এ-মন-জানলা - লা ইওরোনা (মেক্সিকো)
- কৌশিক দাশ
- Aug 6, 2018
- 6 min read
Updated: Feb 19, 2021
যেকোনো দেশের সাহিত্যের মূল ভিত্তি লুকিয়ে থাকে তার লোক কথায়, ঠাকুমা, দিদিমাদের কাছে শোনা গল্পের মাঝে। ভুত পেতনি দত্যি দানোর সেই অদ্ভুতুড়ে পৃথিবী থেকেই উঠে আসে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের লেখা, হুয়ান রুলফোর লেখা বা মারিও ভারগা ইয়সার লেখা।
আমাদের দেশে কত ভূতের গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আর ভূতের ভয় অল্প বিস্তর সবারই আছে, যদিও ভূতের গল্প পড়তে সব বাঙালিই ভালবাসে। ছোটবেলা থেকে কত রকম ভূতের গল্প আমরা শুনেছি। সেরকমই লাতিন আমেরিকার ভূতের গল্পও সারা পৃথিবীতে খুব জনপ্রিয়। কিন্তু স্প্যানিশ ভাষায় লেখা বলে সেগুলি বাঙালি পাঠকদের খুব একটা পড়ার সুযোগ হয় না। আজ একটা নতুন ভূতের গল্প বলবো যে রাত্রিবেলা কাঁদতে কাঁদতে ঘুরে বেড়ায়- ‘লা ইওরোনা’, একটি পৃথিবী বিখ্যাত লাতিন আমেরিকান ভৌতিক লেজেন্ড।
লাতিন আমেরিকার প্রায় সব দেশেই (যেমন মেক্সিকো, চিলি, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, পেরু, কলম্বিয়া, কোস্তারিকা, এল সালভাদোর, উরুগুয়ে, হন্ডুরাস, ভেনেজুয়েলা ইত্যাদি) এবং স্পেনেও এই গল্পটি শোনা যায়। শত শত বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই গল্পটি শুনে আসছে, কিন্তু আজও এই গল্পের জনপ্রিয়তা এতটুকু কমে নি। একটি ভৌতিক লেজেন্ড নিয়ে এত সংখ্যক প্রচলিত গল্পের নজির পৃথিবীতে বিরল। এই ইওরোনাকে নিয়ে এক একটি দেশে এক এক রকম গল্প প্রচলিত থাকলেও গল্পের মূল জায়গাটি কিন্তু সব দেশেই প্রায় এক-
ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রতারিত হয়ে একজন মহিলা তাদের সন্তানকে (সন্তানদের) নদীর জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলে, তারপর সে আত্মহত্যা করে। এরপর তার বেদনাক্লিষ্ট আত্মা নদীর পাড়ে ‘Ayy mis hijos’ (যার অর্থ হল- oh my children) বলে চিৎকার করতে করতে তার সন্তানদের খুঁজে বেড়ায় আর কাঁদতে থাকে।
স্প্যানিশ ভাষায় ‘La llorona’(লা ইওরোনা)শব্দের অর্থ হল the weeping lady বা ক্রন্দনরতা মহিলা।
এবার মেক্সিকোর প্রচলিত গল্প শোনা যাক।
স্পেনীয়রা যখন মেক্সিকোতে উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল গল্পটি সম্ভবত সেই সময়ের। শোনা যায় এক সুন্দরী মেক্সিকান যুবতী একজন স্পেনীয় যুবকের প্রেমে পড়ে এবং তাদের এই গভীর প্রেমের ফল স্বরূপ তাদের তিনটি ফুটফুটে সন্তানের জন্ম হয়। মেক্সিকান যুবতীটি পরম যত্নে তাদের লালন পালন করতে থাকে। বিভিন্ন মিথ্যা আর আলো আঁধারির মধ্যে গোপনে তাদের সম্পর্কটি চলতে থাকে। বিজাতীয় হওয়ায় তারা এই সম্পর্কের কথা কারোর কাছে প্রকাশ করতো না, বিশেষ করে ছেলেটি। এইভাবে কয়েক বছর চলার পরে তিন সন্তান ও স্পেনীয় যুবকটিকে নিয়ে মেয়েটি একটি পরিবারের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। মেয়েটি সব সময় চাইতো যে তার সন্তানেরা যেন তাদের বাবার পরিচয়ে বড় হয়ে ওঠে। তাই সে তাদের সম্পর্কটিকে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে চাইতো, কিন্তু মেয়েটি এই প্রসঙ্গে কথা বললেই সেই স্পেনীয় যুবকটি বার বার এড়িয়ে যেতো, কারণ তার সামাজিক অবস্থান মেয়েটির থেকে অনেক উঁচু ছিল। সে জানতো যে তার সমাজের লোকেরা তাদের এই সম্পর্কটিকে কোনওভাবেই মেনে নেবে না। তাছাড়া সমাজের নিম্ন বর্ণের একটি মেয়েকে বিবাহ করলে তার সামাজিক সম্মান ক্ষুণ্ণ হতে পারে। এই সব ভেবে স্পেনীয় যুবকটি কিছুতেই তাকে বিয়ে করতে রাজী হতো না।
