top of page

স্মরণে - মহাশ্বেতা দেবী

  • পার্থ সেন
  • Aug 27, 2016
  • 3 min read

Updated: Feb 18, 2021


গত ২৮শে জুলাই আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেলেন ‘হাজার চুরাশির মা’, ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘চেট্টিমুন্ডা’, ‘জল’, ‘ভাত’, ‘বায়েন’, ‘আজির’, ‘স্তনদায়িনী’ র স্রস্টা সাহিত্য অ্যাকাডেমি এবং জ্ঞানপীঠ পুরস্কার প্রাপ্ত শ্রদ্ধেয়া মহাশ্বেতা দেবী। শুধু বাংলায় নয় বর্তমান ভারতের প্রবীণতম সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।

১৯২৬ – এ জন্ম ঢাকায়, তাঁর বাবা মনীশ ঘটক ছিলেন কল্লোল যুগের স্বনামধন্য সাহিত্যিক, কবি, মা ধরিত্রী দেবী ছিলেন সে সময়ের এক নাম করা লেখিকা, কাকা ঋত্বিক ঘটক চিরস্মরণীয় চিত্রপরিচালক, বড়মামা অর্থনীতিবিদ শচীন চৌধুরী। বাংলা ভাগের পর পূর্ববঙ্গের ভিটে ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন, বিশ্বভারতী থেকে ইংরাজির স্নাতক, তারপর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজি সাহিত্যে মাস্টার ডিগ্রী অর্জন করেন। অবশ্য ভিত তৈরি হয়েছিল ক্লাস ফাইভ থেকে শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করে, আর সেখানে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেইজ আর ছিলেন স্বয়ং গুরুদেব। স্বাধীনতার বছরে ‘নবান্নে’র রূপকার বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিবাহ, ১৯৬২ তে বিবাহবিচ্ছেদ তারপর অসিত গুপ্তের সাথে দ্বিতীয় বিবাহ। বিজন–মহাশ্বেতার পুত্র নবারুণ ও ছিলেন নামকরা লেখক। ১৯৭৬ সালে দাম্পত্য জীবনের পাকাপাকি ভাবে সমাপ্তি ঘটে।

বিগত ছয় দশক ধরে সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি সমানে লড়াই চালিয়ে গেছেন সামাজিক অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে। অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষদের জন্য তাঁর লড়াই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কখনো আইনের লড়াই, কখনো মিটিং, মিছিল, কখনো বা সাহসী চিঠি বা লেখনী। তাঁর অনমনীয়, আপোষহীন কলম বারে বারে প্রতিবাদ জানিয়েছে মানব সভ্যতার শত্রুদের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশরা লোধা, শবরদের অপরাধপ্রবন জাতি ঘোষণা করেছিল। স্বাধীন ভারতে যাতে সেই তকমা টা তুলে ফেলা যায় তার জন্যে মহাশ্বেতা লড়াই শুরু করেন। মিশে গেছিলেন তাদের জীবনের সাথে। তাঁর সেই লড়াই আমরা আবার দেখেছি সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে বিনা বিচারে আটকে রাখা রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির জন্য। ধারাবাহিক ভাবে লড়াই করেছেন ভূমিদাস প্রথা, গুজরাত হত্যাকাণ্ড, নর্মদা বাঁধ, এমন কি সিঙ্গুর–নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়। অসংখ্য সংগঠনের সঙ্গে তিনি সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন যার মধ্যে দিনমজুর, রিক্সা, বিড়ি শ্রমিক, সাইকেল চালক, মিষ্টি বিক্রেতা, বাউল গায়ক, ইট ভাটা মজদুর, মৃৎশিল্পী সংগঠন ও ছিল।

