top of page

গল্প - প্রেরণা

  • দীপাঞ্জন মাইতি
  • Apr 21, 2017
  • 7 min read

Updated: Feb 18, 2021

“A true artist is not one who is inspired but one who inspires others”….. Salvador Dali…

“Riding the colors with Tanmay Talukdar” - কলকাতার জনপ্রিয় দৈনিকের মনোরঞ্জন বিভাগে ছাপা সাক্ষাতকারটা প্রায় হাজারবার পড়ে ফেলেছে তন্ময়, তাও কিছুতেই কেন যেন সন্তুষ্টি হয় নি। সাক্ষাতকারটা দেওয়ার সময় থেকেই নিজের দেওয়া উত্তরগুলোতে তার কেমন যেন খটকা লেগেছিল, কারণ কিছু উত্তর হয়তো পুরো সত্যি ছিল না। বিশেষ করে একটা প্রশ্ন – “Which one is more important between inspiration and the ultimate outcome??”.. ঠিক করে উত্তরটা দেওয়া হয় নি তন্ময়ের, কারণ হয়তো উত্তরটা তার নিজেরও ঠিক জানা ছিল না।

কয়েক মাস হলো সে একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছে – কারণ ছবি আঁকতে তার একটু একাকীত্বের একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো, তার সাথে মডেলদের সুবিধা অসুবিধা, স্বস্তি- অস্বস্তির ব্যাপারটাকেও গুরুত্ব দিতে হয়। পরিচিত পাড়ায় লোকের পারিপার্শ্বিকের প্রতি অদম্য উৎসাহ বিভিন্ন সময় বেশ অসুবিধা সৃষ্টি করেছে অতীতে। ছ’ বছর আগে আর্ট কলেজ থেকে পাশ করার পর ধীরে ধীরে দু –একটা মণ্ডপ সজ্জার কাজ করতে করতে আর কিছু বইয়ের প্রচ্ছদ করে আস্তে আস্তে আজ বেশ গ্রহণযোগ্য একটা জায়গাই পৌঁছেছে তন্ময়। ইতিমধ্যে দু’টো যুগ্মভাবে এবং দু’টো এককভাবে, ছবির প্রদর্শনীও হয়েছে তার। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসা ছবিটা তার চিরকালের সবচেয়ে প্রিয়। মাঝে মাঝেই তন্ময় নিজেকে বলে - একদিন ওরকম একটা ছবি আঁকতে পারলে বুঝবো আঁকতে পারি। সেই ইচ্ছাটা মাঝেমাঝেই অদম্যভাবে চাড়া দিয়ে উঠলে খোঁজ শুরু হয় মডেলের, প্রতিবারই অজস্র খোঁজাখুঁজির পর যে মডেল তার সবচেয়ে মনঃপুত হয়েছে, তাদেরকে কখনোই সে কাজ চালানোর থেকে বেশী মার্ক্স দিতে পারে নি। একা মডেলদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কখনো কখনো তাদের সাহচর্য্যেও জড়িয়ে পড়েছে তন্ময় এবং তাতে তার মনে হয়েছে বিভিন্ন মানবিক ভুল-ত্রুটিকে আত্মস্থ করে ছবির মানুষটা অনেক বেশী জীবিত হয়ে ওঠে সাধারণত:। তবে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক তার অদূর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় নেই। পারে।বাড়ির তরফ থেকে এ বিষয়ে প্রত্যাশা এবং চাপ দু’টোই বাড়তে থাকায় আপাতত তন্ময় তার স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে থাকছে। মা বাবাকে অনেক চেষ্টাতেও বোঝানো যায় নি সে তার ‘মোনালিসার’ অপেক্ষা করছে। যে দিন সেই মানুষটাকে সে খুঁজে পাবে যে তার ক্যানভাসটাতে পরিতৃপ্তির প্রতিভাস হয়ে উঠতে পারবে সে দিন সেই মানুষটাকে সে নিজের জীবনসঙ্গী করে নেবে নির্দ্বিধায়, ততদিন শুধুই অপেক্ষা। প্রথম প্রথম মা বাবা তো কিছুতেই রাজি হয় নি, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলো সে। এখন মা বাবা সামনে না বললেও - ছেলে গতানুগতিকের বাইরে গিয়েও দাঁড়াতে পেরেছে বলে গর্ববোধ যে করে সেটা তন্ময় বেশ বুঝতে পারে আর সে জন্যই হয়ত তারাও এ অপেক্ষার ভাগীদার হতে অস্বীকার করে নি..

