বড় গল্প - পারফেক্ট স্কোয়্যার
- পার্থ সেন
- Aug 3, 2018
- 42 min read
Updated: Feb 19, 2021

ইতিহাসের পাতা থেকে -
এই কাহিনীর কেন্দ্রস্থল উত্তরবঙ্গে উল্লাসপুর নামের এক সুবিশাল এস্টেট কে ঘিরে। আজকের যে জায়গাটা কুচবিহার শহর বলে পরিচিত সেখান থেকে বেশ খানিকটা দক্ষিনে এলে আসে দিনহাটা। আর দিনহাটা থেকে পূর্বে খানিকটা গেলে পড়ে ধুবড়ী, আরো দক্ষিনে খানিকটা গেলেই বাংলাদেশের সীমানা, সেটা পেরিয়ে বড়শহর কুড়িগ্রাম। দিনহাটা, ধুবড়ী আর কুড়িগ্রাম এই তিন জায়গা যেন একটা ত্রিভুজের মত, আর এই তিন জায়গা নিয়ে সে সময়ে এক সুবিশাল এলাকা ছিল উল্লাসপুর। স্থানীয় মানুষরা বলেন, নেহাত দেশ ভাগ হয়ে গেল তাই, নয়তো স্বাধীন ভারতে সবচেয়ে বড় জেলার মর্যাদা পেতে পারত এই উল্লাসপুর। যাহোক, এ ১৯৪২-৪৩ এর কথা, তখন অবিভক্ত ভারতে এই উল্লাসপুরের এস্টেটের দায়িত্বে তখন ছিলেন রায় রাজপরিবার।
যে সময়ের কথা বলছি তখন এস্টেটের জমিদার তিমির বরন রায়, সুদক্ষ জমিদার, পন্ডিত মানুষ, বাংলা, ইংরাজী, সংস্কৃত তিনটি ভাষায় সমান দক্ষ, একদিকে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে যেমন দহরম মহরম, অন্যদিকে রংপুরের রাজারও খুব কাছের মানুষ। রায়দের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক ছিল বরাবরই মধুর। রায়দের দুর্গাপূজার সময় মহাষষ্ঠীর উদ্বোধনের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রন যেত বাংলার গভর্নরের কাছে। তিমিরবরনের পিতামহ অনাদিশঙ্কর ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে রায়বাহাদুর উপাধি তে ভূষিত হয়েছিলেন। তিমিরবরনের বড়ছেলে কিরনশঙ্কর রায়, তিনি খেলাধুলায় যেমন তুখোড়, জমিদারী এবং ব্রিটিশ আদবকায়দায়ও সমান চৌখস, আবার পড়াশোনাতেও ছিলেন একেবারে প্রথম সারীর ছাত্র। রংপুর জেলা স্কুল পেরিয়ে, কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়াশোনা করেছেন, তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। বাবার ইচ্ছে ছিল ডাক্তারী পড়া, কিন্তু কিরনশঙ্কর গনিতশাস্ত্রকে বড় ভালোবেসে ফেলেছিলেন। তাই আর ডাক্তার হওয়া হল না। তার ওপর ঢাকায় সঙ্গ পেয়েছিলেন আর একজন মহান মানুষের, যিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডীন’। কয়েক বছর আগে কবিগুরু বিজ্ঞানের ওপর লেখা নিজের বই ‘বিশ্ব–পরিচয়’ উৎসর্গ করেছেন তাঁকে, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক, নীলস বোর, অ্যালবার্ট আইন্সটাইনের যুগান্তকারী সৃষ্টি কোয়ান্টাম মেকানিক্সে যিনি নিয়ে এসেছেন এক নতুন কনা, নাম দিয়েছেন ‘বোসন’। তো সেই ঢাকাতেই রিসার্চ শুরু হল, সাথে রইলেন পদার্থবিজ্ঞান এবং গনিতের আর এক অসাধারণ ছাত্র, নাম জন এডওয়ার্ড বিডওয়েল। কিরনশঙ্কর আর এডওয়ার্ড ছিলেন প্রেসিডেন্সীর ক্লাসমেট, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়েও একসাথে, এক ক্লাসে। এডওয়ার্ডদের আবার তিন পুরুষ ধরে বাস এই ভারতে, তাঁর দাদু ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রেসিডেন্ট, বাবা ছিলেন ডাক্তার, ঢাকা জেনারেল হাসপাতালে চাকরি করতেন। পরিচয়ে ব্রিটিশ হলেও এডওয়ার্ড ছিলেন আদপে পুরো ভারতীয়।
কিছুদিন গবেষণা এগোলেও হঠাৎই অবস্থাটা কেমন পালটে গেল, ১৯৪২ সালের শেষের দিকে। মহাত্মা গান্ধী তখন ডাক দিয়েছেন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে, সুভাষ বোস ভারতের বাইরে থেকে বিপ্লবের পরিকল্পনা করছেন, সারা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা তখন উত্তাল, দেশভাগের আতঙ্কে মানুষ তখন নিয়মিত ত্রস্ত, চারদিকে ধরপাকড় আবার এখানে ওখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এদিকে কথা চলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কিরনশঙ্কর এবং এডওয়ার্ডের শিক্ষাগুরু সত্যেন্দ্রনাথ বসু হয়তো চলে যাবেন কলকাতা। এইরকম সময়ে মাত্র দুদিনের জ্বরে তিমিরবরন রায় পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে চলে গেলেন। কিরনশঙ্করকে এসে এস্টেটের এবং সংসারের হাল ধরতে হল। ইতিমধ্যে বেশ বোঝা যাচ্ছে, ব্রিটিশ শাসন শেষ হয়ে আসছে। লালকেল্লায় তিরঙ্গা উড়তে আর কয়েক বছরের অপেক্ষা মাত্র, এডওয়ার্ডের পরিবার বর্গ তখন ভাবতে শুরু করলেন সব নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার কথা। রিসার্চটা আর শেষ হলনা। কিরনশঙ্কর এস্টেটের হাল ধরলেন, আর এডওয়ার্ড চলে গেলেন জার্মানি। ফিজিস্ক আর গনিতে পান্ডিত্য তো ছিলই, তাই এক বছরের চেষ্টায় ইঞ্জিনিয়ারিং ট্রেনিং শেষ করে চাকরি পেলেন জাহাজে।
১৯৪৪ এর শেষের দিক, ভূমধ্যসাগরের উপকূলে গ্রীসের সবচেয়ে বড় বন্দর পিরেইয়াস থেকে এক যাত্রীবাহী জাহাজ রওনা হল গন্তব্য মার্সেই, ফ্রান্সের দক্ষিনে আর এক সুবিখ্যাত বন্দর। জাহাজে ক্যাপ্টেনের দায়িত্বে জন এডওয়ার্ড বিডওয়েল। চারদিন পেরিয়ে গেছে, জাহাজ তখন অ্যাড্রিয়ট সাগর পেরিয়ে আয়োনিয়ান সাগরে পড়েছে, ঠিক এই রকম সময়ে চারপাশ কালো করে এল প্রচন্ড ঝড়। উত্তাল সমুদ্র, প্রবল হাওয়া, প্রচন্ড বৃষ্টিতে যাত্রীবাহী জাহাজ টাল খেয়ে নিজস্ব গতিপথ হারালো। ঘন্টা খানেকের প্রবল চেষ্টার পর যখন জাহাজকে আর বাগে আনা যাচ্ছেনা, বোঝা গেল জাহাজের পশ্চিম কোনে একটা ছোট ফাটল ধরেছে আর সেখান দিয়ে জাহাজে জল ঢুকতে শুরু করেছে। বাকীদের কথা জানা নেই, তবে এডওয়ার্ড বিডওয়েল কিন্তু মাঝসমুদ্রে সেই ডুবন্ত জাহাজ ছেড়ে পালালেন না। তখন আইএমও র আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিয়মের আওতায় সমস্ত যাত্রীবাহি জাহাজ আসতো না। তাই নিয়ম মেনে যে সংখ্যার লাইফবোট রাখা দরকার, দুর্ভাগ্যচক্রে তাও ছিল না এডওয়ার্ডের জাহাজে। মাত্র বারোটা লাইফ বোট, দুশোর ওপর যাত্রী। কিছু মহিলা আর শিশু যাত্রী আর অসুস্থ মানুষকে বের করে দেওয়া হল লাইফবোটের সাহায্যে, নির্দেশ রইল নিকটবর্তী ইতালির দক্ষিনে মাল্টাতে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হবে। এডওয়ার্ড কাজ শুরু করে দিলেন জাহাজের ফাটল মেরামত করতে। কারণ সেটা ছাড়া বাকীদের সলিলসমাধি তো আটকানো যাবে না। সারা রাত ধরে চেষ্টা করলেন একা এডওয়ার্ড, বরফশীতল জল, প্রবল ঝড়, বৃষ্টি সকল কিছুর সঙ্গে একা লড়াই করলেন, সঙ্গে আর কেউ নেই।
পরদিন সূর্য উঠতে দেখা গেল জাহাজে আর জল ঢুকছে না, যদিও জাহাজ গতিপথ হারিয়েছে তবে সেটা সমুদ্রে ভাসমান, যাত্রীরা সবাই ভীত, সন্ত্রস্ত তবে তাঁরা সবাই নিরাপদ, ক্ষুধার্ত তবে প্রাণ হারানোর ভয় থেকে মুক্ত। খালি জাহাজে নীচের ডেকে একজন মানুষ নিঃসাড়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। প্রায় একশো পঞ্চাশ জন যাত্রীর প্রাণ বাঁচিয়ে নিজেকে আর বাঁচাতে পারেননি, জাহাজের ক্যাপ্টেন জন এডওয়ার্ড বিডওয়েল।
[১]
সকালেই মিসড কল টা দেখেছিলাম কিন্তু সময় পাইনি বলে আর করা হয়ে ওঠেনি। অফিস থেকে ফিরে বাড়িতে দরজা খুলছি, এমন সময়ে আমার ফোনে টেক্সট মেসেজ টা ফুটে উঠল, ইংরাজি হরফে লেখা তবে বক্তব্যটা বাংলায়, “জানি না আমাকে মনে আছে কিনা? আমি বীরভুম জেলা স্কুলের অভিজিত, সময় পেলে একটা ফোন করিস”।
আজ প্রায় কুড়ি বছর বাদে অভিজিতের সঙ্গে যে এইভাবে যোগাযোগ হবে সে আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি! অভিজিত আর আমি তথাগত, বীরভুম জেলা স্কুলে আমরা সেই ক্লাস ফাইভ থেকে একসাথে পড়েছি ক্লাস টুয়েল্ভ পর্যন্ত। পড়াশোনা একসাথে করলেও আসলে আমরা ছিলাম ফুটবল খেলার বন্ধু। অভিজিত ছিল গোলকিপার আর আমি ছিলাম স্টপার ব্যাক। প্রায় সাত বছর ধরে খেলার পর আমাদের দুজনের বোঝাপড়া ও ছিল খুব ভালো আর ভাব ও ছিল খুব। আমি আবার ছিলাম আমাদের ক্লাস টীমের ক্যাপ্টেন, সেটা অবশ্য খেলার পারদর্শিতার জন্য নয়। আসলে আমি ছিলাম সকলের কাছে খুব অ্যাক্সেপ্টেবিল! তাই গোপাল স্যার, মানে আমাদের খেলার স্যার আমাকেই সব সময়ে ক্যাপ্টেন করতেন! কিন্তু স্ব্বীকার করতে লজ্জা নেই প্লেয়ার হিসেবে আমি খুব ভালো ছিলাম না! আর অভিজিত ছিল কিন্তু সত্যি অসাধারন গোলকিপার। নিজে খেলার পাতার রিপোর্টার বলে আরো বলছি, টিভির পর্দায় আন্তর্জাতিক গোলকিপারদের বাদ দিলে আমি কিন্তু অভিজিতের মতো গোলকিপার বেশী দেখিনি। কত খেলায় যে ও আমার মিস ক্লিয়ারেন্স বাঁচিয়েছে বা আমাদের গোটা টীমটাকে কত লাইফ লাইন দিয়েছে সে বলতে গেলে একটা উপন্যাস লেখা হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু খেলা ছাড়া অন্য ব্যাপারে অভিজিত ছিল একেবারে উদাসীন, স্কুলের হোম ওয়ার্ক কখনো শেষ করতো না, ক্লাস চলাকালীন প্রায় কি রকম ভাবুক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতো! একবার তো ক্লাস নাইনে ফাইনাল পরীক্ষায় জীবনবিজ্ঞান পরীক্ষার দিন ও ইতিহাস পড়ে চলে এসেছিল। যাই হোক এত উদাসীন ছাত্রের উপর সরস্বতীদেবী তো সাধারনত প্রসন্ন হন না। আর হন ও নি! তাই অভিজিতের রেজাল্ট ও ভালো হয়নি! স্কুলের পর আমার আর ওর পথ আলাদা হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ, অভিজিতরা ছিল একেবারে সত্যিকারের বড়লোক! যদিও ডিটেলে জানতাম না তবে এটা আমরা সবাই জানতাম, দিনাজপুর না কুচবিহার কোথায় যেন অভিজিতদের বিরাট জমিদারি আছে। তা সেই অভিজিত এতোদিন বাদে?
