top of page

গল্প - না বলা কথা

  • অশোক ভট্টাচার্য
  • Aug 17, 2016
  • 5 min read

Updated: Feb 18, 2021

এম এ পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোতে না বেরোতেই মহুয়ার বিয়ের সম্বন্ধ টা পাকা হয়ে গেছিল। তারপর রেজাল্ট বেরোনোর পর পর-ই বিয়ে টা হয়ে যায়। স্বামী চাকরী সূত্রে প্রবাসী বাঙালি, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, আমেরিকায় কোনো এক ভালো কোম্পানি তে কাজ করে। আর তাই কিছুদিনের মধ্যে মহুয়া পাড়ি দিয়েছিল আমেরিকায়। বিয়েটা ভালোই হয়েছিল। বিদেশে চাকরী করা পাত্রকে বিয়ে করে, ওদেশে যাবার পর মাঝে মাঝে ঝামেলা – টামেলায় পড়ার কথা খবরের কাগজে যেরকম পড়া যায়, ওর ক্ষেত্রে সেসব কিছু –ই হয়নি।

তবু প্রথম প্রথম একদম মন বসত না মহুয়ার। দেশের অনেকের কথা মনে পড়ত, বৈভব প্রাচুর্যের মধ্যেও এক এক সময় নীরবে সেই মানুষ গুলোর জন্য মনটা হঠাৎ খুব খারাপ করে উঠত। প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে তবু দু-বার দেশে ঘুরে গেছে, কিন্তু গত পনেরো বছরের মধ্যে একবারও তার আসা হয়ে ওঠেনি। ছেলে মেয়ের পড়াশোনা আর স্বামী উচ্চপদে উঠে যাওয়ায় কর্ম ক্ষেত্রে তাঁর ব্যস্ততা – সব কিছু নিয়ে মহুয়া এখন ভীষণ রকমের ব্যস্ত। কিন্তু সংসারের সব কিছু একা সামলে মহুয়া একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছিল। যাব যাব করেও এত দিন বাদে কোন রকমে কদিন সময় বের করে চলে এসেছে। মাত্র পনের দিনের জন্য। তার মধ্যে বাপের বাড়ির জন্য আট দিন, শ্বশুর বাড়ির জন্য সাত দিন বরাদ্দ। এর মধ্যে আত্মীয় স্বজনের সাথে যত টা পারা যায় দেখা করে নিতে চায় সে। তাই কদিন ধরেই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তার ব্যস্ততা চলছিল।

বাড়ি থেকে বেরিয়েই কয়েক পা হেঁটে রিক্সা স্ট্যান্ড। ব্যস্ত মহুয়া কোন দিকে না তাকিয়ে স্ট্যান্ডে এসে জিজ্ঞেস করল – “কার লাইন?”

কোন কথা না বলে মাঝ বয়সী এক রিকশাওয়ালা রিক্সা নিয়ে এগিয়ে এলো, সুঠাম শরীর, আধ পাকা চুল আর দাড়ি গোঁফে মুখের অর্ধেক টা ঢাকা। হঠাৎই মহুয়ার কেমন যেন গা ছমছম করে উঠল, কে জানে কোনো খারাপ লোক নয়তো? কিন্তু দিনের বেলা আর কি হবে? রিক্সায় উঠে মহুয়া বলল – “বাস স্ট্যান্ডে চলুন, কলকাতা যাবার বাস ধরব, একটু তাড়া আছে, একটু তাড়াতাড়ি চলুন”।

রিকশাওয়ালা কোন দেরী করেনি, যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব মহুয়াকে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দিল। টাকার ব্যাগ থেকে টাকা বার করতে করতে মুখ না তুলে মহুয়া বলল – “কত দেব?”

“থাক লাগবে না”

“লাগবে না?” বিস্ময়ে মহুয়া এবারে মুখ তুলে চাইল।

আবার সেই সংক্ষেপে উত্তর, “থাক লাগবে না”

এবারে রিকশাওয়ালার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু লক্ষ করতেই মহুয়ার আর ভুল হল না, সেই সুন্দর ভাষা ভাষা দুই চোখ, সেই রহস্যময় হাসি, গোঁফ দাড়ির আবরণেও যা ঢাকা পড়েনি। মহুয়া ওর হাত দুটো ধরে ফেলল – “তুমি রহমতদা না?”

