স্মৃতি রোমন্থন - লক্ষ্মীপুজো
- রাহুল দেব লাহিড়ী
- Dec 2, 2018
- 4 min read
Updated: Feb 20, 2021
আমি নিজে প্রবল রকম বা গোঁড়া ধার্মিক নই। কিন্তু বাঙালির পূজাপার্বণের রীতি, নীতি এসব খুব ভালো লাগে। এই উৎসবের মরসুম আজকাল নতুন করে ভালো লাগছে। অনেক বন্ধুদের সমাগম, ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা, বিজয়া করতে যাওয়া- এসবই নতুন মাত্রায় ধরা দিচ্ছে আজকাল। ভাবছি, এভাবে উপভোগ করা হয়নি তো এতকাল! কিছু ছুটে গেছে কি জীবন থেকে? ছুটে তো গেছেই। মহাকালের হাতের মুঠো থেকে বালির মত ঝুরঝুর করে ঝরে গেছে অনেকটা সময়। কিছুই করা হয়নি। অনেক কিছুই করার ছিল কি? তাও নয়। আসলে মধ্য চল্লিশের এই সময়টাই বোধ হয় এমন। এটা কিন্তু তা বলে চাওয়া পাওয়ার হিসেব কষা নয়, শুধু রোমন্থনের মরসুম। বেশি বেশি করে মনে পড়ে যাওয়া ছোটবেলার নানা স্মৃতি, বিশেষ করে সুখস্মৃতি। খেলার মাঠ থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে গোল হয়ে বসেছি সন্ধেবেলা। বন্ধুদের সাথে কত গল্প ঘাসের গোড়া চিবোতে চিবোতে। মাথার ওপর মশার ঝাঁক ভনভন করে অকারণে উড়ছে। মুখ বুজে চোখ বন্ধ করে চিবুক সামান্য তুলে চোঁ ও ও ও আওয়াজ করছি আর বোকা মশার পাল নেমে আসছে নাগালে। মুঠো ভরে খপ করে ধরে ফেলা কয়েকটাকে। স্মৃতিগুলোর আচরণ আজকাল অবিকল এরকম। লক্ষ্মী পুজো চিরকাল আমার প্রিয়। লক্ষ্মী ঠাকুরণ নিতান্তই আমার ঘরের মেয়ে। এই পুজোর উপকরণ, পদ্ধতি, আয়োজন সবই খুব আপন মনে হয় আমার। দুর্গাপুজোর একটা আড়ম্বর আছে। সাথে চার চারটে ছেলে মেয়ে সাথে নিয়ে স্বামীকে সঙ্গে করে দেবী দুর্গা পুরো পাঁচ দিনের জন্য এসে অধিষ্ঠান করেন ধরাধামে। প্রচুর উদ্যোগ, আয়োজন চোখে পরে। বেশ একটা জমকালো ব্যাপার। লক্ষ্মী দেবী ওনার সন্তান হলেও যেন একটু অন্যরকম। ঠিক যেন আগেকার দিনের বাঙালি গৃহস্থ বাড়ির বড় মেয়েটি। শান্ত, চুপচাপ, কিন্তু প্রখর বুদ্ধিমতী। সুরূপা তো বটেই। এই লক্ষ্মীত্ব সার্বজনীন। এমনকি কোনো অশান্ত বাচ্চা ছেলের কাছ থেকেও খুব শান্ত শিষ্ট আচরণ প্রত্যাশা করতে হলে বলতে শুনেছি, ' লক্ষ্মী ছেলের মত চুপ করে বোসো'। আড়ম্বরহীন সার্বজনীন এই পুজো তাই আমার এত প্রিয়। আমার মনে হয় বাঙালি হিন্দু বাড়িতে এত নিষ্ঠাভরে এই লক্ষ্মীপুজো এখনও পালিত হয় বলেই বিশেষতঃ গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে একটা লক্ষ্মীশ্রী চোখে পড়ে আজও। দারিদ্রকে প্রবল তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে সদ্য গোবর নিকানো ছোট্ট উঠোন, চালার ওপর লকলকে লাউ এর লতা আর কোণে তুলসীমঞ্চ চোখে পড়ে। প্রতি সন্ধ্যায় যেখানে মাথায় আঁচল দিয়ে প্রদীপ জ্বালাবেন বাড়ির লক্ষ্মী ভক্তিভরে, কল্যাণ কামনা করবেন সমস্ত মানবজাতির। উলুধ্বনি আর শঙ্খনাদ মুখরিত করে