top of page
  • শুভায়ু বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রবন্ধ - লেখকের স্বাধীনতা- টুকরো খবর

ছেঁড়া ছেঁড়া খবরের কাগজের পাতা। টিভিতে টুকরো খবরের হেডলাইন। লেখকের স্বাধীনতা বোঝানোর কোলাজ। স্বাধীন পৃথিবীতে স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশগুলোর স্বাধীন লেখকদের স্বাধীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্নই উঠবে না। সেই গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম থেকেই কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর তৈরি হয়েছে নানারকম আইন- সমস্ত সভ্য দেশেই।

বাস্তবে কি লেখকের কোন স্বাধীনতা হয়? লেখকরা বলতে ভালবাসেন যে তাঁরা স্বাধীন, তাঁরা তোয়াক্কা করেন না কোন শিকলের, কিন্তু অল্পসংখ্যক ব্যতিক্রম বাদ দিলে, তাঁরা বরাবরই পরাধীন কখনো রাষ্ট্রের কাছে, কখনো ধর্মের কাছে, কখনো চক্ষুলজ্জা বা সুনামের কাছে, কখনো পুরস্কারের কাছে। কিন্তু সেই অল্পসংখ্যক লেখকই সমাজে পরিবর্তন আনতে পারেন। সেই অল্পসংখ্যক লেখকের জন্যই পৃথিবীতে এখনো স্বাধীনতা বেঁচে আছে - মুমূর্ষু অবস্থাতেও।

১৪/২/১৯৮৯

দিস ইজ বি বি সি। আজ ভ্যালেন্টাইন্স ডে। আজকের অনুষ্ঠানে আপনার ভালবাসার লোকটিকে পাঠান আপনার প্রেম। আমরা রেডিওতে প্রচার করবো। প্রোগ্রাম চলছে তখন। হঠাৎ বি বি সির সাংবাদিক জেমস নখটির চোখে পড়লো বার্তাটা। স্যাটানিক ভার্সেস লেখার জন্য ইরানের আয়াতোল্লা খোমেইনি ফতওয়া দিয়েছেন সলমান রুশদির নামে। প্রফেট মোহম্মদকে অপমান করা হয়েছে এই বইয়ে। সমস্ত মুসলমানদের আত্মসম্মানের দোহাই দিয়েছেন আয়াতোল্লা, খতম করতে হবে এর লেখককে! বুঝলাম না। বইটা তো লেখা হয়েছে স্যাটায়ার হিসেবে - হিন্দি ছবির এক অভিনেতাকে কেন্দ্র বা উদ্দেশ্য করে। তাতে ধর্ম কোত্থেকে আসছে? কিন্তু ধর্ম এলো।

সলমান রুশদি বোঝানোর চেষ্টা করলেন সবাইকে- এরকম অভিপ্রায় তাঁর ছিল না, কিন্তু তাতে ফতওয়ার নড়নচড়ন হল না।

২০১৩

প্রায় বছর কুড়ি পেরিয়ে গেছে- কিন্তু এখনো মৃত্যুভয় কাটে নি। এরই মধ্যে ক্ষুরধার লেখনী লিখে ফেলেছে আরও অনেকগুলো স্যাটায়ার- হারুন, লুকা আর আত্মজীবনী জোসেফ আন্তন। এডিনবরা বুক ফেস্টে সেই দৃপ্ত, সৎ লেখকের পৃথিবীটা কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে গত তিরিশ বছরে - সে কথাই বারবার বলছিলেন। জীবনের বাজি রেখে সততাকে আগলে রেখেছেন- তাই তো তিনি বলতে পারেন “আমার যা ইচ্ছে লিখব, তোমার যা ইচ্ছে হবে না, তা পড়ো না।”

২০১২ স্টোরি স্নুপ্সের সাক্ষাৎকারঃ

ওয়াল্টার ডিন আলিয়ারস তাঁর রাজনৈতিক কারনে নিষিদ্ধ (যুদ্ধের বিপক্ষে কথা বলা তো অন্যায় হবেই!) ‘ Fallen Angels’ বইয়ের যুদ্ধবিরোধিতা প্রসঙ্গে বলছেন “The execution of war involves on a very basic level, getting law-abiding and humane people into a mode that allows them to kill other human beings for whom they have no personal animosity.” কি সাঙ্ঘাতিক কথা! এতো ভয়ানক জাতীয়তাবাদবিরোধী!আমরা যুদ্ধ করবো কোন এক অদৃশ্য, অসম্ভব, ভয়ঙ্কর, ভবিষ্যৎ আগ্রাসন থেকে দেশকে রক্ষার জন্য, আর তার সমালোচনা করার তুমি কে হে? সব ব্যান,সব ব্যান!

