top of page

প্রচ্ছদ কাহিনী - বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দারা

  • পার্থ সেন
  • Nov 27, 2017
  • 7 min read

Updated: Feb 18, 2021


যখন ঠিক হল নীড়বাসনার ষষ্ঠ সংখ্যার থিম হবে রহস্য আর গোয়েন্দা গল্প, তার কভার স্টোরি করার দায়িত্ব নিতে আমি কিন্তু সত্যি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। আমার মনে হয় সাহিত্যে রহস্য এমন একটি ধারা যে কোন পাঠককে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি রহস্য গল্পের স্বাদ থেকে বঞ্চিত। আমার ছোটবেলার সংগৃহীত গল্পের বইয়ের মধ্যে বেশীরভাগই ছিল দেশী, বিদেশী নানান রহস্যকাহিনী। কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি, এডগার অ্যালান পো, তাছাড়া ব্রিটিশ, আমেরিকান নানা রহস্য গল্প, এদিকে বাংলায় ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কিরীটী, কাকাবাবু, গোগোল, কর্নেল, জয়ন্ত, মানিক এছাড়া আরো কত বই – তখন সব গোগ্রাসে পাঠ করতাম। তবে পড়া এক আর লেখা আর এক জিনিস। ইচ্ছে রইল আমাদের মাতৃভাষায় বাংলা সাহিত্যে সৃষ্ট রহস্য গোয়েন্দা গল্পের কথা শোনানোর আর কিছু বাতিস্তম্ভের কথা বলার। আমাদের ছোটবেলার সেই মায়া ভরা দিনগুলো থেকে তাঁরা আমাদের আলো দিয়ে আসছেন। ওঁরা না থাকলে হয়তো কোনদিন এই লেখালিখির ভূত মাথায় চাপতোই না। সমস্ত পাঠক পাঠিকাদের কাছে আমার বিনীত নিবেদন আমার এই লেখাটি তাঁরা কতটা গ্রহণ করবেন জানি না, তবে আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করলাম।

সত্যি বলতে কি বইয়ের নামে ‘রহস্য’ বিশেষণটি বিশ্ব সাহিত্যে একটু ‘জেনারিক টার্ম’ মানে বিস্তৃত অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। থ্রিলার, রোমাঞ্চ, গোয়েন্দা, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভৌতিক গল্পকেও রহস্য গল্প বলা হতে পারে। তবু আমার মনে হয়, বাংলা সাহিত্যে, রহস্য গল্প বলতে বোঝায় মূলত অজানা কোন অপরাধের অনুসন্ধান অথবা সত্যের অন্বেষণ। বাংলায় ঠিক থ্রিলার জিনিস টা খুব লেখা হয়নি বরং বাংলায় গোয়েন্দা কাহিনীর জনপ্রিয়তা চিরকালই খুব বেশী। দুঃখের কথা কিন্তু আবার না বললে নয়, সারা বিশ্ব সাহিত্যের মত, বাংলা সাহিত্যেও ‘মেইন-স্ট্রিম’ সাহিত্য চিরকাল এই রহস্য রোমাঞ্চ বা গোয়েন্দা গল্প কে একটি অনাভিজাত্যের তকমা লাগিয়ে দিয়েছে। অথচ বাংলার ধ্রুপদী সাহিত্যের বহু বিখ্যাত সাহিত্যিক যুগে যুগে তাঁদের নিজের পছন্দের গোয়েন্দা তৈরি করেছেন আর তাঁদের জন্য বাংলা গোয়েন্দা বা রহস্য রোমাঞ্চ গল্প এক সময় যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিল তা যে কোন লেখার জন্য ঈর্ষণীয়। তার চেয়ে ও বড় কথা, এদের অগুনতি ভক্ত এবং অনুরাগী যারা আজো ছাপার অক্ষরে এঁদের খোঁজেন অথবা সিনেমার পর্দায় এঁদের দেখতে ছোটেন।

