top of page

গল্প - অবসর

  • প্রদোষ সেন
  • Dec 2, 2018
  • 9 min read

Updated: Feb 20, 2021



।।১।।


বিকেল থেকে সময়টা আর যেন কাটতেই চায় না কল্যাণীর।

স্কুলে পড়ানোর জীবন থেকে অবসর নিয়েছে কয়েক বছর হল, স্বভাবতই চাকরি জীবনের সেই ব্যস্ততা আর থাকার কথা নয়, আর তা নেইও। সেটা কল্যাণী মেনেও নিয়েছে, মানিয়ে নিয়েছিল নিজেকে অনেকটাই সময়ের সঙ্গে। তারপর হঠাৎ প্রদীপ্ত চলে গেল, সাতচল্লিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে ইতি টেনে। কল্যাণী অবশ্য জানে প্রদীপ্ত-র চলে যাওয়াটা হঠাৎ ছিল না – কয়েক বছর ধরেই শরীর ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছিল। চিকিৎসা চলছিল – কিন্তু কখনই সারেনি। এখন সন্দেহ হয় রোগটা বোধহয় ডাক্তাররা ঠিক মত বুঝতেই পারেননি।

প্রদীপ্তর মৃত্যু একটা জোরালো ধাক্কা হলেও কল্যাণী মেনে নিয়েছিল কিছুটা সহজভাবেই – জন্ম হলে মৃত্যু অবধারিত, মন–কে খানিকটা সান্তনা দিয়েছে সেইভাবে। তারপর এখন এক বছর হতে চলল – প্রদীপ্তর অনুপস্থিতির সঙ্গে এখন অনেকটাই খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে। কিন্তু সময় কাটানো মাঝে মাঝে বড় কঠিন হয়ে দাঁড়ায় - সদাব্যাস্ত কর্মজীবনের কথা প্রায়েই মনে পরে।... অথচ এমনটা যে এতো তাড়াতাড়ি হবে ভাবেনি।

...বেশিদিন আগেকার কথা নয় – আট কি নয় বছর হবে, প্রদীপ্ত অবসর নিল একটা বেসরকারি ব্যাঙ্কের বেশ উঁচু পদ থেকে। কল্যাণী তখন সরকারী স্কুলে পড়ায়, ছেলে-মেয়ে দুজনেই চাকরি করে – কোলকাতা শহরের বাইরে। বাড়িতে আধিক্য না থাকলেও বেশ স্বছল অবস্থা। দুজনেই ভেবেছিল এটা ভাল একটা অবসর জীবন কাটানোর সময়।

কাটছিলও।

পার্টি, এখানে-ওখানে নিমন্ত্রন, মাঝে-মধ্যে একটু ঘুরতে যাওয়া, কখনো উইক-এন্ড শপিং - সবই ছিল এর মধ্যে।

কয়েক বছর কাটল এই ভাবেই – এবার কল্যানীর-ও অবসর-র সময় এগিয়ে আসছে - আর বছর খানেকও বাকি নেই। এরমধ্যে কিছু পরিবর্তনও এসেছে – ছেলে-মেয়ে দুজনেই এখন বিবাহিত, প্রদীপ্তর শরিরটা একটু ভেঙ্গেছে। পেটের কাছে একটা ব্যাথা মাঝে মাঝে-ই মাথাচাড়া দেয়। ডাক্তার কয়েকটা টেস্ট করতে বলেছেন, যেগুলো হলে কারণ জানা যাবে আর সেইমত চিকিৎসা শুরু হবে।

একদিন ডিনার করতে বসে প্রদীপ্ত জিগ্যেস করল “ওটা নিয়ে কিছু ভাবলে?”

-“কোনটা?”

-“সুধীন যেটা বলছিল, স্কুলে পড়ানর ব্যাপারটা-“

-“না কিছু ভাবিনি। আর সেটাতো এখন নয়, রিটায়ার করার পর। পরে ভাববো।“

-“আমার মনে হয় তুমি বেশি দেরি কর না, ওদের ‘হ্যাঁ’ বলে দাও। সময়টা তো কাটবে।“

একটু অবাক হয়েছিল কল্যাণী। তাকায় প্রদীপ্তর দিকে “সময়টা কোথায় বলত? আজ এখান কাল ওখান করে তো বেশ ভালই কেটে যাছে – এই বয়সে এর থেকে বেশি ব্যস্ততা আর কি দরকার?”