ফোন ঘোরাতে বেশী সময় লাগেনি, বাইশ বছরের জমে থাকা কথা শেষ করে কাজের কথায় আসতে বেশ করেক মিনিট লাগল। কথায় কথায় জানলাম অভিজিত এখন ঘোর সংসারী, দক্ষিন কলকাতার এক কলেজে অ্যাকাউন্টসে কাজ করে। পাকাপাকি ভাবে কলকাতাবাসী, বাশদ্রোনীতে থাকে, বাড়ি করেছে, এক মেয়ে, ক্লাস নাইনে পড়ে। জানতে ইচ্ছে করল বিশেষ করে, তাই জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু উত্তরটা পেয়ে অবশ্য ভালো লাগেনি। স্কুলের পর আর সে কখনো ফুটবলে পা দেয়নি। এমনকি খেলাও নাকি আর সে দেখে না, বলল “যা চাপ সংসারে! খেলা টেলা সব মাথায় উঠেছে”। কাজের কথা বলতে যেটা বুঝলাম সে আমার সাথে দেখা করতে চায়, আর ব্যাপারটা সে ফোনে বলতে চায় না। ঠিক হল কাল সকালে দেখা হবে।
আমি ঠিক সময়ে পৌঁছেছিলাম, অভিজিত মিনিট দশেক লেট। বাইশ বছর পেরিয়ে গেলেও অভিজিত কে চিনতে আমার কোন অসুবিধা হয়নি। খালি তার মাথার মাঝখানটা খালি হয়ে গেছে আর চোখে একটা মোটা পাওয়ারের চশমা বসেছে। একটা ছোট রেস্টুরেন্টে বসে কথা হচ্ছিল। কাজের কথায় আসতে অবশ্য বেশী সময় লাগেনি,
স্কুলে পড়তে যেটা শুনেছিলাম অভিজিতদের নাকি বিরাট জমিদারী আছে, সেটা সত্যি। কুচবিহারের দক্ষিনে উল্লাসপুর বলে এক জায়গায় তাদের সাত পুরুষের জমিদারী। দেশভাগের পর যদিও অনেকটা জমি পূর্ব পাকিস্তান মানে বাংলাদেশে চলে যায়, তবুও যা এখনো আছে তা দিয়ে গুটি কয়েক কলেজ, হাসপাতাল হয়ে যায়। এখনো সেখান থেকে তাদের নিয়মিত আয়ের ব্যবস্থা আছে এবং সে আয়ের পরিমান কিছু কম নয়। যদিও বর্তমান এবং আগের জেনারেশনের বেশীর ভাগ উত্তরাধিকারীরা বিভিন্ন চাকরীর সাথে যুক্ত এবং তাদের মধ্যে বেশ কিছু সমাজে উচ্চ প্রতিষ্ঠিত, তবুও জমিদারী ব্যাপারটা এখনো বেশ রমরম করে চলছে। অভিজিতের বাবা সৌরীন রায় বর্তমানে সেই এস্টেটের চেয়ারম্যান।
প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো সেই জমিদারী পরিবার, যার ইতিহাসও খুব সমৃদ্ধ। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে অবিভক্ত ভারতের উত্তরপূর্বে যে গুটি কয়েক ধনী বাঙালী পরিবার ছিলেন তার মধ্যে এঁরা ছিলেন অন্যতম। এক সময়ে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে নাকি এঁদের একসাথে ওঠা বসা ছিল। শোনা যায়, এক সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ও নাকি এঁদের এস্টেটে হয়েছে। রংপুরে ব্রিটিশ ঘাঁটি হবার আগে পর্যন্ত এঁদের এস্টেটেই নাকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অফিস ছিল। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি অবস্থাটা পালটায়, স্বাধীনতা আন্দোলনের জোর হাওয়া তখন। আর শোনা যায় সে সময়ে এই পরিবারের বেশ কিছু মানুষ নানান জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত নন। যদিও ইতিহাসে কোথাও কোন উল্লেখ নেই তবে অভিজিত শুনেছে, সুভাষ বোসের সঙ্গে নাকি এঁদের যোগাযোগ ছিল। এমনকি নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজের ডাকে এঁদের পরিবার থেকে বেশ কিছু অর্থনৈতিক সাহায্যও করা হয়।
গত মার্চ মাসে ডঃ দেবকুমার মিত্র নামে এক ইতিহাসের প্রফেসর যিনি আগে বহরমপুর কলেজে পড়াতেন, প্রায় বছর দশ বারো হল রিটায়ার করেছেন, তিনি তাদের এই উল্লাসপুরে আসেন। অভিজিতের বাবা আবার ছিলেন এনার সহপাঠী। ডঃ মিত্র কোথাও তাদের জমিদারী নিয়ে বিস্তৃত ভাবে পড়াশোনা করেছেন এবং সে নিয়ে রিসার্চ করতেই তাঁর আসা। আর একটা উদ্দেশ্যও নাকি ছিল, যদিও অভিজিত সঠিক করে সেটা বলতে পারল না। ‘ইন্ডিয়া টুডে’ তে নাকি তিনি কোন আর্টিকিল পড়েছিলাম বাংলাদেশের পুরোনো জমিদার বাড়ি নিয়ে। তাই গত বছর খানেক ধরে বিভিন্ন পুরোনো জমিদারী ঘুরে দেখছিলেন। যাই হোক, রায় জমিদার বাড়ির লাইব্রেরীতে বসে পড়াশোনা আর এস্টেটের এখানে সেখানে ঘুরে ঘুরে বেশ দিন কাটছিল ডঃ মিত্রর। অভিজিতের বাবাও বিশেষ ভাবে যত্ন করে অতিথি সেবা করছিলেন। তা এই ডঃ মিত্র দিন তেরো চোদ্দ পরে হঠাৎ করে একদিন সকালে বেরিয়ে আর ফিরলেন না। সারা উল্লাসপুর খোঁজা হল, থানা পুলিশ হল, ডঃ মিত্রের বাড়িতে খবর গেল, কিন্তু কোন খবর পাওয়া গেল না। কাছাকাছি স্টেশন বলতে সেই কুচবিহার, সেখানেও খবর নেওয়া হল, কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। কি রকম যেন কর্পূরের মত উবে গেলেন সেই ভদ্রলোক।
অভিজিতের বাবার মন ভেঙে যায়, একে বয়স সত্তরের ওপর, তার ওপর নিয়মিত থানাপুলিশ নিয়ে তাঁকেও যথেষ্ট নাজেহাল হতে হয়। নেহাত জমিদারী এখনো আছে, ওপরমহলে চেনাশোনাও আছে, তাই পুলিশ ছুঁতে পারেনি। কিন্তু অনেক জায়গায় কারনে, অকারনে অসম্মানিত হয়েছেন। তাই ওনার ইচ্ছে যদি কেউ এসে ব্যাপারটা একটু তদন্ত করে দেখে আসলে ব্যাপার টা কি হল! উল্লাসপুরের মত একটা ছোট জায়গা থেকে একজন বাহাত্তর বছরের মানুষের উধাও হয়ে যাওয়া সত্যি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাহলে তিনি গেলেন কোথায়? অবশ্যই ব্যাপারটার মধ্যে খানিকটা তাদের সম্মান এবং প্রতিপত্তি জড়িয়ে আছে।
বেশ খানিকক্ষন এক নাগাড়ে কথা বলে এবারে থামল অভিজিত, আমরা দুজনেই সিগারেট ধরালাম, আমি প্রথম কথা বললাম, “কিন্তু আমি তো ক্রাইম রিপোর্টার নই রে? তাহলে আমি কি করে তদন্ত করব বলতো?”
“আরে রিপোর্টাররা ওসব জানে, তোরা তো পড়াশোনা করিস ঐ সব নিয়ে। আর তাছাড়া, তোর তো চেনাও থাকতে পারে! দ্যাখ, বাবা আজে বাজে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর রাখবেন না, আর নিজেও প্রচুর পড়াশোনা করেন। জেনুইন লোক না হলে বাবা রাজী হবেন না! তুই একটু ভেবে দ্যাখ না! প্লীজ! ব্যাপারটা নিয়ে সত্যি বাবা কি রকম মুচড়ে পড়েছেন। বহু খুঁজে তোকে বার করেছি, প্লীজ একটু দ্যাখ”
“দ্যাখ লালবাজারে আমার অনেক চেনাশোনা আছে, তুই যদি বলিস আমি কিন্তু কথা বলতে পারি”
“নারে প্লীজ, বাবা স্পেশালি বারন করেছেন পুলিশের সাহায্য না নিতে। তুই অন্য কিছু ভাব”
চেনাশোনা যে আমার নেই তা নয়, অভিজিত আমার স্কুলের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। তার বাড়িতে সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর খুঁজে বার করতে আমার দশ মিনিটের বেশী লাগত না। কিন্তু আমার মন বলছে একজন যাহোক তাহোক গোয়েন্দার দ্বারা এ হবার নয়। যদিও আমি উল্লাসপুর চিনি না, তবে একটা এস্টেট থেকে একজন আপাতনিরীহ সত্তর-বাহাত্তর বছরের রিটায়ার্ড প্রফেসরের ভ্যানিশ হয়ে যাওয়াটা যথেষ্ট রহস্যজনক। সুতরাং এ কাজ টম, ডিক, হ্যারিকে দিয়ে হবে না। একজনের কথাই মাথায় এসেছিল, তিনি কোন গোয়েন্দা নন, তিনিও পেশায় একজন প্রফেসর, কলেজে আমার থেকে এক বছরের সিনিয়র, ডিসক্রিট ম্যাথিমেটিক্স নিয়ে আমেরিকায় মেরিল্যান্ডের কোন ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট, তবে ইতিহাসের এবং সাহিত্যের খুব একনিষ্ঠ পাঠক। আর হ্যাঁ, অসম্ভব রকমের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্ত, তিনি ডঃ সব্যসাচী দাশগুপ্ত, আমি অবশ্য প্রফেসর বলে ডাকি। কিন্তু এটাও আমি জানি প্রফেসর কিন্তু গোয়েন্দা হিসেবে তদন্ত করবে না। তবে যদি সেই রকম কাজ না থাকে আমার সঙ্গে হয়তো যেতে পারে দিনকয়েকের জন্য কুচবিহারের সেই জমিদারবাড়ী। কারণ এক, ইতিহাস নিয়ে তো তাঁর বিস্তর পড়াশোনা, তার ওপর এই রকম তিনশো বছরের পুরোনো জমিদারীতে বেড়াতে যাওয়ার চান্সটা হয়তো নাও ছাড়তে পারে।
তাহলে ‘সমকালীন’ দৈনন্দিনের খেলার পাতার সাংবাদিক আমি মানে তথাগত গুপ্ত ডঃ ওয়াটসনের রোল প্লে করব, আর নেপথ্যে কলকাঠি নেড়ে আসল সত্যটা খুঁজে বার করার চেষ্টা করবে প্রফেসর সব্যসাচী দাশগুপ্ত। নিজেকে ডঃ ওয়াটসন বা ব্যোমকেশের ‘অজিত’ ভাবতে হাসিই পাচ্ছিল, কিন্তু অভিজিত সেই বাচ্ছাবয়সের মতো ‘নাছোড়বান্দা’ হয়ে পড়ে রইল।
অভিজিত আবার বলল, “তুই যদি যাস তাহলে আমিও আসব তোর সাথে। আমার এই কদিন কলেজে ছুটি, দু সপ্তাহের জন্য যাওয়ার প্ল্যান এমনিতেই ছিল। মেয়ের গরমের ছুটি, ওরা মামার বাড়ী যাবে। আমার ও সে রকম কোন কাজ নেই কলকাতায়”
মিনিট পাঁচেক ভাবলাম, যদিও আমার মনের মধ্যে কি চলছে সেটা অভিজিতকে বলিনি, প্রশ্ন করলাম – “তা এই উল্লাসপুর যেতে হয় কি করে?”
“তিস্তা-তোর্সা, কাঞ্চনজঙ্ঘা, উত্তরবঙ্গ যে কোন নর্থ বেঙ্গলের ট্রেন ধরে কুচবিহার, তারপর গাড়ীতে ঘণ্টা খানেকের রাস্তা”
“এটা কি কুচবিহারের সাউথ?”
সম্মতিসূচক ভাবে মাথা নাড়ল অভিজিত, নিজে খবরের কাগজে কাজ করি বলে মোটামুটি একটা আইডিয়া আমার আছে, “তাহলে কি প্রায় বাংলাদেশের বর্ডারের কাছাকাছি”
“বলতে পারিস, তবে বর্ডার এলাকাটা মূলত জঙ্গল, এমনিতে সে রকম কোন গন্ডগোল নেই, তাছাড়া বিএসএফের একটা চেকপোস্ট ও আছে”
[২]
প্রফেসর কে রাজী করাতে আমার খুব একটা অসুবিধা হয়নি। আসলে প্রফেসরের মনের কোন এক কোণায় গোয়েন্দা হওয়ার এক সুপ্ত বাসনা সবসময়েই লুকিয়ে থাকে, সুযোগ সুবিধা মত সেটা বেরিয়ে পড়ে। অবশ্য আমি জানতাম এই ব্যাপার টা খুব স্পেশাল তার জন্য। নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও ইতিহাস সব সময়েই তার পছন্দের বিষয়। আর এই পুরো ব্যাপার টার মধ্যে আমরা ইতিহাসের একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম। সুতরাং প্রফেসর যে এই কেস টায় আকৃষ্ট হবে সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আমি একটা স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে অফিসে এক সপ্তাহের ছুটি ম্যানেজ করে ফেলেছিলাম, অভিজিত তৎকালে বুকিং করেছিল। আমরা তিস্তা-তোর্সায় রওনা হলাম ঠিক তিন দিন বাদে। প্ল্যানটা এই রকম ছিল আমরা সেখানে চার-পাচ দিন মতো থাকবো, উদ্দেশ্য একটাই ডঃ মিত্র কে খুঁজে বার করা, অথবা কোন সুত্র বার করা যাতে কোন সন্ধান পাওয়া যায়। তার বেশী ছুটি আমার ও নেই, প্রফেসরের অবশ্য গরমের ছুটি তাও সে নানা কাজে ব্যস্ত। আমি আমার চেনা একটা প্রাইভেট গোয়েন্দা এজেন্সীর সাথে কথা বলে রেখেছিলাম। আমাদের খবরের সন্ধানে অনেক কাজেই তাঁরা সাহায্য বা কাজ করে থাকেন। যদি আমাদের দ্বারা কিছু না হয়, হয়তো তাঁদেরকে চুক্তিবদ্ধ করানো হতে পারে। যদিও সেটা সম্পূর্ণ ভাবে অভিজিত এবং তার বাবার সিদ্ধান্ত।
ট্রেন ঘন্টা খানেকের একটু বেশী লেট ছিল। নিউ কুচবিহার যখন পৌঁছলাম, আটটা বেজে গেছে। স্টেশনে গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, মাল পত্তর তুলে সোজা অভিজিতদের বাড়ি। মাঝে আর কোন ব্রেক নেওয়া হয়নি। ঘন্টা খানেকের একটু বেশীই লাগল পৌঁছতে। রায়বাড়ির সিংহদ্বার যখন পেরোচ্ছি তখন প্রায় দশটা। অভিজিতের বাবা সৌরীন রায়ের সঙ্গে দেখা করাটা প্রথমেই দরকার ছিল, যদিও আমার পরামর্শ মতো অভিজিত আগে ভাগে কথা বলে রেখেছিল। আমরা ট্রেন থেকে নেমে একটু হাত মুখ ধুয়েই কথাটা সেরে নিলাম।
অভিজিতের বাবাকে আমি ছোটবেলায় দেখেছি, কিন্তু আমার ঠিক মনে ছিল না। সত্তরের ওপর বয়স, চালচলন, কথা বার্তা বলার স্টাইল, জামাকাপড় সব নিয়ে একটা দারুন ব্যক্তিত্ব। পুরোনা জমিদারবাড়ির বৈঠকখানা মানে আমরা আধুনিক বাড়িতে যেটা কে ড্রয়িংরুম বলে থাকি সেখানে বসেই কথা হল। জমিদার বাড়ি আমি আগে অনেক দেখেছি, তার বেশীর ভাগ আজকের দিনে ভগ্নাবশেষ হয়ে গেছে, কেউ কেউ আবার পুরোনো বাড়ি ভেঙ্গে আধুনিক বাড়ি বানিয়েছেন। একটা কথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, এই রায়বাড়িতে কিন্তু পর্যাপ্ত রক্ষনাবেক্ষন হয়। বাড়িটা দেখে বোঝা যায় এই বাড়ির বয়স হয়েছে, তবে কোন জায়গাই সেই ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েনি। প্রাথমিক পরিচয়পর্বের পর প্রফেসরই কথা বলল, আর এত ‘টু-দি-পয়েন্ট’ আমি হয়তো বলতে পারতাম না,
“আপনাকে প্রথমেই আমাদের প্ল্যানটা জানিয়ে রাখা দরকার, আমি বা বাবাই মানে তথাগত কেউই কিন্তু গোয়েন্দা নয়। আসলে ও খবরের কাগজে কাজ করে আর তার সূত্রে কিছু চেনা পরিচয় আছে। এই ব্যাপারটা নিয়ে ও আমার সাথে ডিসকাস করছিল তিনদিন আগে। ডঃ মিত্র কে আমি চিনতাম, এক সময়ে উনি কলকাতায় ইংলিশ পড়াতেন, স্কুলের শেষ চার বছর আমি ওনার ছাত্র ও ছিলাম। তাই যখন ডঃ মিত্রর এই হঠাৎ করে নিরদ্দেশ হয়ে যাওয়া ব্যাপারটা শুনলাম ভাবলাম একবার চেষ্টা করে দেখাই যাক না। আর ইতিহাস নিয়ে কিছু পড়াশোনা করেছি, তাই আপনার বাড়িতে আসার লোভটাও ছাড়তে পারলাম না! চলেই এলাম, তা যদি দিন দুই তিন দিনের মধ্যে সেই রকম প্রোগ্রেস না হয় তাহলে হয়তো আমার দ্বারা কাজটা হবে না, সেক্ষেত্রে”
প্রফেসর কে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন সৌরীন রায়, “আমার কি মনে হয় জানেন?”
উৎসুক মুখে চেয়ে আছি, আবার সেই গম্ভীর গলা শুনলাম, “কাজটা যদি হয় তবে দু তিন দিনের মধ্যেই হবে, নয়তো হবে না”
প্রফেসর এবারে চোখ থেকে চশমা টা হাতে নামিয়ে নিয়েছে, সেটা হাতে ধরেই বলল, “কেন? আপনার এই রকম মনে হল কেন?”
“উল্লাসপুর ছেড়ে সে বেড়িয়ে গেলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু আমার মনে হয় সে এখনো আটকে আছে, আর এই উল্লাসপুর থেকে তাকে খুঁজে বার করতে এক দুদিনের বেশী সময় লাগা কি উচিৎ?”
“আপনার কি মনে হয় পুলিশ কি সেটা খোঁজেনি? আর একজন বাহাত্তর বছরের প্রফেসর মানুষের জন্য উল্লাসপুর নিশ্চয়ই লুকিয়ে থাকার মতো কোন জায়গা নয়, তাই নয় কি?”
“পুলিশ যদি সব কাজ ঠিকঠাক করতো তাহলে তো আমি আপনাদের ডাকতাম না! তাঁরা তাঁদের ডেফিনিশন ধরে খুঁজেছে, পায়নি, পাবেও না। কারণ তাঁরা ধরেই নিয়েছেন, ডঃ মিত্র নাকি উল্লাসপুর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছেন। তাই আমি চাই সত্যিটা খুঁজে বার করতে। সত্যি কি সে এখান থেকে চলে গেছে, নাকি এখনো এখানেই আছে”
“বেশ! কিন্তু আমি আবার জিগ্যেস করছি আপনি এতো টা সিওর হচ্ছেন কি করে তিনি এখনো উল্লাসপুরে আটকে আছেন?”
“বেসিক সেন্স! লোকটা নিজের সমস্ত কিছু জিনিসপত্তর রেখে একটা জায়গা থেকে সিমপ্লি ছেড়ে যেতে পারে না! কি পারে?”
“সমস্ত কিছু রেখে মানে?”
