top of page

প্রবন্ধ - শিল্পের স্বাধীনতা

  • অনন্যা ব্যানার্জি
  • Aug 9, 2017
  • 3 min read

Updated: Feb 18, 2021

শিল্প তা সে অঙ্কন, নৃত্য , চলচ্চিত্র , নাটক , সাহিত্য , স্থাপত্য , ভাস্কর্য যাই হোক না কেন তা সর্বদাই সমাজের মানুষের জীবনের দর্পণ। এই শিল্প প্রকাশের মাধ্যমেই স্রষ্টা অমর হয়ে যান অগণিত মানুষের হৃদয়ে। এই শিল্পের মাধ্যমে স্রষ্টা বা রচয়িতার সঙ্গে পাঠক বা দর্শকের এক অদৃশ্য যোগাযোগ স্থাপন হয়। সমাজ কবিকে, লেখক কে বা স্রষ্টাকে চেনে তার সৃষ্টির হাত ধরে। এই শিল্পের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারে তার পূর্বসূরিদের মতামত, জীবন নীতি, ও বিচারধারা। তারা বারংবার স্নাত হয়ে শিল্পীর চিন্তাধারায়।

যে কোন শিল্প, শিল্পীর অমূল্য সাম্পদ। তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি শুধুমাত্র তাঁর মনের ভাব বা মাধুরীকেই পরিস্ফুট করেন তাই নয়, তা ধীরে ধীরে তাঁর জীবনের অবশ্যম্ভাবী অঙ্গ হয়ে ওঠে । ছোট শিশুকে যেমন মা তার মমতায় লালন-পালন করেন ও তাকে এই পৃথিবীর জীবন যুদ্ধের যোগ্য যোদ্ধা করে তুলতে দিবারাত্রি পরিশ্রম করেন, তেমনি শিল্পী তার একান্ত আপন শিল্পকে এই পৃথিবীর মানুষের মধ্যে পরিবেশন করার অনাবিল আনন্দে আপ্লুত হয়ে ওঠেন। কিন্তু সেই শিল্পের বিষয় বা তার ব্যাবহারকে সীমাবদ্ধ করার মানে সেই শিল্প-প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা। তার স্রষ্টার চিন্তাধারার ব্যাপ্তিকে কমিয়ে দিলে কি কখনো মনের সত্যিকার অনুভূতির প্রকাশ সম্ভব? নানা বিচারধারা, নানা নিয়মাবলী ও বিধিবিধানে আবদ্ধ করে ক্রমে আমরা কি শিল্পের স্বতঃস্ফূর্ততার বিঘ্ন ঘটাচ্ছি না? বা ক্রমে আমরা শিল্পের হত্যাকারী হয়ে উঠছি না?