এবারে আসি ইরোটিসিজমে। পুরুষ লেখকরা যত সহজে এনেছেন, মহিলা লেখকরা? কেন? ইরোটিসিজম কি শুধুমাত্র নারীশরীরকে কেন্দ্র করে? কেন আমরা প্রতিভা বসু, আশাপূর্ণা বা নবনীতার লেখায় যৌনতা পাবো না? মার্কেস, মারিও ভারগা ইয়োসা যত সহজে যৌনতা আনতে পারেন, ইসাবেল আয়েন্দে কোথাও যেন আটকে যান। লরেন্স পারেন কিন্তু ভার্জিনিয়া উলফ পারেন না। এ কি মহিলা লেখকদের স্বাভাবিক সৌজন্যবোধ বা চক্ষুলজ্জা থেকে? অ্যানাই নিন ছাড়া এতকাল যৌনতাকে সেভাবে explore করলেন কোথায় মহিলা লেখকরা? বিংশ শতক অবধি মহিলাদের লেখায় একটা আড়াল আবছায়ার মধ্যে ইরোটিসিজমকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। মানে ওই হিন্দি সিনেমায় দুটো গোলাপফুলের কাছাকাছি আসার মতো! এতদিন বাদে এই একবিংশ শতকে কেন তিলোত্তমা বা সঙ্গীতাকে শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে হবে? কেন তসলিমার লেখাকে অসভ্য বলে অভিহিত করা হবে?

আর পুরুষ লেখকরা? বিরাট ফর্দ হয়ে যাবে অশ্লীলতার দায়ে ব্যান করা বইয়ের তালিকায়। ইউলিসিস, ট্রপিক অফ ক্যান্সার, লেডি চ্যাটারলি, লোলিটা, বিবর, প্রজাপতি, রাত ভোরে বৃষ্টি- কতো উদাহরণ দেবো? মনে আছে অনেকদিন আগে পড়া নারায়ণ সান্যালের ‘অশ্লীলতার দায়ে’ - যেখানে মহাভারতের গল্পও অশ্লীল মনে হয় পাঠকের।ট্রপিক অফ ক্যান্সার ইংল্যান্ড আমেরিকার কোন প্রকাশক ছাপতে চায় নি, ওই ‘অসভ্য’ জায়গাগুলো বাদ দিতে হবে। খেপে গেলেন হেনরি মিলার।ছাপলো শেষে ওবেলিস্ক প্রেস, যা আবার প্রাপ্তবয়স্কদের বই ছাপানোর জন্য বিখ্যাত ছিল। তিরিশ বছর পরে ব্যান উঠে যায় ঠিকই, অমর হয়ে যায় ট্রপিক অফ ক্যান্সার, কিন্তু যে প্রজন্মর জন্যে লেখা এই বই- তাঁরা কিন্তু ততদিনে বার্ধক্যের সীমানায় পৌঁছে গেছেন। যদিও সেন্সরের এই বাড়াবাড়ির মধ্যেও হেনরি মিলারের বই ফরাসী রান্নার প্রচ্ছদের মধ্যে লুকিয়ে আমেরিকায় রপ্তানি করা হয়েছিল।

হাংরি জেনারেশনঃ আমাদের বাঙালী সাহিত্যচেতনে হাংরি জেনারেশনের আন্দোলনের মৃত্যু হয়তো অন্যতম লজ্জা। পোষ্টমডারনিজমের এই মুভমেন্ট আরম্ভ হয় ষাটের দশকে। “আধুনিকতার শবদেহের উপর উল্লাসময় নৃত্যের নামই হাংরি জেনারেশন” – (শৈলেশ্বর ঘোষ)। আটমাস ব্যাপী মামলা চলে এর লেখকদের বিরুদ্ধে। অনেকেই গ্রেফতার হন, পরে ছাড়া পান- সবাই, মলয় রায়চৌধুরী ছাড়া। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ? রাষ্ট্রের বিরোধিতা আর অশ্লীলতা! তখনো দেখেছিলাম তথাকথিত স্বাধীন কিছু লেখক মাথা নুইয়েছেন সরকারের কাছে! লজ্জা বললাম, কারণ এই মুভমেন্টের সময় লেখা হয়েছিল কিছু ব্যতিক্রমী, সাহসী, স্বর্গীয় লেখা- আর আমরা, বাংলার তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা যারা নিকারাগুয়ার ক্ষুধার্ত জনগণ থেকে অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙ্গারুর এক্সিস্টেন্সিয়াল ক্রাইসিস থেকে এমনকি বেদ উপনিষদের সময়কার শোষিত জনগণের ডিসএনফ্র্যানচাইজমেন্ট নিয়ে অন্তত আধঘণ্টা বক্তৃতা দিতে পারি, তারা কেউ বুক দিয়ে আগলে রাখলাম না- তরুন এক প্রজন্মের এতোগুলো প্রতিভা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রীয় জুলুমে শহীদ হয়ে গেলো।