তাঁর মতো বিশ্ব ব্যাপী খ্যাতি খুব কম সাহিত্যিকের হয়। ভারতের বহু ভাষায় তাঁর বই অনুবাদ হয়েছে। এমনকি ইংরাজি, ফরাসি, স্প্যানিশ, জার্মান, ইতালিয়ান, কোরিয়ান, জাপানি ভাষাতেও তাঁর বই অনুদিত হয়েছে। ২০০৬ সালে ফ্রাঙ্কফ্রুটে আয়োজিত বইমেলার থিম ছিল ভারতবর্ষ, আর সেই বইমেলার উদ্বোধন করেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক ইংরাজিতে অনুবাদ করেন মহাশ্বেতা দেবীর লেখা। তাই মহাশ্বেতা দেবী কে শুধু বাংলা অথবা ভারতীয় সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে বেঁধে রাখা যায়না, তিনি ছিলেন এক যথার্থ সার্বজনীন, আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক।

সাহিত্যিক মহাশ্বেতার রচনা আলোচনা করার পরিসর এখানে নেই। কিন্তু তাঁর রচনা অন্যদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের, যেখানে ইতিহাস–অন্বেষণ ছিল প্রধান। লোকবৃত্ত, লোক ইতিহাসে তাঁর ছিল অসম্ভব ঝোঁক। বর্তমানের মধ্যে মিশিয়ে রাখতেন ইতিহাসের উপাদান। ঝাঁসির রানী কে নিয়ে জীবনী লিখতে গিয়ে তিনি যে নতুন ধরনের ইতিহাস নির্মাণ করলেন, তার–ই পরিণতি ‘হাজার চুরাশির মা’। সারা উনিশ শতক ধরে মুন্ডাদের অরণ্য ভূমি হারানোর ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে কখন লিখে ফেললেন ‘অরণ্যের অধিকার’। কখনো তিনি সোচ্চার হয়েছেন বঞ্চিত, লাঞ্ছিত আদিবাসীদের কথায় – যার প্রভাব আমরা দেখেছি ‘হুল মাহার’, ‘শনিচরী’ বা ‘দ্রৌপদী’ রচনায়। কখনো বা স্তিমিত কণ্ঠে শুনিয়েছেন নারীশক্তির এঙ্কাউন্টার ছুঁড়ে দেবার কাহিনী – যা আমরা দেখি ‘সাগোয়ানা’ লেখায়। ‘চোটি মুন্ডা ও তার তীর’ উপন্যাসটি নিম্নবর্গের মানুষদের বিদ্রোহের কাহিনী বলে আখ্যায়িত হয়েছিল। আবার ‘হুল মাহার’ উপন্যাসে লিখলেন জমিদার, মহাজন, নীলকর সাহেব, ব্রিটিশ কোম্পানির শোষণ আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাঁওতাল অভ্যুত্থানের কাহিনী। আর একটু পেছনে ১৭৬০-১৭৭০ এর সময়ের বিহার-ওড়িশার নানা আদিবাসী অঞ্চলে রাজস্ব আদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কাহিনী লিখলেন ‘শালগিরার ডাকে’। দীর্ঘ দিন ধরে তিনি ‘বর্তিকা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, সেই পত্রিকার এক একটি সংখ্যা সংগ্রহ করে রাখার মতো। প্রতিটি লেখায় তিনি ডালপালা বিস্তার করে ছড়িয়ে পড়েছেন আদিবাসী, দলিত বা প্রান্তিক মানুষের মধ্যে। সেই সঙ্গে ছিল সাহিত্য রচনায় অসম্ভব প্যাশন। অবাক হয়ে যেতে হয় – মাত্র চার দিনে তিনি রচনা করেছিলেন ‘হাজার চুরাশির মা’। একদিন সকালে শুরু করে সন্ধ্যে বেলা শেষ করেছিলেন ‘স্তনদায়িনী’। তার অসম্ভব রচনাশৈলী আর সাহিত্যের ওপর ভালোবাসা তাঁর রচনা সম্ভারকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিরকালীন করে রাখবে।

মহাশ্বেতা দেবীর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যে একটি যুগের অবসান হলো। সেই শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। কিন্তু তাঁর চিন্তা ভাবনা, দার্শনিক পরিস্ফুটন, সুবিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার আমাদের সাহস যোগাবে, আগামী দিনের কাজ করার প্রেরণা যোগাবে।

Comments


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page