প্রদীপ্ত হেসেছিল। “খুব ভুল বলনি, তবে রিটায়ার করলে স্কুলের টাইম-টা তো পাবে, ওই সময়টা তখন আর ব্যস্ত থাকবে না।“

“ঠিক আছে, আর কয়েকদিন ভাবি – তারপর বলব।“

এরপরেও ওদের কথা হয়েছিল, আর খানিকটা প্রদীপ্তর কথাতেই কল্যাণী রাজি হয় ওই স্কুলে ভল্যান্টারী সার্ভিস দিতে। কথা দেয় মাসদুয়েক পরে। এখন মাঝে-মধ্যে মনে হয়, প্রদীপ্ত বোধয় বুঝতে পেরেছিল ওর শারীরিক অবস্থার কথা – এ অসুখ সহজে সারার নয়। তাই চেয়েছিল কল্যাণী কোথাও কাজে যোগ দিক – নাহলে মুশকিল হবে একা সময় কাটানো।

......


অবসরের দিন এগিয়ে এল কল্যাণীর। স্কুলে বেশ বড় ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়ছিল – যেটায় কল্যাণী একাই ছিল। এরপর কিছু ঘনিষ্ঠ সহকারীরা আর একটা ছোট অনুষ্ঠান করেন – যেটাতে প্রদীপ্তও আমন্ত্রিত ছিল। একজন সহকারী জিগ্যেস করেছিলেন “আপনারা কিভাবে সময় কাটাবেন? শুনেছি আপনাদের ছেলে মেয়েও বাইরে থাকে।”

কল্যাণী বলেছিল “অফিস, কাজ এসব অনেক হয়েছে আর ছেলে-মেয়ে কলকাতার বাইরে তো এখন বেশিরভাগ ঘরেই – অতএব আমার ইছে একটু নিজের পছন্দমত জীবন কাটানো।“

প্রদীপ্ত শুনেছিল, তারপর বলল “আমারও মত মোটামুটি একই – কিন্তু এতদিন এতো ব্যস্ত জীবন কাটানোর পর, একদম চুপচাপ বসে থাকাটা একটু মুশকিল। তাই খানিকটা এনগেজমেন্ট থাকলে বাকি সময়টা আপনি নিজের মত কাটাতে পারেন।“

“এটা কি আপনি আপনার নিজের ক্ষেত্রেও ফিল করেন?”

“হ্যাঁ, খানিকটা তো বটেই।“ খানিকটা থেমে প্রদীপ্ত আবার বলছিল “আমার যেটা মনে হয়, এটা শুধু অবসর সময় কাটানোর ইসু নয়। আপনি যখন চাকরি করছেন, আপনার খ্যাতি, নাম, সহকারী – সব মিলিয়ে আপনার একটা সার্কেল আছে যেখানে আপনি রেকগ্নিসন পাছেন। অবসর নেওয়ার পর কিন্তু ওগুলো সবই মিসিং ।“

“হ্যাঁ, আমিও একইরকম শুনেছি অনেকের কাছে – আই মিন যারা রিটায়ার করেছেন।“

আরেকজন সহকারী কল্যাণী-কে জিগ্যেস করেছিল “তাহলে ম্যাডাম, আপনি কি কিছু করবেন বলে ভেবেছেন?”

কল্যাণী বিশদভাবে কিছু বলেনি, শুধু বলেছিল “দেখি।“

………


যদিও মৌখিক সম্মতি দিয়েছিল কয়েকমাস আগেই, রিটায়ারমেনেট-র পর কল্যাণী আর একবার ভাবতে বসেছিল স্কুলে ভল্যান্তারি সার্ভিস দেওয়ার ব্যাপারে। ভল্যান্টারী সার্ভিস নামেই – ঠিক টাইমে ক্লাসে যেতে হবে, বেশিরভাগ দিন দুপুর একটা অবধি থাকতে হবে। এই নিয়মমাফিক জীবন অনেকদিন কাটিয়েছে – তাই আর চায়নি।

কিন্তু প্রদীপ্তকে ও চেনে – যখনই এই ব্যাপারে কথা হয়, বলে “তোমার এটা ছাড়া উচিত নয়। আর, আমি সুধীনের কাছে যা শুনেছি, ওরা যাতায়াত করার জন্য একটা টাকা মাসে চালু করেছে। আমি জানি আমাদের ওই টাকা না পেলেও চলবে – কিন্তু এটা একটা ইনসেন্টিভ বলতে পার।“

