

কয়েক সেকেন্ডের বিরতির পর মৃগাঙ্ক মুখ খুলল। “আচ্ছা একটা কথা জিগ্যেস করছি। তুমি অ্যাসট্রলজি-তে বিশ্বাস কর?”

অতীন একটু অবাক ভাবে তাকিয়ে বলল “হঠাৎ এই প্রশ্ন? তুমি কি বলছ আমি এর জন্য জ্যোতিষীর কাছে যাব?”

“ব্যাপারটা অত ফরমাল ভাবে ভেব না দাদা। তোমার যদি ইচ্ছে থাকে আমাকে জানিও। আমাদের একজন ফ্যামিলি ফ্রেন্ড আছে। ভদ্রলোক আমার শালার বন্ধু। ক্যাজুয়ালি দেখিয়ে দেব্, কোন ফরমাল কিছু ব্যাপার নেই।“

এক মুহূর্ত থেমে মৃগাঙ্ক আবার বলল “উনি প্রফেশনাল জ্যোতিষী নন। যদিও হাত রিড করতে পারেন, যাকে পামিস্ট্রি বলে। পড়াশুনা করেছেন এই ব্যাপারে। যদি ইচ্ছে থাকে আমাকে জানিও।“

“আমি কোনদিন এসবে বিশ্বাস করিনি আর কারুর কাছে যাইও নি। শুধু মনে আছে, যখন আমি স্কুলে পড়ি, বাবার পরিচিত একজন আমাদের বাড়িতে আসতেন আর আমাদের অনেকেই তাকে হাত দেখাতেন।“

“না সেই জন্যই বলছি যদি দেখাতে চাও তো জানিও। আমিও যে এইসব ব্যাপারে খুব বিশ্বাস করি তা নয়। কিন্তু এর ওপর একটু বিশ্বাস আছে কারণ রিসেন্টলি দেখলাম কয়েকটা ব্যাপারে প্রেডিকশন মিলে গেল।“

“আচ্ছা ধর আমি এনার কাছে গেলাম আর উনি বললেন আমি কেসে হেরে যাব। তাহলে আমি কি করব? আই মিন আমি যাওয়ার আগে কি কি হতে পারে সেটা ভাবছি।“

এই প্রশ্নের উত্তর মৃগাঙ্কর জানা নেই।

কিন্তু উত্তর দিতে হল না। তখনকার মত ওদের আলোচনায় ছেদ পড়ল। চায়ের ট্রে হাতে কাকলী এসে গেছে। সঙ্গে অনিন্দিতাও।



।। ৩।।



মৃগাঙ্কর প্রস্তাবটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মত নয়। প্রথমে অতীনের যেটা বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল, সেটাই আস্তে আস্তে মনে ধরছিল।

আজ কোর্টে একটা হিয়ারিং ছিল। আগের গুলোর মতই। নতুন করে আশাহত হওয়ার কিছু নেই।

বাড়ি ফেরার পথে সেই কথাই ভাবছিল অতীন।

এর মধ্যে ছেলের বিয়ের কথাটা কিছুটা এগিয়েছে।

আজ বাড়ি ফিরে একবার কাকলির সঙ্গে কথা বলে, ওই জ্যোতিষীকে দেখানর ব্যাপারটা ঠিক করে ফেলবে অতীন। এমনিতেই কেসের যে কি ফয়সালা হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কবে হবে তাও কিছু বোঝা যাচ্ছে না। সুতরাং একবার দেখালে মন্দ কি? যদি বলে জেতার চান্স আছে, তাহলে একটা আশার আলো তো পাওয়া যাবে।

কাকলী যখন অতীনের কাছে প্রস্তাবটা শুনল শুধু আশ্চর্যই হয়নি একটু বিরক্তও হল।

“দ্যাখ আমার যেটা মনে হয় ওই কেসটা যেমন চলছে চলুক। ওটা নিয়ে তোমার আর রোজ মাথা-ব্যাথা না করাই ভাল।“

“হ্যাঁ সেটা ঠিক। কিন্তু এখানে যখন সুযোগ পাচ্ছি একবার দেখিয়ে আসি।“

“এসবে তুমি তো কোনদিন বিশ্বাস করতে না। হঠাৎ এখন?”

