top of page

ভ্রমণকথা - ভেনিসের পথে

  • প্রদোষ সেন
  • Mar 3, 2019
  • 4 min read

ইতালির বহু পুরনো শহরগুলির মধ্যে একটি হল ভেনিস এবং এই শহর একটি বানিজ্যিক কেন্দ্রও বটে। কথিত আছে এই শহর প্রতিষ্ঠিত হয় ৪২১ খ্রিষ্টাব্দে। একসময় ভেনিস ছিল ইওরোপের খুবই বর্ধিষ্ণু শহর। তারপর থেকে অনেক ঝড় বয়ে গেছে এই শহরের ওপর দিয়ে এবং আধুনিক ভেনিসের জন্ম ১৬০০ শতাব্দির পরে। যাইহোক ইতিহাস লিখতে বসিনি, তা অনেক বইতেই পাওয়া যায়। কিন্তু ভেনিস নিয়ে লিখতে গেলে ইতিহাস এসেই পরে, তা বাদ দিয়ে লেখা কঠিন।


কিছুদিন আগে আমার ভেনিস যাওয়ার সুযোগ আসে কাজের সুত্রে। ফ্রাঙ্কফ্রুটে থেকে মোটামুটি এক ঘণ্টার ফ্লাইট ভেনিস। বরফ-এ ঢাকা আল্পস পর্বত দেখতে দেখতে পৌছনো। এয়ারপোর্টে নেমে যেটা ভাল লাগল তা হল এর নাম - মার্ক পোলো এয়ারপোর্ট, বিখ্যাত বানিজ্যিক এবং ভ্রমণকারী মার্ক পোলো-র নামে। আমাদের দেশে যেমন সব কিছুর নামকরণ হয় রাজনীতিক নেতা-দের নামে, এটা তার থেকে একটা ব্যতিক্রম। ইওরোপ-এ এই রকম উদাহরন অবশ্য আরো আছে – যেমন রোম এয়ারপোর্ট, এটির নামকরণ হয়েছে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির নামে।


বই-তে পড়েছি ভেনিস-কে বলা হয় ‘ভাসমান শহর’ বা ‘Floating City’. ১১৮ – টি দ্বীপ নিয়ে তৈরি এই শহর, আর পুরো শহরে অনেক ব্রিজ আছে যেগুলো এই দ্বীপ-গুলোকে যোগ করে। তাই এইরকম একটা জায়গার কথা কল্পনা করলে জল – সমুদ্র এই সবের কথাই মনে আসে। এরোপ্লেন যখন ল্যান্ড করছে দেখলাম আমার অনুমান খুব ভুল নয় – রানওয়ে থেকে সামান্য দূরে দেখা যাছে নীল সমুদ্র – অ্যাড্রিয়াটিক সাগর।


ভেনিস-র পুরনো শহর – যেখানে সব টুরিস্ট-রা ভিড় করেন, এয়ারপোর্ট থেকে বেশ দূর। খানিকটা বাসে গিয়ে তারপর waterbus (স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে ‘ভাপারেত্ত’) করে যাওয়াটাই রীতি, বেশিরভাগ তাই করে থাকেন। আমরা নিলাম একটা প্রাইভেট মোটরবোট। ভাড়া একটু বেশি, কিন্তু ছোট বোট বলে অনেক সরু গলির মধ্যে দিয়ে যেতে পারে। এটা একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা – দুপাশে পরপর বহু পুরনো বাড়ি, যার অনেক ইট খসে পড়েছে, পুরনো দরজাতেও জল লেগে অবস্থা বেশ খারাপ। আর তার ঠিক পাশ দিয়েই চলেছে এই মোটরবোট গুলি। এটা অনেকটা তুলনা করা যায় কলকাতার ধর্মতলা স্ট্রিট বা বিঁধান সরণী দিয়ে যদি নৌকো করে যাওয়া হয়, অনেকটা তার সঙ্গে, শুধু দুপাশে দোকান নয়, তার জায়গায় বসতবাড়ি।


