top of page

গল্প - তোমার খোলা হাওয়া

  • উৎসা সরকার
  • Mar 20, 2019
  • 4 min read



অচেনা একটা মেয়ে এসে বেলা আড়াইটে নাগাদ চিঠিটা দিয়ে গিয়েছিল একতলার ভাড়াটে মাসিমার হাতে। চিঠি দিয়ে মেয়েটা আর দাঁড়ায়নি, হয়ত শ্রেয়ার নির্দেশ। বাসবীকে লেখা একটা ছোট্ট চিরকুট বলা যায়।


এই কাহিনী আজ থেকে বারো বছর আগের, 2007 সালের ঘটনা। শ্রেয়া তার আট বছর আগে থেকে বাড়িছাড়া। জীবনের প্রায় সব সিদ্ধান্তই নিজের ইচ্ছেতে নিয়েছে মেয়েটা। কখনো নিজস্বতা বিসর্জন দিয়ে কাউকে খুশি করতে মাথা নাড়েনি। ওর চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যটাই প্রথম থেকেই ভালো লেগেছিল বাসবীর। মা বাপ মরা মেয়ে বাসবী মানুষ হয়েছিল মাসির কাছে। মাত্র উনিশ বছর বয়সে বৌ হয়ে এসেছিল চক্রবর্তী বাড়িতে। সমবয়সী ছোট ননদ শ্রেয়া তাকে নাম ধরেই ডেকে এসেছে, বৌদি বলেনি কখনও। কর্তা সুরেশ তখন কলেজ ষ্ট্রীটে পৈতৃক বইয়ের ব্যবসায় জমিয়ে বসছে সবেমাত্র। মধ্য কলকাতার তেতাল্লিশ নম্বর চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ের নোনাধরা শ্যাওলাপড়া তিনতলা বাড়িটার একমাত্র বৌ বাসবী।একতলা ভাড়া দেওয়া, দোতলা আর তিনতলা মিলিয়ে থাকতেন বাসবীর শ্বশুর বীরেন চক্রবর্তী ও কাকাশ্বশুর নীরেন চক্রবর্তী। অতি রক্ষণশীল পরিবারের চার দেওয়ালের মধ্যে সূর্যের আলো ঢুকলেও, অন্ধকারই বেশি ছিল। তাই বাড়ির বৌয়ের কলেজে পড়া নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল নব্বইয়ের দশকেও। শেষকালে শ্রেয়ার জেদের কাছে হার মানতে হয়েছিল চক্রবর্তী পরিবারকে। প্রাইভেটে বিএ পাশ করল বাসবী। শ্রেয়া বেঁকে বসেছিল যে, নাহলে সেও কলেজ ছাড়বে। মায়ের পাখার বাড়ি খেয়েও বাসবীর পড়াশুনায় জোরালো সমর্থন জানিয়েছিল। স্বামী সুরেশ ছিল একটু বেশি রকমের ভালোমানুষ,ব্যক্তিত্বের বড়ই অভাব তাকে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধেই মুখর হতে দেয়নি।

মেধাবী ছাত্রী শ্রেয়া ইকনমিক্স নিয়ে পড়েছিল। বিএ পাশ করতেই বড় নন্দাই বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এলেন, পাত্রের হাতিবাগানে কাপড়ের ব্যবসা, অতি উচ্চবিত্ত পরিবার। শ্বশুরের মতে হীরের টুকরো ছেলে। বিয়েটা কিন্তু হলনা।পাত্রের শ্রেয়াকে খুব পছন্দ ছিল, কিন্তু শ্রেয়া স্পষ্টতই না বলে দিল। এর পিছনে এক রক্তাক্ত কাহিনী ছিল যা বাসবী ছাড়া কেউ জানতনা। স্থানীয় এক অস্থি বিশেষজ্ঞ বেশ কিছুদিন ধরে শাশুড়ির কোমর ব্যথার চিকিৎসা করছিলেন। একেবারেই পাড়ার ডাক্তার,শ্রেয়া মা কে নিয়ে তার চেম্বারে প্রায়ই যেত।ক্রমশ ওদের মধ্যে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ডাক্তারটি এম এস পাশ করে হঠাৎ একদিন লন্ডন চলে গেল আর এক ডাক্তার পাত্রীর হাত ধরে। আনুষ্ঠানিক ভাবেই সবিনয়ে বিদায় জানিয়ে গেল শ্রেয়াকে। সব শুনে হতভম্ব বাসবী বলেছিল, " এত বড় অন্যায়টা তোর সঙ্গে কেন করল?"