এই মূহুর্তে তার পুরো মনোযোগ আগামী দুর্গাপূজার মণ্ডপসজ্জাতে থাকার কথা ছিল। কিন্তু, নিজের সাক্ষাতকারটা এতবার করে পড়ে পড়ে।সেই একটাই প্রশ্ন তার মনে চেপে বসেছিল, “কোনটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ প্রেরণা না সৃষ্টি??” আর এর উত্তরটা না পাওয়া অবধি যেন কিছুতেই শান্ত হচ্ছিলো না মনটা। সে আজ অবধি যা ছবি এঁকেছে সবসময় যে সেগুলো মডেলদের সামনে বসিয়ে আঁকা তা নয় কিন্তু কোথাও না কোথাও, কোনো না কোনো সময় যাদের দেখেছে তাদেরই ছবি এঁকেছে সে। তাদের বাস্তবের সাথে নিজের কল্পনার রং মিশিয়ে তার সাদা ক্যানভাসটাতে রামধনু ফুটিয়েছে রোজ। সবাই সেই রামধনুদের দেখেছে খুশি হয়েছে, অবাক হয়েছে, কেউ কেউ হয়ত খোঁজার চেষ্টাও করেছে রামধনু কোথা থেকে উঠেছে কিন্তু যথেষ্ট চেষ্টা করে নি, খুঁজেও পায় নি যেমন আকাশের শেষের ঠিক সেই কোণাটা খুঁজে পাওয়া যায় নি। প্রেরণার অস্তিত্ব অনুচ্চারিত থাকতে থাকতে অপ্রাসঙ্গিক হতে থাকে, কিন্তু তারা বেঁচে থাকে সাত রঙের কৃতজ্ঞতায়। একটা পোট্রেটের সবটাই যদি কাল্পনিক হয়!! চোখের স্বপ্ন, চুলের ভাঁজ, কানের দুল, নাকের নথ, ঠোঁটের হাসি সবটাই অচেনা হবে সেই মুখটার যাকে সে নিজে বা অন্য কেউ কখনো দেখে নি – তার মোনালিসা.... আর সেখান থেকেই শুরু হয় তন্ময়ের নতুন প্রচেষ্টা “প্রেরণা!!”

কারোর থেকে যেন কোনোভাবেই অনুপ্রেরণা না আসে এই জন্য নিজেকে একেবারে বাইরের পৃথিবী থেকে আলাদা করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই তন্ময়, এমন কি খবরের কাগজটাও নেওয়া বন্ধ করে দেয়। সারাদিন মা এর সাথে একবার কথা বলা ছাড়া বাকি সময়টা পার্থিব প্রয়োজনের আকস্মিকতার বাইরে সে নিজেকে ক্যানভাস আর সোফার মাঝের ৩ ফিটের পৃথিবীতে আবদ্ধ করে নেই। আকাশ বলতে একটা ফল্স সিলিং, মাটি বলতে মেঝের মার্বেল আর বাতাস বলতে বাতানুকূল যন্ত্রের কৃত্রিমতা। শুরুতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল, প্রথম প্রথম কিছুই যখন ঠিক যাচ্ছিলো না বারবার মুছতে মুছতে শেষ অবধি যখন পেন্সিলের আঁচড়গুলো নির্ধারিত আকার নিতে শুরু করছিলো সেগুলো বড্ড চেনা পরিচিত হয়ে উঠছিল। কিছুতেই ছবিটা যেন সে মনের মতো করে শুরু করতে পারছিলো না।

দু-এক সপ্তাহ আঁকা মোছা – মোছা আঁকা করতে করতে এই ছবিটাই তন্ময়ের ধ্যান জ্ঞান হয়ে উঠলো। এরকমই চলতে চলতে খাওয়া ঘুম প্রায় সব ছেড়ে তন্ময় ডুবে যেতে থাকলো তার মোনালিসা কে মনের মত করে গড়তে। শয়নে স্বপনে জাগরণে শুধু ছবি, শুধু অচেনা একটা মুখ খোঁজা – খোঁজা অচেনা এক জোড়া চোখ। একদিন দু’টো চোখ আঁকার পর অনেকক্ষণ চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। অনেক চেষ্টা করেও মনে পড়লো না এ চোখ দু’টো সে কবে কোথায় দেখেছে। ক্যানভাসটাকে সব দিক থেকে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলো সে – শেষমেশ সে আঁকতে পেরেছে সেই চোখ যাতে ডুব দিয়ে সে সৃজন আকাশের উন্মুক্ততা অনুভব পেরেছে, না এ চোখ কারোর মত না.. কেবল তার “মোনালিসা” র। চোখ দু’টো আঁকার পর একটা সঠিক মুখশ্রী তৈরি করতে পারলে হয়ত বাকিটা করতে তাকে বিশেষ বেগ পেতে হবে না – আবার শুরু হলো এক অচেনা মুখের খোঁজ। বেশীরভাগ সময়ই আজকাল তন্ময় চোখ দু’টোর দিকে তাকিয়ে থাকে অন্যমনস্কভাবে।

