top of page

অণু গল্প - গল্পগুচ্ছ

  • অনন্যা ব্যানার্জী
  • Apr 4, 2018
  • 3 min read

Updated: Feb 19, 2021

পুনর্জন্ম


স্বরূপা বরাবরই একটু চুপ চাপ। একা বসে ছবি আঁকা, হাতের কাজ করতে সে বরাবরই খুব ভালবাসে। পড়াশুনা করেছে গ্রামের স্কুলে। বিএ পড়া শেষ হলেই বিয়ে হয়ে যায় তার। ঠিক যেমনটি আজ ও হয় গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে।


গ্রামের লোক তো স্বরূপার শ্বশুর বাড়ি র আয়োজন, প্রতিপত্তি দেখে হতবাক। স্বরূপার কী পছন্দ তা নিয়ে কারুর কোন মাথাব্যথা ছিল না। বিয়ের পর ক্রমে স্বরূপা তার নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে মল্লিক বাড়ির ছোট বৌ হয়ে উঠলো খুব সহজে। তার ঠাকুমার দেওয়া সুন্দর নাম টারো আর কোন অস্তিত্ব রইলো না যেন।


সেই দিন সকালে চিঠিটা এলো ডাকে। কাজের দিদি স্বরূপা মল্লিক বলে কেউ থাকে না বলে চিঠি ফেরত পাঠাচ্ছিলো। তখন ই স্বরূপা পৌঁছায় দরজায়।


চিঠি দেখে আর যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। টরেন্টোর আর্ট এ্যাকাডেমিতে ওর পাঠানো আঁকা সম্মানিত হতে চলেছে। চিঠিটা তিন চার বার নিজের মনে পড়েও আশ মেটে না। সে খবর দিতে যায় তার আঁকার স্যার কে। তার উৎসাহেই আজ এই দিন এসেছে স্বরূপা র জীবনে। আর কিছু দিন এই পরিবেশে কারুর বৌমা, কারুর বৌদি, কারুর জা, কারুর কাকিমা হয়ে বাঁচতে বাঁচতে, স্বরূপা যেন নিজের পরিচয় নিজেই হারিয়ে ফেলেছিল। আজ আবার পুনর্জন্ম হলো স্বরূপা মল্লিকের। আর হারাতে দেবে না সে নিজেকে। ভেবেই শরীরে এক বিদ্যুৎ খেলে গেল চকিতে।



অন্য একদিন


নীলাঞ্জনা এবারেও অন্য দুই বারের মতো এমে পরীক্ষা র ফর্ম টা ভরেছে নিজের জমানো টাকায়। পড়াশুনা ও করেছে মোটামুটি, বাড়ি সংসার সামলে যতটা করা সম্ভব। কিন্তু গতকাল রাত থেকে মিঠীর জ্বর। মনে হচ্ছে এবার ও দেওয়া হবে না পরীক্ষা টা।


হঠাৎ পাশে এসে দাঁড়াল প্রিয়তোষ। "নীলাঞ্জনা, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। আমাদের দশটার আগে পৌঁছোতে হলে আধ ঘণ্টার মধ্যে বেরোতে হবে।" - বলেই হনহন করে চলে যায় সে। নীলাঞ্জনা ছুটে গিয়ে বলে - "ডঃ সেন তো আজ বসবে না বিকেলের আগে, আমি ফোনে এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছি তো।"

প্রিয়তোষ কাছে এসে বলে- "এই সপ্তাহ টা আমি ছুটি নিয়েছি। যাতে তুমি ভালো ভাবে পরীক্ষা দিতে পারো । তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও গিয়ে। মিঠীকে আমি সামলে নেবো।"


নীলাঞ্জনা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু ক্ষণ। চোখ দুটো আবছা হয়ে আসে জলে। ভাল করে কথা বলতে পারে না যেন হঠাৎ। মুখ দিয়ে শুধু দুটো কথা বেরোয় -"থ্যাংকস প্রিয়তোষ"।