“জামা কাপড়, সুটকেস, মোবাইল, এমনকি টাকা পয়সাও সব কিছু ঘরে রয়েছে যে রকম ছিল! পরনের জামা কাপড় ছাড়া জিনিস বলতে দুটো জিনিস মিসিং, এক তার মানিব্যাগ, দুই একটা টর্চ। সে দুদিন আগে রাতে তাকে দিয়েছিলাম। এই অঞ্চলে রাতে মাঝেমধ্যে কারেন্ট চলে যায়, তখন খুব দরকার হয়।”
আমাদের কথার মাঝে দু মিনিটের বিরতি হল, কারণ চা এসেছে, চায়ের কাপ এবং অন্য সরঞ্জাম দেখে বোঝাই যায় জমিদারী না থাকলেও এস্টেট এখনো রমরম করে চলছে। কেটলির ঢাকনা খুলতেই দার্জিলিং চায়ের গন্ধ নাকে এল। প্রফেসর বিরতি ভেঙ্গে প্রসঙ্গে ফিরল, “আচ্ছা এই দশ বারো দিন যে উনি আপনার বাড়িতে ছিলেন, এই এলাকায় কি খুব ঘোরাঘুরি করতেন নাকি মোটামুটি বাড়িতেই থাকতেন?”
“ঘোরাঘুরি খুব একটা করত বলে বলেনি। খালি আমার কাছ থেকে এই এলাকার একটা ম্যাপ চেয়েছিল। আমি মাঝে একদিন ওকে নিয়ে গেছিলাম ঐ মিউনিসিপ্যালিটি অফিসে, ওখান থেকে একটা ম্যাপও জোগাড় হয়েছিল। এছাড়া, আর কোন দিন তো বাড়ির বাইরে যেতে হয়েছে বলে জানা নেই”
“ম্যাপ কেন লাগবে কিছু বলেছিলেন!”
“জিগ্যেস করতে বলল, এতোদিনের পুরোনো জায়গা, জায়গাটাকে জানতে গেলে নাকি ম্যাপ দরকার হবে। আমি ও আর বেশী কিছু জিগ্যেস করিনি”
কয়েক সেকেন্ডের বিরতির পর সৌরীন রায় আবার বললেন, “আর একটা ব্যাপার কি জানেন? তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে কোথায় গেলেন সেটা আমার না জানলেও চলবে। একটা বাহাত্তর বছরের বিপত্নীক মানুষ, তার যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাবে, তাতে কার কি? না কারুর অনুমতির প্রয়োজন আছে, না কাউকে জানানোর প্রয়োজন আছে! কিন্তু সে ছিল আমার বাড়ির অতিথি। আমি খালি একটাই জিনিস জানতে চাই, সে কোন বিপদে পড়ল না তো?”
“সত্যি করে একটা কথা বলুন তো, আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন যে বা যারা তাঁর কোন অনিষ্ট করতে পারে?”
“সন্দেহের তো প্রশ্ন আসছে না! এই উল্লাসপুরে তাকে তো কেউ চিনতোই না, সুতরাং অনিষ্ট বা ক্ষতি করার তো কোন মোটিভ থাকছে বলে আমার মনে হয়না”
প্রফেসর এক দৃষ্টে নীচের দিকে চেয়ে আছে, সবাই চুপচাপ আমার মনে একটা প্রশ্ন অনেকক্ষন থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছিল সেটা করে ফেললাম, “আচ্ছা মেসোমশাই, অভিজিতের মুখে শুনছিলাম এই এস্টেট পেরিয়ে কালিন্দী আর উজারা – এই দুটো জঙ্গল, সেটা পাড় করে বাংলাদেশের সীমানা। কোন বন্য প্রানী দ্বারা আক্রান্ত হবার আছে কি?”
সৌরীন রায় মৃদু হাসলেন, তারপর বললেন “তুমি যে গোয়েন্দা নও সেটা না বললেও বোঝা যায়! বন্যপ্রানী আক্রমন করলে ধস্তাধস্তির চিহ্ন পাওয়া যেত, তাই না! আর গ্রামের লোকেরা সেই খবর অনেক তাড়াতাড়ি পেয়ে যায়। তবে যাইহোক, এই জঙ্গলে বন্যপ্রানী নেই। এতো ঠিক তরাই অঞ্চল নয়, সমতলে এই রকম জঙ্গলে বন্যপ্রানী পাওয়া যায় না। এমনকি শেয়াল, নেকড়েও নেই। সাপখোপ ও আছে বলে খুব একটা শুনিনি। তবে তুমি জঙ্গলের কথাটা উল্লেখ করে ভালো করেছ, বন্যপ্রানী না থাকলেও অন্য কোন বিপদের সম্ভাবনাও থাকতে পারে, তাই আমি পুলিশকে বলেছিলাম। শুনেছি তাঁরা জঙ্গলে কতটা সার্চ করেছেন তবে, ক্লু বোধহয় কিছু পায়নি, পেলে জানতাম নিশ্চয়ই”
চুপ করতেই হল, প্রফেসরের গলা আবার শুনতে পেলাম, “আচ্ছা, ডঃ মিত্র কে আপনি ইনভাইট করেছিলেন নাকি উনি নিজেই এসেছিলেন?”
“আমার সঙ্গে যোগাযোগ বিশেষ ছিল না। অনেক কাল আগে এক সময়ে এক সাথে পড়াশোনা করেছি, তারপর আমার আর ওর লাইন ও আলাদা হয়ে যায়। তবে মাঝে মধ্যে খবর টবর পেতাম, আর ও নিয়মিত লেখালেখি করত, অনেক পত্রপত্রিকা তে ও ওর লেখা আমি পড়েছি। বছর দুয়েক আগে এক ভাইপোর বিয়েতে কলকাতায় ওর সাথে দেখা হয়। তারপর মাঝে এক-দুবার কথাবার্তা হয়েছিল। তা গত নভেম্বরে ও আমাকে আবার যোগাযোগ করে, ফোন করেছিল। বলল বাংলার পুরোনো জমিদারী বাড়ি নিয়ে রিসার্চ করছে, এখানে দিন কয়েক আসতে চায়। আসলে গত বছরে মাঝামাঝি, সময়টা ঠিক মনে নেই, খুব সম্ভব জুলাই বা আগস্ট হবে। ‘ইন্ডিয়া টুডে’ তে আমাদের বাড়ি নিয়ে একটা লেখা বেড়িয়েছিল। সেই লেখা পড়ে সে আমাদের বাড়ির কথা জেনেছে, আর সেখান থেকেই ব্যাপারটার শুরু। ডঃ আদিত্য পাঠক, ভারতের ব্রিটিশ সময় কাল নিয়ে প্রচুর রিসার্চ করেছেন, উনিই লিখেছিলেন এইটা। আমার অবশ্য তখন পড়া হয় নি, এই দিন কয়েক আগে পড়লাম, ঐ পড়াল। ঐ নিয়ে এসেছিল, ও যে ঘরে থাকছিল সেখানে আপনি ঐ বইটাও পেয়ে যাবেন। আমাদের একটা লাইব্রেরী ও আছে, সেখানেও সে বেশ পড়াশোনা করছিল দিন কয়েক”
“লাইব্রেরী এখনো আপনারা মেইন্টেইন করেন?”
“না সে রকম কিছু নয়। শুনেছি এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নিয়মিত বই আদান প্রাদান হতো। ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের অনেক কালেকশন ছিল। তবে এখন নিয়মিত সাপ্লাই কমে গেছে, আর হয় না বললেই চলে, তবে অবশিষ্ট এখনো অনেক কিছু আছে।”
“আচ্ছা, ওনার বাড়িতে কে কে আছে?”
“বাড়ি বলতে সে থাকতো কল্যানী। স্ত্রী গত হয়েছেন প্রায় পাঁচ বছর হল, একটিই মেয়ে, বিয়ে করে সে ব্যাঙ্গালোরে থাকে। খবর পাঠিয়েছিলাম, এক দুবার কথাও হয়েছিল, তবে কাজের কথা সে রকম কিছুই জানা যায়নি”
“আচ্ছা, এই ঘটনা টা ঠিক ঘটল কবে?”
“২৩শে মার্চ, সকালে। আগের দিন সন্ধ্যেবেলা বেশ আড্ডা হল, তারপর এক সাথে ডিনার করলাম। একটু টিভি দেখাও হল, তারপর দুজনেই শুতে গেছি। শুনেছিলাম ও সকালে ছটা নাগাদ মর্নিং ওয়াকে যেত, আমার আবার ঘুম ভাঙতে একটু দেরী হয়। কিন্তু সকালে সাড়ে আটটা নাগাদ আমরা দুই বুড়োতে একসাথে চা খেতাম। তা সেই দিন অপেক্ষা করতে লাগলাম, কিন্তু আর সে এল না”
“ঠিক আগের দিন বা এক দুদিন আগে এমন কিছু বলেছিলেন যেটা ভাবলে এখন একটু আনইউসুয়াল লাগে”
“সে রকম তো কিছু নয়, তবে এখানে পড়াশোনা করতে করতে যা তথ্য কালেক্ট করছিল সেই গুলো মাঝে মধ্যে পড়ে পড়ে শোনাতো আমাকে। নেতাজী সুভাষ বোসের আমাদের বাড়িতে আসার কথাটাও ও কোন পুরোনো পত্রিকায় পড়েছে, সেটাও বলছিল। তা ও একটা ডাইরি তে লিখছিল সবকিছু, আপনি সেটা পেয়ে যাবেন। পুলিশে নিয়ে গেছিল পড়তে, তারপর দিন কয়েক বাদে সেটা আবার ফেরত ও দিয়ে গেল”
প্রফেসর চুপ করেই ছিল, আমি ও কোন কথা বলিনি, বেশ মিনিট খানেকের নীরবতা, এবারে অভিজিত প্রথম কথা বলল, “বাবা, আমি তাহলে দক্ষিনের দোতলায় এঁদের থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি”
প্রফেসরের গলা আবার শুনলাম, “আমি একটা কথা বলতে চাই। যদি সমস্যা না থাকে, আমরা কি ডঃ মিত্র যে ঘরে ছিলেন সেই ঘরে থাকতে পারি। জানি প্রায় দেড় মাস হয়ে গেছে, কিন্তু যদি কোন ক্লু পাওয়া যায়”
সৌরীন রায় সাথে সাথেই রাজী হলেন, “আমাদের কোন সমস্যা নেই, আপনারা সেখানেই থাকবেন। যখন যে দরকার হোক, আমাকে বলবেন। কোথায় যাবার হলে, বা কোন কিছু লাগলে। আর এই জায়গাটা বেশ বড় তো, এখন অবশ্য সাইকেল, রিক্সা এমনকি অটো ও চলছে। তবে, আপনারা আমার অতিথি, যে কোন দরকার হলে এস্টেটের গাড়ি নিয়ে বেরোবেন। আর হ্যাঁ, আর একটা কথা, আমি কিন্তু আপনাদের ভরসা করছি। আমি জানি আপনারা পেশাদার নন, আর আপনারা টাকার জন্য এখানে আসেন নি। তবে যে কদিন এখানে থাকবেন আপনাদের থাকা খাওয়া পুরোটাই কিন্তু এস্টেটের দায়িত্ব। ডঃ মিত্র কে খুঁজে বার করুন, এর সঙ্গে এতো বছরের আমাদের অর্জিত সুনাম আর প্রতিপত্তি জড়িয়ে আছে। আর কাজে সফল হলে কিন্তু পারিশ্রমিক নিতেই হবে, আর সেটা হবে আমার ইচ্ছে মতো। তখন কিন্তু না বলা যাবে না”
[৩]
প্রায় ঘণ্টা দেড়েক হয়ে গেল প্রফেসর কিন্তু একটা কথাও বলেনি। ট্রেনে পরে আসা জামা কাপড় সে এখনো চেঞ্জ করেনি। শেষ দশ মিনিটে তিনটে সিগারেট শেষ করেছে, ডঃ মিত্রর সমস্ত জিনিসপত্র বার তিনেক নিরীক্ষণ করেছে, ডাইরিটা বারে বারে উলটে পালটে দেখছে। একবার দুবার আমি উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি, একটা দুটো প্রশ্ন ও করেছি কিন্তু আমার দিকে প্রফেসর এমন ভাবে চেয়ে দেখেছে যে ভাব খানা এমন, ‘এখন আমাকে বিরক্ত কোরনা!’ অভিজিত বার দুয়েক এসে জিগ্যেস করে গেছে কিছু লাগবে কি না। প্রফেসর হয়তো শুনতেও পায়নি! দেড়টায় লাঞ্চের আগাম সময় জানিয়ে গেছে, প্রফেসর কেমন নির্লিপ্ত মুখে চেয়েছিল। বার দুয়েক বলেওছি, “আরে চানটা তো করে এসো, ওদের খাবার রেডি হয়ে যাবে” কিন্তু সে কথার কোন উত্তর দেয়নি। আমি প্রফেসরের সঙ্গে এই রকম কাজে আগে কখনো আসিনি। সুতরাং যদিও সে আমার অনেক দিনের বন্ধু কিন্তু এই রকম ব্যাপার দেখে আমার ভেতরে ভেতরে একটা বিরক্তি আসছিল। ডঃ মিত্রর রেখে যাওয়া ‘ইন্ডিয়া টুডে’ টাই পড়া শুরু করলাম, প্রায় পুরোটাই আমার পড়া হয়ে এসেছে এমন সময়ে তার গলা শুনলাম।
“সৌরীন রায় যে ম্যাপটা জোগাড় করে দিয়েছিলেন, সেটা কিন্তু খুব সম্ভব ঘরে নেই বুঝলে! প্রফেসর কি উধাও হয়ে যাবার পর সেটা কি সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলেন?”
আমি তাকালাম, প্রফেসর তার নিজস্ব স্টাইলে সিগারেটের ধোঁয়ার রিং করছে, আমার দিকে না চেয়ে সে আবার বলল – “চারটে খটকা লাগছে আর একটা ইনফরমেশন লাগবে, বুঝলে!” আমি কোন প্রশ্ন করিনি, সে নিজেই বলে চলল, “এক, সকাল ছটায় যে লোকটা মর্নিং ওয়াকে যায় সে সকাল চারটে দশে অ্যালার্ম দেয় কেন?”
“মানে?”
“টাইম পিস টা দেখো, ঘড়িতে চারটে দশে অ্যালার্ম সেট করা। এই ঘরেতে অন্য আর কেউ এসে ঘড়িতে নতুন করে অ্যালার্ম দেবে কি?”
“আর বাকি খটকা?”
“২২শে মার্চের একটা টেলিগ্রাফ কাগজ রয়েছে, দেখো ঐ কোনের টেবিলের ওপরে রাখা। সেখানে ২৩শে মার্চের সকালের সূর্যোদয়ের সময়ের ওপর একটা লাল পেনের দাগ রয়েছে। বাহাত্তর বছরের ইতিহাসের অধ্যাপক কি তাহলে সকাল সকাল উঠে উল্লাসপুরের একটা ম্যাপ হাতে করে সূর্যোদয় দেখতে গেলেন?”
“দাগটা যে ওনার দেওয়া, সেটা বুঝলে কি করে?”
“সারা ঘরে দুটো পেন রয়েছে, একটার কালি কালো, আর একটার লাল। সুতরাং দাগটা যে ওনার দেওয়া সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই”
“আর?”
“তার চেয়েও বড়, আরো দুটো ব্যাপার আছে, আর সে দুটোই সবচেয়ে বড় রহস্য! একজন ইতিহাসের অধ্যাপককে তেজস্ক্রিয়তা মানে রেডিওঅ্যাক্টিভিটি নিয়ে পড়াশোনা করার প্রয়োজন হতে পারে কি? ডাইরিটা দেখো, হায়ার ফিজিক্স, হায়ার ম্যাথিমেটিক্স নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেছেন। তিনি তো এসেছিলেন রায়বাড়ির ইতিহাস জানতে! তাহলে আবার ম্যাথস, ফিজিস্ক এসব নিয়ে পড়াশোনা করার দরকার হল কেন?”
“অভিজিত বলছিল ওর প্রপিতামহ নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডঃ সত্যেন বোসের অধীনে রিসার্চ করতেন”
“হ্যাঁ, সেটা আমি ও শুনেছি, তবে ডাইরিতে যা নোট করা রয়েছে সেসব সব পড়াশোনা কিন্তু এখানে বসে করা নয়”
“তুমি এতোটা সিওর হলে কি করে?”
“দুটো কারনে! এক, তিনটে প্রিন্টেড ডকুমেন্টস রয়েছে সেগুলো নিশ্চয়ই এখানে নেওয়া নয়। আর দুই, যে দুটো পেন এখানে রাখা রয়েছে সেই পেনে কিন্তু এইসব নোট করা হয়নি। সুতরাং পড়াশোনাটা অনেক দিন ধরেই চলছিল। সেটা কি কোন বিশেষ প্রয়োজনে?”