এর সঠিক জবাব অতীনের কাছেও নেই। এতগুলো টাকার ব্যাপার বলে? নাকি অনিশ্চয়তার চাপ আর নিতে পারছে না? হয়ত দুটোই। তবে নিঃসন্দেহে মানসিক একটা চাপ আছে। আর সেটা যদি কিছুটা কমে।

অতীনকে চুপ থাকতে দেখে কাকলী বলল “তুমি তো আমার কথা শুনবে না। যা ভাল বোঝ কর।“

……

অতীন নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে হাজির হল ভদ্রলোকের বাড়িতে।

মৃগাঙ্কই সব ব্যাবস্থা করে দিয়েছে।

ভদ্রলোকের নাম তন্ময়। তন্ময় গাঙ্গুলি।

চেহারায় একটা বিনম্র আর শিক্ষিত ভাব আছে।

দুএকটা মামুলি কথার পর অতীন প্রসঙ্গে চলে এল। পুরো কথাটা গুছিয়ে বলতে মিনিট তিনেক লাগল অতীনের। কথাগুলো মন দিয়ে শুনল তন্ময়। তারপর হাতের রেখা দেখায় মন দিল।

বেশ খানিকক্ষণ দেখার পর কিছু প্রশ্ন করল। যেগুলো অতীন দেখল ওর জীবনের সঙ্গে মিলেও যাচ্ছে। বিশ্বাসটা একটু বাড়ল তন্ময়ের ওপর।

আরও মিনিট খানেক পরে তন্ময় সোজা হয়ে বসল। মুখের ভাব দেখে কিছু বোঝা যায়না। বলল “আপনার ছেলের বিয়ে হয়ে যাবে এই বছরেই। সেই নিয়ে কোন চিন্তার কারণ নেই।“

“আর কেসের ব্যাপারটা?” অতীনের গলায় একটু চিন্তার ছাপ।

“হ্যাঁ কেসটা আপনাকে এখন ভোগাচ্ছে। কিন্তু আপনি কেসটা জিতবেন, একটু টাইম লাগবে।“

কথাটা শোনার পর অতীনের যেন নিজেকে অনেকটা হাল্কা মনে হল। একটা ভাড় যেন মাথা থেকে নেমে যাচ্ছে।

কিন্তু না, এখনো কথা শেষ হয়নি তন্ময়ের।

বলল “কিন্তু আপনাকে এটাও জানাচ্ছি যে আপনার একটা বড় ফাঁড়া রয়েছে। সেটা আপনার জীবন হানিকর হতে পারে। আর যার জন্য কেসের ফয়সালা আপনি নাও দেখতে পারেন।“

এটা আশা করেনি অতীন। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। মাথাটা ভোঁ-ভোঁ করতে থাকে। এসবে তো কোনদিন বিশ্বাস করেনি। তাহলে আজ ভয় কিসের এই ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে?

কিছুক্ষন অতীনকে চুপ করে থাকতে দেখে তন্ময় জিগ্যেস করে “আপনি ঠিক আছেন তো?”

কোনমতে ‘হ্যাঁ’ বলল অতীন।

অনিশ্চয়তা কাটাতে, একটু আশার আলো দেখতে এখানে এসেছিল অতীন। আরও বড় অনিশ্চয়তার মুখে পড়ল।

বাড়ি গিয়ে কাকলিকে কি বলবে সব কথা? কিরকম প্রতিক্রিয়া দেখবে?

ভাবতে ভাবতে উঠে পরে অতীন।



(অলংকরণ - অরূপ রায় চৌধুরী)



Comments


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page