কবিতা - কবিতার শিশুশিক্ষা
- দেবাশিস ভট্টাচার্য
- Dec 2, 2018
- 2 min read
Updated: Feb 20, 2021
কবিতার কিনডারগারটেনে আমি বসে থাকি
অনেক শিশুর মধ্যে একা
এখনো তো ভাল করে খড়ি ধরতে শিখি নি
ব্লাকবোর্ড হোয়াইট বোর্ড বেয়ে বৃষ্টির বারিধারা নামতে দেখে
মুখে আঙ্গুল পুরে ভাবি
ভাবতে ভাবতে তেষ্টা পেয়ে যায়
কবিতার কিনডারগারটেনে শিশুশিক্ষার পোস্টারগুলি পড়তে পারি না
কিন্তু তাদের উজ্জ্বল বেগুনি হলদে বাসন্তী জয়বাসন্তী রং
আমার দুচোখ জ্বালিয়ে দিয়ে যায়
এখনো ঠিক ভাল করে খড়ি ধরতে শিখি নি
কিন্তু ঘরের ছাদ থেকে ফাটলের সবুজাভ দাগ
আমার শিশু বুকে কোদালের মত ঘা দেয়
বিকেলে মা নিতে আসবে জানি
জিগ্যেস করবে টিফিন খেয়েছি কি না
আমার নিঃসঙ্গ আঙ্গুলে খেলা করে
লতানো সরীসৃপের মত
অন্য শিশুদের ক্রোধ ঈর্ষা লোভ
তাদের থেকেও না থাকা
কবিতার কিনডারগারটেনটি ক্রমশ নির্জন দুপুরের রোদ্দুরে তলিয়ে
যেতে থাকে
একটা নিষিদ্ধ গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে ক্রমশ বড় হতে হতে
গোটানো প্যাপিরাসের মত খুলে যায়
আমার শিশু মন বুঝতে পারে না
শুধু আঙ্গুল নিশপিশ করে
কতক্ষণে কয়েকটি ভাঙ্গাচোরা অক্ষর সাজাবে।
আমার শাদা শার্ট আর নীল প্যান্ট কিনডারগারটেনের আয়নায়
একটু ঝাপসা হলেও দেখা যায়, কিন্তু আমার মুখ দেখা যায় না
লাল মাটির পাত্রে জলমগ্ন লতার মত
আমার বিস্ময়াহত বালক মুখখানি
কিনডারগারটেনটিকে খুঁটিয়ে দেখে, পরীক্ষা করে
কোথাও একটা ওলটানো ছেঁড়া খাতা, কোথাও একটা পেন্সিল কাটার ছুরি
রং পেন্সিল লাল নীল বেগুনি হলুদ
কিনডারগারটেনের মাঠে দোলনা চেয়ার জাঙ্গল জিম
আর শৈশবের তীব্র মান অভিমান হিংসা
আমার নির্জন চোখে যতদূর দেখা যায় মাঠের মতন অকথ্য সবুজ
একটা লাল জ্বলন্ত মশালের মত পেন্সিল নিয়ে আমি হাঁটু গেড়ে বসি
কিনডারগারটেনের দেয়ালের এক কোণে
নিজেকে উন্মুক্ত করে দি ।
বিকেলে মা নিতে এলে ছুটতে ছুটতে মায়ের হাত ধরে
রাস্তার উপর ফুচকা ঝালমুড়ি হজমি আইসক্রিম রোল
রাস্তায় আমার শৈশব ছাড়া পেয়ে দাপাদাপি করে
কবিতার কিনডারগাটেন পড়ে থাকে তালাবন্ধ, লতাপাতার বেড়ার আড়ালে
দ্বীপের মত, করুণ, আমি অন্য সব কিছু নিয়ে ভুলে থাকি
যতক্ষণ না আবার পরের দিন মার হাত পৌঁছে দিয়ে যায়
কবিতার কিনডারগারটেনে।
কবিতার কিনডারগারটেন আসলে ঠিক কোথায় তা বলতে পারব না
মা নিয়ে যায় হাত ধরে
একেকদিন একেকটা পথে
মাঝে মাঝে বাঁধানো রাস্তা থেকে কাঁচা রাস্তা, একটা পাঁচিলের ফুটো দিয়ে
বেড়ালের মত গলে
সিঁড়ি ভেঙ্গে জলপ্রপাতের শব্দ অনুসরণ করে
মৃত ও জীবিতদের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে
যে ইষ্টিশানে দাঁড়িয়ে একা একটি রেলগাড়ি বৃষ্টিতে ভিজছে
তারই কোনও একটি ল্যাম্পপোস্টের তলায়
কেউ এসে আমায় একটা লজেন্স দিয়ে বলছে
নাও খোকা আশ্চর্য লজেন্স
আমার জিভে তার স্বাদ অনেকদিন পুরনো বইয়ের গন্ধের মত,
তার মধ্যে সামান্য নোনতা স্বাদ, আমার শুকিয়ে যাওয়া কান্নার জলবিন্দুর মত
কবিতার কিনডারগারটেন মাঝে মাঝে রাত্রিবেলা চাঁদের আলোয়
দিকনির্দেশহীন ভেলার মত ভেসে যায়
গভীর থেকে আরও গভীর অন্ধকারে
মা, তখন ভয়ানক একা লাগে।

Comments