এতক্ষণের সেই লুকোনো হাসি এবারে মুখে প্রকাশ পেল, রহমত আলি হেসে উঠল – “আরে দিদিমণি, এখনো রহমতদাকে মনে রেখেছ?”

“রাখব না? বিয়ের পরে দূরে চলে গেলেও সবার কথা আমার মনে পড়ত।”

“তাই?”

“সত্যি বলছি! আগে যখনই এসেছি তোমার খোঁজ নিয়েছি। দেখা পাইনি। আগের বারে তো এই রিক্সাস্ট্যান্ডে এসে তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। শুনে ছিলাম তুমি নাকি কোথায় চলে গেছো!”

“ঠিকই শুনেছ। তুমি বিয়ে হয়ে চলে যাবার পর আমি ও বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিলাম। পাঁচ ছয় বছর ধরে ঘুরে বেড়ালাম এখানে ওখানে, নানা ধর্মস্থানে। মাঝে মাঝে একটা দুটো চিঠি লিখে বাড়ির সাথে যোগাযোগ রাখতাম। বাড়ি বলতে তো খালি মা। প্রতিবার চিঠির উত্তর আসতো, অন্য কে দিয়ে লেখানো। কান্নাকাটি করতো বাড়ি ফিরে আসার জন্য। তারপর আবার একদিন বাড়ি ফিরে এলাম।”

কথা বলতে বলতে মহুয়া কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়েছিল, মনে পড়ছিল সেই অনেক পুরোনো দিনের কথা। তখন উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে মহুয়া কলেজে ভর্তি হয়েছে। কলেজ বাড়ি থেকে বেশী দূরে নয়, রিক্সা করে বাস স্ট্যান্ড তারপর চারটে স্টপ। মহুয়ার বেশ মনে পড়ছে সেসব দিনের কথা। প্রথম দিনে বাবা তাকে পুরোটাই রিক্সাতে চাপিয়ে কলেজে পৌঁছে দিয়েছিলেন, আর এই রহমতদার রিক্সাতেই। প্রথম দিনে কলেজ যাবার আনন্দে অন্য দিকে তাকানোর ফুরসৎ ছিলো না মহুয়ার। তবু লক্ষ্য করেছিল, সুপুরুষ, সুঠাম চেহারা আর ভাসাভাসা চোখের এই যুবককে ঠিক রিকশাওয়ালা মানায় না। যাহোক, তিন বছরের কলেজ আর দুই বছরেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময় মহুয়া নিয়মিত যাতায়াত করেছে এই রহমত আলির রিক্সাতেই। আর নিয়মিত যাতায়াত করতে করতেই রহমত আলির সাথে বেশ পরিচয় হয়ে যায়। মাসকাবারি না হলেও এই রহমত আলির রিক্সাই হয়ে উঠেছিল মহুয়ার বাঁধা রিক্সা। আর রহমত আলি হয়ে গেল রহমতদা। আর মহুয়া হয়ে গেল দিদিমণি। আর শেষের দুটো বছর মহুয়াকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সোজা বাড়িতে নিয়ে আসতে রহমত আলি সোজা চলে আসতো বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের কাছে। মহুয়া গেট থেকে বেরিয়ে রিক্সায় উঠে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করত – “রহমতদা তুমি কি করে বুঝতে পারো আমার এই সময়ে ছুটি?”

“বা রে! একটা হপ্তা লক্ষ্য করলেই তো বোঝা যায়, কবে কোন সময়ে বেরোবে?”

“তাই বলে তুমি এতো দূর ফাঁকা রিক্সা নিয়ে আমার জন্য আসো?”

“না ফাঁকা আসতে তো হয় না। এদিকে আসার লোক পেয়ে যাই, আর তুমি ও তো রোজ দেখি গেট থেকে এদিকে ওদিকে চেয়ে দেখ, আমার রিক্সাটা দেখা যায় কি না?”

যেন কোন গোপন কাজ ধরা পড়ে গেছে। মহুয়া হেসে ফেলে – “তুমি তাও লক্ষ্য করেছো?”