বাংলা সাহিত্যে কাহিনীর মূলে রহস্যের প্রয়োগ সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ থেকে শুরু, যদিও সে উপন্যাসকে কখনোই রহস্য কাহিনী বলা যায় না। এই ব্যাপারটায় একটু মতান্তর আছে, কেউ বলেন নগেন্দ্রনাথ গুপ্তর ‘চুরি না বাহাদুরি’ বাংলায় লেখা প্রথম লেখা গোয়েন্দা গল্প, তবে বেশীর ভাগ পণ্ডিত বলেন বাংলায় ডিকেটটিভ ফিকশন শুরু হয় ১৮৯২ সালে, তৎকালীন কলকাতা পুলিশের ডিকেটটিভ ডিপার্টমেন্টের অফিসার প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘বনমালী দাসের হত্যা’ গল্প দিয়ে। অবশ্য নিজে ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনস্থ একজন কর্মচারী হওয়ায় ওনার প্রায় সব লেখায় ঔপনিবেশিক একটা প্রভাব দেখা যায়, বেশীর ভাগ গল্পেই ভারতীয়দের তিনি বিপদজনক বা সহজ কথায় ক্রিমিন্যাল বলে দেখিয়েছিলেন। প্রিয়নাথের শুরু করা ধারা বজায় রেখে পরের বছরে প্রকাশ পেয়েছিল গিরিশ বসুর লেখা ‘সেকালের গোয়েন্দা কাহিনী’, তার বছর তিনেক বাদে কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় লিখলেন ‘বাকাউল্লার দপ্তর’। তৎকালীন ঠগিদের দমন করতে কলকাতা পুলিশ কমিশনার স্লিম্যানের অধীনস্থ চাকরিরত এক পুলিশ ইন্সপেক্টরের কাহিনী। সুকুমারের সেনের কথায়, ধারাবাহিক ভাবে স্বীকৃত প্রাপ্ত প্রথম গোয়েন্দা গল্প লেখক ছিলেন পাঁচকড়ি দে। তাঁর বহু গ্রন্থ অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করাও হয়েছিল। রোমান্সে সঙ্গে রহস্যের মিশ্রণ সেই থেকেই শুরু। আর একটি নতুন ধারা শুরু করেছিলেন পাঁচকড়ি, সৃষ্টি করেছিলেন বিদেশী গোয়েন্দার অবিকল অনুকরণে কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র – দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র, অরিন্দম বসু। তাঁর প্রায় সমস্ত কাহিনী বিদেশী লেখকদের রচনা থেকে গ্রহণ করা অথবা বিদেশী গল্প অনুবাদ করা। অনেক সময় পাঁচকড়ি বিদেশী গোয়েন্দাকে বাঙ্গালীর বেশে উপস্থিত করেছেন, এমনকি তাঁর একটি গল্পে স্বয়ং শার্লক হোমস বাঙ্গালী পোশাকে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তরুণ পাঠককে আকর্ষণ করার ব্যাপারে যিনি পাঁচকড়ি দেকেও ছাড়িয়ে গেছিলেন তিনি ছিলেন দীনেন্দ্রকুমার রায়। একই ধারায় তিনিও বিদেশী গল্পের বই বা কাহিনীকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। খালি তফাত ছিল, দীনেন্দ্রকুমার বিদেশীদের সাজ-পোশাক বা নাম পরিবর্তন করেননি, এমন কি ঘটনাস্থল অবিকৃত রেখেছিলেন। তাই তাঁর প্রায় সব গল্পের পটভূমিকা লন্ডন শহর বা ক্রয়ডন বিমান ঘাঁটি বা ফুলহাম শহর অথবা টেমস নদীকে ঘিরে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, দীনেন্দ্রকুমার ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক, তাঁর ‘পল্লীচিত্র’ বা ‘পল্লীবৈচিত্র্য’ ইত্যাদি গ্রন্থের সাহিত্যিক মূল্য অপরিসীম হওয়া সত্ত্বেও তাঁর রবার্ট ব্লেক সিরিজের ‘ভুতের জাহাজ’, ‘চিনের ড্রাগন’, ‘রূপসী মরুবাসিনী’ পাঠকদের কাছে অনেক বেশী জনপ্রিয় হয়েছিল।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ঔপনিবেশিক প্রভাব ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে বাংলা গোয়েন্দা কাহিনীর শৈশব ছাড়িয়ে কৈশোরে পদার্পণ করে। আর সেই সঙ্গে এক ঝাঁক সাহিত্যিক এলেন রহস্য আর গোয়েন্দা গল্পের ডালি নিয়ে। অবশ্যই অন্যতম পথ প্রদর্শক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৯৬ সালে লিখেছিলেন ছোটগল্প ‘ডিটেকটিভ’ যা ‘গল্পগুচ্ছ’এ স্থান পেল। আরো শিখিয়েছিলেন গোয়েন্দা গল্পের নামকরণে অনুপ্রাসের প্রয়োগ, ইংরাজিতে যাকে বলা হয় alliteration। যার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রয়োগ দেখা যায়, সত্যজিতের লেখায় জটায়ুর গল্পের বইয়ের নামকরণে, ‘সাহারায় শিহরন’, ‘হন্ডুরাসে হাহাকার’, ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ ইত্যাদি, অথবা চরিত্রের নামকরণে, যেমন ‘মগনলাল মেঘরাজ’। যাই হোক, ১৯২০ সালে বাংলায় গোয়েন্দা কাহিনীর এক বিশেষ দিক খুলে গেল এক তরুণ সাহিত্যিকের হাত ধরে, তিনি হেমেন্দ্র কুমার রায়। হেমেন্দ্র কুমার নিয়ে এলেন তিন জোড়া ভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনী কে, জয়ন্ত – মানিক সঙ্গে ইন্সপেক্টর সুন্দরবাবু, বিমল – কুমার আর হেমন্ত – রবীন সঙ্গে ইনস্পেক্টর সতীশ। তাঁর লেখা ‘যকের ধন’, ‘জয়ন্তর কীর্তি’, ‘মানুষ পিশাচ’, ‘শাহজাহানের ময়ূর’ শুধু বিখ্যাত গোয়েন্দা গল্প নয়, আজকের অনেক নতুন সাহিত্যিকেরও অনুপ্রেরণার উৎস। যদিও গল্পের ধাঁচ, কাহিনীর প্রক্ষেপ, অনুসন্ধান রীতিতে হেমেন্দ্র কুমার অনুসরণ করেছিলেন কোনান ডয়েল এবং এডগার অ্যালেন পো কে, তবুও মৌলিক গোয়েন্দা চরিত্রের অবতারণা সেই প্রথম। তারপর পরের তিন দশক ধরে বাংলা সাহিত্যে রহস্য গল্পের বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারে ভেসে গেলেন পাঠক পাঠিকারা। শিবরাম চক্রবর্তী নিয়ে এলেন ‘কল্কে কাশী’, প্রভাত মুখোপাধ্যায় নিয়ে এলেন ‘গোবর্ধন’, প্রেমেন্দ্র মিত্র নিয়ে এলেন ‘পরাশর বর্মা’, গজেন্দ্র কুমার মিত্র নিয়ে এলেন ‘তরুণ গুপ্ত’, আরো অনেকে এলেন। তাঁদের মধ্যে দুজনের কথা বলতেই হবে। প্রথম জন “প্রায় সাড়ে ছয় ফিট লম্বা, গৌরবর্ণ, বলিষ্ঠ চেহারা, মাথা – ভর্তি কোঁকড়ানো চুল, ব্যাকব্রাশ করা, চোখে পুরু লেন্সের কালো সেলুলয়েড ফ্রেমের চশমা, দাড়ি গোঁফ নিখুঁত ভাবে কামানো” বাংলা সাহিত্য তাকে চিনলো কিরীটী রায় নামে, স্রষ্টা ডঃ নীহার রঞ্জন গুপ্ত। আর দ্বিতীয় জন, যার হাত ধরে বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্য যৌবনে পদার্পণ করে। “তেইশ, চব্বিশ বছরের এক যুবক, যাকে দেখলে শিক্ষিত মনে হয়, গায়ের রং ফরসা, বেশ সুশ্রী, সুগঠিত চেহারা, চোখে মুখে বুদ্ধির একটা ছাপ আছে”। হ্যারিসন রোডের ওপর কোন এক মেস বাড়ির তিন তলা ভাড়া নিয়ে তিনি থাকতেন, তাঁর সংসারে দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন পরিচারক পুঁটিরাম, তিনি সত্যান্বেষী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি তিনি ছিলেন ব্যোমকেশ বক্সী।

ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় গোয়েন্দা গল্পের প্রধান আকর্ষণ গল্পের কাহিনীতে, ঘটনার অভিনবত্বে, গল্পের প্লটে, চরিত্রের বিন্যাসে, ঘটনার আকস্মিকতায় এবং অবশ্যই ক্লাইম্যাক্সে। এ সবেতে শরদিন্দু ছিলেন অনন্য। ঔপনিবেশিক প্রভাব কে সরিয়ে দিয়ে, বিদেশী সাহিত্য থেকে আলাদা এক নতুন ঘরানায় সম্পূর্ণ বাঙ্গালিয়ানায় ভর করে তরতর করে সেই যে এগিয়ে চলা শুরু করেছিলেন ব্যোমকেশ, আজ ও তিনি চলছেন। ১৯৩২ সালে বসুমতী পত্রিকায় বাঙালী পাঠকগনের পরিচয় হল ব্যোমকেশের সঙ্গে, ‘সত্যান্বেষী’ গল্পে। আর আজ বাংলা ছাড়িয়ে হিন্দি বলিউডে তাঁর চাহিদা, তাঁকে দেখতে মাল্টিপ্লেক্সে উপচে পড়ে ভিড়। অথচ তিনি সুপারম্যান নন, সাধারন বাঙ্গালী ভদ্রলোকের মতো, পরনে ধুতি ও শার্ট, রিভলবারের প্রয়োগ ও নামমাত্র করেছেন, হাতাহাতি মারামারি কখনো করেন নি, বাইরে থেকে দেখে বা তাঁর কথা শুনে একবার ও মনে হয় না তাঁর মধ্যে অসামান্য কিছু আছে, কিন্তু তিনি অনায়াসে হোমস, পোয়ারো, মিস মারপল, উইমসি, কাম্পিয়ন, নিরো উলফ বা অ্যাপলবির সঙ্গে এক আসনে বসতে পারেন।