“আরো একটা বড় রহস্য আছে! এই ভদ্রলোক দাবা নিয়ে বেশ পড়াশোনা করছিলেন। তিনি কি এই বয়সে এসে খেলা টা শিখতে চাইছিলেন? কিন্তু কোন দাবার বোর্ড বা ঘুঁটি তো এখানে নেই! তুমি তো খেলার পাতার সাংবাদিক, কি মনে হয় তোমার? বোর্ড ছাড়া দাবা শেখা যায়? এই দেখো, ডাইরি ভর্তি দাবার ছক আঁকা, একটা বই ও রয়েছে ওখানে। খুব সম্ভব এখান থেকেই কেনা।”
চুপ করে রইলাম, সত্যি আগে কখনো শুনিনি, ঘুঁটি আর বোর্ড ছাড়া দাবাখেলা শেখার কথা।“ডঃ মিত্রর ফোনে কিছু ইনফরমেশন পেলে?”
“না, সে রকম কিছু নয়”
“আর ইনফরমেশন লাগবে, সেটা নিয়ে কি বলছিলে?”
“সৌরীন রায় কে একবার জিগ্যেস করতে হবে, এই রায়বাড়ির সঙ্গে কি নেপালের কোন কানেকশন আছে বা আগে কখন ছিল কিনা? ডঃ মিত্রর পড়াশোনার জিনিসের মধ্যে একটা চিঠি রয়েছে সেটা নেপালীতে লেখা, আমি যদিও নেপালী জানিনা, তবে এর হরফ গুলো যে নেপালী সেটা বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি।”
“তুমি কি ভাবছো বলো তো?”
“তোমার দুটো হেল্প লাগবে। এক, তুমি ‘ইন্ডিয়া টুডে’র আদিত্য পাঠক কে একটা ফোন করো, তোমাদের প্রফেশন এক তো! চট করে টাইম পেয়ে যাবে, রায়বাড়ির ইতিহাসের কিছু না জানা তথ্য আছে, সেটা আমাদের আগে জানতে হবে। আর দুই, এই নেপালীতে লেখা চিঠিটা কপি করে তোমার কাগজের অফিসে পাঠিয়ে দাও, এর অনুবাদটা জানতে হবে”
অভিজিত এসে লাঞ্চে ডেকে নিয়ে গেল। খাবার জায়গাটা কিন্তু একেবারে আধুনিক আসবাব এবং সরঞ্জামে ভর্তি। খুব খাওয়া হল, অভিজিতের বাড়িতে ছোট বেলায়ও আমি খেয়েছি, তবে সে সিউড়ির বাড়িতে, তার বাবা চাকরী সূত্রে থাকতেন। এই রকম রাজকীয় ব্যবস্থা ছিল না! প্রফেসর কিন্তু চিন্তায় ডুবে আছে সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম, যদিও নেপালের কানেকশনটা জানার ছিল, সে কথা সে নিজেই তুলল। সৌরীন রায় কিছু তেমন বলতে পারলেন না, “আমাদের সঙ্গে নেপালের কানেকশন ছিল বলে আমি জানি না, তবে এতদিনের জমিদারী, সেখানে কোন শরিক যদি নেপালে গিয়ে থাকেন বা তার পরিচিত কেউ যদি নেপালের বাসিন্দা হয়ে থাকেন আমার জানার কথা নয়”
“আচ্ছা, আপনার পিতামহ মানে কিরনশঙ্কর কি নিয়ে রিসার্চ করেছিলেন, জানেন কিছু?”
“ম্যাথিমেটিক্স নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন সেটা আমি জানতাম, তবে ওনার রিসার্চ তো শেষ হয়নি। মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়, আমার প্রপিতামহ হঠাৎ করে মারা যান, সাংসারিক আর খানিকটা অর্থনৈতিক চাপে কিরনশঙ্করের রিসার্চ বন্ধ হয়ে যায়। আর উনিও তারপর খুব বেশী দিন বাঁচেন নি। ওনার জীবনটা অবশ্য খুবই দুর্ভাগ্যের। লেখাপড়া, খেলাধুলা সবেতে ছিলেন তুখোড়, শুনেছি যত সুন্দর নাকি ঘোড়ায় চড়তেন তত সুন্দর ইংরাজী বলতেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যেন বোসের ছাত্র ছিলেন। ১৯৪৫ সালের শুরুর দিকে তখন উত্তাল ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উনি জড়িয়ে পড়েছিলেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে। আর সেই সময়ে এক রাজনৈতিক অন্তরদ্বন্দ্বে তার অকালমৃত্যু হয়। কেউ বলেন রাজনৈতিক হত্যা, কেউ বা আবার বলেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারনে মৃত্যু। শুনেছি ডেডবডি পাওয়া গেছিল নাকি দুই-তিন দিন বাদে, বন্ধু স্থানীয় কেউ নাকি পেছন থেকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছিল। আমার বাবার বয়স তখন মাত্র দুই, বাবার কাকা তখন সংসারের হাল ধরেন, পরে জমিদারীরও হাল ধরেন”
খাবার পর আরো মিনিট পনের কথা হল, সে রকম কাজের কিছু অবশ্য জানা যায়নি। ডঃ মিত্রের দাবা নিয়ে ইন্টারেস্টের যে পরিচয় আমরা পেয়েছিলাম, তা নিয়ে সৌরীন রায় তেমন কোন তথ্য দিতে পারলেন না।
লাঞ্চ শেষ করে প্রথল কাজ ছিল আদিত্য পাঠক কে ফোন করা। ওনার ফোন নম্বর পেতে আমার সময় লাগে নি, সাথে সাথেই ফোন ঘোরালাম। খুবই সজ্জন মানুষ, সময় ও দিলেন। খুব ধীর গতিতে কথা বলেন, আমিই মূলত কথা বললাম যদিও আগে থেকে প্রফেসরের সাথে পরামর্শ করা ছিল।
“গত বছর ইন্ডিয়া টুডে তে আপনি যে কুচবিহারের রায়বাড়িকে নিয়ে লিখেছিলেন সেইখানে আমরা আপাতত আছি। আসলে আমাদের এক প্রাক্তন শিক্ষক ডঃ দেব কুমার মিত্র, ইতিহাসের প্রফেসর ছিলেন, বছর দশেক হল রিটায়ার করেছেন, দু মাসে আগে এই রায়দের বাড়িতে এসেছিলেন। তারপর হঠাৎ করে কেমন নিরুদ্দেশ হয়ে যান, তো তাঁরই খোঁজে আমরা এসেছি। তো সেই ব্যাপারে আপনার একটু হেল্প লাগবে”
“বলুন, আমি কি করতে পারি?”
“আচ্ছা, আপনি এই রায় বাড়ির কথা জানলেন কোথা থেকে? কোন স্পেসিফিক সোর্স?”
“প্রায় তিন বছর আগে আমি তখন ইটালীতে ফ্লোরেন্স শহরে গেছি একটা রিসার্চের কাজে, সেখানে একটা মিউজিয়ামে আমি একটা চিঠি পড়ি। অদ্ভুত সেই চিঠি, রেবেকা ফিওরেন্টিনো নামে এক মহিলার লেখা। সে চিঠি হয়তো কাউকে উদ্দেশ্য করে লেখা নয়, অথবা আমি হয়তো বুঝতে পারিনি। সাল টা ঠিক মনে নেই, এই ১৯৪৪-৪৫ হবে, কোন জাহাজে চেপে তিনি এথেন্স থেকে মার্সেই যাচ্ছিলেন, সঙ্গে তাঁর দুটি সন্তান, একটি সাড়ে তিন বছরের মেয়ে আর একটি এক বছরের ছেলে। সেই পথে হঠাৎ জাহাজ ডুবির সম্ভাবনা আসে। জাহাজের ক্যাপ্টেন লাইফবোটে করে তাঁকে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে রওনা করে দেন। আর নৌকায় ওঠার সময় তাঁর হাতে দেন একটি ছোট বাক্স, আর বলে দেন সেই বাক্সটিকে পৌঁছনোর ঠিকানা। সেই বাক্স পৌঁছনোর কথা ছিল সুদূর ভারতবর্ষের উত্তর পূর্বে উল্লাসপুর বলে এক জায়গায় রায় জমিদার বাড়িতে, ভদ্রমহিলা সেই ঘটনা আর সেই সব তথ্যকে এক করে একটা চিঠির আকারে তিনি লিখে রেখে যান। আর ফ্লোরেন্সের মিউজিয়ামে সেই লেখাটাতেই আমার চোখ পড়ে যায়। সেখান থেকেই প্রথম আমি এই রায়বাড়ির কথাটা জানতে পারি। তারপর দেশে ফিরে পড়াশোনা শুরু করি, ইতিহাসের অনেক পুরোনো জার্নালে আমি ওদের বাড়ির উল্লেখ দেখতে পাই”
মাঝপথে থামাতেই হল, “এক মিনিট! এক মিনিট! আপনার কাছে সেই চিঠির কি কোন কপি আছে? তোলা ফটো বা অনুবাদ করা কিছু”
“বিদেশের মিউজিয়ামে ফটো তোলা তো যায় না, তবে আমি নিজেই সেটাকে হাতে লিখে এনেছিলাম, আমার কাছে তার কপি রাখা আছে। আপনার তার কপি পাঠিয়ে দিচ্ছি”
“হ্যাঁ, আপনি আরো কিছু বলছিলেন রায় বাড়ির সম্বন্ধে, আমি দুঃখিত, আমি আপনাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছিলাম। আরো কিছু ইনফরমেশন শেয়ার করলে ভালো হয়”
“ইন্ডিয়া টুডে র লেখাটার সময় আমি বেশ কিছু ডকুমেন্টস কালেক্ট করেছিলাম, আমি বরং সেই গুলো আপনাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, একটু পড়াশোনা করে দেখুন, হয়তো কাজের কিছু পেয়ে যাবেন”
“কোনভাবে কি আপনার সাথে ডঃ মিত্রর কোন যোগাযোগ হয়েছিল রিসেন্ট সময়ে?”
“না, আমি তো সেই রকম কোন নাম মনে করতে পারছিনা যিনি আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন”
“অন্য কেউ, আপনার ঐ লেখা পড়ে আপনাকে কি যোগাযোগ করেছিল এর মধ্যে, রায়বাড়ির ইতিহাস জানার জন্য বা ঐ সম্পর্কিত অন্য কোন তথ্যের সন্ধানে?”
“না আমার তো তেমন কিছু মনে পড়ছে না! আচ্ছা একটা কথা জানতে পারি কি?”
“নিশ্চয়ই, বলুন”
“আমার একটাই জিনিস জানার ছিল, ডঃ মিত্রর নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার পেছনে ইতিহাসের কি কোন কানেকশন থাকতে পারে? একটাই কানেকশনই মনে আসে, হয়তো উনি কিছুর সন্ধানে সেখানে গিয়েছিলেন। অথবা সেখানে থাকতে থাকতে কিছুর সন্ধান পেয়েছিলেন”
“মানে?”
প্রায় পাঁচ সেকেন্ডের নীরবতা, তারপর ডঃ পাঠকের গলা শুনলাম, “হয়তো কোন গুপ্তধন, হিডেন ট্রেজার! আর তারপর কেউ তার ক্ষতি করল,”
আদিত্য পাঠকের ধারনাটা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ার মত ছিল না, সত্যি বলতে প্রফেসর ও সেই একই লাইনে ভাবছিল। তার মুখেও একই কথা শুনলাম “গুপ্তধনের ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তবে ডঃ মিত্রকে ক্ষতি কে করবে?” বরং সে ভাবছিল রেবেকা ফিওরেন্টিনোর লেখা চিঠিটা নিয়ে, দুবার শুনলাম কথাটা তার মুখে, “জলে ডুবে যাচ্ছে এই রকম জাহাজের একজন ক্যাপ্টেন একটা ছোট বাক্সে করে কিই বা পাঠাতে পারে?”
ডঃ মিত্রর ডাইরি নিয়ে প্রফেসর আবার বসল, আমি খানিক টা এদিক ওদিক ঘুরে সময় কাটাচ্ছি, একটা সিগারেট ধরিয়েছি, ঠিক এই সময়ে ফোনে পর পর দুটো মেসেজ আসার শব্দ হল, প্রথম টা ডঃ মিত্রর জিনিস পত্রের মধ্যে পাওয়া নেপালী ভাষায় লেখা চিঠির অনুবাদিত সংস্করন আর পরেরটা ডঃ আদিত্য পাঠকের পাঠানো ফ্লোরেন্সের মিউজিয়ামে পাওয়া সেই প্রায় আশি বছরের পুরোনো চিঠি। নেপালী তে লেখা চিঠিটা লেখা গত বছর ডিসেম্বরে, যিনি লিখেছেন তাঁর নাম অমিত গৌতম, ঠিকানা পূর্ব নেপালের ‘মধুমাল্লা’ নামক এক জায়গা, প্রফেসর ম্যাপ দেখল, সে জায়গা শিলিগুড়ি নাকি থেকে ১০০ কিলোমিটার পশ্চিমে, লিখেছেন –
“আপনার চিঠি পেয়ে খুব ভালো লাগল, আজ দশ বছর হয়ে গেছে বীরভদ্র সিংহ মারা গেছেন। যে যুদ্ধে কিরনশঙ্কর মারা গেছিলেন সেই যুদ্ধে বীরভদ্র একটা চোখ আর একটা হাত চিরকালের মত হারিয়ে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে এসেছিলেন সীমানার এপাড়ে। সেই থেকে নেপালেই ছিলেন প্রায় সত্তর বছর। শেষ কুড়ি বছর খুব কষ্টে কেটেছে তাঁর। কিরনশঙ্করের মৃত্যু বীরভদ্রকে শোকে পাথর করে দিয়েছিল। আরো দুঃখ পেয়েছিলেন বিশ্বাসঘাতকের তকমা লেগে যাওয়ায়। কিরনশঙ্করের বাড়ির মানুষরা নাকি মনে করতেন বীরভদ্রই গুলি টা চালিয়েছিলেন, তাও আবার পেছন থেকে। কিন্তু কেউ জানেনা, পেছনে থেকে গুলিটা আসলে শত্রুপক্ষ চালিয়েছিল, নিজের ডান হাতের ওপর গুলিটা নিয়েছিলেন কিরনশঙ্কর কে বাঁচাতে। আর সেই হাতটাও চিরকালের মতো অকেজো হয়ে গেছিল। কিন্তু কেউ জানতেই পারলো না সত্যিটা! সীমানা পেরোতে আর সাহস পাননি, তবে ন্যায়ের আশায় অনেকবার চিঠি লিখেছেন। কিন্তু ভারত সরকার বা বাংলার সরকার সেসব চিঠির কোন জবাব দেয়নি। আপনি যা জানতে চেয়েছিলেন আমি হয়তো তার কোনটারই উত্তর দিতে পারবো না। তবে শেষ পাঁচ বছর যখন বীরভদ্র মানসিক ভারহাম্য হারিয়ে ছিলেন তখন তাঁকে দুটো জিনিস বলতে আমরা খুব শুনেছি, জানি না আপনার কোন কাজে লাগবে কি না? এক, আলিবাবার রুপকথা গল্প সত্যি হয়ে দেখেছো? আর দুই, নেতাজী আসবেন, ঠিক আসবেন, ফৌজের জন্য জিনিস সব কিছু রাখা আছে।”
পরের চিঠিটা রেবেকা ফিওরেন্টিনোর লেখা, “ক্যাপ্টেন সাহেব বলেছিলেন ওনার নাম জন এডওয়ার্ড বিডওয়েল। ক্যাপ্টেন আপনি আমার স্যালুট জানবেন। আপনার মতো মানুষরা আজও আছেন তাই পৃথিবীটা এখনো এত সুন্দর। খালি আপনাদের মতো সুন্দর মানুষরাই সেখান ছেড়ে চলে যান এতো তাড়াতাড়ি! আপনি ছাড়া আমি, এক বছরের ব্রুনো বা সাড়ে তিন বছরের আলেসান্দ্রিয়া কেউ কি বাঁচতাম? সে কি ভয়ংকর সন্ধ্যা! আকাশ চারদিক কালো করে এসেছে, ঠাণ্ডা এলোপাথাড়ি হাওয়া, অত বড় জাহাজ নিয়ন্ত্রনেই থাকছে না। ক্যাপ্টেন সাহেব আমাদের বললেন জাহাজে জল ঢুকছে, দশটা মাত্র লাইফ বোট আছে, আমাদের যাদের সঙ্গে বাচ্ছা রয়েছে তাদেরকে আগে বের কর দেওয়া হবে। কাছেই নাকি মাল্টা, এক ঘণ্টা বড়জোর দেড় ঘন্টায় পৌঁছে যাবো। কিন্তু আমাকে তো অন্য দায়িত্ব দেওয়া হল। জানতে চাওয়ায় ক্যাপ্টেন সাহেব খালি বললেন, দুই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম আর চেষ্টায় এই জিনিস তৈরি হয়েছে, সে জিনিসকে তার নিজের জায়গায় পৌঁছতেই হবে। আমার এক হাতের মুঠোয় সেই ছোট বাক্স আর অন্য হাতে বাচ্ছা দুটোর হাত চেপে সেই লাইফ বোটে চেপে উত্তাল জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে মাল্টার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ক্যাপ্টেন ঠিকানাটা আমার হাতে লিখে দিয়ে ছিলেন, রায়বাড়ি, উল্লাসপুর, বেঙ্গল, ইন্ডিয়া। আরো দুটো কথা বলে লিখে পাঠাতে বলেছিলেন। ঠিক শুনেছিলাম তো? ঢোকার রাস্তায় সূর্যের কিরন আর বেরোনোর রাস্তা তোমার বা আমার নামে। পোস্ট অফিস থেকে সব কিছু ভারতের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম কিন্তু যদি না পৌঁছয়? জানিনা, কি হবে? ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করবেন। ২৩শে ডিসেম্বর, ১৯৪৪”
[৪]
তদন্তের প্রথম দিনেই এতোটা তথ্য পাওয়া যাবে আমি সেটা আশা করিনি। প্রফেসরের মুখ দেখে অবশ্য বোঝার উপায় নেই সত্যি আমরা এগিয়েছি নাকি পিছিয়ে যাচ্ছি। রাতে ডিনারের সময়ে সে কোন কথা বলেনি, বুঝতে পারছি সে গভীর চিন্তায় মগ্ন রয়েছে। রাতে খাওয়া সেরে সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে, যদিও চোখ দুটো খোলা, সিলিঙ্গের দিকে তাকিয়ে। পাঁচ ছয় খানা প্রশ্ন করে যখন কোণ উত্তর পেলাম না, খানিক টা নিরাশ হয়ে ঘরের বাইরে এসে ব্যালকনিতে পায়চারি করব ভাবছি, ঠিক এই সময়ে তার গলা শুনলাম – “সৌরীন রায় ঠিকই বলেছেন, কাজটা এক দুই দিনের বেশী নয়, বেশী দেরী হয়ে গেল সব ঘেঁটে যাবে”
“কি মনে হচ্ছে তোমার? ডঃ মিত্র কি উল্লাসপুরেই আছেন নাকি অন্য কোথাও?”