২৬শে ফেব্রুয়ারি ২০১২

সন্ধ্যের খবরে ঢাকাবাসী জানলো যে মুক্তমনা ব্লগার অভিজিত রায়কে “চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে” খুন করেছে একদল দুষ্কৃতিরা। এর সঙ্গে স্বাধীনতার কি সম্পর্ক? কারণ অভিজিত রায় ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লিখছিলেন বহুদিন ধরে- আর ধর্মীয় কুসংস্কার আর ধর্মকে এক করে দেখার লোকের অভাব নেই এই একবিংশ শতাব্দীতেও। সুতরাং কোপাও আর মুখ বন্ধ করে দাও।

কয়েকদিন বাদে জানা গেল অভিজিত রায়কে কুপিয়েছিলেন দুজন আর তাদেরকে জনচক্ষুর আড়ালে রেখেছিলেন আরও প্রায় তিরিশজন- যাতে আততায়ীদের পরিচয় প্রকাশ না পায়। বড়ো সাংগঠনিক শক্তি ছাড়া এই আক্রমণ অসম্ভব। আক্রোশে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন মুক্তমনা আরও অনেক বাংলাদেশি লেখক- অধিকাংশই অবশ্য সাবধানী। যেটা শুনতে পেলাম না তাহলো হায়েনার হাসি “সাহিত্যিকের আবার স্বাধীনতা! বলদের বিষ্ঠা!”

কিন্ত অভিজিতদের আত্মত্যাগ, যা আমার মতে একুশে ফেব্রুয়ারির সমগোত্রীয়, তা একেবারে বৃথা যায় নি। এগিয়ে এলো আরও অনেক স্বর- শহীদ হল আরও দুয়েকজন, কিন্তু ইউটিউব খুললে এখন অনেক অনেক কণ্ঠস্বর শোনা যায়, যারা এতদিন ভয়ে লুকিয়েছিলেন, ভয় করতে করতে সেই ভয়ের ভয়টাই তাদের শেষ হয়ে গেছে (কোন এক হিন্দি ফিল্মের ডায়ালগ অবলম্বনে)

আমস্টারডাম ল ফার্মে ড্যানিয়েল অভারগ এর লেখা- “ Liberty is a paradox”। বা বলা ভালো “liberty is surrounded by paradox” জন মিলসের উদ্ধৃতি তুলে দিয়েছেন তিনি” ‘সত্যি’ কথাটার অর্থ হল লজিক্যালি ‘অসত্য’র অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়া। শুধু তাই নয়, সেই ‘অসত্য’কে না শুনলে ‘সত্য’কে বোঝাই যাবে না। “If you prevent a certain view from being expressed, there is no longer any discussion possible” তারপরই পাই সেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লাইন “It is replacement of dialogue by monologue”। এইখানেই আমাদের সভ্যতার পরীক্ষা। ফেসবুকের পাতায় কোন সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করে লিখে “ভেরি স্যাড” বলে কমেন্ট করে হবে না, লিখতে হবে জোরালো লেখা, আঁকতে হবে কার্টুন, তাতে হাজতবাস হলে হবে, প্রাণসংশয় হলে হবে। নইলে, ঢুলুঢুলু চোখে সিউডো-আঁতলামো ছাড়া আর কিছুই হবে না। সততা ছেড়ে ভালো লেখা হয় না, হয় আখের গোছানো। প্রলোভন তো আসবেই - আজকাল পুরস্কার দেবার এবং বিনা দ্বিধায় নেবার হিড়িকের মধ্যে আমার শুধু এক শান্ত ফরাসী দার্শনিকের কথাই মনে পড়ে। জা পল সারত্র। নোবেল প্রাইজ নিতে অস্বীকার করেছিলেন কারণ তাঁর মনে হয়েছিল এতে লেখকের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ক্ষুণ্ণ হয়- অবশ্য সারত্রেরা সব সময় জন্মান না। সেজন্যই তাঁরা অমর হয়ে থাকেন সাহিত্যের জগতে।

সবশেষে বলি শ্রীমতী মা থিডার কথা। মায়ানমারের এই লেখক যথারীতি রাষ্ট্রবিরোধী লেখার জন্য জুনটা সরকারের বিষনজরে পড়েন। তিনি তাও লিখে চলেন। নরওয়ে থেকে তাঁকে দেওয়া হয় ‘Freedom of Expression’ পুরস্কার। তিনি নিতে যেতে পারেন নি এই ভয়ে যে তাঁকে আর ফিরে আসতে দেবে না মায়ানমারের সরকার। যে ভিডিও বার্তাটি তিনি পাঠান তার বক্তব্য “ নিজের জন্য ভাবছি না, আমি এখানে না থাকলে আমার লেখা থাকবে না- সেটা বড়ো ক্ষতি। Literature needs freedom and freedom needs literature”।

নীড়বাসনা  বৈশাখ ১৪২৯
bottom of page