কিছুদিন পর স্পেনীয় যুবকটি তাকে ছেড়ে দিয়ে উচ্চ সামাজিক মর্যাদা সম্পন্না একজন স্পেনীয় মহিলাকে বিবাহ করে। তার এই বিবাহের সংবাদ জানার পর মেয়েটি বুঝতে পারলো যে স্পেনীয় যুবকটি তার সাথে প্রতারণা করেছে। তার এই আচরণে মেয়েটি খুব মানসিক আঘাত পায়। তার ভালোবাসার মানুষের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে সে তার তিন সন্তানকে নিয়ে নদীর পাড়ে চলে যায়। তারপর তাদের একবার পরম মাতৃস্নেহে জড়িয়ে ধরে এবং তারপরই তাদের নদীর জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলে।
সাময়িক ক্রোধের বশে সে কাজটি করলেও কিছুক্ষণ পর সে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় আসে, কিন্তু ততক্ষণে তার সন্তানেরা নদীর স্রোতে তলিয়ে গেছে। সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে দু হাত বিস্তৃত করে নদীর পাড় ধরে ছুটতে ছুটতে শুরু করে আর তার সন্তানদের পাগলের মত খুঁজতে থাকে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে। এরপর একরাশ বেদনা ও অনুতাপ বুকে নিয়ে সেও নদীর জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।
এবার আর একটি প্রচলিত গল্প শোনা যাক…
মেক্সিকোতে যখন স্প্যানিশ উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল গল্পটিও সম্ভবত সেই সময়ের। একটি ছোট গ্রামে মারিয়া নামে একটি সুন্দরী মেয়ে ছিল। তার জন্ম হয়েছিল একটি গরীব কৃষক পরিবারে।
ধীরে ধীরে মারিয়া বড় হতে লাগলো, তার সৌন্দর্য দিনে দিনে আরও বাড়তে লাগলো। গ্রামের সেরা সুন্দরী হিসেবে তার খ্যাতিও ছিল।
একদিন হঠাৎ ঘোড়ার পিঠে চেপে এক ধনী, সুদর্শন স্পেনীয় যুবক তাদের গ্রামে এসে উপস্থিত হল। তারা দুজনেই একে অপরের রূপে মুগ্ধ হল। তারপর সেই স্পেনীয় যুবক তাকে প্রেম নিবেদন করে এবং মারিয়া তার সাথে প্রেম বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এই সম্পর্কের ফলে মারিয়ার পরিবারের লোকজন খুশী হলেও, সেই স্পেনীয় যুবকের পরিবার এতে খুশী হয় নি। স্পেনীয় যুবকটি এক দরিদ্র পরিবারের মেয়ের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে জেনে তার বাবা খুব রেগে যান এবং স্বভাবতই তিনি এই বিয়ে মেনে নেন নি। তাই মারিয়া এবং তার স্পেনীয় স্বামী তাদের গ্রামেই একটি বাড়ী তৈরি করে থাকতে শুরু করে। এভাবেই দিন কাটতে থাকে, মারিয়া যমজ সন্তানের জন্ম দেয়।
কিন্তু মাঝে মাঝেই তার স্বামী কাজের জন্য মাসের পর মাস বাইরে কাটাতো। মারিয়াকে আর সময় দিত না। মাঝে মাঝে বাড়ী এলেও সে শুধু তার সন্তানদের সাথেই দেখা করতো, মারিয়ার প্রতি তার কোনও ভালবাসা বা দায়বদ্ধতা ছিল না। এভাবেই তাদের মধ্যে ক্রমশ দুরত্ব বাড়তে থাকে।