তুলবে পরিবেশ। আমাদের বাড়ির লক্ষ্মীপুজো হয় ভর সন্ধেবেলা। জ্ঞান হওয়া ইস্তক এর ব্যতিক্রম চোখে পড়েনি। পুজোর সকালটা খুব মায়াভরা ছিল। আমার মা স্বয়ং সেদিন সক্কাল বেলা সদ্যস্নাতা হয়ে লাল পাড় শাড়ি পরে স্বয়ং লক্ষ্মী। বাড়ির তুলসী মঞ্চ পরিষ্কার করে বাঁধানো উঠোন আর গোটা বাড়ির বারান্দা ধোয়া মোছা হলেই শুরু হতো আলপনা দেওয়া। আমার ছোটপিসি খুব ভালো ছবি আঁকতেন। আমাদের বাড়ির দেওয়ালে আজও তাঁর আঁকা ছবি শোভা পায়। তা, সেই সকাল থেকে পিসির আলপনা দেওয়া শুরু হতো। প্রথমে উঠোন। এখানে একটা ধানের গোলা আঁকা হল প্রথমে। আমরা দুই ভাই উবু হয়ে বসে চালের গুঁড়ি আর খড়িমাটি মেশানো গোলায় ন্যাকড়া চুবিয়ে অদ্ভুত দক্ষতায় তুলে নিয়ে হাতের সব আঙ্গুল একত্র করে শুধু অনামিকা দিয়ে আঁকা সেই শিল্পকর্ম দেখছি মুগ্ধ হয়ে। মাঝে মাঝে শিল্প সমালোচক দুই ভাইয়ের নির্দেশে খুঁটিনাটির দিকে সস্নেহ প্রশ্রয়ে ফুটে উঠছে ধানের গোলার জানলার শিক অথবা টিনের চুড়োর ঢালের মাপ। এরপর চালের ওপর বসবে মা লক্ষ্মীর বাহন। শ্বেত শুভ্র লক্ষ্মী পেঁচা। আঁকা শেষ হলে কটমট করে তাকাবে ঘাড় কাত করে আমাদের দু ভাইয়ের দিকে। তারপর ধানের গোলার ডানপাশে একটা শঙ্খ আঁকা হবে। এরপর লক্ষ্মী ঠাকুরের পা। প্রথমে একজোড়া । তারপর বাঁ পা ডান পা এগিয়ে চলবে নিখুঁত পদক্ষেপে। এই পা আঁকা হবে গোটা বাড়ি জুড়েই। পরবর্তী চার পাঁচ ঘণ্টা প্রবল সাবধানে থাকা সত্তেও আমার বা দাদার পায়ে লেগে এক দু জায়গায় আলপনা ধেবড়ে যাবেই। আমরা তাকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত পাপোশ দিয়ে ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে বিফল হয়ে তিরস্কৃত হব। এরই মধ্যে ঠাকুর ঘর থেকে সম্বচ্ছরে একবার বেরোনো ঢাউস পুজোর বাসন, যেগুলো আবার বেশির ভাগই কাঁসা বা পিতলের, সেগুলোকে ছাই আর লেবু ঘষে চকচকে করে মেজে ফেলেছেন মা। পুরো ব্যাপারটা তদারকি করছেন আমার ঠাকুমা। পুজোর দিন সব বড়দের মুখেই একটা লাল টকটকে ভাব। একেই বুঝি লক্ষ্মীশ্রী বলে। এরপর ঠাকুরের অধিষ্ঠান হবে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট জলচৌকির ওপর। এই জলচৌকিকে প্রথমে ভালো করে ধুয়ে, তাতে আলপনা দিয়ে তারপর লাল কাপড় বিছানো হবে। এই স্থাপনা পর্বটা খুব ইন্টারেস্টিং ছিল। প্রথমে ধান মাপা বেতের মাঝারি সাইজের একটা পাত্র, যাকে 'কাঠা' বলে, সেটার তিন চতুর্থাংশ ধান দিয়ে ভর্তি হবে। তার ওপর দেওয়া হবে সিঁদুর মাখানো কয়েন আর কড়ি। এভাবেই সম্ভবতঃ পয়সাকড়ি কথাটার উদ্ভব। যা হোক, এরপর কাঠা ভর্তি হলে তার গায়ে গোলা সিঁদুর দিয়ে পাঁচটা দাগ দেবেন মা। তারপর এতে সিঁদুরের চারতলা একটা গোল আর মাথা সূচালো কৌটো বসানো হবে। সব শেষে লাল চেলি দিয়ে তাকে এমনভাবে মা ঢেকে দেবেন, যেন একজন নারী ঘোমটা