এক সপ্তাহ মত কেটেছে। রবিবার সন্ধ্যেবেলা – সুধীন আর একজন ভদ্রলোক হঠাৎ হাজির ওদের ফ্ল্যাটে।

প্রাথমিক আলাপ পরিচয়ে জানা গেল, ভদ্রলোকের নাম অমিয়, অমিয় ঘোষ। ইনি হছেন স্কুলের সহ-প্রধান শিক্ষক। দুজনেরই খুব ইচ্ছা যে কল্যাণী ওই স্কুলে জয়েন করুক আর যেহেতু এটা ভলান্টারী সার্ভিস, ও চাইলে দু সপ্তাহের নোটিস দিয়ে ছেড়ে দিতে পারবে।

এর প্রায় এক মাস পরে কল্যাণী ওই স্কুলে জয়েন করেছে। এই স্কুল একটু অন্যরকম – স্কুলের ম্যানেজমেন্ট, টিচারটা সবই একটু আলাদা। কিন্তু তাতে কল্যাণী-র খুব একটা যায়ে-আসে না। ওর পড়াতে ভাল লাগে আর যে কারণে জয়েন করেছিল – সময় খানিকটা কাটানো, দুটোই হয়। প্রদীপ্ত জিগ্যেস করলে অবশ্য বলে “তুমি বারবার বললে তাই জয়েন করলাম – নাহলে করতাম না।“

প্রদীপ্তকে চুপ করে থাকতে দেখে ও আবার বলে “এই সব টাইমে যাওয়া-আসা আর পোষায়ে না – অনেক হয়েছে।“

অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেল প্রদীপ্তর মৃত্যুর পর।

কল্যাণী এখন একা । না একা মানে এমন নয় যে ওর কেউ নেই – ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব সবাই আছে। আবার তারা থেকেও নেই। সকলের একটা নিজস্ব লাইফ আছে, ছেলে-মেয়ের রয়েছে নিজেদের কেরিয়ার – তাই সকলেই এখন ব্যস্ত, দৌড়ছে - কেউ আস্তে, কেউবা জোরে।

কল্যাণী নিজের দৌড়টা নিজের গতিতে দৌড়তে চায়। ছেলে যখন বলল “আমার কাছে মাস তিনেকের জন্য চল, তারপর ভেবে দেখ কি করবে”। কল্যাণী রাজি হয়নি। হায়দ্রাবাদে কিছুদিন মেয়ের কাছে থেকে ফিরে এসেছে কলকাতায়।

একা থাকাটা সহজ হয়নি, এখনো নয়।

মাঝেমধ্যে মনে হয়, স্কুলের টাইমটা আর কিছু বেশি হলে ভালই হত। বিশেষত বিকেল থেকে সন্ধ্যে – খুব বেশি মনে হয় সময়টা।



।।২।।


তখন বিকেল পাঁচটা মত বাজে, ফোনটা বেজে উঠল। আজকাল ফোন কমই আসে, যেটুকু আসে তাও মোবাইল-এ। তাই ল্যান্ডলাইনে ফোন আসতে কল্যাণী একটু অবাকই হল – হয়ত কোন ভুল নাম্বার হবে।

“হ্যালো” – ফোন তুলতে ওপাশ থেকে এক অপরিচিত ছেলের গলা।

কল্যাণী “হ্যাঁ বলুন” বলতে ওপাশ থেকে বলল “কল্যাণী ম্যাডাম বলছেন?”

-“হ্যাঁ বলছি।“

-“আপনি আমাকে মনে করতে পারবেন কিনা জানিনা, আমি প্রীতম – আপনার একজন পুরোনো স্টুডেন্ট।“

- “না আমি ঠিক মনে করতে পারছি না, বুঝতেই তো পারছো কত স্টুডেন্ট আসে যায়।”

- “না সে ঠিক আছে...”

-“তা কি দরকার বল” – কল্যাণী কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে।

-“ম্যাডাম আপনি হয়ত শুনেছেন যে আমাদের স্কুলে একশ' বছর সেলিব্রেশন হবে পরের মাসে, মানে সেপ্টেম্বর মাসে। তারিখটা হল ২৯।“

- আছা, আমি শুনেছিলাম হবে – তারিখ অবশ্য জানতাম না।“

-“তো সেই ব্যাপারে একটু আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই...মানে আপনার যদি কোন অসুবিধা না থাকে।“

-“না অসুবিধে কেন থাকবে? কবে আসবে বল...”

