top of page

নদীর ধারে বাড়ি

  • শঙ্খ করভৌমিক
  • Apr 5, 2016
  • 4 min read

Updated: Feb 17, 2021

বেশির ভাগ মানুষের বাড়ি নদীর ধারে। এখন না হলেও এককালে ছিল। নিদেনপক্ষে বাপ ঠাকুরদার বাড়ি নদীর ধারে ছিল।

আমারও তাই। এককালে ছিল।

হয়েছে কি, বহু বছর ভাড়া বাড়িতে থাকতে থাকতে আমার বাবা একদিন ঠিক করলেন এবার একটা নিজের বাড়ি চাই। কিন্তু যথেষ্ট টাকা পয়সা হাতে ছিল না। খবর পেয়ে শহরের একমাত্র ডাক্তার তথা সম্পন্ন চাষি হেমবাবু তাঁর কিছুটা জমি সস্তায় বিক্রি করার প্রস্তাব দিলেন। আর কয়েক দিনের ব্যবধানে শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, কাঠচেরাই কলের মালিক ঝন্টু সেন সস্তায় কিছু কাঠ বিক্রি করার প্রস্তাব দিলেন।

ব্যস, দুমাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেল শহরের এক মাত্র কাঠের বাড়ি। নদীর ধারে। আমাদের ফুর্তি দেখে কে! কাঠের বাড়ি বলে কথা। তল্লাটে কারো নেই। আনন্দে আমরা দুভাই খুরপি দিয়ে মাটি খুঁড়ে একটা চোরা কুঠুরি বানাতে লেগে গেলাম। গর্ত একটু একটু করে গভীর হয়, আর আমরা নেমে দেখি আমাদের দুজনের জায়গা হয় কি না? তিন মাসের অক্লান্ত চেষ্টায় হাঁটু অবধি গভীর সুড়ঙ্গ তৈরি হল।

আমাদের নতুন বাড়ি যেন ইচ্ছেমত ছবি আঁকার খাতা – আজ মায়ের ইচ্ছে হল একটা কুয়োতলা হলে বেশ হয়, তো অমনি কোথা থেকে একদল লোক এসে কুয়ো খুঁড়তে লেগে গেল। কাল আমার ইচ্ছে হল একটা কুকুর পোষার, তো তৈরি হয়ে গেল সোভিয়েত দেশের ছবির মতো দেখতে কুকুরের ঘর।

কিন্তু কাঠের বাড়ির হ্যাপাও কম নয় দেখা গেল। উইপোকার উৎপাতে মাঝে মাঝেই কাঠ রঙ করাতে হত। মাঝে মাঝে দেয়ালের একটা দুটো কাঠ পাল্টাতেও হত। সেই জন্য আমাদের ধারনা ছিল বাড়ি তৈরি এখনো শেষ হয়নি।

ভারি মজার শহর। নদীর ব্রিজ পেরিয়ে বাঁধের মতো উঁচু একটা পাকা রাস্তা। সেই রাস্তা থেকে শাখাপ্রশাখার মতো ঢালু কাঁচা রাস্তা নেমে গিয়ে এক একটা বাড়ীর সদর দরজায় ঠেকেছে। দুটো এই রকম কাঁচা রাস্তার মাঝখানে বৃষ্টির জল জমে পুকুরমত হয়েছে। একবার কারা যেন দুটো বাচ্ছা হাতিকে ঐ পুকুরে নিয়ে এলো স্নান করাতে। মাঝেমাঝে ওই উঁচু বাঁধানো রাস্তা দিয়ে একজন মানুষ একপাল শুওর নিয়ে কোথায় যেন যায়। বিয়েবাড়ির শোভাযাত্রা গেলে আমরা দুভাই দৌড়ে দেখতে যাই। রোডরোলার গেলেও যাই।

বাড়ীর পেছনে ধানক্ষেত আর পাটক্ষেত। মাঝেমাঝে ট্রাক্টর আসে চাষ করতে। সেও আমাদের একটা কৌতূহলের জিনিস। বর্ষাকালে সেই ক্ষেতে জল জমে পুকুর বা সমুদ্র হয়ে যায়। আলগুলো আর দেখা যায় না – নিরবিচ্ছিন্ন জল। অবিশ্রান্ত ব্যাঙের ডাক আর কদাচিৎ সাপে ব্যাং ধরার আওয়াজ। ক্ষেতগুলোর কাছেই রয়েছে একটা পুকুর – আসলামের পুকুর না মকবুলের পুকুর কি যেন বলত লোকে। সেই পুকুরের উঁচু পাড়ে একবার ওঝার ঝাড়ফুঁক দেখেছিলাম একবার। আর দাঙ্গার সময় আমাদের শেখানো হয়েছিল হামলা হলে সেই পুকুরে লুকিয়ে থাকতে।

শুকনো ঋতুতে আবার মাঝে মাঝেই খড়ের চালে আগুন লাগে। আমাদের বারান্দা থেকে দেখা যায়। ঢং ঢং ঘণ্টা বাজিয়ে আসে দমকল – আমরা বলি “আগুনের গাড়ি”।