এরকমই একদিন সোফাই বসে এক মন দিয়ে চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তন্ময়ের ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল - ছোটো থেকেই ছবি আঁকতে ভালোবাসতো তন্ময়, কি করে যেন মন থেকেই মুখ আঁকত, গাছ আঁকত, তাদের যেমন ইচ্ছা রঙে রঙিন করত.... কে জানে ঠিক কি করে!! প্রথম প্রথম মা –বাবা রাজি না হওয়াই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আর্ট কলেজের ডিগ্রীটা অর্জন করেছে সে। আর এখন সেই ছোটবেলার ভালোবাসাটাকেই আঁকড়ে জীবন জীবিকার সংগ্রামে নেমেছে সে, ছবি এঁকেছে, ছবি একজিবিশেনে গেছে – প্রশংসাও পেয়েছে, কয়েকটা তো বিক্রিও হয়েছে বেশ দামে – পরিচিতি দিলেও ছবিগুলো সন্তুষ্টি দিতে পারে নি তন্ময়কে কারণ, সে আর ছোটবেলার মত কল্পনার স্রোতে নতুন দেশে ভেসে যেতে পারে না। একটা সন্তুষ্টির জায়গাও অবশ্য আছে তন্ময়ের, মধ্যবিত্ত বাঙালী বাড়ির ছেলে হয়েও একটা Passion কে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যেতে পেরেছে। এসব হাজার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন অজান্তেই চোখ লেগে গেছিলো তন্ময়ের। ঘুমের ঘোরে সে দেখলো একটা সবুজ মাঠের পাশে একটা জঙ্গল, পড়ন্ত বিকেলের সময় মাঠের মাঝখান দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে একটা ছেলে। কিসের খোঁজে কেন যেন সে ছুটে যাচ্ছে ঐ জঙ্গলটার দিকে, রাতের অন্ধকারের দিকে। মুখটা দেখতে পাচ্ছিলো না তন্ময়, কিন্তু জামাটা খুব চেনা লাগছিলো। জঙ্গলটা খুব ঘন খুব অন্ধকার, সামনের সারির গাছগুলো বাদে আর কিছু দেখা যাচ্ছিলো না। ছেলেটা দৌড়তে দৌড়তে জঙ্গলে ঢুকে গেলো, হাতড়াতে হাতড়াতে গাছের পাতা ঠেলে সরিয়ে সে গভীরে ঢুকে যেতে থাকলো। সে কিছু যেন খুঁজছিলো কিন্তু কি? একটু দূরে কি একটা যেন দেখে সে থেমে গেলো – একজোড়া চোখ, শুধু একজোড়া চোখ, তার পেছনে কোনো মুখ নেই – সেই চোখের পেছনের মুখটাকে কাছ থেকে দেখতেই বোধহয় এগিয়ে গেলো ছেলেটা কিন্তু, সে চোখ জোড়া পেছোতে থাকল... হঠাৎ হারিয়ে গেলো চোখগুলো, না দেখতে পেয়ে হঠাৎ একটা গর্তে তলিয়ে গেলো ছেলেটা.... একটা ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুমটা ভেঙে গিয়ে তন্ময় দেখলো তার দিকে তাকিয়ে আছে ক্যানভাসের সেই চোখ দু’টো.... খুব অস্বস্তি লাগলো তন্ময়ের, এই দু’টো চোখই ছিল তার স্বপ্নে, কিছু যেন ওরা বলতে চাইছিলো। কিন্তু কি??