-“সামনের রবিবার সন্ধ্যের দিকে আসব, ছটা নাগাদ।“ কল্যাণী সম্মতি জানাতে প্রীতম বলে “আপনার বাড়ীর ঠিকানাটা একটু বলুন।“

ল্যান্ডফোন-টার তাহলে কিছু ব্যবহার এখনো আছে, ফোনটা নামিয়ে কল্যাণী ভাবে। কয়েকদিন ধরেই ভাবছিল এই লাইনটা ফেরত দিয়ে দেবে।

......


প্রীতম এল ছটার একটু পরেই। ফোনে চিনতে না পারলেও, দেখার পর চিনতে অসুবিধে হল না কল্যাণীর। যদিও প্রতি বছর অনেক ছাত্রছাত্রী এসেছে, প্রীতমকে মনে পড়ল একজন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে।

অনেকদিন পরে দেখা – প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময় করতে লাগল কিছুক্ষণ। তারপর প্রীতম যা বলল তার সারমর্ম হছে এইরকম।


স্কুলের একশবছর পূর্তি অনুষ্ঠান বেশ জাঁকজমক করে হবে। সরকারী সাহায্য ছাড়া কিছু প্রাইভেট স্পন্সরশিপ পাওয়া গেছে – তাই টাকাপয়সার কোন অভাব নেই। নাটক, আবৃতি, গান – এইসব নিয়ে সারাদিনের অনুষ্ঠান। স্কুলের পুরনো টিচার-দের সংবর্ধনা দেওয়া হবে। প্রীতমের অনুরোধ কল্যাণী যেন কয়েকটা গান করে।

কল্যাণী ভুলেই গিয়েছিল যে একদিন ও বেশ ভাল গান করত। প্রীতমের অনুরোধ শুনে আকাশ থেকে পরে “আমি? গান?”

“কেন ম্যাডাম, আপনার মনে নেই আপনি আমাদের গানের অনুষ্ঠান করিয়েছিলেন?”

“ আরে সে করিয়েছিলাম পূরবীর সঙ্গে – ও তো তোদের গানের টিচার ছিল। ওকে বলেছিস?”

“ হ্যাঁ ওনাকেও বলেছি, উনিও রাজি হয়েছেন। আপনি ‘না’ বলবেন না।“ এরপর কল্যাণী আর বেশিক্ষণ ‘না’ বলতে পারেনি – শেষে সম্মতি দিতে হল। প্রীতম এও জানাল যে রীতিমতো রিহার্সাল হবে আর কবে, কখন হবে এসব-ই ও জানিয়ে দেবে।

………।


নির্দিষ্ট দিনে স্কুলে রিহার্সাল শুরু হল। পুরনো সহকর্মীদের অনেকের সঙ্গে অনেকদিন পরে দেখা – কুশল বিনিময়, একটু কথাবার্তা-গল্পগুজব, সময়টা ভালই কাটল। সপ্তাহে তিনদিন করে হবে, বিকেলবেলা।

কয়েকদিন এভাবে কাটল, কল্যাণী এখন খানিকটা হলেও ব্যস্ত। সকালের স্কুলে ভলান্টারি সার্ভিস, দুপুরবেলা বাড়ি এসে কিছু কাজ থাকে, এরপর লাঞ্চ – তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বিকেলের দিকে পুরোনো স্কুল। রিহার্সাল। যদিও সপ্তাহে তিনদিন, এই ব্যস্ততা কল্যাণীর একটু বেশি মনে হয় কোন কোন সময়। অথচ একটা সময় এর থেকে অনেক বেশি ব্যস্ত জীবন ছিল ওর, আর সেটা সামলেছে কত সহজে। ছেলে-মেয়ের স্কুল, পড়াশুনা, নিজের স্কুল, প্রদীপ্তর অফিস, অফিসের পার্টি, আত্মীয়-স্বজন – সব মিলিয়ে ব্যস্ততা খুব বেশিই ছিল। কিন্তু নিজেকে মানিয়ে নিয়ে ছিল সেই জীবনের সঙ্গে। আসলে ওটা ছিল জীবনের একটা সময় – আর আজকের দিনগুলো অন্য একটা সময়। তুলনা চলে না। কিন্তু মনের কোথাও যেন ওই ব্যস্ততাকে ফিরে পাওয়ার একটা বাসনা থেকে গেছে।