১৯৬৫ সালে সত্যজিৎ রায়ের লেখায় সন্দেশ পত্রিকায় আত্মপ্রকাশ করলেন আর এক জন, সাতাশ বছরের এক তরুণ, ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা, যদিও সুঠাম এবং বলিষ্ঠ তবু রহস্যের সমাধানে তিনি মূলত ব্যবহার করেন ‘মগজাস্ত্র’, অজস্র বই, উপাদেয় খাবার, সংগীত আর চারমিনার সিগারেটের একনিষ্ঠ ভক্ত, যিনি প্রথম ছাপানো কার্ড নিয়ে এলেন, তাতে লেখা প্রদোষ চন্দ্র মিত্র, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। তিনি প্রথম কিশোরপাঠ্য ও বয়স্কপাঠ্যের বিভাজন রেখা মুছিয়ে দিলেন আর হয়ে উঠলেন বাংলা সাহিত্যের চিরকালের সর্বপ্রচারিত চরিত্র ‘ফেলুদা’। সাথে গল্প বলার জন্য ছিলেন ওনার খুড়তুতো ভাই (ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি তে অবশ্য মাসতুতো বলা আছে), আর ছিলেন এক নিপাট ভালো মানুষ, রহস্য রোমাঞ্চ গল্পের লেখক, রসিক লালমোহন গাঙ্গুলি। সত্যজিতের সাহিত্য মূলত নারীবর্জিত হওয়ায় ফেলুদা চরিত্রের সম্পূর্ণতা নিয়ে অবশ্য কেউ কেউ প্রশ্ন করেন। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, ফেলুদার মৌতাত গুনিদের (মানে চলতি কথায় ফ্যান) মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা কিছু কম নেই। ঘটনার প্রক্ষেপ, অপরাধ এবং অনুসন্ধানের সূক্ষ্মতা, কাহিনীর বাস্তবতা, মৌলিকত্ব, শব্দ দিয়ে তৈরি করা ছবিতে সাজানো ফেলুদা আজও বাংলা সাহিত্যের সেরা প্যাকেজ, আজ পঞ্চাশ বছর বাদেও বেস্ট সেলার।

প্রথমে ব্যোমকেশ এবং ব্যোমকেশ-উত্তর যুগে ফেলুদা যখন মধ্যগগনে আরো বেশ কিছু উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের আকাশে এসেছেন। এঁদের মধ্যে কিছু চরিত্রের কথা না বললেই নয়। হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘পারিজাত বক্সী’, সমরেশ বসুর ‘অশোক ঠাকুর’, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের রিটায়ার্ড কর্নেল ‘নীলাদ্রি শেখর সরকার’, বিমল করের ‘কিকিরা’, আশাপূর্ণা দেবীর ‘বটকেষ্ট সর্দার’, স্বপন কুমারের ‘দীপক চ্যাটার্জি’, শশধর দত্তের ‘মোহন’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লালবাজার গোয়েন্দা দপ্তরের কর্মরত ‘শবর দাশগুপ্ত’, সমরেশ মজুমদারের বেকার যুবক অর্জুন এঁরা সকলেই কিন্তু নিজস্ব ঘরানায়, বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মৌলিক এবং অনন্য। সত্যি বলতে কি বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের ঝুলি এতোটাই সমৃদ্ধ যে শিশু বা কিশোর বয়স থেকে আমরা নিজেদের ডিকেটটিভ বলে ভাবতে শুরু করতাম। উৎসাহ যুগিয়েছিলেন সমরেশ বসু, তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি গোগোল কে দিয়ে, আর ছিলেন ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়। Enid Blyton এর Famous Five Series এর স্টাইলে আমাদের শুনিয়েছিলেন পাণ্ডব গোয়েন্দার গল্প। আর একজনের কথা না বললে আমাদের হয়তো কৈশোর সম্পূর্ণ হত না, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনবদ্য সৃষ্টি, তিনি কোন ডিটেকটিভ নন, তিনি ছিলেন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের প্রাক্তন এক ডিরেক্টর, ক্রাচ হাতে যিনি একের পর এক দুঃসাহসিক অভিযান করেছেন সত্যের বা রহস্যের উৎস সন্ধানে, ভালো নাম রাজা রায়চৌধুরি আমরা চিনতাম ‘কাকাবাবু’ নামে। নারায়ণ সান্যাল গোয়েন্দা গল্প সিরিজ শুরু করেছিলেন নাম রেখেছিলেন ‘কাঁটা’ সিরিজ, কেন্দ্রীয় চরিত্রে গোয়েন্দার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন ব্যারিস্টার পি কে বসু। এছাড়া প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের মধ্যে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী অনেক গোয়েন্দা কাহিনী লিখেছেন তবে বিশেষ কোন গোয়েন্দা চরিত্রের অবতারণা করেননি। সত্তর এবং আশির দশকে অনুবাদ সাহিত্য খুব জনপ্রিয় জয়ে ওঠে। আর তিনজনের কথা আমাকে বলতেই হবে, প্রদীপ্ত রায়ের লেখা ‘জগাপিসী’, মনোজ সেনের লেখা ‘দময়ন্তী’ আর সুচিত্রা ভট্টাচার্যের লেখা ‘মিতিন মাসী’ – এঁরা ছিলেন বাংলা সাহিত্যের মহিলা গোয়েন্দা। আরো অনেককার কথা লেখা হল না, পাঠক পাঠিকা রা নিজগুণে ক্ষমা করবেন।

বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা গল্পের জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় পৌঁছেছিল সেটা বোঝাতে একটা তথ্য দেওয়ার দরকার। ১৯৮৩ সালে সুকুমার সেনের সভাপতিত্বে সে সময়ের বিখ্যাত কিছু সাহিত্যিক যারা ছিলেন শার্লক হোমসের বিরাট ভক্ত, যেমন প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত, সন্তোষ কুমার ঘোষ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমরেশ বসু, দেবীপদ ভট্টাচার্য, অরুণ কুমার মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, আনন্দ বাগচী, বাদল বসু প্রমুখ ‘হোমসিয়ানা’ নামে একটি ক্লাব শুরু করেন। সাহিত্য আলোচনা ছাড়া, নতুন রহস্যের উপস্থাপনা এবং সমাধান নিয়ে সেখানে নিয়মিত আলোচনা হত।

পরিশেষে একটা কথা বলতেই হয়, গত এক শতক ধরে অজস্র গ্রন্থরাজির পর, নব্বইএর দশকের শেষের দিক থেকে হঠাৎ করে রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজে কেমন করে যেন এক ভাঁটা পড়ে যায়। তার কারণ আমার জানা নেই, অথচ চলচ্চিত্রে বা টিভি সিরিয়ালে রহস্যের ব্যবহার বা প্রয়োগ কিন্তু একেবারেই কমেনি, বরং আরো বেড়েছে। তাহলে কি আমরা পাঠক হিসেবে রহস্য গল্প কাহিনী বা গল্পের বই পড়া কমিয়ে ফেলছি? নাকি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি? নাকি আজকের ইলেকট্রনিক আর ইন্টারনেটের যুগে আমরা পড়ার অভ্যাস ছেড়ে দিচ্ছি? কিন্তু তা বোধহয় ঠিক নয়। বিদেশী সাহিত্যে অসংখ্য লেখা কিন্তু প্রকাশিত হচ্ছে। মারস, প্যাটারসন, স্টেফান কিং, মিগ্যান, ফলেট, গ্রিসাম, ড্যান ব্রাউন এঁরা কিন্তু নিয়মিত থ্রিলার লিখে চলেছেন। মনের কোনে একটা অজানা আশঙ্কা উঁকি দেয়, তাহলে কি বাংলার পাঠক পাঠিকা কমে আসছেন? তাহলে তো আমাদের মাতৃভাষার অস্তিত্বনিয়ে একটা প্রশ্ন আসে। সে অনেক বড় প্রসঙ্গ। যা হোক, আমি নৈরাশ্যবাদী নই, আশা রাখব আবার খুব তাড়াতাড়ি বাংলায় রহস্য গল্পের সূর্য আবার সাহিত্যের মধ্য গগনে ফিরে আসবে।

** ইন্টারনেট সূত্রে পাওয়া নানা পুরোনো বই য়ের প্রচ্ছদ থেকে নেওয়া ছবি নিয়ে উপরের কোলাজ করা হয়েছে

Comments


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page