কোন কোন জায়গায় জলপথ অবশ্য বেশ প্রশস্ত। যেতে যেতে চোখে পড়ে ছোট ছোট ব্রিজ, আর্চের মত আকার, পায়ে হেঁটে জলপথ পেরোনোর জন্য। দেখতে দেখতে হঠাৎ খেয়াল হল যে আমরা হোটেলে পোঁছে গেছি। হোটেলের নাম Cavaletto & Doge Orseolo – কিন্তু সেখানেও আশ্চর্য হওয়ার পালা। কোন রাস্তা নয় – আমাদের নামতে হবে একটা ছোট কাঠের সিঁড়ির (jetty হিসাবে ব্যবহৃত) ওপর – সেখান থেকে কয়েক পা হেঁটে হোটেল। ঠিক উলটোদিকে এখানকার খুব পরিচিত আর জনপ্রিয় “Hard Rock Café”.


এই Cavaletto hotel ভেনিসের খুব পুরনো হোটেলগুলোর অন্যতম আর ঐতিহাসিক St. Mark square থেকে খুব কাছেই। ওখানে পৌঁছে জানলাম এই হোটেলে অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তি অতিথি হিসেবে থেকে গেছেন – তার মধ্যে একজন হলেন Winston Churchill.


হোটেল বিল্ডিং-টা অনেক পুরনো তা দেখেই বোঝা যায় – যদিও পরবর্তীকালে অনেক নতুন কাজ হয়েছে। কিন্তু কিছু জিনিষ যে বদলানো সম্ভব নয় সেটা বুঝলাম চেক-ইন করে লিফট-এ ঢোকার পর। লিফট খুব ছোট – সেটা হোটেল-র একজন স্টাফ-কে জিজ্ঞেস করায় বলল এই হোটেল দুশো বছরের বেশি পুরনো। আগে লিফট ছিল না – অনেক পড়ে লাগানো হয়েছে। কিন্তু বিল্ডিং-র প্রতিটি ফ্লোর একরকম নয় – তাই লিফট ওপর তলা অবধি যায়না। আমাদের দুতলা-এ নেমে শেষতলা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে। মাল নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা বেশ কষ্টকর ব্যাপার – তাই করতে হল। সিঁড়িগুলো সরু আর ল্যান্ডিং-টা বেশ ছোট – অনেকটা উত্তর কলকাতা-র পুরনো বাড়ীর মত। এই হোটেল গুলোর এত চাহিদা শুধুমাত্র এর অবস্থান-র (location) জন্য।


সেন্ট মার্ক স্কোয়ার সত্যি দেখার মত স্থান – ঐতিহাসিক তো বটেই, একটি বিশাল স্কোয়ার, জনসাধারণের জন্য। এখানে রয়েছে বহু পুরনো Clock tower আর Basillica church. একজন স্থানীয় ভদ্রলোক বললেন এগুলি সাতশ বছরের বেশি পুরনো (পরে ইন্টারনেটে দেখলাম তার চেয়েও বেশি)। এগুলি দেখে মনে পড়ে সেই বিখ্যাত প্রবাদ “Rome was not built in a day”. কথাটা ভেনিসের ক্ষেত্রে তো প্রযোজ্য বটেই।


সারাদিন অগুন্তি টুরিস্ট ভিড় করেন এই স্কোয়ারে। Basillica – তে ঢোকার লাইন দেখলাম একশ মিটার ছাড়িয়ে গেছে। যদিও দেখে মনে হয় পশ্চিমের দেশগুলো থেকে অনেক বেশি ভিড়, খেয়াল করলে আফ্রিকা, জাপান, কোরিয়া এবং ভারতীয় টুরিস্টও প্রায়েই চোখে পড়ে। বেশির ভাগই সকালবেলা ‘ভাপারেত্ত’ করে এখানে চলে আসেন। সারাদিন কাটিয়ে সন্ধেবেলা ফিরে যান হোটেলে, যেগুলো ভেনিসের শহরের নতুন অঞ্চলে অবস্থিত।