তিন-চার সপ্তাহ যেতে না যেতেই, কল্যাণী বেশ খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এই নতুন জীবনে। এর মধ্যে একদিন স্টুডেন্ট অ্যাসোশিয়েসন থেকে দু-তিনজন এসেছিল দেখা করতে। শর্মিষ্ঠা আর দিব্যেন্দু। দুজনেই ওর পুরনো স্টুডেন্ট।

কথা প্রসঙ্গে শর্মিষ্ঠা বলল “আপনাকে দিয়ে গান গাওয়ানোর আইডিয়াটা প্রথম প্রীতমই আমাদের বলে। তখন আমরাও রাজি হয়ে যাই।“

অন্যের মুখে নিজের প্রশংসা শুনতে ভালোই লাগে, কল্যাণী তার কিছু ব্যতিক্রম নয়। তবু খানিকটা ভদ্রতা দেখানোর জন্য বলে “যাই তোরা বলিস, আমাকে এসবের মধ্যে আর না জড়ালেই পারতিস।“

“না ম্যাডাম, এটা কেন বলছেন? আমরা রিহার্সালে শুনলাম, আপনি এখনো যা গাইছেন – জাস্ট অসাধারণ।“ কল্যাণীকে চুপ দেখে শর্মিষ্ঠা আবার বলে “আমার এখনো মনে আছে স্কুলে আপনি আমাদের বেশ কয়েকবার গান করিয়েছিলেন।“

কল্যাণী স্মিত হেসে বলে “সেতো অনেকদিন আগেকার কথা – দেখি এখন কিরকম হয়। “

“ভালোই হবে ম্যাডাম, আমরা ওই ব্যাপারে সিওর।“

………


স্কুলের অনুষ্ঠান আশাতীত ভালভাবে হল।

অনুষ্ঠানের জাঁকজমক, পরিচালনা সবকিছু একদম পরিকল্পনা মাফিক হয়েছে। সকলেই খুব খুশী। কল্যাণী আরো খুশী এই কারণে যে ওর গানের অনেকেই প্রশংসা করেছে। এত জনের সামনে গাওয়া – একটু টেনশন ছিল বইকি। কিন্তু শেষ হয়েছে ভালোভাবে। প্রীতম, শর্মিষ্ঠা এবং পুরোনো সহকারীরা – সবাই দেখা করে অভিনন্দন জানিয়ে গেছে।


।।৩।।


স্কুলের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে তিন-চার দিন হল। কল্যাণী আবার নিজের অবসর জীবনে ফিরে গেছে। স্কুলের অনুষ্ঠানটা নিয়ে কয়েকদিন সত্যিই একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এখন মনে হচ্ছে মাস খানেক সময় খারাপ কাটেনি, মাঝেমধ্যে এরকম হলে মন্দ লাগে না। কর্মজীবনে মনে হত অনেক হয়েছে – এবার অবসর নিয়ে একটু বিশ্রাম নিলেই হয়। এখন তো বিশ্রামের অনেক সময়, তবু কেন…চিন্তায় ছেদ পড়ল – মোবাইলটা বাজছে।

পাশের ঘরে মোবাইলটা রয়েছে। প্রীতমের ফোন।

“হ্যালো ম্যাডাম, প্রীতম বলছি।“ – গলায় একটা ইতস্তত ভাব।

“হ্যাঁ বল।“

“আপনাকে ফোন করছি আর একটা রিকোয়েস্ট করতে-“

“আবার কি? এইতো দুদিন আগে সব শেষ হল।“ – কল্যাণী কথার মাঝখানেই বলে।

“না ম্যাডাম আমি জানি আপনি হয়ত বিরক্ত হবেন, তবু বলছি।“ কল্যাণীকে চুপ দেখে প্রীতম বলতে থাকে “আমাদের অফিসের এক অনুষ্ঠানে আপনি যদি একটু গান করতে –“ আর চুপ করে থাকতে পারেনা কল্যাণী।

“না বাবা, আমাকে আর নয় –“

“ম্যাডাম আপনার গান সেদিন অসাধারণ হয়েছে। আপনি এইটাও প্লিজ করে দিন, আমি আর রিকোয়েস্ট করব না।“ কল্যাণী আবার চুপ, মুহূর্তের জন্য। প্রীতম বলতে থাকে “ফোনে সব কথা হবে না, আমি শনিবার সন্ধ্যেবেলা আপনার বাড়ি আসব। অসুবিধে নেই তো?”