তাসের ঘর


রমা বিয়ের পর আজ প্রথম এসেছে তার বাপের বাড়িতে। এসে থেকে সকলকে তার শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তির প্রতি পত্তির গল্প করতে ব্যস্ত খুব।মা কেন জানি শুনেও না শোনা করছে সব। তার স্বামী কত বিরাট চাকরি করে, শ্বশুর মশাই কত বড় উকিল, সবসময় বাড়িতে ক্লায়েন্ট দের ভিড়। ননদ ম্যাথেমেটিক্সে এমে করছে। শাশুড়ি সবসময় কিটী পার্টি আর বন্ধু দের দ্বারা পরিবেষ্টিত। এক কথায় বাড়িতে সবসময় চাঁদের হাট। এত কথা এক নিঃশ্বাসে দাদা, বৌদি, বাবা, মায়ের কাছে বলতে বলতে তাড়াতাড়ি সে রান্নাঘরের দিকে ছুটে যায়। চোখের কোণের জল মুছে তাড়াতাড়ি ফিরে যাবে ওদের কাছে।


হঠাৎ পিঠে কে এসে হাত রাখলো। ঘুরে দেখে মা। মা বলে "হ্যাঁ রে তরী, তোকে এমে পরীক্ষা দিতে দেবে তো ওরা"? মায়ের সরল প্রশ্নে তরী আর নিজেকে সামলাতে পারে না। কেঁদে কেঁদে মাকে জড়িয়ে বলে "আমি আর কোনদিন ও ওখানে ফিরে যাব না, মা। ওদের জীবনে আমার ছোট ছোট ইচ্ছের কোন দাম নেই। আমি স্থির করেছি, তোমাদের এখানে থেকে ই বাকী পড়াশোনা শেষ করবো। দেবে তো মা থাকতে তোমার কাছে?"। মা ও মেয়ে দুজনেই কাঁদতে থাকে অঝোর ধারায়।



বন্ধ দরজা


প্রতিবার ই বন্ধ দরজা টার দিকে চোখ গেলে মনটা ছটফট করে ওঠে বিমলের। জীবনের অনেক গুলো বছর সে কাটিয়েছে ওই ঘরটিতে। মনে পড়ে সেই রাতগুলো যখন মা শুধু ই জল খেয়ে শুয়ে পড়ত রাতে। মনে পড়ে সেই রাত থাকতে মায়ের ঘুম থেকে উঠে জলের জন্য লাইন দেওয়া। মনে পড়ে সেই শেষ দিনগুলো যখন মার গা ফেটে পড়ছে জ্বরে, কিন্তু মুখ‌ জুড়ে সেই হাসি যা আশ্বাস দিতে চায় যে মা ভাল আছে, কিছু হয়নি, পাছে ছেলে ব্যস্ত হয়।


ওই ঘরটা জুড়ে কেমন চারদিকে একটা মা-মা গন্ধ আছে। ঘরে ঢুকলেই যেন বিমল শুনতে পায় তার মায়ের হাতের চুড়ির আওয়াজ। শেষ দিকে মায়ের হাতের চুড়ি জোড়া দেখতে পেত না বিমল। জিজ্ঞেস করলে অনায়াসে কথা ঘুরিয়ে দিত মা।


মনে পড়ে মা-ছেলের কথোপকথন। মা চাইতেন ছেলে পড়াশোনা শিখে অনেক বড় হোক। মায়ের একটা ই ইচ্ছে ছিল - বলতো একদিন বড় হয়ে তুই আমাকে হরিদ্বার নিয়ে যাস। বড় শখ আমার তীর্থ করার।


বিমল এখন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে মস্ত অফিসার। বছরের বেশীর ভাগ সময় বাইরেই থাকে। বাড়ি এলে কেন জানি এই ঘরটায় কিছুতেই ঢুকতে পারে না। নিজেকে বড় দোষী মনে হয়। মায়ের একটা মাত্র ইচ্ছে, সেটা ও ছেলে হয়ে পূর্ণ করতে পারেনি সে।


দরজায় মাথা রেখে বসলে যেন মায়ের মমতা ভরা মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিমলের। আজ আর এই ঘরটায় কেউ থাকে না। বাড়ি ওয়ালা এটাকে স্টোর রুম করে দিয়েছে। অনেক টাকার লালসা দেখিয়েও কোন ফল হয়নি। অনাদি বাবু বিক্রি করবেন না এই ঘর। মনে হয়, মা অভিমান করে বিমলের কাছে ধরা দিতে চায় না। তাও সে কলকাতায় এলে প্রতি বার এসে বসে থাকে এই বন্ধ দরজার বাইরে। তার এতেই তীর্থ করা হয় যে।



Comments


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page