“অন্য কোথাও নয়, এই উল্লাসপুরেই আছেন। তবে জীবিত কি মৃত, সেটা বলতে পারবো না?”
“মৃত মানে? খুনের কেস?”
“মৃত মানেই কি খুন হতে হবে? তোমরা খবরের কাগজের লোক তো, সবসময়ে একটা খুন খারাপি চাই, তাই না! ওসব পরে হবে, তার আগে কয়েকটা ধাঁধাঁ, আমাদের সলভ করতে হবে। আর কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে। প্রথম ধাঁধাঁ, ধরে নেওয়া যাক, এডওয়ার্ড সেই বাক্স কিরনশঙ্কর কে পাঠালেন। তাহলে জন এডওয়ার্ড বিডওয়েল আর কিরনশঙ্কর রায়, দুজনের নামে কি কোন মিল আছে? থাকলে কি মিল? আর মিল না থাকলে তোমার বা আমার নাম এই কথা লেখা হল কেন? এবারে পরের ধাঁধাঁ, জন এডওয়ার্ড বিডওয়েল বলেছেন ঢোকার রাস্তায় সূর্যের কিরন, আবার ২৩শে মার্চের খবরের কাগজে সূর্যোদয়ের সময়ের ওপর ডঃ মিত্র দাগ কেটে রেখেছেন। সুতরাং এডওয়ার্ড বিডওয়েল ছোট বাক্সে করে যে জিনিস টা পাঠিয়েছেন তার সঙ্গে সূর্যোদয়ের একটা কানেকশন রয়েছে। তৃতীয় ধাঁধাঁ, আলিবাবার রুপকথা গল্প মানে কি চিচিং ফাঁক আর চিচিং বন্ধ। আর সেই গুহায় ঢোকা আর বেরোনোর সুত্র সেটাই কি এডওয়ার্ড লিখে পাঠালেন? ‘ঢোকার রাস্তায় সূর্যের কিরন আর বেরোনোর রাস্তা তোমার বা আমার নামে’। এ ছাড়াও আরো কয়েকটা প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে, যেগুলোর উত্তর আমাদের কাছে নেই। একটা ছোট বাক্সে করে একজন জাহাজের ক্যাপ্টেন কিই বা পাঠাতে পারেন? কোন সংকেত? কোন সুত্র? নাকি অন্য কিছু? যেটাকে আবার তিনি অনেক পরিশ্রম করে বানিয়েছেন। আবার দেখো, বীরভদ্র বলতেন - নেতাজী আসবেন, ফৌজের জন্য জিনিস সব কিছু রাখা আছে। নেতাজী কে? সুভাষ চন্দ্র বোস? ফৌজ মানে কি আজাদ হিন্দ ফৌজ? কি রাখা থাকতে পারে তাদের জন্য?”
প্রফেসর একটা সিগারেট ধরালো, আমি কোন কথা বলিনি। পুরো সিগারেট টা শেষ করে প্রফেসর আবার নিজেই কথা বলল – “বাবাই আমার কি মনে হয় জানো, এই সব কটা জিনিস লিঙ্কড! একটা কিছু আছে, সেটাকে নিয়েই এতো ধাঁধাঁ”
“সেটা হয়তো কোন লুকোনো ট্রেজার! হয়তো আজাদ হিন্দ ফৌজকে দেওয়া হবে বলে ঠিক হয়েছিল বা দেওয়া হয়েছিল”
“হতে পারে, আর সেটা খুব বাস্তব বলেই মনে হয়। কিন্তু ট্রেজার হলে এডওয়ার্ড বিডওয়েল বাক্সে করে কি পাঠালো? যার সঙ্গে সূর্যোদয়ের আবার একটা যোগসূত্র রয়েছে। আর ট্রেজারই যদি হবে, আর সেটা আজাদ হিন্দ ফৌজকে দেওয়ার জন্য রেখে দেওয়া হয় সেটা তো কিরনশঙ্কর নিজের জানা জায়গাতেই রাখবে। কারণ সেই সে সময়ে জমিদারীর মালিক। তাহলে তার ঢোকার রাস্তায় সূর্যের কিরন আর বেরোনোর রাস্তা তোমার বা আমার নাম লাগবে কেন?”
“পুরো ব্যাপার টা আমার কাছে কেমন যেন ডেডলক করে যাচ্ছে, আমার তো মাথায় কিছু আসছে না”
আমার কথা যেন শুনতে পায়নি এই রকম ভাবে প্রফেসর আবার একটা সিগারেট ধরালো। আমি আবার বললাম, “আচ্ছা, আমাকে একটা কথা বলবে? তুমি কি প্রফেসর কে খুঁজতে এসেছে নাকি এই সব উৎপটাং ধাঁধাঁ সলভ করতে এসেছে বলতো? প্রফেসরকে খোঁজার কোন চেষ্টা করছো না তো?”
“কে বললে করছি না? ধাঁধাঁর উত্তর না বেরোলে প্রফেসরও বেরোবেন না!”
“তাহলে ধাঁধাঁ সলভ করতে করতে প্রফেসর হারিয়ে গেলেন?”
“আমার কি মনে হয় জানো, প্রফেসর আমার থেকে অনেক বেশী বুদ্ধিমান! এই সব ধাঁধাঁ তিনি সলভ করে ফেলেছিলেন! সূর্যোদয়ের সঙ্গে এই পুরো ব্যাপারটার যে কি রিলেশন আছে, সেটা ডঃ মিত্র বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু এটাও একটা ব্যাপার, সব কিছু ইনফরমেশন পেয়েছিলেন? যেমন ধরো, আদিত্য পাঠকের সাথে ওনার কথা হয়নি, সুতরাং রেবেকা ফিওরেন্টিনোর লেখা চিঠির কথা হয়তো তিনি জানতেন না। কিন্তু তিনি যা জানতেন আমরা কিন্তু এখনো অতটা জানতে পারিনি। তাহলে কি তিনি আরো কিছু ইনফরমেশন পেয়েছিলেন? সেটা কি? কোথা থেকে?”
অনেকক্ষন ধরে কথা টা মাথায় আসছিল, এবারে বলেই ফেললাম, “এই শোনো না, তুমি অভয় দিলে একটা কথা বলব?”
সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো, “তুমি হাসবে না কিন্তু। মানে বলছিলাম কি, আচ্ছা, এই এতো দিনের পুরোনো এস্টেট, তারপর বর্ডার এরিয়া, পরিত্যক্ত এলাকা তো থাকতেও পারে। তাই বলছিলাম সেই ব্যোমকেশের চোরাবালি গল্পের মত সেই রকম নিছু নেই তো? প্রফেসর হয়তো চোরাবালি তে হারিয়ে গেলেন”
প্রফেসর আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো, আমি আশা করছিলাম সে হেসে ফেলবে, বরং উলটোটাই হল, সে বললে, “কথাটা কিন্তু মন্দ বলনি! চোরাবালি হয়তো নেই, থাকলে এখানকার স্থানীয় লোকেরা জানতে পারতো! তবে পরিত্যক্ত এলাকা থাকতেই পারে, সেখানে হয়তো কোন বিপদে পড়ে গেলেন, তারপর হারিয়ে গেলেন! কিন্তু একেবারে লোপাট! সেটা কি করে সম্ভব? একটা কাজ করা যাক, ম্যাপ একটা আমাদের ও লাগবে! এই এলাকাটার একটা সার্ভে করতে হবে!”
আর কিছু বলার আগেই প্রফেসরের ফোন বেজে উঠল, দু চারটে কথা শুনে যা বুঝলাম এই রায়বাড়ির ব্যাপারেই কথা হচ্ছে, ও পাড়ে কে আছে সে কোন মতেই আমাকে বলবে না, কাজে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। রাতে যখন শুয়েছি তখন ও সে কথা বলছে, আর ল্যাপটপেও কি সব দেখছে। আমি আর ঘাঁটাইনি, শুয়ে পড়েছি। ও হ্যাঁ, আর একটা নতুন জিনিস দেখলাম, প্রফেসর ল্যাপটপের স্ক্রিন সেভারে রবীন্দ্রসংগীতের অডিওফাইল লিঙ্ক করে রেখেছে। কাজেই চালাতে আর হয়না, নিজে থেকেই গান চালু হয়ে যায়। সে মুখে নাই বলুক আমি জানি সঞ্চয়িতা বা গীতবিতানের ফিফটি পারসেন্টের বেশী তার মুখস্থ আছে। বুঝলাম, এমনি এমনি হয় নি, সাধনাটা সব সময়ে চলতে থাকে। একে তো টায়ার্ড ছিলাম, তার ওপর গানও চলছিল বলে ঘুমোতে সময় লাগে নি।
পরদিন সকালে যখন উঠলাম ঘড়িতে কাঁটা সাড়ে সাতটা পেরিয়েছে। কিন্তু প্রফেসর ঘরে নেই, ওর বিছানার দিকে তাকিয়ে আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি, সারা রাত সে বিছানায় শোয়নি। বেশ কয়েকদিন আগে একবার আমাকে বলেছিল, “মাথার কাজ করতে থাকলে তাহলে শরীরটাকে বিশ্রাম দিতে নেই। বিছানায় শুয়ে পড়লে ঘুম আসতে বাধ্য”। সে নয় বুঝলাম কিন্তু এত সকালে সে গেল কোথায়? সেও কি ডঃ মিত্রর মতো কাউকে না জানিয়ে সূর্যোদয় দেখতে গেল। বাধ্য হয়ে ফোন ঘোরালাম, একবার রিং হতেই ফোন তুলল, “কি ব্যাপার? ঘুম ভাঙ্গল?”
“তুমি কোথায়?”
“এখানেই আছি, এই একটু ঘুরে টুরে দেখছি, তোমার বন্ধু ও রয়েছেন আমার সাথে। আমাকে সব দেখাচ্ছেন”
“তা একটু আমাকে নিয়ে যাওয়া যেতো না? একা একা চলে গেলে?”
“আসলে তুমি এতো গভীর নিদ্রায় ছিলে, তোমাকে তুলতে ইচ্ছে করল না! যাহোক, আমি আসছি, ঘরেই থেকো, কথা আছে”
প্রায় মিনিট পনের বাদে সে এল, সাথে সাথেই এল আমাদের মর্নিংটি। সেই সুসজ্জিত কেটলি, দার্জিলিং চায়ের সুবাস, চায়ের কাপ টা সেখলেই চা খেতে ইচ্ছে করবে। “চলো, হাত মুখ ধুয়ে নাও, এই রকম রাজকীয় চা তাড়াতাড়ি সদ্ব্যবহার করে ফেল, যাও তাড়াতাড়ি এসো” প্রফেসর কিন্তু আজ উৎফুল্ল কালকের মতো গোমড়া মুখে ঘুরছে না! হয়তো ভালো খবর কিছু আছে!
মিনিট পাঁচেক বাদে যখন ঘরে এসেছি সে তখন চা তৈরি করে ফেলেছে, নিজে থেকেই বলল, “কাল রাতে অনেক কিছু জানলাম জানো!”
“কার সাথে কথা বলছিলে অত রাত অবধি?”
“কার সাথে কথা বলছিলাম ছাড়ো তো! তুমি তাঁকে চিনবে না। কাজের কথা শোনো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিরনশঙ্করের রিসার্চ পার্টনার কে ছিলেন জানো? জন এডওয়ার্ড বিডওয়েল। ডঃ মিত্রর খাতায় সে পড়াশোনাটা চলছিল গত কয়েক মাস ধরে সেটাও এই একই বিষয় নিয়ে। সুতরাং রিসার্চের খবরটা তিনি পেয়েছিলেন, আর ব্যাপারটা বিস্তৃত ভাবে বুঝতে চাইছিলেন। কিন্তু কেন? যাই হোক, রিসার্চটা হচ্ছিল হাই টেম্পারেচারে এনার্জি মলিকিউলস গুলো এক একটা বিশেষ প্যাটার্নে ভাঙ্গতে থাকে, তারপর যখন আবার জোড়া লাগে অন্য একটা প্যাটার্নে লাগে, সেখান থেকেই আইসোটোপ তৈরি হয়। একটা বেসিক রুল কিন্তু এনার্জি মলিকিউলসরা মেনে চলে। তারা যখন ভাঙ্গে তখন সব সময় একটা স্কোয়্যার নম্বর তৈরি করে, মানে ৪, ৯, ১৬, ২৫, ৩৬, ৪৯, ৬৪ এই রকম আর কি? এবারে আমাদের প্রথম ধাঁধাঁ টা কি ছিল? জন এডওয়ার্ড বিডওয়েল আর কিরনশঙ্কর রায়, দুজনের নামে কি কোন মিল আছে? থাকলে কি মিল? কাল সারা রাত ভেবেছি, কিছুতেই মাথায় আসছে না! এদিকে আমার সিগারেট প্যাকেট অনেকক্ষন শেষ, তোমারটাও শেষ হব হব করছে, ঠিক এক সময়ে এঁদের বাড়ির ঘড়িতে চারটের ঘন্টা বাজল। আর কেন জানি না, সেই শব্দে আমার মাথায় একটা ৪৪০ ভোল্টের ইলেকট্রিক তরঙ্গ খেলল। খাতা, পেনসিল নিয়ে বসে পড়লাম, আর একটা অদ্ভুত মিল দেখলাম। তুমি যদি ইংরাজি হরফ গুলোকে ১,২,৩,৪ করে সাজাও, তাহলে ‘এ’ হবে ১, ‘বি’ হবে ২ এই রকম করে ‘জেড’ হবে ২৬। কি তাইতো? এবারে এই নিয়ম মেনে দুজনের নাম লেখো, কিরনশঙ্কর রায় বা জন এডওয়ার্ড বিডওয়েল দুজনের নামে ব্যবহার করা ইংরাজী অ্যালফাবেট গুলো তে তুমি যদি যোগ কর, তাহলে যোগফল হবে ১৬৯। আর একটা কথা মনে রেখো, ট্রেনে আসতে আসতে অভিজিত বলছিল, ওঁরা কিন্তু রায় নয়, ওঁরা রে। তাই কিরনশঙ্কর রায় নয় কিরনশঙ্কর রে করে নামটা লিখলাম। যোগফলটাও মিলে গেল। যাইহোক, এখানেও পারফেক্ট স্কোয়্যার। আর সেটাই মিল! ক্রিপ্টোগ্রাফির কি অসাধারণ প্রয়োগ! সুতরাং এডওয়ার্ড বিডওয়েল যা পাঠিয়েছিলেন তাতে এই ১৬৯ সংখ্যাটার ব্যবহার হতেই হবে, এবারে প্রশ্ন হল তিনি কি পাঠিয়েছিলেন?”