তন্ময়ের সেই মুখ খোঁজা, মুখের ছবি আঁকার চেষ্টা চলতে থাকলো অনেকগুলো ছবি এঁকেও কিছুতেই সেই ছবিটা হচ্ছিলো না যেটাকে সে “মোনালিসা” বলে ডাকবে... সেই ছবি আঁকতে আঁকতে রোজ স্বপ্নে সেই চোখগুলো বারেবারে ফিরে আসতো। ঐ চোখগুলোর পেছনে তাড়া করতে করতে কোথাও হয়ত সেই মুখটার কাছে পৌঁছানোটাই লক্ষ্য ছিল তার অবচেতনে। সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছিলো তন্ময়ের বাস্তব আর স্বপ্নের মধ্যে, সেই এক স্বপ্নের রোজ আসা রোজ সেই চোখ তাড়া করে রোজ সেই গর্তে পড়ে যাওয়া, কিছুতেই সেই গর্ত পেরোতে পারে না ছেলেটা আর তন্ময় খুঁজে পায় না মুখটা। অন্যদিকে তন্ময়ের সামাজিক যোগাযোগ বলতে মায়ের সাথে দিনে কোনো এক সময় একবার ফোনে কথা বলা আর খাবারের প্রয়োজনে হোম ডেলিভারি ব্যাস। কিন্তু, চোখের পেছনের সে মুখটাকে কিছুতেই দেখতে পাচ্ছিলো না তন্ময়। এভাবেই একের পর এক সপ্তাহ পেরোতে থাকলো, সপ্তাহ থেকে মাস এসে মাস পেরোতে চলে।

এভাবে চলতে চলতে স্বপ্নটা এতটাই ঘিরে ধরে তন্ময়কে যে ছবির থেকে বেশী, ছেলেটা স্বপ্নের গর্তটাকে পেরোবে কি করে সারাক্ষণ সেই ভাবনাই ভাবতে শুরু করেছিলো, কারণ তার বিশ্বাস ছিল ঐ গর্ত পেরনোটা ছিল তার কল্পনার পরীক্ষা আর সেটা পেরোলেই...... মোনালিসা। ভাবতে ভাবতে একদিন সেই স্বপ্নের ছেলেটা হয়ত তন্ময়ের ভাবনার জোরেই পেরিয়ে গেলো গর্তটা। আজ আর হারিয়ে গেলো না চোখগুলো। কিন্তু, দূরে যেতো থাকলো.... খুব হালকা আবছা মতো একটা মুখ যেন সে দেখতে পেলো। তন্ময় আঁকতে গেলে স্বপ্নের সেই আবছা পাওয়া মুখটা ধীরে ধীরে আকার পেতে থাকে। মুখটা ক্যানভাসে যতটা স্পষ্ট হতে থাকে তত স্পষ্ট হতে থাকে তন্ময়ের স্বপ্নেও। স্বপ্নটা তার ছবির প্রেরণা না ছবিটা তার স্বপ্নের বিষয় বস্তু, কোনটা বাস্তব কোনটা স্বপ্ন সব আরো আরো গুলিয়ে যেতে থাকলো। ইতিমধ্যে তন্ময় বুঝতে পেরেছিলো যে স্বপ্নের ছেলেটা আর কেউ নয় সে নিজেই।

মুখটা স্পষ্ট হতে হতে স্বপ্নে একটা পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠছিলো সে যেন অনেকটা ঠিক তার মত হয়ে উঠছিল যাকে সে মোনালিসা নামে ডাকতে পারবে। ধীরে ধীরে স্বপ্নের ঘোরে তন্ময় তার মোনালিসার সাথে কথা বলতে শুরু করে। কথা বলাটা যদিও এক তরফা মানে একা তন্ময়ই কথা বলত তার মোনালিসা কখনো কোনো কথা বলে নি। এতদিনের অপেক্ষার পর সেই কল্পনার নারীকে স্বপ্নে পেয়ে তন্ময় নিজেকে প্রায় বাস্তব থেকে হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। এভাবে বহুবছরের অপেক্ষা আর প্রায় মাস দু-তিনেকের চেষ্টার পর তন্ময়ের সামনে দাঁড়িয়েছিল তার ভালোবাসা, তার আরাধনা, তার মোনালিসা। খুব খুব খুশি হয়েছিলো তন্ময় বোধহয় এই প্রথম এত খুশি হয়েছিলো সে। কিন্তু, খুব অদ্ভুত ঘটনা ঘটল সে রাতে। স্বপ্ন এলো, সে স্বপ্নে তন্ময় নিজে ছিল সেই মাঠ সেই জঙ্গল সেই গর্ত সব ছিল কিন্তু মোনালিসা এলো না। তন্ময় কিছুতেই কিছু বুঝে উঠতে পারলো না কি হচ্ছে এটা। কিন্তু খুব খারাপ লাগলো, তার সবচেয়ে খুশির দিনে সে যার এত অপেক্ষা করছিল সে মানুষটাই এলো না। পরপর কয়েকদিন একই জিনিস হতে থাকাই, খুব খারাপ লাগতে থাকে তন্ময়ের। কি করবে কিছুতেই বুঝতে পারছিলো না সে, ধীরে ধীরে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তে থাকে সে। হঠাৎ কি যেন মনে হলো নিজের আঁকা সেই মোনালিসার ছবিটার কিছুটা মুছে ফেলে তন্ময়। সে রাতে ক্যানভাসে অসম্পূর্ণ হয়ে স্বপ্নে সশরীরে ফিরে আসে মোনালিসা। ফিরে আসে তন্ময়ের মুখের হাসি। আবার ছবিটা পুরো করলেই সেই এক জিনিস, আবার হারিয়ে যায় মোনালিসা তার স্বপ্ন থেকে।

