top of page

সম্পাদকের কলমে

  • শুভাশিস ভট্টাচার্য
  • Apr 8, 2019
  • 5 min read

‘হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে। বেড়া-ভাঙার মাতন নামে উদ্দাম উল্লাসে॥ তোমার মোহন এল ভীষণ বেশে, আকাশ ঢাকা জটিল কেশে-- বুঝি এল তোমার সাধন ধন চরম সর্বনাশে॥‘


বৈশাখ এসে গেল। বৈশাখী ঝড়ে জীর্ণ জীবনের গ্লানি এবং পুরাতনের বন্ধন উড়িয়ে দিয়ে, নতুন জীবনের আশা আনন্দ আর খুশির প্রতিশ্রুতি নিয়ে এল বাঙলা নববর্ষ। আর 'বৈশাখ' উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যে নামটি অবশ্যম্ভাবী ভাবে এসে পড়ে, তিনি হলেন আমাদের প্রেরণা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ থেকে চার বছর আগে, ছিন্নমূল জীবনের পথে, সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের শিকড় সন্ধানে, নীড়বাসনার পথচলা শুরু, মহাকবির হাত ধরে । তাঁর জীবনদর্শন আর আপনাদের ভালবাসা পাথেয় করে, এতটা পথ পেরিয়ে, আপনাদের জন্য নিয়ে এলাম নীড়বাসনার ‘চতুর্থ বর্ষ-দশম সংখ্যা’। আপনাদের ভালবাসা এবং আশীর্বাদ আমাদের সাথে থাকলে আমরা একসাথে আরও অনেক দূর পাড়ি দেয়ার আশা রাখি।


দেশ এবং দেশের বাইরের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক জঙ্গি উন্মত্ততা এবং অস্থিরতার মধ্য দিয়ে আর একটা বাঙলা বছর শেষ হল। জঙ্গি উন্মত্ততা বর্তমান বিশ্বের এক করুণ বাস্তবতা। সময়ের সাথে জঙ্গি হামলা বাড়ছে বই কমছে না। জঙ্গি হামলার লম্বা তালিকার মধ্যে সাম্প্রতিকতম তিনটি ঘটনার উল্লেখ করছি - জানুয়ারিতে ফিলিপাইনের গির্জায় বোমা হামলায় নিহত হন কমপক্ষে ২৭ জন, ফেব্রুয়ারিতে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলায় শহিদ হন ৪০ জন । মার্চে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটো মসজিদে বন্দুকধারীর হামলায় নিহত হন কমপক্ষে ৪৯ জন । এই সমস্ত অমানবিক জঙ্গি হামলার যত তীব্র নিন্দাই করি না কেন তা কম হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই জঙ্গি হামলার মুলে কাজ করছে সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় এবং জাতিগত বিভেদ এবং বিদ্বেষ। জঙ্গিবাদের আক্রমণের মূল লক্ষ আমাদের মানবতা-বোধ এবং স্বাধীন চেতনাকে ধ্বংস করা । বিশ্ব জঙ্গিবাদ আমাদের ঠেলে দিতে চাইছে মানবতা-বোধ এবং গণতান্ত্রিক-বোধ বিহীন এক অন্ধকার সময়ের দিকে, যেখানে আতঙ্ক ও ত্রাস গ্রাস করে মানুষের স্বাধীনতা আর নেমে আসে মৃত্যু-শীতল বিপর্যয়। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্তরে মোকাবিলা করতে হবে। সামাজিক স্তরে পৃথিবীর সকল শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ এক হয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এবং সামাজিক ন্যায় এবং গণতন্ত্রের পক্ষে গণচেতনা গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক স্তরে পৃথিবীর সকল দেশের সরকার এক হয়ে জঙ্গি দমনের জন্য আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগ করতে হবে। এই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের অস্ত্র হল মানবতার গান - ‘গাহি সাম্যের গান-মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’। আশা করব বৈশাখের অগ্নি-স্নানে জঙ্গি উন্মত্ততার আবর্জনা দূর হয়ে যাবে। নূতন বছর আমাদের শুভ-বোধের আলো দেখাবে এবং আমরা সবাই সঙ্কীর্ণ চিন্তার গণ্ডি থেকে মুক্ত হয়ে বৃহত্তর মানবতার বন্ধনে আবদ্ধ হব।


জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের আর এক অস্ত্র গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। গণতন্ত্র আমাদের দেয় সমন্বিত এবং সহনশীল পরিবেশ। গণতন্ত্রের ইংরাজি পরিভাষা ‘ডেমোক্রেসি’ শব্দটি এসেছে গ্রীক ‘দেমোক্রাতিয়া’ শব্দ থেকে। যেখানে ‘দেমোস’ মানে ‘জনগণ’ এবং ‘ক্রাতোস’ মানে 'শাসন'। আক্ষরিক অর্থে ‘দেমোক্রাতিয়া’ মানে ‘জনগণের শাসন’। গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের দ্বারা জনগণের জন্য নির্বাচিত হয়। আজ যখন এই সম্পাদকীয় লিখছি তখন, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে, আমাদের দেশ, ভারতবর্ষে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এক মাসের বেশি সময় নিয়ে চলা এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়, সাত পর্বে, নব্বই কোটির বেশি ভারতীয় তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করবে, পরবর্তী সরকার নির্বাচনের জন্য। মনে রাখবেন আপনার ভোট মূল্যবান এবং গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব। আমরা আশা করব নির্বাচনী প্রক্রিয়া অবাধ এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পূর্ণ হবে।


সাহিত্যের মুল আস্বাদ তার ‘রস’ যা আমাদের মনে ভাবের সঞ্চার করে। রস শব্দটির মূল অর্থ হচ্ছে আস্বাদন করা। কাব্যতত্ত্বের প্রধান পুরুষ আচার্য ভরত তাঁর নাট্যশাস্ত্রে ঘোষণা করেছেন এই বলে যে ‘রস ব্যতিরেকে কোন বিষয়েরই প্রবর্তনা (সূচনা) হয় না।‘ । রস কি ? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন –'রস্যতে আস্বাদ্যতে ইতি রস:'। সরল এই বাক্যটি বুঝিয়ে দিল যা আস্বাদিত হয় সেই বস্তুই 'রস'। চতুর্দশ শতাব্দের বিশ্বনাথ কবিরাজ তাঁর ‘সাহিত্য দর্পণ’ গ্রন্থে আচার্য ভরত-এর কথারই প্রতিধ্বনিত করলেন- ‘রস্যতে ইতি রস:’। অর্থাৎ যা রসিত বা আস্বাদিত হয়, তাই রস। অলঙ্কারশাস্ত্র মতে কাব্যরস নয় প্রকার। এবং তারা আমাদের মনে নয়টি স্থায়ী ভাবের সৃষ্টি করে। যথা: রতি ভাব থেকে শৃঙ্গার রস, হাস ভাব থেকে হাস্য রস, শোক ভাব থেকে করুণ রস, ক্রোধ ভাব থেকে রৌদ্র রস, উৎসাহ ভাব থেকে বীর রস, ভয় ভাব থেকে ভয়ানক রস, জুগুপ্সা ভাব থেকে বীভৎস রস, বিস্ময় ভাব থেকে অদ্ভুত রস এবং শম ভাব থেকে শান্ত রস । নয় রসের অন্যতম রস ‘ভয়ানক রস’ নিয়েই এবারের নীড়বাসনার সংখ্যা ‘সাহিত্যে ভুত বা ভীতিপ্রদ সাহিত্য’ । একটি কথা প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল যে ভূতের গল্পের সংখ্যা করার মানে এই নয় যে আমরা ভূত বা অন্য কোনও অবৈজ্ঞানিক কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের সমর্থন বা প্রচার করছি। আমরা সবরকম কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে এবং বিজ্ঞান মনস্কতার পক্ষে। আমরা ভূতের গল্পকে শুধুমাত্র সাহিত্যের একটি বিশেষ রসের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপনা করতে এবং উপভোগ করতে চাইছি।


মানুষের কল্পনায় ভূতের ধারণা অনেক প্রাচীন। এমনকি এটাও নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে মানুষের কল্পনায় ভূতের আবির্ভাব আধুনিক দেব দেবীর আবির্ভাবের অনেক আগেই হয়েছে। লক্ষ লক্ষ বছর আগে যখন আদিম মানুষ ছোট ছোট দলে হান্টার-গ্যাদারার-এর জীবন যাপন করত তখন থেকেই অজানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ব্যাখ্যা করতে মানুষের দরকার হয়েছে অশুভ শক্তির কল্পনার। এর পরে কৃষি বিপ্লব এবং ক্রমে কৃষিভিত্তিক প্রাচীন মানব সভ্যতার উদ্ভব হয় এবং অনেক মানুষ একসাথে বসবাস করতে শুরু করে। ক্রমে কৃষিজমিতে রাজার অধিকার ঘটে এবং সমাজে রাজার আনুগত্য বজায় রাখতে আধুনিক ধর্ম এবং আধুনিক দেবতাদের কল্পনা জরুরি হয়ে পরে। বেশির ভাগ প্রাচীন সাহিত্যে মুল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল রাজার গুন কীর্তন। সেখানে রাজাকে দেবতাদের প্রতিনিধি হিসেবে দেখানো হত আর রাজার প্রতিপক্ষকে দেখানো হত ভুত প্রেত দত্যিদানো হিসেবে। এর উদাহরণ আমরা পাই বেশীরভাগ মিথলজিতেই। যেমন – রামায়ণে রাম দেবতা এবং রামের প্রতিপক্ষ রাবণ রাক্ষস। এরকম উদাহরণ আমরা পাই অন্যান্য মহাকাব্যতেও যেমন মহাভারত, ইলিয়াড এবং ওডিসি।


