top of page

গল্প - তুমি কী কেবলই ছবি

  • অনন্যা ব্যানার্জী
  • Aug 10, 2018
  • 4 min read

Updated: Feb 19, 2021

"কাল আমার প্রোমোশন উপলক্ষে একটা ছোট গেট টুগেদার রাখবো। সব বন্ধু ও তাদের স্ত্রীরা আসবে। এবার আমার বসকেও নেমন্তন্ন করলাম।" - এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে অফিসে বেরিয়ে গেল রূপ। বিয়ের পর পর অভ্যাস না থাকায় সব অ্যারেঞ্জমেণ্ট করতে বেশ অসুবিধায় পড়তে হতো পৃথাকে । এখন সবই নখদর্পনে তার। তা বিয়ের দশ বছর হয়ে গেল পৃথা ও রূপের। আজ সকাল থেকে ডান চোখটা নাচছে। "কোন খারাপ খবর আসবে নাকি?" ভাবতে ভাবতেই, সকালের newspaper টা হাতে নেয় পৃথা। চোখ বোলাতে থাকে খবর গুলোর দিকে। চোখ আটকায় প্রথম পাতার নিচের খবরটায়। IAS কাঞ্জিলাল দত্তের ছেলে অয়নাভ দত্ত গত রবিবার দীর্ঘ বারো বছর পর দেশে ফিরেছে। তার বাবা, ছেলের ইচ্ছেকে সম্মান জানাতে, ও তার প্রতিভা সকলের সামনে তুলে ধরতে কলকাতায় এক Art exhibition আয়োজন করছেন। চলবে আগামী পাঁচ দিন।


পুরনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতেই দরজায় তালা লাগিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায় পৃথা। গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবে - "সব থেকেও কী যেন নেই রূপ ও তার জীবনে, তাদের সম্পর্কে।"


পৃথা এখন রেডিও জকি। কাজ থাকে বেশী দিন সন্ধ্যায়। এখন যে শো-টা পৃথা পরিবেশন করে, তার সময় সন্ধ্যা ৮ টা থেকে ১০টা। তার নাম - "just pyar kiye ja". গতকাল একটা ফোন এসেছিল, নাম বলল প্রীতম সিংহ। কিন্তু অদ্ভুত পরিষ্কার বাংলায় অত্যন্ত চেনা গলায় অপরদিক থেকে অনুরোধ করল গানের। হ্যাঁ, সেই গান যা দিনের পর দিন পৃথা আর অয়ন শুনতো "এই যে হেথায়, কুঞ্জ ছায়ায়" । গানটা আবার প্রায় বারো বছর পর শুনে চোখগুলো অজান্তেই জলে ভরে যায় পৃথার। "তবে কী অয়ন ই ফোন করেছিল? না বারো বছর পর IAS এর ছেলে বড় artist অয়নাভ দত্ত কেন নাম বদলে পৃথাকে ফোন করতে যাবে রেডিও-শো-তে?" - পৃথা শান্ত করে নিজেকে। ভাবে সব মনের ভুল। তারপর আজ সকালের খবর। একটার পর একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার জীবনে।


মনে পড়ে কলেজের সেই দিন গুলোর কথা। চাইলেও সেইসব সুখস্মৃতি তার পিছু ছাড়ে না কখনো। "তবে কী সত্যিই মানুষের জীবনে প্রেম একবারই আসে?" পৃথার থেকে কলেজে দুবছরের সিনিয়র ছিল অয়ন। অপূর্ব ছবি আঁকতো অয়ন। ক্যান্টিনের কাগজে বসে অবহেলায় স্কেচ করতো পেনে। কিন্তু তেমনই বাউণ্ডুলে ছিল। কফি কাপে চাপা দিয়ে উঠে চলে যেত, কখনো আর সেই আঁকার খোঁজ করতো না। পৃথা কতবার নিজে ওই স্কেচ তুলে এনে বাড়িতে যত্ন করে রেখেছে। ভগবান প্রদত্ত গুণের কোন কদর ছিল না অয়নের জীবনে।


মাঝে মাঝে রেগে গেলে বলতো - "বাবা IAS বলে কেন তাকেও IAS হতে হবে? art নাকি খুব ডাউনমার্কেট। এতে মনের খিদে মিটলেও, পকেট ফাঁকা থাকবে"। ফর্সা ছেলে, রাগে দুঃখে মুখ-চোখ লাল হয়ে যেত। পৃথা কতবার জল এনে দিয়েছে, শান্ত করার চেষ্টা করেছে অয়নকে। বুঝিয়েছে - "পড়াশুনা করে পরে তুমি তোমার ইচ্ছে মত পথ বেছে নিও। এতে সবদিক বাঁচবে।"


অয়ন পড়াশুনাতেও ছিল তুখোড়। কিন্তু বাবার ওপর রাগ করে পড়াশুনা করতে চাইতো না মোটেও। অয়নকে কখনো না বললেও, মনে মনে খুব পছন্দ করতো পৃথা অয়নকে। অয়নও পৃথাকে আঁকড়ে ধরেছিল সব অবস্থাতে। বলতো - "তুমি, আমায় ছেড়ে কখনো চলে যেও না পৃথা। দেখছো তো মা সেই ছোটবেলায় চলে গেছেন। বাবার সময় খুব কম। সময় পেলেও তাতে আমার দোষের চর্চা করতে সময় বেরিয়ে যায়। আমাকে কেউ বোঝে না তোমার মত।"