আমার মাথায়ও একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলল, “কোন লক বা তালা জাতীয় কিছু কি? খুলতে গেলে হয়তো ঐ ১৬৯ সংখ্যাটা ব্যবহার করতে হবে। আর সেটাকেই হয়তো বীরভদ্র চিচিংফাঁক বা চিচিংবন্ধ বলেছেন”
“অবশ্যই হতে পারে, কিন্তু কম্বিনেশনের ভিত্তিতে তালা সেতো নতুন জিনিস নয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকে ব্যবহার হচ্ছে। সেটা বানাতে গেলে দুই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম আর চেষ্টা লাগে কি? আবার অত কষ্ট করে সেই সুদূর ভুমধ্যসাগর থেকে সেই ঝড় বাদলের রাতে ভারতবর্ষে পাঠানো হল একটা কম্বিনেশন লক? ডাইজেস্ট হচ্ছে না! তার চেয়ে অনেক সহজে কিরনশঙ্কর সে জিনিস এইখানে ঢাকা বা কলকাতায় পেয়ে যেতেন! আর ঠিক এই জায়গায় এসে, আমার চিন্তা আটকে যাচ্ছে। আর তখনই মনে হচ্ছে এটা হয়তো কোন লক নয়”
অকাট্য যুক্তি, এরপরে আর কিছু বলা চলে না, প্রসঙ্গ পালটালাম “সকালে বেরিয়ে ছিলে নতুন কিছু খবর পেলে?”
“কয়েকটা জিনিস জানলাম জানো, খুব ইন্টারেস্টিং! ধুবড়ীর উত্তরে আর মাঝপাড়ার ঠিক আগে প্রায় একশো একর পরিত্যক্ত জমি পড়ে আছে, যেটা সেদিন আসতে আসতে দেখলাম, যেটাকে একটা জঙ্গলের মত লাগছিল। কি ছিল জানো সেখানে? ১৮৩০ সালে সেই জমি নীল চাষে লাগানো হয়েছিল। রায়রা নাকি সাহেবদের বড়সড় পৃষ্ঠপোষক ছিল, তাই না চাইতেই জমি দিয়ে দেয়। তারপর যখন নীলচাষ এখানে বন্ধ হয়ে বিহারে শিফট করে গেল, এই জায়গাটায় ব্রিটিশরা বলল এখানে কবরস্থান হবে। নীল চাষ করে করে জমি এমনিতেই নষ্ট হয়ে গেছিল, আবার রায়রা নাকি অর্থনৈতিক সাহায্যও করেছিল। শুনলাম সারা উত্তরবঙ্গ খুঁজলেও এত বড় কবরস্থান নাকি বেশী পাওয়া যাবেনা। তবে এখন আর ব্যবহার হয় না। দেশভাগের আগে ব্রিটিশরা এখান থেকে বসতি গুটিয়ে নেয়। পশ্চিমবঙ্গ আর পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পর জায়গাটা ‘ডিসপিউটেড’ হয়ে যায় আর দীর্ঘদিন জনবসতিহীন থাকতে থাকতে তারপর থেকে একটা জঙ্গলে পরিনত হয়। অন্য প্রসঙ্গে বলছি, তোমার বন্ধুকে বললাম আরকিওলজিক্যাল সার্ভে চিঠি লিখে তাড়াতাড়ি জানাতে, এখানে নাকি ষাট সত্তরটা গ্রেভ এখানে পড়ে আছে, ওদের বংশধরেরা জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হবে!”
“তুমি কি সেই কবর স্থানে একবার যাওয়ার প্ল্যান করছ?”
“গেলে হয়! তবে ম্যাপটা আগে পেতে হবে, এই রকম আরো কত যে একশো একর জমি এই চত্বরে এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে সেটা জানা দরকার। হ্যাঁ, আর একটাও খুব ইন্টারেস্টিং জিনিস জানলাম, উল্লাসপুরে রায়েদের কাছে নাকি প্রচুর ধনসম্পদ, মনিমানিক্য ছিল। কিরনশঙ্করের আকস্মিক মৃত্যুর পর সে সম্পত্তির অনেকটাই নাকি লুট হয়। তবে, অমিত গৌতমের লেখায় আমরা যেটা জানলাম সেটা কিন্তু ভুল নয়। স্থানীয় মানুষ আজও মনে করেন, বীরভদ্রের আর একটা নাম নিঃসন্দেহে মীরজাফর রাখা যায়! কারণ, কিরনশঙ্করকে পেছন থেকে গুলিটা তিনিই চালিয়ে ছিলেন। তারপর রায়দের অনেক ধনসম্পদ নিয়ে উল্লাসপুর ছেড়ে পালিয়ে যান। তবে কোথায় গেছেন সেটা নাকি কারুর জানা নেই আর একটা কথা, বীরভদ্র সিংহ কিন্তু কিরনশঙ্করের কোন বাল্যবন্ধু নন, বংশ পরম্পরায় বীরভদ্ররা ছিলেন রায়বাড়ির রাজ মিস্ত্রী। কিরনশঙ্কর মারা যাওয়ার পর বীরভদ্র নাকি উল্লাসপুর ছেড়ে পালিয়ে যান।”
“কিন্তু অমিত গৌতমের চিঠি বলছে বীরভদ্রের শেষ জীবন খুব কষ্টে কেটেছে। ধনসম্পদ নিয়েই যদি পালাবে তাহলে অর্থাভাব হওয়া উচিৎ ছিল না! আর চিঠি পড়ে তো মনে হচ্ছে বীরভদ্র শেষ জীবনে খুব কষ্টে ছিলেন, শারীরিক এবং মানসিক সব দিক থেকে”
“একেবারে ঠিক! এ ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভাবে একমত। উল্লাসপুরের সাধারন মানুষ যেটা জানে, সেটা হয় অসম্পূর্ণ অথবা ভুল! আসলে রায়দের ধনসম্পদ নিয়ে অন্য কেউ উল্লাসপুর ছেড়ে পালিয়ে যান আর দোষটা এসে পড়ে বীরভদ্রের ঘাড়ে। আর একটা সম্ভাবনাও রয়ে গেছে! হয়তো সেই ধনসম্পদ আজও এই উল্লাসপুরের কোথাও রয়ে গেছে”
“আর ডঃ মিত্র সেটা বুঝতে পেরেছিলেন?”
“হান্ড্রেড পারসেন্ট! বুঝতে পেরেছিলেন, হয়তো সত্যিটাও জানতে পেরেছিলেন! কিন্তু সেটা খুঁজতে গিয়ে তিনি নিজে যে কোথায় গেলেন সেটাই বোঝা যাচ্ছে না!”
[৫]
সারাদিন কেমন আলস্যে কাটলো, প্রফেসর বেরিয়ে পড়েছিল উল্লাসপুরের ম্যাপের সন্ধানে। অভিজিত প্রফেসরের সঙ্গে যেতে পারেনি, তার কি সব কাজ ছিল, তবে ওদের গাড়ি গেছিল তার সাথে। আমি সারা দিন এদিকে ওদিকে ঘোরাঘুরি করেই কাটাচ্ছিলাম। দুপুরের লাঞ্চে প্রফেসর আসেনি, ফোনে বলল – “একবার থানায় যেতে হবে, আমি এদিকেই লাঞ্চ করে নেবো, চিন্তা কোর না”
লাঞ্চে অভিজিতের সঙ্গেই করছিলাম, সেই রকম রাজকীয় ব্যবস্থা আবার। একটু কুণ্ঠা থাকলেও প্রশ্নটা করেই ফেললাম, “আচ্ছা তোরা কি রোজ এই রকম দশ রকমের পদ দিয়ে ভাত খাস”
হেসে ফেলেছিল অভিজিত, “একেবারে না, আরে বাবার এস্কিমিক হার্ট, সব খাওয়া বারন, মা কোনদিনই বেশী খেতেন না, আমার ও বয়সের সাথে সব বন্ধ হয়ে গেছে। আসলে বাড়িতে গেস্ট এলে বাবা আবার সেই চল্লিশের দশকে ফিরে যান”। ওর মুখেই শুনলাম সুভাষ চন্দ্র বোস শুধু আসেনই নি, ওদের বাড়িতে নাকি খেয়েও গেছেন। তাই এখনো তার স্মৃতিতে ওর বাবা বলেন “অতিথির জন্য সেরা ব্যবস্থা”। আমাদের সেই ছোটবেলার কিছু স্মৃতিচারণ হচ্ছিল, স্কুলের কথা, পুরোনো বন্ধুদের কথা, আর একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটল। আর সত্যি ডঃ মিত্রকে খুঁজে পেলে যেমন একটা স্বস্তি হবে, এবারেও আমার সেই রকমই হল। আসলে পাঁচ দিন আগে থেকেই অভিজিতের যত বার কথা বলেছি, একবার ও ফুটবল নিয়ে কথা বলেনি। আমি পেশায় ক্রীড়া সাংবাদিক, খেলার এত কভারেজ করি, কিন্তু একবার ও আমাকে খেলা নিয়ে কিছু জিগ্যেস করেনি। সত্যি বলতে অভিজিত আর ফুটবল এই দুটো ব্যাপার এক জায়গায় নেই এটা ভেবেও আমার ভালো লাগছিল না। তো, সামনে ফুটবল বিশ্বকাপ, সেই নিয়ে রোজ কাগজে নানা খবর আসছে, হাতে আজকের কাগজ ছিল, সেখানে বর্তমানের সেরা গোলকিপার নিয়ে একটা বেশ ভালো কভারেজ এসেছে। আমার পড়া হয়ে গেছিল, ইচ্ছে করে একটু তাতাবার জন্য বললাম – ‘এই ন্যয়ারটাকে নিয়ে বড্ড মাতামাতি করছে কাগজ গুলো! জার্মানি যে কি ভাবছে ওকে নিয়ে”
কথা শেষ হল না, সেই বাইশ বছর আগের মতো জবাব এলো – “ন্যয়ারকে নিয়ে কোন কথা নয়! ও রকম গোলকিপার দেখেছিস আগে? গোলকিপিঙের কনসেপ্টটাই চেঞ্জ করে দিয়েছে ও। লেভ ইয়াসিনের পর ন্যয়ার!”
ন্যয়ার কে আমারও ভালো লাগে, সত্যি বলতে কি খুবই ভালো লাগে। তবে “লেভ ইয়াসিনের পর ন্যয়ার” নাকি মাঝখানে অন্য কেউ, তা জানার বা তা নিয়ে তর্ক করার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না। তবে ব্যাপার টা আমাকে খুব স্বস্তি দিল। অভিজিতের গোলকিপার প্রীতিটা আগের মতোই রয়ে গেছে! ছিয়াশির ওয়ার্ল্ড কাপের পর আমরা যখন সবাই মারাদোনা, সক্রেটিস, প্লাতিনিকে নিয়ে আলোচনা করতাম ও পড়ে থাকতো শিলটন, শুম্যাখার, মারি পাফ কে নিয়ে! যাক নিজের পছন্দ টা এখনো ছাড়েনি অভিজিত!
যাহোক, শেষ দুপুরটায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, প্রফেসর এসে ঘুম ভাঙ্গালো। “ওঠো, কত ঘুমোবে বলতো? সারাদিন ধরে খালি ঘুমিয়েই যাচ্ছে, এই এসেছ তদন্ত করতে?”
“তদন্ত তো তুমি করছো! আমি তো স্রেফ ছুটি কাটাচ্ছি! তা বলো কি জানলে সারা শহর ঘুরে?”
প্রফেসর একটা সিগারেট ধরালো, “ডঃ মিত্রর মেয়েকে ফোন করেছিলাম, গত বছর মার্চ মাসে তিনি প্রায় এক মাস নেপালে কাটিয়েছিলেন। কেন গেছিলেন সেটা জানা নেই”
“সেখানেই কি বীরভদ্রর ব্যাপার টা জানতে পারেন?”
“হতে পারে। আর পুলিশ যে একেবারে কিছু করেনি তা কিন্তু নয়! থানায় সাতজন মাত্র পুলিশ! সে নিয়ে এই কেস সলভ করা অসম্ভব, যেখানে আমাদের দেশে আবার কনভেনশনাল ক্রাইম এতো বেশী?”
“কিছু বলল ওরা?”
“ডঃ দেব কুমার মিত্র অটো ভাড়া করে মাঝে মাঝেই এখান থেকে প্রায় পঞ্চাশ, পঞ্চান্ন মিনিট জার্নি করে কুচবিহার সদরে একটা সাইবার কাফেতে যাচ্ছিলেন, এই খবরটা কিন্তু পুলিশই দিল”
“রোজ যেতেন?”
“এই কদিনে চার পাঁচ বার গেছিলেন, এবং শুধু ইন্টারনেট ব্যবহার করা নয় নিয়মিত বেশ কিছু ফোনও করেছিলেন। তারপর সেই সাইবার কাফের পুরোনো ওয়েব পেজ এবং ফোনের ডিটেল চেক করে পুলিশ এটা জানতে পারে, ডঃ মিত্র একটি বিশেষ ব্যাপারে পড়াশোনা করছিলেন। এমিলি রোজমারি স্টার্ক নামে এই ব্রিটিশ মহিলা যিনি কিনা ১৯৩৯ সালে মারা যান, তার সম্পর্কে এই পড়াশোনাটা চলছিল। নিয়মিত ফোনে কথা বলছিলেন ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম বা এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত বেশ হিস্টোরিয়ানের সঙ্গে”
“এই বয়সে এতো পড়াশোনা? এতো এক অদ্ভুত পাগল লোক?”
“আরো একটা পয়েন্ট! পুলিশ এটাও বলল, এই তো ইনফরমেশন নিয়ে ডঃ মিত্রর এই যে পাগলামি সেটা কিন্তু আজ প্রথম নয়। বহরমপুর কলেজের চাকরীটা খুইয়েছিলেন এই পাগলামির জন্য। ইতিহাসের অধ্যাপক, ক্লাসে ছাত্রদের প্রোবাবিলিটি শেখাচ্ছিলেন”
“তুমি কি বুঝছ পুরোটা শুনে”
“পুরো গল্পটা তো এখনো বলিনি, এবারে বলব। তথ্য পুলিশ অনেক পেয়েছে, কিন্তু দুইয়ে দুইয়ে চার পুলিশ করতে পারেনি। ডঃ মিত্রর দেখিয়ে দেওয়া রাস্তায় বাকী ইনফরমেশনটা আমি সংগ্রহ করলাম, বেশ কিছু মানুষের সাহায্যে। ইংরাজিতে রোজমারি বাংলায় রোজমেরী কে ছিলেন জানো? তিনি ছিলেন রংপুরের কোম্পানীর রেসিডেন্ট রিচমন্ডের মেয়ে এবং তিনি ছিলেন আজীবন অবিবাহিত। আর রিচমন্ড কে ছিলেন? জন এডওয়ার্ড বিডওয়েলের দাদু। সুতরাং রোজমেরী স্টার্ক ছিলেন এডওয়ার্ডের পিসি। তবে মনে রেখো, ১৯৪৪ সালে ঝড় বাদলে রাতে এডওয়ার্ড যখন বাক্সটা পাঠাচ্ছেন তখন কিন্তু রোজমেরী মারা গেছেন। সুতরাং বাকী লিঙ্কটা এবার তোমাকে আর আমাকে বার করতে হবে”
“আচ্ছা এই রোজমারি স্টার্ক ও পারফেক্ট স্কোয়্যার?”
“নিঃসন্দেহে! মিলতেই হবে, মেলাও, যোগফল পাবে ২২৫, আবার পারফেক্ট স্কোয়্যার। এটা ঠিক সেই সিরিয়াল কিলিং-এর রহস্যের মতো, প্রতি স্টেপে স্টেপে কিরনশঙ্কর আর এডওয়ার্ড সুত্র ছেড়ে গেছেন, কিন্তু সেটা কি ? কেন ছেড়ে গেলেন? আমি এতটাই গর্দভ এখনো সেটা বুঝতে পারছি না।”
“আচ্ছা প্রফেসর, রোজমারি যদি রংপুরেই থাকতেন তাহলে ওনাকে হয়তো সমাধিস্থ এখানেই করা হয়েছে। একবার কবর স্থানে রোজমারির জায়গাটা খুঁজে দেখলে হয় না? যদি কিছু ক্লু পাওয়া যায়!”