একদিন সে যখন তার সন্তানদের নিয়ে নদীর ধারে একটি ছোট রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, হঠাৎ সেই পথে ওই যুবকের ঘোড়ার গাড়িটি তাদের সামনে এসে থামলো। সেই ঘোড়ার গাড়িতে একজন সুন্দরী মহিলাও তার পাশে বসে ছিল। সে ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে তার সন্তানদের সাথে কথা বলে, একটু আদর করেই আবার ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরে সেখান থেকে চলে গেল। মারিয়ার সাথে কথা বলা তো দূরের কথা, সে মারিয়ার দিকে ফিরেও তাকায় নি। মারিয়ার বুঝতে আর কোনও অসুবিধে হল না যে তার স্বামী তার সাথে প্রতারণা করেছে।
স্বামীর এই রকম আচরণে সে খুব কষ্ট পেল এবং রাগে ফেটে পড়লো। দুর্ভাগ্যবশত সেই রাগ গিয়ে পড়ল তার সন্তানদের ওপর। এরপর সেই দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটল- প্রচণ্ড রাগে সে সাময়িকভাবে তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো এবং তার সন্তানদের নদীর জলে ডুবিয়ে মেরে ফেললো। তারপর থেকেই সে দিবারাত্র ওই নদীর পাড়ে তার সন্তানদের খুঁজে বেড়াতো। মনের দুঃখে সে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয়। এর ফলে সে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে, তার সুন্দর চেহারাটি ক্রমে কঙ্কালসার হয়ে যায় এবং দীর্ঘদিন অনাহারে থাকার ফলে তার মৃত্যু হয়।
যাই হোক, সেই মেক্সিকান মহিলার মৃত্যুর পর থেকেই সেই নদীর পাড়ে, যেখানে এই ঘটনাটি ঘটেছিল, সেখানে তার বেদনাবহুল আর্তনাদ, কান্না ও বিলাপ শোনা যায়। আবার কেউ কেউ বলে তাকে নদীর পাড়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতেও দেখা যায়। সে তার হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের খুঁজে বেড়ায় আর তাদের জন্য বিলাপ করে কাঁদতে থাকে।
মৃত্যুর পরেও তার এই আত্মগ্লানি তাকে এক মুহূর্ত স্থির থাকতে দেয় না। জনশ্রুতি যে তার এই বিলাপ রাত্রিবেলা শহরের প্রাণ কেন্দ্রে, নির্জন রাস্তা ঘাটে ও অন্যান্য জায়গাতেও শোনা যায়। কখনও সে চিৎকার করে কাঁদে, কখনও তার গোঙানির শব্দ শোনা যায়। এই বিলাপ শুনে যারা জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখেছে তাদের বর্ণনা অনুযায়ী সাদা পোশাক পরিহিতা ছিপছিপে চেহারার একজন মহিলা রাতের অন্ধকারে নদীর পাড়ে, নির্জন রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় আর তার সন্তানদের খুঁজে বেড়ায়, ‘Ayyyy mis hijos’ (আই মিস ইখোস, যার অর্থ হল ‘oh my children’) বলে চিৎকার করতে থাকে আর তারপরেই তেক্সকোকো লেকের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। রাত্রি বেলা মাঝে মঝে তার হাড় হিম করা কান্নার শব্দ এখনও শুনতে পাওয়া যায়। আরও বলা হয় কেউ যদি ইওরোনার কান্না শুনতে পায় তখনই তার উল্টো দিকে ছুটে পালিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ সেখানকার স্থানীয় মানুষ বিশ্বাস করে কেউ যদি ইওরোনার কান্না শোনে তাহলে তার জীবনে দুর্ভাগ্য নেমে আসে, এমনকি তার মৃত্যুও হতে পারে।