“না ঠিক আছে-”

“ওকে। আমার সঙ্গে আর একজন হয়ত আসবেন।“

প্রীতম ফোন রেখে দিলে কল্যাণী ভাবে কি শুরু করেছে ছেলেটা? সোজাসুজি ও না বলে দিলেই ব্যপারটা চুকে যেতো। কিন্তু মনের মধ্যে যে একটা ইচ্ছা আছে – সেই জন্যই বোধয় ও না বলতে পারেনি। মনে পরে প্রদীপ্তর কথা। তখনো ও অবসর নেয়নি, প্রদীপ্ত বলেছিল “চুপচাপ বসে থাকাটা অত সহজ নয়।”

......।


নির্দিষ্ট দিনে প্রীতম এল সময়মত, সঙ্গে আর একজন ভদ্রলোক। মাঝবয়সী, নাম বললেন রক্তিম। প্রথম আলাপ পরিচয়ের পর বেশিরভাগ কথা উনিই বললেন।

অফিসে একটা অনুষ্ঠান হছে মাসখানেক পরে। সেখানে একটা গীতিনাট্য পরিবেশনা হবে। তাতে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউসিক রয়েছে – সেখানে তিনটে গান গাইতে হবে। রবীন্দ্রসংগীত। অন্তত দুটো গান ওরা অনুরধ করছে কল্যাণীকে করতে কারণ সেগুলো একজন আর্টিস্টের মুখ দিয়ে গাওয়া হবে। রক্তিম ওই গীতিনাট্য পরিচালনা করছে। এই গীতিনাট্য ছাড়া আর অনেককিছু রয়েছে অনুষ্ঠানে আর শেষ হবে একজন খুব নামকরা গায়কের গান দিয়ে।

এক্ষেত্রে প্রীতমকে খুব বেশি অনুনয়-বিনয় করতে হলনা। রক্তিমের কথাতে অনেকটাই কাজ হয়েছে। কল্যাণী প্রায় রাজি।

শুধু একটা কথা বলল প্রীতমকে “এর পর কিন্তু আর নয়।“

যদিও কথাটা কেন বলল নিজেও জানেনা। শুধুই কি বলার জন্য? প্রশংসা, খ্যাতি, আর পাঁচটা জনের সান্নিধ্য – এসব তো ওর ভালই লাগে। এখনো। প্রীতম ছাত্র বলে কি ওর সামনে এগুলো প্রকাশ করতে অনিহা? নাকি এটা একটা অহংবোধ?

………


স্কুলের থেকে এখনে অনুষ্ঠানের জাঁকজমক যে অনেক বেশি হবে সেটা কল্যাণী কিছু দিন গিয়েই বুঝেছে। বেশ বড় করে হবে - তার রিহার্সাল, তোড়জোড় চলছে। একটা হল ভাড়া করা হয়েছে নিউটাউনে। কল্যাণীর সঙ্গে বেশ কয়েকজনের পরিচয়ও হয়েছে – তার মধ্যে একজন মধুমিতা। ওই এসে পরিচয় করল “নমস্কার, আমি মধুমিতা – আপনার গানে লিপ দিচ্ছি।“

-“ও নমস্কার। তা কেমন হছে ভাই আমার গান?“

-“ খুব খুব ভাল। আপনাকে নিয়ে আসার জন্য আমরা প্রীতমকে থ্যাংকস দিয়েছি।“

প্রশংসা শুনতে কল্যাণীর ভালই লাগে, একটু হেসে বলে “হ্যাঁ, ও না বললে তো আমার আসা হত না।“ ...মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল কল্যাণী – খেয়াল হল ফোন বাজছে। মেয়ের ফোন, “কি রকম চলছে তোমার রিহার্সাল?”

-“চলছে ভালই, একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছি-“

_”হ্যাঁ, সেতো বুঝতেই পারছি, নিজে ফোন করছ না। কাল ফোন করলাম বেজে গেল – মিসড কল দেখনি?”