অবাধ্য চোখের জল কোনোমতে ঠেকিয়ে শ্রেয়া বলেছিল, " এটাই আমাকে জানতে হবে, মানুষ অপরাধ করে কেন। আমি এত সহজে হারবনা রে।"

খামখেয়ালি একরোখা মেয়েটা নিজেই সিদ্ধান্ত নিলো কিভাবে চলবে। পুনে চলে গেল 'ক্রিমিনোলজি ' বা 'অপরাধবিজ্ঞান ' নিয়ে পড়াশুনা করতে। তুমুল ঝড় উঠল বাড়িতে। শ্বশুরের বজ্রনিনাদ,শাশুড়ির কান্না, বড় ননদের চোখ রাঙানি, সবই বিফলে গেল। অকপটে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াল শ্রেয়া," আমাকে আপাতত কিছু টাকাপয়সা দাও। আমার বিয়ে দিলেও তো খরচা করতে।"

বাসবীর বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল। এবাড়িতে যে তাকে সবচেয়ে বেশি বুঝত, তার চাওয়া পাওয়াকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিত, সেই এত দূরে চলে যাচ্ছে !! তবু সে খুশি হল,থাক মেয়েটা নিজের মত করে বাঁচুক। সুরেশ বাসবীর অনুরোধে বাবাকে বোঝাতে গিয়ে চূড়ান্ত হেনস্থা হল,শ্বশুর ক্ষোভে ফেটে পড়লেন," নারীবাদী হাওয়া উঠেছে এবাড়িতে। আমি ঘাস খাইনা সুরেশ, লোক চরিয়ে খাই। স্ত্রী-বুদ্ধিতে চলতে যেওনা, সর্বনাশ হবে।অমন সম্বন্ধ পায়ে ঠেলে মেয়ে চললেন ভিন রাজ্যে দিগগজ হতে!! এত দেমাক, ওর মুখ আর আমি এ জীবনে দেখবনা।"

সেই সময়ের মধ্য কলকাতার মধ্যযুগীয় গোঁড়া রক্ষণশীল ঐ মানুষটার কাছে 'অপরাধবিজ্ঞান' নিয়ে পড়াটা ছিল নিছকই ভণ্ডামি। চোর কেন চুরি করে, খুনি কেন খুন করে- এইসব পয়সা খরচ করে পড়ার কোনও যুক্তি খুঁজে পাননি কলেজ স্ট্রিটের ' বুক হাউস ' এর কর্ণধার বীরেন চক্রবর্তী।

শ্রেয়া চলে যেতেই বাড়িটা কেমন ঝিমিয়ে পড়ল। মাসে একখানা কি দুখানা চিঠি দেয় বাসবীকে। একতলার ভাড়াটে মাসিমার নামে আসে, গোপনে সেই চিঠি ঘরে এনে লুকিয়ে পড়ে বাসবী। পুনেতে গিয়ে বাঙালী বন্ধু পেয়েছে, ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপালও যথাসাধ্য সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। খুব স্বস্তি পেয়েছে বাসবী, শ্রেয়া যদি কষ্টে থাকত,ও সহ্য করতে পারতনা ।

দেখতে দেখতে কেটে গেছে আটটা বছর। বাসবী মা হয়েছে।ছেলে তার স্কুলে যাচ্ছে। ওদিকে পাশ করে চাকরি নিয়েছে শ্রেয়া। এক সংশোধনাগারে,জুভেনাইল কোর্টে বিচার হওয়া অপরাধীদের কাউন্সেলিং করা তার কাজ। বাসবীকে লেখে," এ এক আশ্চর্য অনুভূতি। কচি কচি মুখগুলোর চোখের ভাষায় এক অদ্ভুত যন্ত্রণা। আবার কেউ কেউ রুক্ষ কঠিন।"

উত্তরে বাসবী লেখে," বেশ আছিস রে।


তুই যা পেরেছিস, আমি তা পারিনি। আজ এত বছরেও মাথার ঘোমটা খসলনা, পায়ের আগল ভাঙলনা। হেঁসেল সামলাচ্ছি আর ছেলে মানুষ করছি। আজও দোকান বাজারে গেলে সঙ্গে তোর দাদা বা দিদি বা অন্য কেউ। এক গা গয়না পরে স্বর্ণকাতান গায়ে জড়িয়ে কোনও অনুষ্ঠানে গেলেই শুনি " বৌটি তোমাদের ভারি লক্ষ্মী ।" তখন মনে মনে বলি," কি ক্ষতি হত যদি আর একটু অলক্ষ্মী হতাম? যাক তুই কবে আসবি? আয়না রে একবার অভিমান ভুলে।"