অলৌকিক এবং ভূতের গল্প কাহিনীর প্রতি আকর্ষণ সার্বজনীন। আমাদের অনেকেরই ছোটবেলা কেটেছে শ্রী দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার মহাশয়ের ঠাকুরমার ঝুলির ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী ভুত প্রেত দত্যি দানোর সাথে। বাংলার অনেক প্রথিতযশা সাহিত্যিক ভৌতিক পটভূমি নিয়ে গল্প উপন্যাস লিখেছেন। তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ, শরদিন্দু, পরশুরাম, লীলা মজুমদার, দীনেন্দ্রকুমার রায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীহাররঞ্জন গুপ্ত বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য । সাম্প্রতিক লেখকদের মধ্যে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভূতের গল্প গুলি নিঃসন্দেহে খুবই জনপ্রিয়। ভূতের গল্প আমাদের কল্পনাপ্রবণ মনকে প্রতিনিয়ত উসকে দেয়। আমাদের এই সংখ্যায় আমরা ভূত বিষয়ে অনেকগুলি প্রবন্ধ, গল্প এবং কবিতা সংগ্রহ করেছি। আপনাদের ভাল লাগলে আমাদের প্রচেষ্টা সফল হবে।


নীড়বাসনার প্রতিটি সংখ্যাতেই আমরা চেষ্টা করি আপনাদের জন্য নূতন কিছু নিয়ে আসার। এই প্রয়াস থেকেই আমরা এর আগের বিভিন্ন সংখ্যায় আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছিলাম 'জোড় কবিতা', 'এ-মন-জানলা', 'নীড়বাসনা সাহিত্য-যাপন', 'অনুস্বর্গ' এবং 'অণু-যাপন'। অন্যবারের মতো এবারেও থাকছে দুটি পরীক্ষামূলক প্রয়াস।


প্রথমটি দীপাঞ্জন মাইতি।র সম্পাদনায় ‘শিরোনাম’ নামের চেনা-নাম-অচেনা-কাহিনী-গুচ্ছের একটি বিভাগ যেখানে প্রতিটি অণুগল্প যেগুলি কি না একান্তই মৌলিক কিন্তু নামটা নেওয়া হয়েছে আপনাদের খুব চেনা কোন বিখ্যাত উপন্যাসের অথবা গল্পের অথবা সিনেমার।


দ্বিতীয়টি অরুণাভ দত্তের সম্পাদনায় ভিন্ন কবিদের বিভিন্ন অণুকবিতা নিয়ে একটি সম্পূর্ণ নূতন স্বাদের জোড় কবিতা ‘রাধা’। আমরা এর আগেও জোড় কবিতা প্রকাশ করেছি। কিন্তু এবারের প্রকাশ দুটি বিষয়ে আলাদা, প্রথমত এই জোড় কবিতা প্রকৃত অর্থে সম্পাদিত হয়েছে। অরুণাভর সম্পাদনায় জোড় কবিতাটিতে একক চিন্তার এক বহমান স্রোত এসেছে। তার জন্য অরুণাভ দরকার মত কাটা ছেঁড়া করেছে। দ্বিতীয়ত আলাদা করে বিভিন্ন চরণের কবির নাম দেওয়া হয় নি। এই জোড় কবিতাটি যেন কবিতার যৌথ খামার, যেখানে কবিতা কবির ব্যক্তিগত মালিকানা ছেড়ে কৌমের মালিকানায় বিলীন হয়ে গেছে।


আশা করি আমাদের প্রয়াস আপনাদের ভাল লাগবে এবং আপনারা আপনাদের সাহিত্য ভাবনা আমাদের সাথে ভাগ করে, আমাদের সমৃদ্ধ করে তুলবেন।


আপনাদের সকলকে জানাই বাঙলা নববর্ষের শুভেচ্ছা। আগামী দিন গুলো আপনাদের খুব ভাল কাটুক। আপনারা সবাই ভালো থাকুন, সাহিত্যে থাকুন আর আমাদের সঙ্গে থাকুন।






Comments


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page