আমাদের বাড়ীর একটা মজার ব্যাপার ছিল। বাড়ীর দুটো অংশ দুটো আলাদা মিউনিসিপ্যালিটির (নাকি ব্লক? নাকি পঞ্চায়েত) এর অংশ ছিল। দাঙ্গার সময় যখন কার্ফু হতো তখন বাড়ীর সামনের গেট দিয়ে বেরোনো বেআইনী, কিন্তু পেছনের দরজা দিয়ে বেরোনোতে কোন দোষ নেই। এইরকম সব জটিল ব্যাপার।

ছোট্ট শহর। সন্ধে আটটা না বাজতেই স্থানীয় দমকলের স্টেশনে সাইরেন বাজে, রেডিওতে স্থানীয় সংবাদ শুনে লোকজন খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

নিত্য এর ওর বাড়ি বেড়াতে যাওয়া লেগেই আছে। তারজন্য কাউকে ফোন করে জিগ্যেস করার দরকার হয়না যে সে সন্ধ্যেয় বাড়ি থাকবে কিনা? বাড়িতে গিয়ে তাকে না পাওয়া গেলে অন্য কারো বাড়ি যাওয়া যাবে। আর অতিথি আপ্যায়ন? সেটা তো যখন তখন করতে হতে পারে। খাবার বানিয়ে দেওয়া হবে। আর নাড়ুটারু তো স্টকে থাকেই।

বেড়াতে যাওয়ার জায়গা আরও আছে – প্রাচীন কচ্ছপ আর বিরাট মাছভর্তি পুকুরওয়ালা মন্দির, শহরের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর। যেদিকে দুচোখ যায় ধানক্ষেত আর দুপাশে কৃষ্ণচুড়া গাছে সাজানো সটান সোজা রাস্তা দিয়ে সেখানে যাওয়া। নয়তো জঙ্গলের মধ্যে সেই প্রাচীন মন্দির যেখানে নরবলি হতো। নয়তো টিলার ওপর সেই আশ্রম যেটা সারা বছর শুনশান কিন্তু শীতকালে পনের দিন উৎসব হয় আর লোকেরা হলুদ হলুদ জামা পরে একঘেয়ে সুরে গান গায় আর বাঁশি বাজায়। অনেকে খিচুড়িও খায়, কিন্তু আমাদের বাইরে খাওয়া বারণ।

কিন্তু সব বেড়ানোর সেরা বেড়ানো হচ্ছে বিকেলে সন্ধ্যাদিদির সঙ্গে নদীর ধারে হাঁটতে যাওয়া।

নদী মাঝারি রকমের চওড়া। বৈশাখে হাঁটু জল না হলেও কোমর জল থাকে। বর্ষায় রীতিমত বিপদজনক। একবার এইরকম এক বর্ষায় কি করে যেন একটা কুমির ভেসে এসেছিল বলে শোনা যায়। আর একবার ঐ নদীরই ধারে এক দানবীয় গোসাপ ধরা পড়েছিল – দেখতে গিয়েছিলাম।

শীতকালে নদীর মাঝখানে আশুবাবুর টাকমাথার মতো দুটো চর জেগে ওঠে। ধবধবে সাদা বালি। তারমধ্যে একটা চরে কাঠকুটো তৈরি একটা বাড়ী দেখতে পাই, অনেকটা বুড়ির বাড়ির মতো। কিন্তু সেই ঘর থেকে কাউকে ঢুকতে বা বেরোতে দেখা যায় না। বর্ষায় ঘরসহ চর আবার বেপাত্তা হয়ে যায়।

নদীর ওপর ব্রিজ, ব্রিজ পেরোলে সমতলের শেষ টিলা – টিলা আর পাহাড় নিয়ে কেমন রহস্যময়! একবার মা বাবার সঙ্গে ব্রিজ পেরিয়ে পায়ে হেঁটে কার যেন বাড়ি গিয়েছিলাম টিলার ওপরে। এত বছর পর দেখছি কি উপলক্ষে গিয়েছিলাম তাই নিয়ে দুভাই তে একটা মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে – বিবাহবার্ষিকী, না মৃত্যুবার্ষিকী?

নদীতে কারা যেন বড় বড় বাঁশের আঁটি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কোথা থেকে আসে আর কোথায় যায় আমরা জানি না। আর জানার কোন ইচ্ছেও কারো নেই এটা আমাদের বেশ অবাক করে।

একদিন বর্ষার সময় গিয়ে দেখি ভালো জল জমেছে – চড়াটড়া সব ডুবে গেছে। জল কেমন যেন ঘোলাটে। আর জলের ঢেউয়ে হুড়মুড় ভেসে আসছে কত কচুরিপানা।

বাড়ীতে ফিরে মা-কে বলাতে মা বিশ্বাসই করল না। কচুরিপানা নাকি নদীতে থাকে না। কচুরিপানা পুকুর ছেড়ে কোথাও যায়না।

আমরাও ভেবেছিলাম পুরানো শহর ছেড়ে কোথাও যাবনা। কিন্তু ঘটনাচক্রে, তিরিশ বছর পর দেখছি ছত্র ভঙ্গ হয়ে পড়েছি। কেউ কলকাতায়, কেউ সিধে আমেরিকায়।

মানুষই সময়ের স্রোতে কোথায় কোথায় ভেসে যায়, কচুরিপানা তো সামান্য জিনিস!

Commentaires


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page