“তাই তো রোজ চলে আসি এখানে”

এর কিছু দিন বাদে এম এ পরীক্ষা দেওয়ার আগে মহুয়ার বিয়ের সম্বন্ধ আসা শুরু হয়ে গেল। আর মহুয়া এটা বেশ বুঝতে পারছিল তার এই প্রতিদিনের যাতায়াত খুব তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যাবে। আর খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে ঠিক হবে আর বিয়ে হয়ে গেলে চলে যেতে হবে অন্যত্র। আর ঠিক তখনই কেমন যেন এক মানসিক বেদনা অনুভব করত রহমতদার জন্য। তবে কোন কোন সময়ে মনটা দুর্বল হলে আবার শক্ত করে নিত। মনকে বোঝাত কি আবোল তাবোল ভাবছে সে? থাক না রহমতদার সুন্দর শরীরের এক অমোঘ আকর্ষণ, তাই বলে ধর্ম আলাদা, পরিবেশ আলাদা, সামাজিক মর্যাদায় কখনো মিলবে না। ওর মনে মাঝে মাঝে যে চিন্তা টা আসছে – সেটা অবাস্তব, ক্ষণিকের মোহ, আর নাটকীয় কিছু করার সাহস সে পায় নি। তবু শেষ দিনে রহমতের রিক্সা থেকে নামার সময় একটু দূরে নিয়ে গিয়েছিল রহমতদা কে। বলেছিল, “রহমতদা আমার পড়া শেষ হয়ে গেল, আর হয়তো তোমার সাথে দেখা হবে না।” রহমতের মুখ টা কেমন যেন কালি মেরে গেছিল, তবে ধীরে ধীরে উত্তর দিয়েছিল – “হ্যাঁ, একদিন তো শেষ হয়ে যাবেই”

“তুমি ভুলে যাবে আমাকে, তাই না?”

রহমত কোন উত্তর দেয় নি, খালি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়েছিল। মহুয়া নিজের ব্যাগ থেকে একটি পাঞ্জাবি – পাজামা বের করে রহমত আলির হাতে দিয়েছিল আর বলেছিল – “রহমতদা তুমি এটা পোড়ো। যত দিন না ছিঁড়ে যায় ততদিন আমার কথা টা অন্তত মনে রেখো”

মহুয়ার বেশ মনে আছে, রহমত পাঞ্জাবি – পাজামা টা মাথায় ঠে কিয়ে বলেছিল, “আল্লা, মেহেরবান”

হঠাৎ মহুয়ার সম্বিত ফিরে এল, রহমতের কথায় – “দিদিমণি তোমার তাড়া আছে বললে না?”

সে কথার উত্তর না দিয়ে মহুয়া জিজ্ঞেস করল – “রহমতদা তুমি বিয়ে করেছ?”

ম্লান মুখে তবে মুখে সেই হাসি, রহমত উত্তর দিল – “না”

“কেন?”

হাসি মুখে উত্তর দিল রহমত – “দিদিমণি সে রকম মেয়ে খুঁজে পেলাম কই?”

“তোমার মা তোমাকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়নি?”

“দিয়েছিল, কিন্তু রাজি হয়নি”

“তাই বলে তুমি সারা টা জীবন এই রকম একা একা কাটিয়ে দেবে”

“ক্ষতি কি? এই তো বেশ আছি”

কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে গেল, মহুয়া আবার জিজ্ঞেস করল, “রহমতদা সেই পাঞ্জাবি – পাজামা টা কি করলে? পড়েছিলে?”

“না পড়িনি, পড়লে যদি ছিঁড়ে যায়। তাই বাক্সে তুলে রেখেছি। মন খারাপ হলে মাঝে মধ্যে বাক্স থেকে বের করে দেখি, রোদে দিই, আবার তুলে রাখি।”

এবারে মহুয়ার সেই পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল - “যত দিন না ছিঁড়ে যায় ততদিন আমার কথা টা অন্তত মনে রেখো” মুখ ফুটে সে আর কিছু বলতে পারলাম না। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, “রহমতদা”

হাতদুটো তখন ও রহমতের হাতে ধরা। রহমত বলে উঠল, “দিদিমণি, পরপর কত গুলো বাস তো কোলকাতার দিকে চলে গেল!”

Comments


নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page