-“না হয়ত খেয়াল করিনি, বল এখন-“

-“না এমনি কিছু বলার মত নেই। কাল ফোন করে পেলাম না তাই আজ করলাম।“

কল্যাণীকে চুপ থাকতে দেখে, মেয়ে বলতে থাকে “প্রীতম-কে একবার থ্যাঙ্কস জানিয়েছ? ও যে তোমাকে পরপর দুবার গান গাইতে সুযোগ করে দিল।“

এই কথাটা আগেও একবার ও কল্যাণীকে বলেছিল। একটু ইতস্তত ভাবে কল্যাণী জবাব দেয় “না বলব। একদিন সুবিধামত বলব। আসলে আমার এসব খুব ভাল লাগেনা, তাই ভাবি ‘থ্যাংকস’ জানালে যদি আবার রিকোয়েস্ট করে।“

-“ভাল লাগেনা তো করছ কেন? ওকে বলে দাও করতে পারবে না।“

এর কোন উত্তর নেই কল্যাণীর কাছে।

মেয়ে আবার বলে “আসলে আমার মনে হয় উলটোটা। তোমার এগুলো ভালই লাগছে আর সেইজন্যই করছ। এরমধ্যে ভুল তো কিছু নেই আর সময়ও কাটছে। ওকে একটা ‘থ্যাংকস’ জানাতে কি অসুবিধে আছে?”

একমত হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখতে পায়না কল্যাণী। “হ্যাঁ, এই প্রোগ্রামটা হয়ে যাক, বলে দেব।“

......।


এতো প্রশংসা পাবে কল্যাণী ভাবেনি। সব মিলিয়ে অনুষ্ঠান ভাল হলেও, প্রায় সবাই কল্যাণীর গানের প্রশংসা করেছে। এটা ওর কাছে সবথেকে বড় পাওনা। অনুষ্ঠান শেষে প্রীতম এসেছিল দেখা করতে “ম্যাদাম, আজ সব কথা হবে না, আমার আজ প্রচুর কাজ। আমি একদিন আপনার বাড়ি আসব।“

-“না না ঠিক আছে, বুঝতেই পারছি তুই আজ খুব ব্যস্ত।“

-“আমাদের অফিসের একটা গাড়ি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। আপনি এখানেই ওয়েট করুন, ড্রাইভার এসে নিয়ে যাবে-“ বলে প্রীতম বিদায় নেয় সেদিনের মত।

.........


প্রীতমের হাতে একটা মাঝারি সাইজের গিফট প্যাক।

সেটা কল্যাণীর হাতে দিয়ে ও বলে “এটা একটা ছোট গিফট আমাদের অফিসের তরফ থেকে, মেমেনটো বলতে পারেন। যারা সেদিন ওখানে গান বা নাটক করেছে, তাদের আমরা দিয়েছি।“

কল্যাণী প্রীতমের মুখোমুখি একটা সোফায় বসলে, প্রীতম কথা শুরু করে।

“ম্যাডাম, আমি দিল্লী চলে যাচ্ছি – মানে অফিস থেকে ট্রান্সফার হয়ে গেছি। পরের সপ্তাহে যাব।“

কথাগুলো কল্যাণীর ঠিক কানে ঢুকল না।


প্রীতম বলতে থাকে “আর একটা খবর। আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, সামনের ফেব্রুয়ারিতে – আমি আপনাকে ফোন করব আর কার্ড পাঠাবো। আপনি অবশ্যই আসবেন।“

মাথাটা ঘুরতে থাকে। বুঝতে পারে না কি বলবে। জোর করে একটু স্মিত হাসি মুখে এনে কল্যাণী জিগ্যেস করে “কবে যাচ্ছিস দিল্লী?”

-“ওই যে বললাম, আগামী সপ্তাহে।“

-“ওঃ”

প্রীতম আর বেশীক্ষণ বসেনি। কল্যানীও ওকে অনুরোধ করেনি। এমনকি ‘থ্যাংকস’ টা জানাতেও ভুলে গেছে। জানাবে পরে কোন সময়ে। আজ সম্ভব ছিলনা। কিছুদিনের জন্য হলেও ছেলেটার জন্য ওর জীবনে একটা বৈচিত্র্য এসেছিল। সেই সময়টা কেটে গেছে। কল্যাণী ফিরে যাবে তার ‘অবসর’ জীবনে। একার জগতে , যেটা এখন বাস্তব।


কোনমতে নিজেকে সামলে, টিভির সুইচ টা অন করে কল্যাণী।





Comentarios


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page