আবার কেউ কেউ বলে সাদা মলিন গাউন পরে সে কাঁদতে কাঁদতে নদীর জলে ভেসে বেড়ায় বা নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ায়। তাকে বিভিন্ন নদী, হ্রদের ধারে রাত্রিবেলা ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।
প্রচলিত গল্প থেকে জানা যায় মৃত্যুর পর সে যখন স্বর্গে যায় তাকে স্বর্গে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় নি, কারণ সেখানে তার সন্তানদের সম্বন্ধে জানতে চাওয়া হয়। তাকে বলা হয় যতদিন না পর্যন্ত তার সন্তানদের সে খুঁজে নিয়ে আসতে পারবে তাকে স্বর্গে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হবে না। ফলে সে আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসতে বাধ্য হয় এবং সে একটি অভিশপ্ত ও বেদনাক্লিষ্ট আত্মা হিসেবেই জীবিত ও প্রেত জগতের মধ্যবর্তী স্থানেই ঘুরে বেড়ায়। তাই সে নদীর পাড়ে কাঁদতে কাঁদতে তার মৃত সন্তানদের খুঁজতে থাকে, কারণ তার কৃতকার্যের জন্য তার আত্মা আর কখনও প্রেতলোকে ফিরতে পারবে না।
শোনা যায় ‘ইওরোনা’ তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ছোট শিশুদের ধরে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তাই লাতিন আমেরিকার অনেক দেশেই রাতের অন্ধকারে ছোট বাচ্চাদের একা একা বাইরে বেরোতে নিষেধ করা হয়, কারণ তাদের ধারণা ইওরোনা এই ছোট বাচ্চাদের ধরে নিয়ে গেলে তারা আর কখনও বাড়ীতে ফিরে আসতে পারবে না।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট- লা মালিঞ্চে ও ইওরোনা
মেক্সিকোতে কোনও বিশ্বাসঘাতককে বোঝাতে ‘মালিঞ্চিস্তা’ (malinchista) শব্দটি ব্যবহার করা হয়, ঠিক আমাদের এখানে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ যে অর্থে ব্যবহৃত হয়।
স্পেনীয়রা যুদ্ধে জয়ী হয়ে অ্যাজটেক সভ্যতার দখল নিয়েছিল এবং তার পেছনে একটি বড় ভুমিকা ছিল দোনিয়া মারিনার। এই দোনিয়া মারিনা ছিল একজন মেক্সিকান গালফ কোস্ট- এর নাউয়া মহিলা। দোনিয়া মারিনা ‘লা মালিঞ্চে’ (La Malinche) নামেই পরিচিত। তাবাস্কোর ২০ জন ক্রীতদাসীর মধ্যে সে ছিল অন্যতম। সে মেক্সিকোতে স্পেনীয় আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম রূপকার এরনান কোর্তেসের উপদেষ্টা, প্রেমিকা, ও দোভাষীর কাজ করতো। কারণ সে ছিল স্থানীয় মেয়ে, তাই স্বভাবতই স্থানীয় ভাষা খুব ভালো জানতো। পরবর্তীকালে তাদের একটি সন্তানও হয়েছিল, যার নাম ছিল মার্তিন, তাকেই প্রথম ‘মেস্তিজো’ (people of mixed European and indigenous American ancestry) বলে গন্য করা হয়।
মেক্সিকোতে এই দোনিয়া মারিনা বা মালিঞ্চেকে বিশ্বাসঘাতকতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে গন্য করা হয়।
অনেকে মনে করেন এই ইওরোনা গল্পের উৎপত্তি সেই সময়েই হয়েছিল- স্থানীয় আমেরিকান ও তার স্পেনীয় প্রেমিকের প্রেম ও বিশ্বাসঘাতকতার গল্প। ‘ইওরোনা’-কে মেস্তিজাখের (mestizaje - interbreeding and cultural intermixing of Spanish and local American people) অন্যতম প্রতীক বলে গন্য করা হয়।
যদিও ইওরোনাকে নিয়ে এরকম প্রচুর প্রচলিত গল্প আছে। তবে এই ইওরোনা গল্পের উৎপত্তি ঠিক কবে হয়েছিল সেটা সঠিক করে কেউ বলতে পারে না।

Comentarios