এক অদ্ভুত দ্বিধাগ্রস্ত মূহুর্ত ছিল তন্ময়ের জীবনে, একদিকে তার গোটা জীবনের অপেক্ষা ছিল অন্যদিকে ছিল তার সেই সৃষ্টি যা তার স্বপ্ন ছিল। একদিকে তার সৃষ্টি অন্যদিকে তার এক অচেনা প্রেরণা যাদের অস্তিত্ব কোথাও না কোথাও একে অপরের ওপর ছিল, তাদের যোগসূত্র ছিল তন্ময় আর তারা দু’জনেই তন্ময়ের কল্পনার অংশ একজন সশরীরে তবু বাস্তবে অন্যজন ক্যানভাসে। তন্ময় কিছুতেই কি করবে বুঝতে না পেরে... বারবার জিজ্ঞাসা করতো মোনালিসাকে সে কি করবে.. । মোনালিসা শেষমেশ একদিন উত্তর দিলো “ তুমি আমাকে গড়েছ ওর প্রেরণা করে না ওকে ধরে গড়েছ আমায়? কোনটা তোমার সত্যি? কোনটা আমার? তোমার ক্যানভাস তোমার সাথে কথা বলবে না কোনোদিন কিন্তু তোমার হয়ে কথা বলবে। আমি.... ঠিক জানি না।” মোনালিসা উঠে যেতে যাচ্ছিল তন্ময় তার হাতটা ধরে জিজ্ঞাসা করে - কেনো তোমরা দু’জনে একসাথে থাকতে পারো না... মোনালিসা বলে “ ওর অসম্পূর্ণতার প্রয়োজন আমি.. ও সম্পূর্ণ হয়ে গেলে আমার আর অস্তিত্বের কোনো কারণ থাকে না... আমি তোমার কল্পনা থেকে মুছে গিয়ে নতুন প্রেরণাকে জায়গা করে না দিলে তুমি আর আঁকবে কি করে?” আর আমি যদি আঁকতে না চাই!! যদি এটাই আমার শেষ ছবি হয় তুমি কি...!! “ না তুমি ছবি শেষ করে ফেললে আর আমার কোনো প্রয়োজন নেই, আমি কেবলমাত্র তোমার ছবির প্রেরণা।” আর তুমি কি করলে রয়ে যাবে আমার সাথে? “ তোমার ছবি শেষ হলে আমিও শেষ।”মোনালিসা এবার চলে যেতে গেলে তন্ময় তার হাতটা ধরতে গেলো কিন্তু ধরতে পারলো না। মোনালিসা হারিয়ে যেতে থাকলো সেই জঙ্গলটার গভীরে তন্ময় তাকে ধরতে গেলো। সব ফেলে ছুটতে গিয়ে পেছনে ঘুরে ক্যানভাসের অসম্পূর্ণ মোনালিসাকে দেখতে গিয়ে হঠাৎ একটা গর্তে পড়ে গেলো। এবারের গর্তটা আগেরবারের থেকে আলাদা ছিল, নিজেকে ওজনশূন্য মনে হলো তন্ময়ের .......... মোনালিসার কোলে মাথা দিয়ে শুয়েছিলো তন্ময়, কিন্তু সেই চোখ দু’টো আবার শুধু সেই চোখ দু’টো .... দেখতে পেলো সে চোখ বোজা মাত্র। আঁতকে উঠলো তন্ময়..... অস্ফুট স্বরে বলে উঠল অসম্পূর্ণ ।

The true genius shudders at incompleteness — imperfection — and usually prefers silence to saying the something which is not everything that should be said.” ― Edgar Allan Poe

Comments


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page