“ব্রিলিয়ান্ট!” প্রফেসর কে এতো জোরে চেঁচিয়ে উঠতে আমি কখনো দেখিনি। “চলো, এখনই চলো। কবরস্থান ছাড়া রায় বাড়ির সঙ্গে রোজমারির সঙ্গে অন্য কোন লিঙ্ক থাকা তো উচিৎ নয়, সুতরাং ওনার কবর স্থান খুঁজতে হবে”
অভিজিতকে খবর পাঠানো হল, ও সাথে সাথেই এল, সঙ্গে দুজনকে নিয়ে আমরা এগোলাম কবরস্থানের উদ্দেশ্যে। আমাদের সঙ্গে যে দুজন ছিলেন তাঁদের একজন এস্টেটের অফিসে কাজ করেন, নাম সম্বিত বসু, প্রথমে বলছিলেন – “এমনিতে কোন অসুবিধা নেই, তবে পরিত্যক্ত এলাকা তো, সাপ খোপ থাকতে পারে, আমি বরং কাল পরিষ্কার করিয়ে রাখি”
কিন্তু প্রফেসর অপেক্ষা করতে চাইলো না, সঙ্গে কার্বলিক অ্যাসিড, ঝোপ পরিস্কার করার কিছু লাঠি রইল, অভিজিত আমাদের পা ঢাকা বড় জুতো ও জোগাড় করে দিয়েছিল। ওর বাবাকে আমরা কিছু জানাই নি, অন্ধকার হবার আগেই আমাদের কবরস্থানে পৌঁছনোর দরকার ছিল, আমরা পৌঁছেও গেলাম। দীর্ঘ দিনের সেই পরিত্যক্ত সেই কবর স্থানে পৌঁছে দুই মিনিটের মধ্যে সেটা বুঝলাম এখানে এমিলি রোজমারি স্টার্কের কবর খুঁজে বার করা খুব সহজ নয়। প্রথমত কবর স্থানে যে মার্বেল প্রস্তর ফলক টা রাখা হয়, সেটাকে কিনা সমাধির নিশান করা হয়ে থাকে, সেটাই অনেক জায়গায় নেই, কোন জায়গায় সেটা ভেঙ্গে গিয়ে অর্ধেক অবশিষ্ট আছে, কোন জায়গায় তার ওপর এত ময়লা জমেছে যে সেটাতে কি লেখা আছে সেটা বোঝা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, অজস্র আগাছায়, বড় বড় গাছে পুরো জায়গাটা ভর্তি, সুতরাং সেই ঘন গাছের আচ্ছাদনের নিচে ঠিক কোন জায়গায় সমাধি আছে আর কোন জায়গাটা খালি জায়গা, সেটা বোঝা মোটেও সহজ হবে না। আমি প্রফেসরের দিকে তাকালাম, বুঝতে পারলাম তার মনেও এক প্রশ্ন। খুব আস্তে গলায় আমাকে বলল – “পাথরের ওপর কি লেখা আছে তা তো বোঝাই যাচ্ছে না, নাম দেখে রোজমেরী স্টার্ককে খুঁজে বার করা সম্ভব হবে না, অন্যকিছু ক্লু আছে”
মিনিট পাচেক এলোপাথাড়ি ঘোরাঘুরির পর কিছুই হল না, আমরা ঠিক করলাম ফিরে আসব। ফিরে আসছিলাম, হঠাত প্রফেসর থমকে দাঁড়িয়ে গেল, “কি হল?”
প্রফেসর এবারে সম্বিত বাবুর তাকালো, “সম্বিতবাবু, এখানে কটা গ্রেভ আছে সব নিয়ে? টোটাল? একটু জানা যাবে? আমার নাম দরকার নেই, আপনি খালি টোটাল নম্বরটা বলুন”
সম্ভিতবাবু ওনার সহকারী মানুষ কে গোনা শুরু করলেন, আমাদের জীপ ড্রাইভার ও সে কাজে যোগ দিল, মিনিট পাঁচেক বাদে, তখন ও কাজ টা পুরোদমে শুরু হয়নি, প্রফেসর আবার বলল – “সম্বিতবাবু, আমি জানি কটা আছে?”
“মানে?”
“আপনি গুনুন, তবে হয় ৬৪ হবে নয়তো ৮১, এর বাইরে হবে না!”
“আবার পারফেক্ট স্কোয়্যার?” অজান্তেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
প্রফেসর মুখে আর কিছু বলেনি, খালি একটা সিগারেট ধরালো। কাজটা শেষ হল, তখন ঘড়িতে প্রায় ছটা, আকাশে আলো আছে তবে আর মিনিট দশেকের মধ্যে অন্ধকার ছেয়ে ফেলবে। সম্বিতবাবু টোটাল নম্বরটা কনফার্ম করলেন, আমরা বাকিরা সবাই অবাক হয়ে চেয়ে আছি, কারণ গোরস্থানে সর্বসাকুল্যে ৬৪ টা কবরস্থান আছে। সুতরাং প্রফেসরের অনুমান নির্ভুল। আবার পারফেক্ট স্কোয়্যার।
সন্ধ্যে থেকে প্রফেসরের মুখে একটা কথা শুনিনি, যখনই দেখেছি হয় পায়চারি করছে নয়তো সিগারেট খাচ্ছে। আজ তো ডিনারেও গেল না, আমি অবশ্য গেছিলাম। অভিজিতের সঙ্গে বেশ ভালো একটা আড্ডা ও হল আজে, ঘরে ফিরলাম, তখন প্রায় সাড়ে দশটা। একেবারে প্রস্তুত ছিলাম না প্রফেসরের এই কথাটার জন্য, আমার দিকে তা তাকিয়ে কথা গুলো বলল, তবে সেই গুলো আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা সেটা নিঃসন্দেহ।
“আচ্ছা, কুইন্স গ্যামবিট আক্সেপ্টেড, এটা তো একটা দাবার চাল! তাই না?”
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, সে আবার বললে – “সাদা বোড়ে নিয়ে আমি গেলাম ডি-৪, কালোর বোড়ে নিয়ে তুমি এলে ডি-৫, তারপর আমি সাদার দ্বিতীয় বোড়ে নিয়ে এলাম সি-৪, তুমি কালো বোড়ে নিয়ে ডি-৫ থেকে সি-৪ এ এসে আমার সাদা বোড়েটা কেটে দিলে, তার মানে আমি কুইন্স গ্যামবিট আক্সেপ্ট করলাম। কি ঠিক তো?”
“কি পাগলের মতো বকছ? তুমি কি আমার জন্য এই রাতে দাবার ক্লাস নেবে?”
“না, কিন্তু জানতে চাইছি কুইন্স গ্যামবিট আক্সেপ্টেড এই কথাটার মানে অন্য কিছু বোঝায় কি?”
“আরে সেতো তুমি আগেই বললে, ডঃ মিত্র দাবা শিখছিলেন। সেটাকে নিয়ে এখন এতো ডিসকাশনের মানে কি?”
“ডঃ মিত্রর খাতায় কিন্তু ‘কুইন্স গ্যামবিট আক্সেপ্টেড’ কথাটা আমি পাইনি”
“তাহলে?”
“গোরস্থান থেকে বেরোনোর সময় একটা চার্চের ভগ্নাবশেষ খেয়াল করেছিলে কি? সেই চার্চের বাঁদিকের পাথরের দেওয়ালে খোদাই করে ইংরাজিতে লেখা রয়েছে কুইন্স গ্যামবিট আক্সেপ্টেড। আপাতদৃষ্টিতে একেবারে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক কিন্তু কে লিখল লেখাটা? পাথর কেটে এতো যত্ন করে লেখাটা হলো কেন?”
আমি আর ভাবতে পারছিলাম না, অজান্তে মুখে একটা কথা চলে এল, “এখানে আবার পারফেক্ট স্কোয়্যার নেই তো?”
“সেটাই তো ধরার চেষ্টা করছি, কিছুতেই পারছি না”
“তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও, কাল সারা রাত ঘুমোও নি, আজকেও জাগা, ঘুমোলে দেখবে চট করে কাল মাথা খুলে যাবে”
“বেশ, তাহলে চল, ঘুমিয়ে পড়া যাক”
প্রফেসর আর কোন কথা বলে নি, উঠে এসে আলোটা নিভিয়ে দিল।
রাতে কটা জানি না, আমার ঘুম ভাঙ্গলো, প্রফেসরের গলার আওয়াজে। “উঠে পড়, মাথা খুলে গেছে”
ঘুম জড়ানো চোখে দেখলাম প্রফেসর পূর্ণ উদ্দমে আর একটা সিগারেট ধরালো, আবার বলল “উঠে পড়, কথা আছে। মনে হচ্ছে আরো খানিকটা এগিয়েছি”
উঠে বসতেই হল, “কি বুঝলে?”
“দাবার বোর্ডে কটা জায়গা থাকে?”
ভাবতে হয়নি, উত্তর জানা ছিল, “চৌষট্টি”
“গোরস্থানে কটা গ্রেভ আছে?”
আবার উত্তর এল “চৌষট্টি”
“এবারে এই ৬৪টা কবরস্থান নিয়ে একটা দাবার বোর্ড বানাও, কুইন্স গ্যামবিট আক্সেপ্টেড মানে তুমি এখন কোথায়? দাবার বোর্ডে, সি-৪, আর সি-৪ ই হল এমিলি রোজমারি স্টার্কের কবরস্থান। আর সেখানেই আমাদের কাহিনীর ক্ল্যাইম্যাক্স!”
“কিন্তু তুমি কোনদিক থেকে স্টার্ট করে সি-৪ এ পৌছবে”
“সায়েন্সের স্টুডেন্ট, সব নিয়ম মেনে করা, আমাদের ম্যাপের উত্তর-দক্ষিন ডাইরেকশন ধরে এগোতে হবে”
“তুমি সিওর?”
“হতেই হবে। আর আমার মনে হয়, এই সব কিছু কিরনশঙ্কর করেছিলেন তার সম্পত্তিকে লুকিয়ে রাখবার জন্য নয়। কোন এক বিশেষ ব্যাক্তিকে দেওয়ার জন্য, তাই তাঁর অবর্তমানে সেই সম্পত্তি যাতে ঠিক জায়গায় পৌঁছয় তাই এই রকম ক্লু রাখা আছে। আমাদের তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে সেই সি ৪ এ, দেখতে হবে কেমন কুইন্স গ্যামবিটের চাল রাখা আছে”
ঘড়িতে চোখ পড়তে বুঝলাম প্রফেসর যখন আমাকে ঘুম থেকে তুলেছে তখন পাঁচটাও বাজে নি। দু রাত না ঘুমিয়ে এত এনার্জি কি করে যে আসে, জানি না। আর বিছানায় শোয়া হলনা, ছটার সমর অভিজিত কে ফোন করলাম। আরো এক ঘন্টা লাগল আমাদের বেরোতে।
সম্বিতবাবু এবং অভিজিতদের এস্টেটের অফিসের আর দুই মানুষের সাহায্যে আমাদের সেই তথাকথিত সি-৪ কবরস্থান টা খুঁজে পেলাম। সকাল থেকে খোঁজা শুরু হয়েছিল আমি ঠিক জায়গায় পৌঁছলাম তখন প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেল। কফিনের ওপর মার্বেল ফলক নেই, সুতরাং কবরস্থান দেখে এটাই যে রোজমারির কবরস্থান বোঝা যায়নি। যদিও প্রফেসরের বলছিল, আমরা কোন ভুল করিনি। কবরস্থানে পৌঁছে দেখা গেল, সেখানে কোন কফিন নেই। প্রফেসর বলল, “প্রায় আশি বছর কেটে গেছে, সুতরাং এটা যে হতেই পারে। তার ওপর মাঝে দুটো-তিনটে যুদ্ধ হয়ে গেছে। মাঝে এই রকম পরিত্যক্ত কবরস্থান, কফিন না থাকাটাই স্বাভাবিক”, কিন্তু অবাক যেটা লাগল প্রফেসর না বললেও আমি বুঝতে পারছিলাম, এই কবরস্থানে কিন্তু মাঝে হাত পড়েছে। চারপাশে জঙ্গল থাকলেও এই কবরস্থানে কিন্তু জঙ্গল বা আগাছা অনেকটাই পরিষ্কার অন্যগুলোর তুলনায়। প্রফেসরের চোখের দিকে তাকালাম, বুঝলাম তার মনেও এই কথা চলছে “ডঃ মিত্র কি দেড় মাস আগে এখানেই এসেছিলেন?” আরো ভালো ভাবে নিরীক্ষণের পর আমরা যেটা বুঝলাম কফিনের নিচে আর একটা বেশ বড় ৫ফুট বাই ৪ ফুটের পাথরের ফলক লাগানো রয়েছে, সেটার চারদিকে আর একটা লোহার ফ্রেম লাগানো রয়েছে। খানিকক্ষন চেষ্টা হল যাতে ঐ ফলকটাকে ফ্রেম থেকে সরানো যায়, কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। এবারে যেটা দেখা গেল সেটা আরো অদ্ভুত। পাথরের নীচে তিনটে গজাল এমন ভাবে লাগালো, ঠিক যেন একটা লক। আর সেই লক অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে পাথরের ফলকের সঙ্গে লেগে আছে, সেটাকে ছেনি বাটালি দিয়ে সেটাকে খোলা সম্ভব নয়। বেশ মিনিট দশ পনেরো মিনিটের চেষ্টা হল কিন্তু জিনিসটা খোলা গেল না। আমরা যখন সবাই ভাবছি আমাদের পরিবর্তী স্টেপ কি হবে প্রফেসরের গলা শুনলাম, “চলুন এবারে বাড়ি ফেরা যাক, আমার যেটা দেখার সেটা দেখা হয়ে গেছে”।
আমি জানি আমার হাজার প্রশ্নের উত্তরে প্রফেসর এখন কিছুই বলবে না, তাই আমি আর কিছু বলিনি। লাঞ্চের পর ঘরে এসে সারা দুপুর ধরে প্রফেসর সেইসব পুরোনো কাগজপত্র, বই, ডঃ মিত্র বই ঘাঁটছিল, আমি সকালে অসম্পূর্ণ ঘুমটাকে সম্পূর্ণ করার কথা ভাবছি, এমন সময়ে প্রফেসরের গলা শুনলাম, “ক্ল্যাইম্যাক্সের জায়গাটা আমরা ঠিক বুঝেছি, কিন্তু সময়টা ঠিক ধরতে পারিনি”
“মানে?”
“সূর্যোদয় ছাড়া ক্ল্যাইম্যাক্সটা হবে না।”
“তার মানে, ডঃ মিত্র এই স্পটেই সেদিন গেছিলেন?”
প্রফেসর মুখে কিছু বলেনি, খালি সম্মতিসুচক ভাবে মাথা নাড়ল। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, “তাহলে ভদ্রলোক তারপর গেলেন কোথায়?”