প্রচূর কাফে, পিজা স্টল, সুভেনির দোকান আর ভেনিসের বিখ্যাত Murano Crystal – র দোকান রয়েছে এই স্কোয়ার ঘিরে। আর আছে কিছু দামী ঘড়ি, গয়নার দোকান। যদিও সেগুলো-তে খুব একটা ক্রেতা চোখে পড়ে না। এখানে সকলকে দেখে মনে হয় কারুর কোন তাড়া নেই, একদম নির্ভেজাল ছুটি কাটাতে এসেছে।


বেশ খানিক সময় এখানে কাটিয়ে আমরা এগোই আর এক দর্শণীয় জায়গার দিকে – যা হল রিয়ালটো (Rialto) ব্রিজ। সেন্ট মার্ক থেকে রিয়ালটো শয়ে শয়ে টুরিস্ট যাতায়াত করছেন, সুতরাং কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয় না। ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পরলেই হল। কিন্তু এখানকার মিউনিসিপ্যালিটি একটা ভাল কাজ করেছে , প্রতি রাস্তার মোড়ে তীরচিহ্ন দিয়ে রেখেছে, যা অনুসরন করলে আর অসুবিধে হওয়ার কারন নেই।


রিয়ালটো যাওয়ার রাস্তায় আবার মিল খুঁজে পাই উত্তর কলকাতা-র সঙ্গে। রাস্তাতো নয়, বেশীর ভাগই সরু গলি। একটা গলি শেষ হলে একটা চত্বর, সেখানে কিছু দোকানপাট। তারপর সুরু হয়েছে আর একটা গলি। তার মধ্যে দিয়েই চলেছে টুরিস্ট-র দল। অনেক বড় বড় দোকান-ও গজিয়ে উঠেছে এই গলির ভিতর। মাঝে মধ্যে মানুষের ট্রাফিক জ্যামের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ি।


দুটো জিনিষ চোখে পড়ে, প্রথমটা হল এতো ভিড় হলেও রাস্তাগুলো বেশ পরিস্কার। আর দ্বিতীয়টা হল অনেক পুলিশের উপস্থিতি। যেটা আগে যখন এসেছিলাম দেখিনি। কেন সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না, ইওরোপে সাম্প্রতিক ঘটতে থাকা ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে।


যাহোক খানিক পরে এই মানুষের সমুদ্র পেরিয়ে পৌঁছই রিয়ালটো।

এটি নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক ব্রিজ কারণ এটি ভেনিসের সবচেয়ে পুরনো ব্রিজ – প্রথম তৈরি হয় ১২০০ থেকে ১৩০০ সালের মধ্যে। তখন এটি পন্টুন ব্রিজ ছিল – পরে ১৬০০ সালের কিছু আগে নতুন ব্রিজ তৈরি হয় যেটা এখন দাড়িয়ে আছে। আর্চ আকৃতি-র ব্রিজ। অসংখ্য টুরিস্ট ব্রিজ-এর ওপর দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন, স্বভাবতই। একজন দোকানদার আমাদের বললেন রিয়ালটো-তে ফটো তোলা একটা অবশ্য করণীয়, যে কারণে অনেক সময় ব্রিজ-এ ভিড় খুব বেশি হয়, যেটা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা একটু বিরক্ত হন।


সারাদিনের এই ব্যস্ত ভেনিসের একটা অন্য রুপ চোখে পরে রাত্রি হলে। অনেক টুরিস্ট ঘরে বা হোটেলে ফিরে যান আর সেন্ট মার্ক স্কোয়ার আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে থাকে। তখন যেন পুরনো ভেনিসের একটা আদল ফিরে আসে, আলো-আঁধারিতে সেন্ট মার্ক স্কোয়ার আরো সুন্দর মনে হয়।


খুব সকালের দিকটাও স্কোয়ার খালি থাকে – কিন্তু সেই দৃশ্য অন্যরকম।

পরদিন ব্রেকফাস্ট শেষ হতে মনে হল এবার ভেনিসকে বিদায় জানানোর সময় হয়ে আসছে। আবার জলপথে প্রাইভেট নৌকো করে যাব, এবার গন্তব্য রেলওয়ে স্টেশন। ওখান থেকে হাইস্পিড ট্রেনে করে মিলান, ইতালির ‘Fashion Capital’.

Comments


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page