পৃথার কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কখনো কখনো পৃথাকে নিয়ে যেত নিজের বাড়িতে। এত বড় বাড়িতে লোক দুজন। কাজের লোকে ভরা বাড়ি। পৃথা হেসে বলতো - "মালিক চাকরের ratio টা normalize করার কথা কী ভাবছেন না, কাকু?" অয়ন সব কথা শুনেও না শোনা করে, পৃথাকে হাত ধরে নিয়ে যেত নিজের ঘরে, তার জগতে। অয়নের জগতটা ছিল বড়ই রঙীন। তাতে কালো আসতে খুব ভয় পেত। বা হয়তো এলেও অন্য রঙের প্রভাবে সেও হয়ে উঠতো প্রাণময়। পৃথার অয়নের বাড়িতে পছন্দ ছিল অয়নের ঘরের দক্ষিণের জানলাটা। খুললেই সামনে দেখা যেত গঙ্গা। হাওয়ার সঙ্গে বেল ফুলের মিষ্টি সুবাস এসে মাতিয়ে দিত দুই তরুণ-তরুণীকে। ওই জালনায় বসে একবার পৃথার ছবি এঁকে ছিল অয়ন। ওই ছবির মধ্যে দিয়ে পৃথা যেন নিজেকে নতুন করে চিনেছিল সেদিন। এ যেন এক অন্য পৃথা, যে নিজের রূপ, চাঞ্চল্য নিয়ে অতি গোপনে বাস করে শুধুই অয়নের হৃদয়ে। এই ছবিতে কোথাও তার দারিদ্র, তার দুর্বলতার স্পর্শ নেই।


গ্রয়াডুয়েশন করে অয়নকে USA তে পড়তে পাঠায় আঙ্কেল। ইচ্ছে না থাকলেও যেতে বাধ্য হয় অয়ন। পৃথার ও তার এক বছরের মধ্যে বিয়ে হয় রূপের সাথে। গরীব মা-বাবা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব পূর্ণ করতে চেয়েছিলেন। আর অয়নের বাবার চিঠিও এসেছিল পৃথার বাড়িতে। পৃথাকে অয়নের জীবন থেকে চলে যাওয়ার মূল্য জানতে চেয়েছিলেন উনি। লোকলজ্জার ভয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে ঠিক করে পৃথাকে গোত্রান্তরিত করে পৃথার বাবা। অয়নের ফোন নম্বর ব্লক করে দেওয়া হয় সঙ্গে সঙ্গে। তারপর আর কখনো যোগাযোগ হয়নি তাদের।


পৃথাও নিজের বৈবাহিক জীবনের প্রতি কোন ত্রুটি রাখতে চায়নি। রূপের তো এতে কোন দোষ ছিল না। সে কেন তবে কষ্ট পাবে? কর্তব্য পৃথা করে গেছে সংসারের প্রতি। স্বামীর প্রতি। বিয়ের পর কখনো ইচ্ছে করেই অয়নের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি পৃথা। সবসময় পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি বলে মনে মনে নিজেকে কখনো মাফ করতে পারেনি পৃথা।


আজকের সকালে অয়নাভ দত্তর "art exhibition" এর news টা দেখেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল পৃথার। তাই তো সকালে ফাঁকায় ফাঁকায় দেখবে বলে পৃথা বেরিয়ে পড়েছে Birla Academyর উদ্দেশ্যে। ছবির catalogue নিয়ে পৃথা এগিয়ে যায় painting গুলো র দিকে। সেই গান ভেসে আসছে হলে - "এই জীবনে যে কটি দিন পাব, তোমায়-আমায় হেসে খেলে....." ।


ছবিগুলো দেখেই পৃথা বোঝে এই তুলির টান, রঙের খেলা তার অতি পরিচিত। কয়েকটা ছবিতে যেন সে দেখতে পায় সেই প্রিয় জানলা, সেই বেল গাছ, গঙ্গার ধার। এগোতে এগোতে সে এসে দাঁড়ায় শেষ ছবিটার সামনে। চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে জলে। এ তো তার ই ছবি, যা অয়ন এঁকে ছিল বহু যত্ন সহকারে। নীচে ছোট করে লেখা - "Not for sale". - সত্যিই তো চাইলেই কী একটা সম্পর্ক, একটা বন্ধুত্ব ভেঙে দেওয়া যায়? ভালবাসা কী বিক্রি হয়? হলে তার মূল্য নির্ধারণ করবে কে?" - তাড়াতাড়ি হল থেকে বেরিয়ে আসে পৃথা। দৌড়ে যায় লিফ্টের দিকে।


চোখ মুছে ছুটে যায় গাড়ির দিকে। বাড়িতে মেলা কাজ পড়ে। কালকের পার্টির আয়োজন করতে হবে যে। মনে মনে ভগবানের উদ্দেশ্যে অয়নের জন্য প্রার্থনা জানায় পৃথা - "অয়ন, তুমি ভাল থেকো। তোমার আঁকার মধ্যে দিয়ে আমাদের ভালবাসা ছড়িয়ে পড়ুক দেশে-বিদেশে। আমার ভালবাসা চিরকাল বেঁচে থাক তোমার তুলিতে। একে কখনো হারিয়ে যেতে দিওনা।"




Comments


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page