“সেটাই তো বুঝতে পারছি না, কাল সকাল সাড়ে চারটের বেরোতে হবে, আমি, তুমি আর অভিজিত, আর কাউকে নেওয়ার দরকার নেই”
[৬]
সারা রাত আমার ভালো করে ঘুম হয় নি, অভিজিত রাতে আমাদের ঘরেই ছিল। আমরা ঠিক চারটে কুড়িতে বেরিয়েছি, অভিজিত নিজেই আমাদের ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে। অভিজিতের মনেও অনেক প্রশ্ন ছিল, ওকে কাল রাতে আমি খানিকটা ব্রিফ করে রেখেছিলাম, প্রফেসর কোন কথাই বলছিল না। বুঝতে পারছি মনের মধ্যে একটা ঝড় চলছে, বোঝা যাচ্ছে একটা কিছু হবে কিন্তু কি হবে সেটা সম্পূর্ণ অজানা। গোরস্থানে গেটে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রোজমারির কবরস্থানে আমরা যখন পৌঁছলাম তখন চারটে সাইত্রিশ। সূর্যোদয়ের সময়টা কাগজে দেখে রেখেছিলাম ৪-৫৫। রোজমারির কবরস্থানের আগাছা, জঙ্গল পরিষ্কার করা হয়েছিল কালকেই, আমরা তিনজনেই দাঁড়িয়ে আছি। আর একটা জিনিস ও দেখলাম যেটা কাল বুঝিনি, কবরস্থানের পূর্ব দিকের গাছ গুলো কিন্তু অনেক উঁচু এবং তুলনামূলক ভাবে অনেক ঘন। ঘন জঙ্গল হলেও এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে, আকাশ আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে আসছে।
চারটে পঞ্চান্ন হয়ে গেল, পূর্ব আকাশে সূর্য দেখা দিল, সূর্যের তেরছা কিরন গাছের ফাঁক দিয়ে আসতে শুরু করেছে। আমরা সবাই সেই ৫ফুট বাই ৪ ফুটের পাথরের ফলক আর লোহার ফ্রেমকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি, তারপরেই আমাদের বিস্ময়ের পালা শুরু! একটা আওয়াজ কোথা থেকে এলো জানি না, ঠিক যেন একটা তালা খোলা হল, আমরা তিনজনে মিলে পাথরের ফলকটাকে একটু টানতেই বুঝলাম, সে লকটা কাজ গজাল গুলোকে ধরে রেখেছিল, কিন্তু সেই লকটা কিন্তু এখন নিজে নিজেই খুলে গেছে, ঠিক যেমন করে একটা স্ক্রু ম্যানহোলের ঢাকনা কে ধরে রাখে, ঠিক তেমন করে এখন পাথরের ফলকটা লোহার ফ্রেমের গায়ে লেগে আছে। প্রফেসর পাথরের ফলকটা এক হাতে টেনে তুলল, যতটা জায়গা হলো তাতে একজন মানুষ স্বছন্দে ভেতরে ঢুকতে পারে। প্রফেসর ঢুকে পড়ল, আমরা দুজন পিছু পিছু। পাথরের ঢাকনাটা আলগা করে বসানো রইল লোহার ফ্রেমের ওপর। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, খালি চোখে কিছু দেখা যাচ্ছে না, আমাদের দুজনের কাছেই টর্চ ছিল, জ্বালাতেই বুঝলাম সিঁড়ি আরো নেমে যাচ্ছে, দুটো সিঁড়ি নেমেছি আর এক দুঃসহ গন্ধ আমার নাকে এল, এখন আর বেরোনোর উপায় নেই, আমরা আরো সামনে এগিয়ে গেলাম। নটা সিঁড়ি নামার পর সেটা বুঝলাম এটা একটা ছোট ঘর, চারদিক টর্চের আলোয় খুঁজতে যেটা দেখলাম আমি হয়তো এই জীবনে সেটা ভুলতে পারবো না! সেই ঘরের কোনে কাঠ হয়ে পড়ে আছেন ডঃ মিত্র, দেড় মাসের কাছাকাছি আটকে পড়ে আছেন তিনি, অক্সিজেন, জল, খাদ্যের অভাবে এক ভয়াবহ মৃত্যু হয়েছে তাঁর, সারা শরীরে তাঁর পচন শুরু হয়ে গেছে। চোখের নজর যখন স্থিত হল, অন্য দিকে তাকিয়ে দেখলাম বড় বড় সাইজের দুটো বাক্স, প্রফেসর বাক্স দুটো খুলল – বাক্সে সাজানো রয়েছে অজস্র মণিমাণিক্য, সোনা, দানা, পুরোনো মোহর। মনিমানিক্য, সোনাদানার মুল্য কত হবে আমি জানি না, তবে কয়েক কোটি ছাড়িয়ে যাবে সেটা বলাই বাহুল্য। এবারে আমার পায়ে যেন কিছু ঠেকল, আলো ফেলে দেখলাম আর একটা টর্চ, মনে পড়ল সৌরীন রায় দিয়েছিলেন ডঃ মিত্র কে!
একদিকে অসহ্য গন্ধ আর চাপা সেই জায়গায় নিশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল, সুতরাং আমাদের তাড়াতাড়ি সে গুহা থেকে বেরোতে হবে, আমরা প্রফেসরকে আবার অনুসরন করলাম, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যেটা দেখলাম সেটা আবার চরম বিস্ময়েয়। পাথরের ঢাকনা আবার সেই লোহার ফ্রেমের ওপরে চেপে বসে পড়েছে। ভেতর থেকে চাপ দিয়ে সেটা খোলা সম্ভব নয়, আমার সিক্সথ সেন্স যেন আমার মুখে কথা ফোটাল, “প্রফেসর, বেরোনোর রাস্তায় পারফেক্ট স্কোয়্যার”। টর্চের আলোয় খোঁজা হল, পেয়ে ও গেলাম, ছোট একটা সিলিন্ডারের মতো, লোহার ফ্রেমের নীচের দিকে লাগানো। সেখানে পরিস্কার তিনটে নম্বর বাছা যেতে পারে, আমাদের অনুমান মিলে গেল, কম্বিনেশন লক খোলার নম্বর ১৬৯, সেটা চাপ দিতেই আগেকার মতো তালা খোলার আওয়াজ, পাথরের ঢাকনা নিজে থেকে আলগা হয়ে গেল।
রায়বাড়ির বৈঠকখানায় বসেই কথা হচ্ছিল। প্রফেসর বলছিল আমরা সবাই শুনছিলাম, “আমি যতটা বুঝেছি ততটা বলব, তবে এখানে আমার কিছু অনুমানও আছে। পুরো সত্যি হয়তো নাও হতে পারে, কিন্তু মোটামুটি জিনিসটা এই রকমের। আমাদের এই ঘটনার শুরু তখন কিরনশঙ্কর আর এডওয়ার্ড বিডওয়েলের রিসার্চ মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস পৃথিবীর দুই প্রান্ত হলেও এদের দুজনের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, এবং এঁরা ঠিক করলেন একটা লক তৈরি হবে, যে লকের দুটো লিভার থাকবে। বাইরের লিভারটা অ্যাক্টিভ হবে সূর্যের আলোয়, আর ভেতরের টা খুলবে একটি বিশেষ নম্বরের কম্বিনেশনে। আমার মনে হয়, যে কোন তিন সংখ্যার পারফেক্ট স্কোয়্যার নম্বরের সাহায্যে এই লক ভেতর থেকে খুলতে পারে। ১২১, ১৪৪ অথবা ৬২৫ যে কোন পারফেক্ট স্কোয়্যার সংখ্যার কাজ করা উচিত। এডওয়ার্ড বিডওয়েল জার্মানিতে গেলেন এবং কম্বিনেশন লক বানানোর প্রযুক্তি টা শিখে ফেললেন। এবারে রিসার্চ চলতে থাকলো, যে লিভার সূর্যের আলোয় সক্রিয় হবে তাঁকে বানাতে হবে একটি বিশেষ তেজস্ক্রিয় উপাদানের সাহায্যে। সেও বানানো হল।
এবারে কথাটা হল, লকটা তৈরি হবে কেন? যদিও রায়রা বংশপরম্পরায় ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষক, কিন্তু কিরনশঙ্কর আবার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে দীক্ষিত। সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ বাহিনীকে কথা দিয়েছেন অর্থ সাহায্য করবেন। তাহলে সেই ধন সম্পদকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু কোথায় লুকোবেন? মাথা খাটিয়ে একটা জায়গা বার করলেন। ব্রিটিশদের সেই কবরস্থান যা তখন সাধারন মানুষের ব্যবহারের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। এমিলি রোজমারি স্টার্কের কবর স্থানের নিচে বিশেষ গুহা তৈরি হল। আরো অনেক কবর ছিল! এমিলি রোজমারি স্টার্ক কেন? দুটো কারণ মনে আসে। এক, হয়তো তিনি ছিলেন এডওয়ার্ডের পিসি, এডওয়ার্ড ছিলেন ওনার খুব কাছের মানুষ, আর নয়তো, তাঁর নামে সেই পারফেক্ট স্কোয়্যার! যা হোক, সেই গুহা তৈরি করলেন বীরভদ্র, যাকে আপনারা মীরজাফর বলেন। আর কিরনশঙ্কর একটা ক্লু রেখে গেলেন, যদি তিনি আক্রান্ত হন। কবরস্থানে ঢোকার মুখে পুরোনো চার্চে প্রস্তর ফলকে লিখে দিলেন ‘কুইন্স গ্যামবিট আক্সেপ্টেড’। তারমানে দাবার বোর্ড ধরে এগিয়ে যাও, তারপর একটি বিশেষ স্থানে রইল আমার লুকোনো সম্পদ। পাতালে ঢোকার মুখে লাগালো হল এই লক। সূর্যের আলোয় সেই লক নিজে থেকে খুলবে, কয়েক সেকেন্ডের জন্য, তারপর আর নয়। এখানেও এক অনবদ্য প্রযুক্তি ব্যবহার হল। সূর্যোদয়ের সময় সূর্য থেকে যে প্রথম যে কিরন আসে তার একটি বিশেষ অ্যাঙ্গেল এবং বিশেষ তরঙ্গ দৈর্ঘ্য থাকে। সেই বিকিরনেই এই লক সক্রিয় হবে এবং সূর্যের অ্যাঙ্গেল সামান্য পরিবর্তন হলেই সেই লক আবার নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। তখন খোলার রাস্তা খালি ভেতর থেকেই। সুতরাং ভেতরে ঢুকে পড়লে বেরোতে গেলে এক বিশেষ কম্বিনেশনের সাহায্য নিতে হবে। নাহলে কোন ভাবেই গুহা থেকে আর বেরোনো যাবে না। এক অসাধারণ নিরাপত্তার প্রয়োগ। কিন্তু কোনভাবে কিরনশঙ্কর আক্রান্ত হলেন, যা অর্থ, সম্পদ জমানো হয়েছিল তা আর নেতাজীর আজাদ হিন্দ বাহিনীকে দেওয়া হল না। এডওয়ার্ড বিডওয়েল আগেই মারা গেছেন, সুতরাং আর একজন মাত্র মানুষ রয়ে গেলেন যিনি এই জিনিসটা জানতেন, তিনি বীরভদ্র। কি পরিস্থিতিতে তিনি নেপালে চলে গেলেন বা কেনই বা চলে গেলেন সে আমি জানিনা!
যাই হোক প্রায় সত্তর-আশি বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটা আর একবার নতুন করে শুরু হল বছর খানেক আগে যখন ডঃ দেব কুমার মিত্র কোনভাবে নেপালে বীরভদ্রের রেখে যাওয়া কোন ইনফরমেশন পেলেন এবং সেইখান থেকে অনুসন্ধান শুরু করেন। ইতিমধ্যে ডঃ আদিত্য পাঠক ‘ইন্ডিয়া টুডে’ তে আপনাদের বাড়ি নিয়ে লিখেছেন, ডঃ মিত্রর বদ্ধমুল ধারনা হল আপনাদের বাড়িতে লুকোনো ধন আছে। রায় বাড়ি সংক্রান্ত তথ্যসংগ্রহ শুরু করলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিরনশঙ্করের রিসার্চ পেপার জোগাড় করে পড়াশোনা শুরু করলেন। তারপর সুবিধামত, তিনি এখানে চলে এলেন, কিন্তু তিনি একটা মস্ত বড় ভুল করেন। নিজের আসার উদ্দেশ্যটা তিনি আপনার কাছে গোপন করেন। কেন, আমার জানা নেই? হয়তো ধন সম্পদের লোভ, অথবা নাম, যশ, প্রতিপত্তির ইচ্ছা সে আমি জানি না। যা হোক, দিন কয়েকের চেষ্টায় তিনি কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটা জেনে ফেললেন। কিরনশঙ্কর কোন নিরাপদ জায়গায় ধনসম্পদ লুকিয়ে রেখেছেন এবং সেই জায়গাটাও তাঁর জানা হয়ে যায়। খালি একটা জিনিস তিনি জানতেন না, গুহা থেকে বেরোনোর রাস্তা। আর শেষ ভুলটা করলেন, তিনি একা গেলেন সেই ধনসম্পত্তির খোঁজে, আর সেই ভয়ঙ্কর মৃত্যু তাঁকে গ্রাস করল, কেউ জানতে পারল না।
প্রফেসর সামনের টেবিলে রাখা জলের গ্লাস থেকে বেশ খানিক টা জল খেয়ে আবার শুরু করল – “পুলিশকে সব বলা আছে কাল তাঁরা আসবেন, ডঃ মিত্রর পচিত গলিত দেহটা বার করবে, তারপর যা করার তাঁরা করবেন। আমি সব কিছু তাঁদের সব এক্সপ্লেইন করেছি, আমার সঙ্গে কথাও হয়ে গেছে তাঁরা আপনাদের কোন সমস্যা করবেন না। ওনার মেয়েকেও ব্যাঙ্গালোরে খবর পাঠানো হয়েছে, তিনি ও আসবেন। হ্যাঁ, একটা সমস্যা থাকবেই যতক্ষণ না পুরোটা মেটে, কিন্তু কি করবেন বলুন? মাটির নিচে যা লুকোনো আছে তা একদিন তো বেরতোই! আর আপনাদের অনেক প্রশ্নের সামনে সেগুলো দাঁড় করাতো। যা হোক, দুটো প্রকান্ড সাইজের ট্রাঙ্ক আছে, এই পুরো ধনসম্পদ পুরোটাই কিন্তু আপনাদের। তাতে কারুর কোন অধিকার নেই, এত আলগা সোনা মাটির নিচে ফেলে রাখবেন না। সেটাকে উদ্ধার করুন, আপনাদের সম্পত্তি আপনারা ঠিক করে রাখার ব্যবস্থা করুন। আর হ্যাঁ, হয়তো পুরোনো কিছু কাগজপত্র বা চিঠিপত্র বেরোবে, সেই গুলোকে ঠিক করে রাখবেন। সেই সব জিনিসের ঐতিহাসিক মুল্য কিন্তু অনেক! আর একটা অনুরোধ, ইতালীর ফ্লোরেন্স মিউজিয়ামে একটা ধন্যবাদজ্ঞাপক চিঠি পাঠিয়ে দেবেন, রেবেকা ফিওরেন্টিনোর চিঠি ছাড়া আপনাদের এই সম্পদের খোঁজ পাওয়া যেতো না!”
কয়েক সেকেন্ডের বিরতি নিয়ে সে আবার বলল, “আমরা কাল সকালে বেরোবো, অভিজিতবাবু আপনাকে একটা হেল্প করতে হবে, তৎকালে আমাদের দুটো টিকিট করে দিন,”
শেষ আধ ঘন্টা সৌরীন রায় কোন কথা বলেন নি, এবারে প্রথম বললেন, “লজ্জা না করে বলুন, আপনাকে কত দেবো! পারিশ্রমিক?” আমার সেই ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ মনে পড়ে গেল।
প্রফেসর চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, আর সেই ঠিক ফেলুদার স্টাইলে বলল “আপনার যা ইচ্ছে হয় আপনি দেবেন, আমাদের নিতে কোন আপত্তি নেই খালি টাকা পয়সা ছাড়া! তবে যদি আপনার আপত্তি না থাকে আমি একটা জিনিস আপনার কাছ থেকে চেয়ে নেব”
“বলুন”
“কিরনশঙ্কর আর এডওয়ার্ড বিডওয়েলের তৈরি ঐ লকটা আমি নেবো। যদিও সেটাকে কফিন থেকে আলাদা করতে সময় লাগবে, পাথর কাটতে হবে তবে সেখান থেকে সেটা বেরোবে। প্রযুক্তিগত আর প্রাকিতিক এই দুটো শক্তি মিলে গিয়ে এই অসাধারণ জিনিসটা তৈরি হয়েছে আমি কিন্তু এই রকম জিনিস আর দেখিনি। আর সেই টেকনোলজির যে কি অনবদ্য প্রয়োগ ভাবা যায় না! তাতে কি নেই? ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথিমেটিক্স, ক্রিপ্টোগ্রাফি, সবশেষে ইঞ্জিনিয়ারিং! বীরভদ্র ঠিকই বলেছেন, আলিবাবার রুপকথার গল্প সত্যি হয়ে গেছে। সাত বছর আমি আমেরিকায় ছিলাম, অনেক রিসার্চ দেখেছি, নিজে যুক্তও থেকেছি অনেক কিছুর সঙ্গে, কিন্তু এই জিনিস দেখিনি। তাই আপনার যদি আপত্তি না থাকে”
কথা শেষ হল না, সৌরীন রায়ও উঠে দাঁড়ালেন, “নিশ্চয়ই নেবেন, ঐ জিনিসের যথার্থ বোদ্ধা যদি কেউ থাকেন সে তো আপনিই! অবশ্যই নেবেন।”
“আর শেষ একটা অনুরোধ, কিন্তু আপনাদের এই বিপুল ধনসম্পদের আজ যে সন্ধান পেলেন তার জন্য বিশেষ কৃতিত্ব কিন্তু বীরভদ্রের প্রাপ্য। তাঁর কিন্তু সব কিছু জানা ছিল, তিনি পারতেন লুকিয়ে লুকিয়ে এসে তারপর সব কিছু নিয়ে পালিয়ে যেতে, তিনি কিন্তু জাননি। বরং পর্যাপ্ত সতর্কতা অবলম্বন করেও যথাযথ ইনফরমেশন দিয়ে গেছিলেন, সুতরাং মীরজাফরের তকমাটা তাঁকে আর দেবেন না। ইতিহাসে ভুল থাকলে আমাদের তো ঠিক করে নেওয়া উচিত! তাই নয়?”
কবিগুরুর ‘বিশ্বপরিচয়’, শরদিন্দুর ‘চোরাবালি’ আর সত্যজিৎ রায়ের ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছাড়া পুরোটাই কাল্পনিক। আর হ্যাঁ, এক বুদ্ধিহীন লেখকের কল্পনা প্রসূত এই কাহিনী। এর মধ্যে কোন বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক বা ভৌগলিক সত্যতা নেই।
コメント