ইউলিসিস
- দীপাঞ্জন মাইতি
- Dec 2, 2018
- 2 min read
Updated: Feb 20, 2021
সাধারণত যে কোনো কবিতার দু'টি মূল উপলব্ধি কেন্দ্র থাকে। একটি কবির এবং একটি পাঠকের। প্রতিটি পাঠক আবার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে একই সৃষ্টিতে অজস্র আঙ্গিক খুঁজে পেতে পারেন। অনুবাদ সাহিত্যে প্রধানত দুইটি প্রচলিত কাঠামো বিদ্যমান - আক্ষরিক অনুবাদ এবং ভাবানুবাদ। আমি আমার এই প্রচেষ্টায় লর্ড টেনিসনের 'ইউলিসিস' কবিতাটির ভাবানুবাদ করার চেষ্টা করছি।
ইউলিসিস কবিতাটির বিষয় বস্তু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বহন করে। ইউলিসিস চরিত্রটি টেনিসন ধার করেছেন প্রাচীন গ্রীক পণ্ডিত হোমারের দুই মহাকাব্য ইলিয়ট এবং ওডিসি থেকে। ওডিসি মহাকাব্যের নায়ক ওডেসিয়াস এর লাতিন নাম হল ইউলিসিস। ইলিয়ট মহাকাব্যে বিখ্যাত ট্রয়ের যুদ্ধ পর্বে ওডেসিয়াসের সাথে পরিচয় পাওয়া যায় যুদ্ধ বীর এবং দক্ষ কূটনীতিক রূপে। ওডেসিয়াসের যুদ্ধশেষে নিজের রাজ্য ইথিকায় ফেরার দশ বছরের রোমাঞ্চকর যাত্রা পর্ব নিয়ে লেখা হয়েছিল ওডিসি।
ইউলিসিস কবিতায় টেনিসন ওডেসিয়াসের ইথিকায় ফেরার পরবর্তী সময়কালের কথা তুলে ধরেছেন। ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন বৃদ্ধ ইউলিসিসের মানসিক অবস্থা; তাঁর মনের বাসনা, মনের কথা। এবং এই চেষ্টায় সাহিত্য আলোচকদের মতে কেবল হোমার নন টেনিসনের উত্তরসূরিদের মধ্যে বিশেষত দান্তে এবং সেক্সপিয়ারের প্রভাব পড়েছে বেশ স্পষ্টভাবে।
এখানে একটি বিষয় অবশ্য উল্লেখ্য কবিতাটি টেনিসন যখন লেখেন তাঁর বয়স ২৪-২৫ বছর মত। সদ্যপ্রয়াত প্রিয় বন্ধু আর্থার হেনরি হ্যলানের মৃত্যুতে তখন টেনিসন বিপর্যস্ত, বিপন্ন। কবিতাটির বিষয়ে টেনিসন নিজে লিখেছিলেন - "ইউলিসিসে আমি যেন বেশীটা আমার কথায় লিখেছি। তখন আমি নিজেকে বোঝাতে চাইছি জীবনে যা হারিয়ে যায় তা হারিয়ে গেলেও বাঁচার লড়াইটা লড়ে যেতে হয় একদম শেষ অবধি। হ্যলানকে উৎসর্গ করা কবিতাগুচ্ছের থেকে তাকে হারানোর বেদনা এ কবিতায় অনেক অনেক বেশী প্রভাব ফেলেছে।" অনুবাদের চেষ্টায় টেনিসনের এই পরিস্থিতি, কবিচেতনা এবং ওডেসিয়াসের চরিত্রচেতনা দুই'কে মেলানোর চেষ্টা করেছি আমি। যুগোপযোগী এবং ব্যাপ্তির স্বার্থে ট্রয়, আকিলিস ইত্যাদি প্রেক্ষাপট পাল্টানো হল।
বৈষম্যের সত্যিকে অস্বীকার করতে ব্যর্থ -
এই রুক্ষ অনুর্বরা পৃথিবীর অলস সম্রাটের কি বা গর্বের হতে পারে!
প্রতি মুহূর্তের আলস্যে আমি -
অপ্রয়োজনীয় আসবাবের ভিড়ে এভাবেই
সমগোত্রীয়দের মাঝে হারিয়ে ফেলছি নিজেকে।
আমি পথিক, পথ ছেড়ে আমি অস্তিত্ব ভুলেছি নিজের,
যে পথে আমি লড়েছি, হেরেছি, জিতেছি, ছুঁয়ে দেখেছি বৃষ্টিকে -
তার বুকে খোদাই করা আছে আমার নাম।
কত শহর, কত জন, কত বিবিধ আচরণ পেরিয়ে এসেছি আমি যাপন ধারাপাতে;
আমার হৃদয় সাক্ষ্যী সেই টুকরো টুকরো অস্তিত্বের সমষ্টিই তো আমি!
তবু কত পথ.. এখনও বাকি..
সময়ের প্রতি পদক্ষেপে অজস্র অনুরূপ সত্যি হারিয়ে যাচ্ছে অবহেলায়,
অবশিষ্টটুকু; আমি ছুটে যেতে চাই, চুরি করে আনতে চাই মৃত্যুর কাছ থেকে,
তার বিনিময়ে আমি অস্তগামী তারার মত দিকচক্রবালের অন্তিম ব্যাপ্তি পেরিয়ে আত্মার ধূসরতায় বিলীন হতে রাজি।
আগামী প্রজন্মের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, স্বস্তির আকাঙ্খা আমি মেনে নিয়েছি,
প্রত্যেকের আপন যাপনসীমা থাকে এবং
প্রত্যেকে তার তার নিজ নিজ বৃত্তে ঈশ্বর,
আর ঠিক এভাবেই সে তার মত; আমি আমার মত।
যেমন আমি শুনতে পাচ্ছি ঐ দূর বন্দরের আহ্বান -
সে কেবল আমাকে নয় তোমাদেরকেও... আমার আমিত্বের সহযাত্রীদের
হাত নেড়ে ডাকছে অচেনা দিগন্তের অভিমুখে।
এসো মহাসমারোহে এগিয়ে যায় আমরা -
পাল তোলো বন্ধুবর.. জাহাজের, পাখনা মেলো আমার সাথে,
এই অলস জীবনের আতিশয্য পেরিয়ে চল সমুদ্রের বুক চিরে
পেরিয়ে যাই গোধূলি সীমান্ত। হয়ত ওখানেই মৃত্যুর বাস!
হয়ত ঐ পারে পিছু ফেলে আসা কোনো প্রিয় বন্ধু অপেক্ষায় আছে আমাদের!
পঞ্জিকামতে ব্যাপ্ত বয়সে আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত আমাদের শরীর আজ দুর্বল হলেও
হৃদয়ক্ষেত্রে আমরা আজও ঠিক তেমনই বীর;
হয়ত কালের খেয়ালে নিয়তি..
এমন কি সময়ও আমাদের পক্ষ ত্যাগ করতে পারে,
তবু আমাদের ইচ্ছাশক্তি কেউ কেড়ে নিতে পারবে না,
আমরা ভেসে যাবো অজানার পথে অনন্তের পথযাত্রী হয়ে।

Comments