ভারতীয় সংবিধানে “freedom of expression” কে সবসময় মাহাত্ম্য দেওয়া হয়েছে। তবুও কোনো বই, চলচ্চিত্র , নাটক প্রকাশের পূর্বে সেন্সর বোর্ড তার কাঁচি চালাতে কখনো পিছপা হয় না। শিল্পের ইতিহাসে এরকম ছুরি-কাঁচির নজির আমরা অনেক পেয়েছি। ধর্মীয় বা রাজনৈতিক উগ্রমতবাদের কারণে মানুষ শুধুমাত্র যে শিল্প প্রকাশে বিঘ্ন তৈরি করেছে তাই নয়, এমনকি অনেক সময় শিল্পীর/ স্রষ্টার জীবন সঙ্কটেরও কারণ হয়েছে। ধর্ম যা চিরকাল মানুষকে সহনশীলতা শেখায়, সেই ধর্মের নামে কিছু অসহনশীল মানুষ শুধু শিল্পের হত্যাই করে না, অনেক সময় অপর মানুষকেও হত্যা করতে পিছপা হয়ে না। ফ্রান্সের চার্লি হেবডোর উপর আক্রমন, সলমন রুশদিকে মারার হুমকি বা ভারতের এম.এফ.হুসেনের চিত্রকে নিয়ে বিতর্ক তারই প্রমাণ বহন করে। তসলিমা নাসরিনের 'লজ্জা', 'মেয়েবেলা', 'দ্বিখণ্ডিত' ,'নেই কিছু নেই' বইগুলি প্রকাশের প্রেক্ষাপটে লেখিকার থেকে শুধুমাত্র দেশের নাগরিকতা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে নির্বাসিত করা হয় তাই নয়, ধার্মিক অনুভূতিকে আঘাত করার দায়ে তাকে ইউরোপ এর জার্মানিতে দীর্ঘ ছয় বছর লুকিয়ে থাকতে হয়। জন নাট্য(জনম) এর সহপ্রতিষ্ঠাতা সফদার হাসমির উদাহরণও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্ট্রিট প্লে নির্দেশনার কাজ তিনি শুরু করেন কিন্ত রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে ১৯৭৫ সালে তৎকালীন গভর্নমেন্টের আদেশে তাঁর এই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৭ এ আবার যখন state of emergency তুলে নেওয়া হয়, সফদার হাসমি আবার ফিরে আসেন তাঁর নির্দেশনার কাজে এবং এরপরেও অনেক স্ট্রিট প্লে মঞ্চস্থ করেন। তাঁর নাটক সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য, প্রান্তিক কৃষকের দুঃখ, যুবকের বেকারত্ব, নারী নিপীড়নের মতন মর্মস্পর্শী বিষয়কে সহায়ক করে মঞ্চস্থ হতো ও সহজেই মানুষের হৃদয়কে ছুঁয়ে যেত। ১৯৮৯ এ 'হাল্লা বোল' নাটকটি মঞ্চস্থ করার সময় তাঁকে আক্রমন করা হয় এবং তিনি মারা যান স্ট্রীট প্লে করার মাশুল দিতে গিয়ে। আজো মুক্ত চিন্তাধারা ভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রকাশ পায় না বা প্রকাশ পেতে অনেক বছর লেগে যায়। 'দি পেইন্টেড হাউস', 'দি গার্ল উইথ দা ড্রাগন ট্যাটু', 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে', 'দা পিঙ্ক মিরর', ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বোরখা’ এমনি কিছু উদাহরণ।

অপরদিকে জাপানের দূরদর্শনে বা চলচ্চিত্রে হিংস্রতা বহুকাল ধরে একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে থাকা স্বত্বেও জাপানে অপরাধের হার বেশ কম ও জাপান একটি শান্তিপ্রিয় দেশ সে ব্যাপারে কেউ দ্বিমত হবেন না। আধুনিক গবেষণা প্রমাণ করেছে যে হিংস্রতা, অশ্লীলতা বা উত্তেজক কোন শিল্প প্রকাশের দ্বারা যে সমাজের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ অনুপ্রাণিত বা উত্তেজিত হবে এই দুটি বিষয়ের মধ্যে কোন অনুবন্ধ নেই। ছোটদের কোন শিল্প দেখা/শোনার ওপরে নিষেধাজ্ঞা সমাজের হিতার্থে করা হলেও, প্রাপ্তবয়স্কদের নিজের পছন্দের শিল্প দেখতে/শুনতে কোন গভর্নমেন্ট বা বেসরকারি সংস্থার আপত্তি কোন ভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। তাই আজকের যুগে হিংস্রতা বা অশ্লীলতা প্রয়োগের মাপকাঠি বা তার গ্রহণযোগ্যতা শিল্পী বা প্রাপ্তবয়স্ক দর্শকের উপরে ছাড়াই একান্ত আবশ্যক। ভারতে শিল্প স্বাধীনতা বহু যুগ ধরে চলে আসছে। প্রাচীনকালে যদি শিল্পের বিষয় বা তার পরিবেশনের উপরে রাজা-মহারাজা বা কোন সরকারের নিষেধ থাকতো তা হলে খাজুরাহ, কোনারক, ওউরঙ্গাবাদের অজন্তা ইলোরার অপূর্ব স্থাপত্য শিল্পের জন্য আজ ভারতবাসী হিসেবে আমরা গর্ব অনুভব করতে পারতাম না। তাই আজ কবিগুরুর ভাষায় শিল্প ও শিল্পীর জন্য এমন পৃথিবীর প্রার্থনা করি-

“চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির

জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর

আপন প্রাঙ্গণ তলে দিবস-শর্বরী

বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,

............

যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি

বিচারের স্রোত পথ ফেলে নাই গ্রাসি

...........

নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ

ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত ।“

Comments


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page