দিয়ে বসে আছেন। সামনে তারপর জলভর্তি ঘটে আম্র পল্লব দিয়ে কচি ডাব বসানো হবে। তার ওপর গামছা। লক্ষ্মী ঠাকুরণের খাওয়ার জন্য চার পাশে পান সুপারি রাখা। লক্ষ্মীর সামনে ধানের ছড়া শোভা পাচ্ছে, পুজো শেষে যা স্থান পাবে সদর দরজার মাথায়। এরপর চলবে ভোগ রান্না। আতপ চাল আর মুগের ডাল, তারমধ্যে বাদাম আর কাজু কিসমিস মিলেমিশে একটা স্বর্গীয় স্বাদের ঝরঝরে খিচুড়ি তৈরি হবে ঠাকুমার তত্বাবধানে মায়ের হাতে। এরপর পাঁচ রকম ভাজা, একটা পাঁচ মিশলি তরকারি, ফুলকপি আলুর ঝোল, চাটনি আর পায়েস। সাথে আবার লুচিও। বাড়ির বড়রা সবাই উপোষ করলেও আমাদের দুই ভাই ছোট হওয়ায় অনুমতি ছিলোনা উপোষের। কিন্তু সন্ধ্যে থেকে অপেক্ষা করে থাকতাম এই খিচুড়ি ভোগ খাওয়ার। অপূর্ব স্বাদ ছিল তার। প্রথম পাতে থাকত ফল প্রসাদ। তারপর একে একে ভাজা ভুজি খিচুড়ি হয়ে তরিতরকারি পড়ত পাতে। পাড়ার অনেকে নিমন্ত্রিত হতেন। বাবা পুজো করতেন। শুদ্ধ সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণে গোটা বাড়ি গমগম করত। অঞ্জলি দিতেন উপোষীরা ভক্তিভরে। শান্তি জল নেওয়া হত পা গুটিয়ে রেখে, যাতে পায়ে না পড়ে। পা টা কি শরীরের থেকে আলাদা কোনো অশুদ্ধ অঙ্গ? কে জানে বাবা! পঞ্চপ্রদীপ দিয়ে আরতি শেষে আগুনের ওপর হাতের তালু ঘুরিয়ে গরম করে মাথায় বুকে মাখিয়ে দিচ্ছেন মা, শরীরটা যেন শীতল আর শুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। শ্বেত উপবীত পরিহিত পিতৃ দেবের চামর অদ্ভুত মুদ্রায় মোচড় দিয়ে আরতি দেখতে পাচ্ছি চোখ বুঝলেই। সবশেষে গোটা বাড়িতে শান্তিজল দেওয়া হবে ঘণ্টা বাজিয়ে। পুজো জুড়ে ধুনুচি থেকে সুগন্ধি ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে উঠবে। শাঁখ বাজবে। শুধু ঘণ্টা বাজানো চলবেনা। এতে শান্ত শিষ্ট দেবী রুষ্টা হবেন। এরপর মা বসবেন গায়ে আঁচল দিয়ে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তে। শুরু করে পাঁচালি পড়া হবে। গোল করে ঘিরে বসা প্রতিবেশিনীরা মাঝে মাঝেই বিহ্বল হয়ে সজল চোখে হুলু ধ্বনি দেবেন। এরপর মা লক্ষ্মী আসবেন ঘরে ঘরে দেখতে 'কো জাগরী', অর্থাৎ কে জেগে আছে বাড়িতে, তা দেখতে। আমরা দুই ভাই দরজা খুলে রেখে অপেক্ষা করে করে ঘুমিয়ে পড়বো। আরেকটু জেগে থাকলেই নির্ঘাত দেখা পেতাম দেবীর বলে আফসোস হবে পরদিন। সামান্য ধৈর্যচ্যুতি আর আত্মনিয়ন্ত্রণের এই অভাবে কত কিছু পাওয়া হলোনা জীবনে। লক্ষ্মীপুজো আজও হয় বাড়িতে। এখন আমার স্ত্রী রান্না করেন। রান্নার স্বাদ অনেকটাই আগের মত আছে। তদারকিতে আমার মা আছেন। আড়ম্বর কমেছে অনেকটাই। নিমন্ত্রিত সংখ্যা সীমিত হয়েছে। আমন্ত্রিত পুরোহিতের সময় সংকুচিত আর প্রফেশনাল আচরণে পূজা যেন একটু কৃত্রিম হয়ে গেছে। তবুও লক্ষ্মী পুজো মানেই আমার কাছে একটা নস্টালজিয়া।

Comments