শ্রেয়া সাহস দিয়ে লেখে," আমি বিশ্বাস করি তুইও একদিন পারবি। চক্রবর্তী বাড়ির সিংদরজা ভেঙে বেরিয়ে আসতে।বহুদিন পর কলকাতায় যাচ্ছি। বাড়ি যাবনা ঠিকই, তবে তোর সঙ্গে দেখা করবই, যেভাবে হোক।" শ্রেয়া আসছে। কবে কোথায় কিভাবে দেখা করবে?হাঁসফাঁস করে বাসবী।শ্রেয়ার কড়া নিষেধ, বাড়ির কাউকে জানানো যাবেনা।শাশুড়ি বহুবার তাকে ইঙ্গিত দিয়েছেন এই কবছরে, চোখের জল ফেলে বলতে চেয়েছেন সে কোনও খবর নিতে পারে কিনা। সুরেশ সবটাই জানে, বাসবীকে খাম পোস্টকার্ড এনে দেওয়া,চিঠি পোস্ট করা- সেই তো করেছে সব।মেরুদণ্ডহীনতা ছাড়া আর তো কোনও দোষ নেই মানুষটার।

তারপর আজ দুপুরে শ্রেয়ার পাঠানো এই ছোট্ট চিরকুট : আমি ভালো নেই রে। ডাক্তার বলেছে হাতে সময় খুব অল্প। ঠাকুরপুকুর,বেড নম্বর একান্ন।

কাঁদলনা বাসবী। গলার কাছে কি যেন একটা দলা পাকিয়ে আসছে। শক্ত হল তার চোয়াল। আয়নায় একবার দেখল নিজেকে। দ্রুত শাড়িটা পাল্টে একটা চাদর জড়িয়ে নিলো গায়ে। হাতব্যাগে কয়েকগোছা নোট ঢুকিয়ে নিয়ে সোজা চলে এলো বৈঠকখানায়,সেখানে পিতা পুত্র ব্যবসার আলোচনায় মগ্ন। " বাবা আমি একটু বেরচ্ছি, জরুরি দরকার।" বাসবীর কণ্ঠস্বরে চমকালেন বৃদ্ধ। " কো---কোথায় যাচ্ছ?" হতভম্ব সুরেশ।

ততক্ষণে সদর দরজা খুলে রাস্তায় পা দিয়েছে বাসবী। ওপারে দাঁড়ানো ট্যাক্সিগুলোর একটা এসে দাঁড়িয়েছে তার হাতের ইশারায়। " বৌমা দাঁড়াও "-- জলদগম্ভীর ডাক ভেসে এলো বীরেন চক্রবর্তীর। জানলায় শাশুড়ির ত্রস্ত মুখ। ছুটে এসেছে সুরেশ, কিছু বলছে। সজোরে ট্যাক্সির পাল্লা বন্ধ করল বাসবী। ঋজু কণ্ঠে বলল, " ঠাকুরপুকুর যাব, তাড়াতাড়ি।"

প্রায় এক যুগ পর তেতাল্লিশ নম্বর চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ের চক্রবর্তী বাড়ির একমাত্র বৌ সম্পূর্ণ একা রাস্তায় পা রাখল। ব্যাগের ভিতর ফোনটা বেজে উঠল বাসবীর।


" হ্যালো, আপনি কি বাসবী চক্রবর্তী বলছেন?

একটা খুব খারাপ খবর আছে,মানে শ্রেয়া----"

"হ্যাঁ বলুন,কি হয়েছে শ্রেয়ার?"

"শ্রেয়া আর নেই।আমিই ওকে নিয়ে এসে হসপিটালে ভর্তি করি আজ একটু আগে।কিন্তু বেচারি আর কোনও সুযোগই দিলনা। শুধু আপনাকে একবার দেখবে বলে কলকাতায়এল,কিন্তু ফ্লাইটেই সেন্স চলে যায়।"

কান্নায় গলা আটকে আসে মেয়েটির।" সরি, আপনাকে আগে খবর দিতে পারিনি। প্লিজ তাড়াতাড়ি চলে আসুন, ঠাকুরপুকুরে,বেড নম্বর একান্ন ।"

শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায় বাসবীর । ফাল্গুনের প্রথম।ট্যাক্সির জানলা দিয়ে হাওয়া ঢুকছে হুহু করে। এইবার কাঁদছে বাসবী। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে চুল। দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে জল ঝরে পড়ছে কোলের উপর। মনে মনে বলছে,"তুই বিশ্বাস কর শ্রেয়া,ঠিক এইভাবে যে আমায় পায়ের বেড়ি ভেঙ্গে স্বাধীন করে দিয়ে যাবি, এ আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। তুই বাড়ি এসে আমায় টেনে বের করে আনলি, তবু দেখা দিলিনা।এত অভিমান !!! "


(নীড়বাসনা আয়োজিত ভৌতিক/ অতীন্দ্রিয় ইভেন্টে 'গল্প' বিভাগে এই গল্পটি প্রথম স্থান অধিকার করে।)


Comentários


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page